প্রণয়োদ্যান—তাহাতে ভ্রমণ—অপূর্ব্ব তরু-পুষ্প দর্শন—সতী-নির্ঝর—প্রণয়ের মূর্ত্তি—তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও আলাপ।

যথা যবে ঋতু সরস বসন্ত
প্রবেশে ধরণী-মাঝে,
শোভে তরু লতা ধরি চারু বেশ
নবীন পল্লব সাজে;
ঝরে ধীরে ধীরে পত্র পুরাতন
ছাড়িয়া বিটপি-অঙ্গ;
চারু কিসলয় প্রকাশিত ধীরে
পাইয়া মলয় সঙ্গ;
নব চারু মৃদু কিসলয় যত
হরিত বরণ মাখা,
পরিয়া সুন্দর মঞ্জরী মধুর
বিকাশে তরুর শাখা;
সে বসন্ত কালে যথা অপরূপ
আনন্দ উথলে মনে,
হৃদয়ে অব্যক্ত সুখের প্রবাহ
প্রকাশ্য নহে বচনে;

এখানে প্রবেশি তেমতি আনন্দ
উপজে হৃদয়ময়;
শীতস্নিগ্ধ রস যেন সে এখানে
বায়ুতে মিশ্রিত রয়;
উদ্যান রচিত দেখি চারি দিকে
প্রকাশিত চারু ছবি,
স্তবকে স্তবকে সাজিছে সুন্দর
বিবিধ শোভা প্রসবি;
অতি মনোহর উদ্যান সে সব
পার্শ্বে পার্শ্বে অবস্থিতি,
অঙ্গে অঙ্গে মিশি, মধুচক্রে যেন
অপূর্ব্ব বিন্যাস-রীতি;
প্রবেশের মুখ পৃথক্‌ সকলে
তথাপি মিলিত সব;
প্রতি উপবনে নব নব ঘ্রাণ
সদা হয় অনুভব।
আশা কহে “বৎস, আমার কাননে
স্থির শান্ত এই দেশ,
ভ্রমিলে এখানে কিছু কাল সুখে
ভুলিবে পথের ক্লেশ।
দেখ ভিন্ন ভিন্ন যত উপবন
ভিন্ন ভিন্ন স্নেহ-স্থান;
সৌহার্দ্দ প্রণয় প্রভৃতি যে রস
সদা স্নিগ্ধ করে প্রাণ।
উচ্চ কোলাহল কটু তিক্ত স্বর
না পাবে শুনিতে এথা,
ধীরে ধীরে গতি, ধীর মিষ্ট ভাষা,
এখানে প্রাণীর প্রথা;
সবে সত্যবাদী, সবে সখ্যভাব,
পরিষ্বঙ্গ প্রাণে প্রাণে;

এখানে প্রাণীরা দ্বেষ হিংসা ছল
কেহ কভু নাহি জানে।
এখানে নাহিক ষড় ঋতু ভেদ,
সমভাবে সূর্য্যোদয়,
আমার কাননে স্নেহময় প্রাণী
এই স্থানে তারা রয়।”
এত কৈয়ে আশা প্রণয়-কাননে
হাসিয়া করে প্রবেশ,
অতুল আনন্দে মাতিল হৃদয়
হেরিয়া মধুর দেশ।
লতা-গৃহ সেথা হেরি চারি ধারে,
অপূর্ব্ব কিরণময়,
অমরাবতীতে যেন দেব-গৃহ
তারকাভূষিত রয়।
পুষ্পময় পথ, মৃত্তিকা পরশ
নাহি হয় পদতলে;
তরু হৈতে স্বতঃ চারু সুকুমার
পুষ্প পড়ে বৃষ্টি-ছলে।
প্রতি গৃহদ্বারে সুখে চক্রবাক
চকোর ভ্রমণ করে;
বায়ুর হিল্লোলে নিরবধি যেন
সুধাধারা সেথা ঝরে।
শোভে তরুরাজি সে প্রদেশময়
ধরে অপরূপ ফুল,
অপূর্ব্ব প্রকৃতি অবনী-ভিতরে
নাহিক তাহার তুল;
যত ক্ষণ থাকে শাখার উপরে
শোভামাত্র দৃষ্টি তার,
মধুর সৌরভ বহে সে কুসুমে
গাঁথিলে হৃদয়ে হার;

