ইতিহাস/ভারত-ইতিহাস-চর্চা

ভারত-ইতিহাস-চর্চা


আমি অন্যত্র এ কথার আলোচনা করিয়াছি যে ভারতবর্ষের ইতিহাস ঠিক রাষ্ট্রীয় ইতিহাস নহে। কেন নহে তাহার কারণ আছে।

 প্রত্যেক জাতির এক-একটি সাধনার বিষয় আছে। সেই মূলগত সাধনটি লইয়াই সেই জাতির সকল লোক আঁট বাধে। নর্মানে স্যাক্সনে মিলিয়। ইংরেজ যখন এক হইয় গেল, যখন তাহদের মধ্যে সমাজভেদ রহিল না, তখন তাহদের মধ্যে একট বড়ো ভেদ রহিল— রাজার সঙ্গে প্রজার স্বার্থের ভেদ। সেই ভেদ যখন একান্ত থাকে তখন রাজার খেয়ালের জন্য প্রজাদের দুঃখ ও ক্ষতি হইতে থাকে। সেই ভেদ বিলুপ্ত করিয়া রাজ-শক্তিতে নানাপ্রকার বাধ বাধিয়া পরস্পরের সামঞ্জস্য সাধনের ইতিহাসই ইংলণ্ডের ইতিহাস। অর্থাং, ইংলণ্ডের যে সমস্যা প্রধান ছিল সেই সমস্যার সমাধান লইয়াই তাহার ইতিহাসের পরিণতি ঘটিয়াছে।

 ইংরেজি ইস্কুলের ছাত্র ভারতের ইতিহাসে সেই রাষ্ট্রীয় ধারার পথই খুজিতে থাকে। খুজিয়া না পাইলে বলে ভারতের ইতিহাস নাই। কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার ভারতের ইতিহাস সেখানেই ভারতের সমস্যা যেখানে।

 প্রত্যেক জাতির সমস্য সেখানেই যেখানে তাহার অসামঞ্জস্য। যাহারা বাহিরে পাশাপাশি আছে অন্তরে তাহাদিগকে মিলিতেই হইবে। এই মিলন-চেষ্টাই মানুষের ধর্ম, এই মিলনেই মানুষের সকল দিকে কল্যাণ। সভ্যতাই এই মিলন।

 আমাদের প্রাচীন ভারতে অসামঞ্জস্য রাজায় প্রজায় ছিল না, সে ছিল এক জাতি-সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য জাতি-সম্প্রদায়ের। এই সকল নানা উপজাতির বর্ণ ভাষা আচার ধর্ম চরিত্রের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অথচ ইহারা সকলেই প্রতিবেশী। ইহাতে এক দিকে যেমন পরস্পরের লড়াই চলিতেছিল তেমনি আর-এক দিকে পরস্পরের সমাজ ও ধর্মের সামঞ্জস্যসাধন-চেষ্টারও বিশ্রাম ছিল না। কী করিলে পরস্পরে মিলিয়া এক বৃহৎ সমাজ গড়িয়া উঠে, অথচ পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য একেবারে বিলুপ্ত না হয়, এই দুঃসাধ্য-সাধনের প্রয়াস বহুকাল হইতে ভারতে চলিয়া আসিতেছে, আজও তাহার সমাধান হয় নাই।

 য়ুনাইটেড স্টেট্‌সের ইতিহাসে যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া চলিতেছে তাহার সঙ্গে ভারত-ইতিহাসের কিছু মিল আছে, কিন্তু অমিলও যথেষ্ট। সেখানে য়ুরোপের নানা স্থান হইতে নানা জাতি মিলিতেছে। কিন্তু তাহারা একই বর্ণের, সুতরাং তাহাদের মিলনের বাধা সুগভীর নহে। তাহা ছাড়া, য়ুরোপের সকল উপজাতির মধ্যে সভ্যতার রূপভেদ নাই। নিগ্রোদের সমস্যার কোন ভালো মীমাংসা আজ পর্যন্ত সেখানে হয় নাই বলিয়া কেবলই দুঃখ অত্যাচার অবিচারের সৃষ্টি হইতেছে, ইহাতেই মনুষ্যত্বের পীড়া ঘটে। এই পীড়া দুর্বল সবল উভয়কেই স্পর্শ করে। তাহা ছাড়া এসিয়াবাসীদের সম্বন্ধে শুধু আমেরিকায় নহে য়ুরোপের সকল উপনিবেশেই বিরোধ চলিতেছে। এসিয়াবাসীকে একেবারে নির্বাসিত করিয়া রাখিলে এই বিরোেধ দেশের বাহিরে গিয়া কালক্রমে আরো প্রবল হইয়া জমিতে থাকিবে এবং একদিন ইহার হিসাব-নিকাশ করিতেই হইবে। আমেরিকার ইতিহাসে আর একটা ব্যাপার দেখিতে পাই, তাহাকে ঐক্যসাধন না বলিয়া একাকারীকরণ বলা যায়। যে-কোনো জাতীয় লোক আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বাস করিতে আসে ভাষায় আচারে ব্যবহারে তাহাকে সম্পূর্ণই আমেরিকান করিয়া তুলিবার চেষ্টা করা হয়। ইহাতে রাষ্ট্রীয় দিক হইতে সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু বৈচিত্র্যমূলক মানবসভ্যতার দিক হইতে ইহাতে ক্ষতিই ঘটে। সৃষ্টিতত্বে যে পরিণতিক্রিয়া দেখি তাহাতে একাকারত্ব আরন্তে দেখা যায়, কিন্তু বিকাশসাধনের সঙ্গে সঙ্গে একের মধ্যে বিভাগ ও সেই বিভাগের মধ্যে ঐক্য প্রকাশ হইতে থাকে। যদি রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পক্ষে একাকারত্বই একান্ত আবশ্যক বলিয়া ধরা হয় তবে বলিতেই হইবে, রাষ্ট্রীয় ঐক্য ঐক্যের আদর্শ নহে। ইহাতে একপ্রকার স্বাধীনতার লোভে মানুষের গভীরতর স্বাধীনতাকে বলপূর্বক বলি দেওয়া হয়। সমস্যার ইহা প্রকৃত সমাধান নহে বলিয়াই ইহাতে জগতে এত নিগুঢ় দাসত্ব ও ব্যাপক দুঃখের সৃষ্টি হইতেছে।

 ভারতবর্ষে নানা জাতির এই সংঘাত ও সামঞ্জস্যের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় বৈদিকযুগ বৌদ্ধযুগে, বৌদ্ধযুগ পৌরাণিক যুগে পরিণত হইয়াছে। এই সৃষ্টির উদ্যমে রাজা ও রাষ্ট্রনীতি প্রধান শক্তি নহে। অবশ্য, বিদেশী রাজা যখন হইতে ভারতে আসিয়াছে তখন হইতে এই স্বাভাবিক সৃষ্টিকার্য বাধা পাওয়ায় আর-একটি অসামঞ্জস্য দেখা দিয়াছে। এইজন্যই ইংরেজ যাহাকে ইতিহাস বলিয়া গণ্য করে ভারতে সেই ইতিহাস মুসলমান-অধিকারের পরে। কিন্তু তাই বলিয়া ইহার অর্থ এমন নহে যে বিদেশী রাজত্বের পর হইতে ভারত-ইতিহাসের প্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়াছে। এই পর্যন্ত বলা যায় যে পূর্বের চেয়ে আমাদের ইতিহাস জটিল হইয়াছে, আমাদের দুরূহু সমস্তায় আরো একটি নূতন গ্রন্থি পড়িয়াছে। এখনো আমাদের মধ্যে ভেদের সমস্ত। এই ভেদ সমাজের ভিতরে থাকাতেই অন্যদেশীয় রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে কিছুতেই ঠিকমত খাটিতেছে না। আমরা অন্য দেশের নকলে যে-সব পস্থা অবলম্বন করিতেছি, বারম্বার তাহা ব্যর্থ হইতেছে।

 যাহাই হউক, আমাদের দেশের এই সামাজিক ইতিহাসের ধারা এখনো আমরা আগাগোড়া অনুসরণ করিয়া দেখি নাই; অনেকটাই অস্পষ্ট আছে এবং অনেক জায়গাতেই ফাঁক পড়িয়াছে। বিশেষত, যেহেতু আমাদের প্রকৃত ইতিহাস সামাজিক এবং ধর্মতন্ত্রমূলক সেইজন্যই আমাদের নিজেদের আজন্মকালীন সামাজিক সংস্কার ও ধর্মবিশ্বাস কুয়াশার মতো আমাদের ইতিহাসের ক্ষেত্রকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। সত্যকে নিরপেক্ষভাবে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে বাধা দিতেছে। যেটুকু গোচর হইয়া উঠিতেছে তাহা বিদেশী ঐতিহাসিকদেরই চেষ্টায়।

 কিন্তু নিজের দেশের ইতিহাসের জন্য চিরদিনই কি এমন করিয়া পরের মুখ তাকাইয়া থাকা চলিবে?