আপনি গ্রথিত হয় সে কুসুম
বৃন্তে বৃন্তে স্বতঃ যুড়ে;
কিন্তু পুনঃ আর নাহি যুগ্ম হয়
বারেক যদ্যপি তুড়ে।
প্রতি ক্ষণে ধরে নব নব ভাব
নবীন মাধুরী তায়;
নেহারি আনন্দে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
নূতন পত্র ছড়ায়;
প্রতি ক্ষণে তাহে নবীন সৌরভে
নবীন পরাগ উঠে,
আসিলে নিকটে আপন হইতে
তরু ছাড়ি হৃদে লুটে।
কত তরু হেন নিরখি সেখানে
শ্রেণীবদ্ধ দলে দলে;
ভ্রমে সুখে কত যুগল পরাণী
নিয়ত তাহার তলে;
করতল পাতি তরুতলে যায়,
সেই মনোহর ফুল
পড়ে কত তায়, পরাণী সকলে
আনন্দে হয় আকুল;
পাতিয়া অঞ্চল দাঁড়ায় দুজনে
গিয়া কোন তরুমূলে,
মুহূর্ত্ত ভিতরে পরিপূর্ণ তাহা
হয় মনোমত ফুলে।
প্রতি তরুতলে ভ্রমে দুই প্রাণী
তরু বৃষ্টি করে ফুল;
যেন বা আনন্দ হেরিয়া তাদের
আনন্দিত তরুকুল।
যথা সে পবিত্র কণ্বের আশ্রমে
হেরে শকুন্তলা-সুখ;

শাখা নত করি পুষ্প ছড়াইল
ফুল তরু ফুল্ল-মুখ;
সেইরূপ হেরি প্রণয়ী যখন
আসে এথা তরুতলে,
তরু নতশিরে করে আশীর্ব্বাদ
বরষি কুসুমদলে।
সে ফুলের মালা পরিয়া গলায়
প্রণয়-প্রফুল্ল প্রাণ
হেরি কত প্রাণী ভ্রমিছে সেখানে
লভিয়া কুসুম-ঘ্রাণ;—
চাঁপা ফুল হেন বরণের শোভা,
সুন্দর নলিন-আঁখি
চলে কত রামা, বল্লভের দেহে
সুখে বাহুলতা রাখি;
কোন সে যুবক চলে মনঃসুখে
বাঁধি নিজ ভূজপাশে
কমল-কোরক সদৃশ তরুণী
অর্দ্ধস্ফুট মৃদু হাসে;
চলেছে সোহাগে কোন বা সুন্দরী
ফুল্ল বিকশিত ছবি,
লোহিত সুন্দর গণ্ডে প্রস্ফুটিত
গুলাব-রঞ্জিত রবি;
আহা কোন রামা স্মিতচারুমুখী
প্রণয়ীর বাহুমূলে
চন্দ্রকর-মাখা শেফালিকা যেন
চলেছে গুণ্ঠন খুলে;
কাহার বদনে ফুটিয়া পড়িছে
মধুর মৃদুল হাস,
সহকারে-কোলে সরস মঞ্জরী
বসন্তে যেন প্রকাশ;

চলেছে মৃগেন্দ্রে জিনিয়া কটিতে
কোন রামা মনঃসুখে,
পূর্ণ ষোল কলা যৌবনে প্রকাশ,
আড়ে হেরে প্রিয়মুখে;
প্রিয় চারু করে রাখি নিজ কর
প্রফুল্ল উৎপল যেন
চলেছে চঞ্চল পঙ্কজ-নয়না
আহা, কত রামা হেন;
নীলপদ্ম যেন ভ্রমে কত নারী
মধুর মাধুরী ধরি,
সুখিনী মহিলা প্রিয়-অঙ্গে অঙ্গ
সুখে সুমিলন করি।
দেখি স্থানে স্থানে কৌতুকে সেখানে
কত উৎস মনোহর,
সুধার সঙ্কাশ সলিল ছড়ায়ে
পড়িছে সহস্র ঝর;
পড়িছে নির্ঝর মরি রে তেমতি
চারি ধারে ধীরে ধীরে,
পুরাণে লিখন জাহ্নবী যেমন
জটায় শিবের শিরে।
কোথা সে ভূতলে ভূপতি-ভবনে
শ্বেতশিলা-বিরচিত,
ক্রীড়া-উৎস সব মহিষী মোহন
মাণিক্য-স্বর্ণ-মণ্ডিত!
উঠিছে নির্ঝর সে কাননময়
নিত্য ক্ষিতিতল ফুটে,
শত ধারা হ'য়ে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া
পুষ্প যেন পড়ে ফুটে;
নীল কৃষ্ণ শ্বেত আদি বর্ণ যত
নিন্দিত করি শোভায়

প্রতি ধারা অঙ্গে কত রঙ্গে তাহে
অপূর্ব্ব বর্ণ ছড়ায়।
ঝরিছে নির্ঝর ধারা হেন কত
প্রণয়-অচল-অঙ্গে,
দেখিলে নয়ন ফিরিতে না চায়
নেহালে ভুলিয়া রঙ্গে।
ফুটে কত ফুল ঘেরি উৎস সব
অমর-নন্দন-ভাতি;
নন্দনে তেমন বুঝি বা সুন্দর
নাহি পুষ্প হেন জাতি।
অতুল সৌন্দর্য্য সে সব কুসুমে
নাহি কভু বৃদ্ধি হ্রাস;
নিরবধি শোভা ফুটে সম ভাবে
নিরবধি ছুটে বাস।
অতি শূন্যগামী চকোর প্রভৃতি
স্বর্গীয় বিহঙ্গ যত,
মৃত্যু কলস্বরে ধারা ধারে ধারে
সুখে ভ্রমে অবিরত।
হেরি কত প্রাণী আসি উৎস-পাশে
ধারাজলে করে স্নান;
নিমেষ ভিতরে নির্ম্মল শরীর
ধরে সুধা-সম ঘ্রাণ।
হেরি কত পুনঃ পরাণী বিস্ময়ে
পরশনে সেই বারি,
পাষাণ হইয়া হারায় সম্বিৎ
চলিতে চিন্তিতে নারি।
কত যে পুরুষ হেরি হেন ভাব
নিবার নির্ঝর পাশে;
কত সে রমণী পাষাণ-মুরতি
চক্ষুজলে সদা ভাসে।

চিন্তিয়া না পাই কারণ তাহার,
আশারে জিজ্ঞাসা করি,
কেন সে প্রাণীরা সলিল-পরশে
থাকে হেন ভাব ধরি!
হাসি কহে আশা "শুন রে বালক,
অতি শুচি এই জল,
পবিত্র-মানস প্রাণী যেই জন
পরশি হয় শীতল;
অপবিত্র-দেহ অপবিত্র-প্রাণ
যে ইহা পরশ করে,
তখনি সে জন সলিল-মাহাত্ম্যে
পাষাণ-মূরতি ধরে;
কাঁদে চিরকাল এই ভাবে সদা
চলৎ-শকতিহীন,
অনুতাপ হেরে অন্য প্রাণী যত
স্নিগ্ধ হয় অনুদিন;
সতী-ঝর নামে এ সব নির্ঝর
সুপবিত্র বারি অতি,
পরশে যে নারী সলিল ইহার
লভে যশঃ নাম সতী;
পুরুষ যে জন কবে ইথে স্নান
জিতেন্দ্রিয় নাম তার,
ধরাধামে থাকি লভে স্বর্গসুখ
আনন্দ লভে অপার।
কঠোর সাধনা প্রণয়ে যাহার
পবিত্র নির্ম্মল মন,
পরচিন্তা চিতে জনমে যে প্রাণী
করে নাই কোন ক্ষণ,
সেই নারী নর পরশে এ বারি,
অন্যে না ছুঁইতে পারে;

অন্যে যে পরশে অপবিত্র মনে
আই দশা ঘটে তারে।”
নিরখি নির্ঝর নিকটে সে সব
ভ্রমে প্রাণী এক জন,
মধুময় হাসি, মধুর মাধুরী
অঙ্গেতে করে ধারণ;
অতি সুললিত আকৃতি তাহার
দেহকান্তি নিরুপম,
মুখে দিব্য ছটা অধরে সতত
মৃদু হাসি সুধা-সম;
গলে প্রস্ফুটিত প্রীতিকর দাম
গ্রথিত অপূর্ব্ব ফুলে;
স্বতঃ-নিনাদিত মধুর বাদিত্র
লম্বিত বাহুর মূলে;
সুখে করি গান ভ্রমে ঝরে ঝরে
সরল সুমিষ্ট ভাষে;
বিমল বদনে নিরমল জ্যোতি
সূর্য্য-আভা পরকাশে।
নিবার-বিলাসী প্রাণিগণ তারে
কত সমাদর করে;
বসায়ে নিকটে আনন্দে বিহ্বল
শুনে গীত প্রেমভরে।
হেরি কত ক্ষণ জিজ্ঞাসি আশারে
কেবা সে অপূর্ব্ব জন,
তুষি এ সবারে নির্ঝরে নির্ঝরে
এরূপে করে ভ্রমণ?
আশা কহে হাসি "এই যে পরাণী
দেখিতে হেন সুঠাম,
প্রণয়-কাননে চিরদিন বাস,
সন্তোষ ইহার নাম।”