 বৌদ্ধযুগ ভারত-ইতিহাসের একটি প্রধান যুগ। ইহা আর্য-ভারতবর্ষ ও হিন্দু-ভারতবর্ষের মাঝখানকার যুগ। আর্যযুগে ভারতের আগন্তুক ও আদিম অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ চলিতেছিল। বৌদ্ধযুগে সেই-সকল বিরুদ্ধ জাতিদের মাঝখানকার বেড়াগুলি একধর্মবন্যায় ভাঙিয়াছিল— শুধু তাই নয়, বাহিরের নানা জাতি এই ধর্মের আহ্বানে ভারতবাসীদের সঙ্গে মিশিয়াছিল। তার পরে এই মিশ্রণকে যথাসম্ভব স্বীকার করিয়া এবং ইহাকে লইয়া একটা ব্যবস্থা খাড়া করিয়া আধুনিক হিন্দুযুগ মাথা তুলিয়াছে। বৈদিকযুগ এবং হিন্দুযুগের মধ্যে আচারে ও পূজাতন্ত্রে যে গুরুতর পার্থক্য আছে তাহার মাঝখানের সন্ধিস্থল বৌদ্ধযুগ। এই যুগে আর্য ও অনার্য এক গণ্ডির মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। ইহার ফলে উভয়ের মানস প্রকৃতি ও বাহ্য আচারের মধ্যে আদানপ্রদান ও রপ্তানিষ্পত্তির চেষ্টা হইতে থাকে। কাজটা অত্যন্ত কঠিন; তাই সকল দিকেই বেশ সুসংগত রকমে রফা হইয়া গিয়াছে তাহাও বলিতে পারি না। আভ্যন্তরিক নানা অসংগতির জন্য আমরা অন্তরে বাহিরে দুর্বল রহিয়াছি; সামাজিক ব্যবহারে এবং ধর্মবিশ্বাসে পদে পদেই বিচারবুদ্ধিকে অন্ধ করিয়া আমাদিগকে চলিতে হয়— যাহা-কিছু আছে তাহাকে বুদ্ধির দ্বারা মিলাইয়া লওয়া নহে, অভ্যাসের দ্বারা মানিয়া লওয়াই আমরা প্রধানত আশ্রয় করিয়াছি।

 যাহাই হউক, আমাদের এই বর্তমান যুগকে যদি ঠিকমত চিনিতে হয় তবে পূর্ববর্তী সন্ধিযুগের সঙ্গে আমাদের ভালোরূপ পরিচয় হওয়া চাই। একটা কারণে আমাদের দেশে এই পরিচয়ের ব্যাঘাত ঘটিয়াছে। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা বৌদ্ধধর্মের যে সম্প্রদায়ের রূপটিকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়া আলোচনা করিয়া থাকেন তাহা হীনযান সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বজ্ঞানের দিকেই বেশি ঝোঁক দিয়াছে। মহাযান সম্প্রদায়ে বৌদ্ধ ধর্মের হৃদয়ের দিকটা প্রকাশ করে। সেইজন্য মানব-ইতিহাসের সৃষ্টিতে এই সম্প্রদায়ই প্রধানতর। শ্যাম চীন জাপান জাভা প্রভৃতি দেশে এই মহাযান সম্প্রদায়ই প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। এইজন্যই মহাযান সম্প্রদায় এমন একটা প্রণালীর মতো হইয়াছিল যাহার ভিতর দিয়া নানা জাতির নানা ক্রিয়াকর্ম মন্ত্রতন্ত্র পূজার্চনা ভারতে প্রবাহিত এবং এক মন্থনদণ্ডের দ্বারা মথিত হইয়াছে।

 এই মহাযান সম্প্রদায়ের শাস্ত্রগুলিকে আলোচনা করিয়া দেখিলে আমাদের পুরাণগুলির সঙ্গে সকল বিষয়েই তাহার আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। এই সাদৃশ্যের কিছু অংশ বৌদ্ধধর্মের নিজেরই বিশুদ্ধ স্বরূপগত, কিন্তু অনেকটা ভারতের অবৈদিক সমাজের সহিত মিশ্রণ-জনিত। এই মিশ্রণের উপাদানগুলি নূতন নহে; ইহারাও অনেক কালের পুরাতন, মানবের শিশুকালের সৃষ্টি। দিনের বেলায় যেমন তারা দেখা যায় না তেমনি বৈদিক কালের সাহিত্যে এগুলি প্রকাশ পায় নাই, দেশের মধ্যে ইহারা ছড়ানো ছিল। বৌদ্ধযুগে যখন নানা জাতির সম্মিশ্রণ হইল তখন ক্রমশ ইহাদের প্রভাব জাগিয়া উঠিল এবং বৌদ্ধযুগের শেষভাগে ইহারাই আর-সমস্তকে ঠেলিয়া ভিড় করিয়া দাঁড়াইল। সেই ভিড়ের মধ্যে শৃঙ্খলা করিবার চেষ্টা, যাহা নিতান্ত অনার্য তাহাকে আর্যবেশ পাইবার প্রয়াস, ইহাই হিন্দুযুগের ঐতিহাসিক সাধনা।

 অতএব, ভারতের প্রকৃত ইতিহাসের ধারা যাঁঁহারা অনুসরণ করিতে চান তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া এই মহাযান বৌদ্ধপুরাণসকলের অনুশীলন করিতে হইবে।•••