সে যুব-প্রসঙ্গে করি আলাপন
আশার সহ উল্লাসে,
চলিতে চলিতে আসি কিছু দূর
এক লতাগৃহ-পাশে;
হেরি তার মাঝে প্রাণী এক জন
অন্য জন পাশে বসি;
মেঘের আড়ালে উদয় যেমন
পূর্ণকলা চারু শশী!
বসি তার কাছে সতৃষ্ণ নয়ন
চাহিয়া বদন তার,
কতই শুশ্রূষা কতই যতন
করে হেরি অনিবার।
নির্ব্বাণ-উন্মুখ প্রদীপ যেমন
ক্ষণে স্নিগ্ধ ক্ষণে জ্বলে,
প্রাণী সেই জন বিকাশে তেমতি
কিরণ মুখমণ্ডলে।
নাহি অন্য আশা নাহি অন্য তৃষা
কেবল বদনে চায়;
সূর্য্য-অংশু-রেখা পড়ে যদি তাহে,
কেশজালে ঢাকে তায়।
নিম্পন্দ শরীর যেন সে অসাড়
হৃদয় ছাড়িয়া প্রাণ
আসিয়া যেমন নিবিড় হইয়া
নয়নে পেয়েছে স্থান।
মলিন বদন প্রাণী অন্য জন
দেখাইছে বিভীষিকা
কত যে প্রকার নিমেষে নিমেষে
বর্ণেতে অসাধ্য লিখা;
কখন বা বেগে কণ্ঠে চাপি কর
করিছে নিশ্বাস রোধ;



কখন বা নখে ছিঁড়ি ওষ্ঠাধর
উঠিছে করিয়া ক্রোধ;
কখন মাটিতে ভাঙ্গিছে ললাট,
রুধির করিছে পাত,
কভু সর্ব্ব অঙ্গে ধূলি ছড়াইয়া
বক্ষে করে করাঘাত;
কখন গর্জ্জন করিছে বিকট,
দন্তে দন্তে ঘরষণ,
কখন পড়িছে ধরাতল'পরে
সংজ্ঞাহীন বিচেতন;
প্রাণী অন্য জন নিকটে যে তার,
কতই যতনে, হায়,
সেবিছে তাহায় করিছে শুশ্রূষা
ঘুচাইতে সে মূর্চ্ছায়।
কভু ধীরে ধীরে করশাখা খুলে
মার্জ্জিছে হৃদয়দেশ;
কভু করতল কভু পদতাল
কভু ঘর্ষে ধীরে কেশ;
কখন তুলিছে হৃদয়-উপরে
অবসন্ন বাহুলতা;
কভু স্নেহপূর্ণ বলিছে শ্রবণে
পীযুষ-পূরিত কথা;
কখন আনিয়া বারি সুশীতল
বদনে করে সিঞ্চন;
কখন তুলিয়া মৃদুল সুগন্ধ
নাসাগ্রে করে ধারণ;
আবার যখন চেতন পাইয়া
হয় সে উন্মাদ-প্রায়,
মধুর মধুর বীণাবাদ্য করি
স্নিগ্ধ করে পুনঃ তায়।

}}

হেরে সে প্রাণীরে কত যে আহ্লাদ
হৃদয়ে হইল মম।
বাসনা ফুটিল যেন নিরবধি
হেরি মুখ নিরুপম।
দেখেছি অনেক প্রণয়ী পরাণী
হেরে পরস্পর মুখ,
নয়ন-হিল্লোলে ভাসি এ উহার
পিয়ে সুধাসম সুখ,
বসি নিরজনে করে আলাপন
সুমধুর স্বর মুখে,
প্রেমানন্দে ভোর হইয়া দু জনে
হেরে নিরন্তর সুখে;
কপোতী যেমন কপোতের মুখে
মুখ দিয়া সুখে চায়,
মৃদু কলধ্বনি মধুর কূজন
কুহরে ঘন গলায়—
দেখে পরস্পরে দোঁহে মনঃসুখে
লভিয়া প্রণয়-ঘ্রাণ;
আনন্দ-পুলকে পুলকিত তনু,
সুখে পুলকিত প্রাণ;—
দেখেছি অনেক সেইরূপ ভাব
প্রণয় প্রকাশ, হায়,
প্রণয়ী জনের প্রেমের অনলে
বদন বহ্নির প্রায়;
কিন্তু কভু হেন বিশুদ্ধ প্রণয়,
নির্ম্মল স্নেহের ক্ষীর
নাহি দেখি চক্ষে মানব-শরীরে
প্রগাঢ় হেন গভীর।
কতই উৎসুক অন্তরে তখন
হেরি সে প্রাণিবদন;

নব জলধর নিরখে যেমন
চাতক উৎসুক মন;
অথবা যেমন ধনাঢ্য-আগারে
দুঃখী হেরে ধনরাশি;
সুখে নিরন্তর নিরখি তেমতি
আনন্দ-বাম্পেতে ভাসি।
পাইয়া সুযোগ গিয়া কাছে তার
বিনয়ে জিজ্ঞাসা করি,
কিরূপে এরূপে থাকে সে সেখানে
এক ধ্যান চিত্তে ধরি,
কি সুখে উম্মাদে লৈয়ে করে সেবা,
সহে নিত্য এত ক্লেশ,
কেন সে মণ্ডপে জাগ্রত সতত
থাকিতে এতেক দেশ।
সম্বদ্ধ বীণাতে পড়িলে যেমন
সহসা কাহার কর,
আপন হইতে উঠে সে বাজিয়া
নিঃসারি মধুর স্বর;
সেইরূপ ভাব কহে সেই জন
জ্যোৎস্না যেন মুখে ফুটে,
কি সুখ-সম্ভোগ করে সে সতত
কি আনন্দ প্রাণে উঠে;
কহে সে “কেমনে বুঝাব তোমায়
কিবা যে আনন্দে থাকি,
এ লতা-মণ্ডপে বসিয়া ইহাঁরে
কেন এ যতনে রাখি;
প্রণয়ী যে নয় কেমনে বুঝিবে
প্রণয়ের কিবা প্রথা;
মরু কি জানিবে স্রোতধারা কিবা
মধুময় তরুলতা!

বসি এইখানে দ্যুলোক ভুবন,
বৈকুণ্ঠ দেখিতে পাই;
জলনিধি মেঘ বায়ু ব্যোম ধরা
সকলি ভুলিয়া যাই!
ভাবি যেন মনে আসি সুরবালা
আনিয়া স্বর্গের রথ
ঘেরিয়া আমারে লইয়া বিমানে
চলে বহি শূন্য-পথ,
প্রবেশি স্বরগে নিরখি সেখানে
নন্দনবনের ফুল,
শুনি দেবধ্বনি হেরি মনঃসুখে
মন্দাকিনী-নদীকূল;
দেববৃন্দ সেথা দেখায় আমারে
আনন্দে অমরালয়;
তারা শশধর অমৃত-ভাণ্ডার,
সুর-সুখ সমুদয়।
কেমনে বুঝাব সে সুখ তোমারে
বাণীতে বর্ণিব কিবা—
দিবাকর-জ্যোতি জ্যোতি যে কিরূপ
তাহা সে প্রকাশে দিবা!"
যথা হুতাশন পরশে যেমন
যখন গৃহের ছদ;
প্রথমে প্রকাশ ধূম অনর্গল
শেষে অনলের হ্রদ।
বলিতে বলিতে সেইরূপ তার
বদন পুরে ছটায়,
নেত্রে বাষ্পধূম নিমেষে শরীর
প্রদীপ্ত বহ্নির প্রায়।
পরে পুনরায় সেই প্রাণী-পাশে
এক চিন্তা এক ধ্যান

ধরিয়া আবার প্রাণী সেই জন
পুনঃ কৈলা অধিষ্ঠান।
নিদাঘ-তাপিত বিহগ যেমন
পাইলে বরষা-জল,
সুখে ধৌত করে আর্দ্র-পক্ষ-ক্লেদ,
স্নানে হয় সুশীতল;
শুনে বাণী তার তেমতি শীতল
পরাণ হইল মম;
হেরি বার বার ফিরে ফিরে চাহি
সেই মুখ সুধা-সম।
অতৃপ্ত নয়নে হেরি কত বার,
ভাবি কত মনে মনে—
ভাবি নিরমল মাধুরী তেমন
বুঝি নাই ত্রিভুবনে।
বিস্ময় ভাবিয়া চাহি আশামুখ,
আশা বুঝি অভিলাষ,
কহিলা তখন আনন্দে হাসিয়া
বদনে মধুর ভাষ;
"এই যে পরাণী এ কাননে মম
হেন সুখী নিরমল
প্রণয় নামেতে ভুবন-বিখ্যাত,
নিত্য সেবে ভূমণ্ডল।”
শুনি আশাবাণী রোমাঞ্চ শরীর
আকুল হইয়া চাই;
প্রাণের হুতাশে প্রণয় ভাবিয়া
বিধিরে স্মরিয়া যাই।