এপিক্টেটসের উপদেশ/মানুষের মধ্যে ঈশ্বর
মানুষের মধ্যে ঈশ্বর।
১। ঈশ্বর হিতকারী। মঙ্গলও হিতকারী। অতএব ইহাই সম্ভব, —যেখানে ঈশ্বরের সারাংশ সেইখানে মঙ্গলেরও সারাংশ থাকিবে। ঈশ্বরের সারাংশ কি?—মেদমজ্জা মাংস?—না, তাহা হইতেই পারে। না।—ভূসম্পত্তি? না, তাহাও নহে। যশ? না, তাহাও নহে। আত্মা?—হাঁ তাহাই বটে। ইহা মঙ্গলেরও সারাংশ। ইহা কি তুমি উদ্ভিজ্জের মধ্যে খুঁজিয়া পাইবে? কখনই না। কোন অজ্ঞান জীবের মধ্যে খুঁজিয়া পাইবে?—কখনই না। বুদ্ধি জ্ঞানসম্পন্ন জীব আর অজ্ঞান জীব এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ, সেই ভেদের মধ্যেই ইহার অন্বেষণ না করিয়া, এখনও তবে অন্যত্র কেন অন্বেষণ করিতেছ?
২। উদ্ভিজ্জরা ইন্দ্রিয়-প্রতীতি অনুসারে কাজ করে না। অতএব, ইহাদের সম্বন্ধে মঙ্গলামঙ্গলের কথা আমি বলিতেছি না। ইন্দ্রিয়প্রতীতি অনুসারে কাজ করিবার যাহাদের শক্তি আছে, মঙ্গলের কথা তাহাদের সম্বন্ধেই খাটে। শুধু কি তাই? না, শুধু তাহাই নহে। কেননা তা যদি হয়, তবে বলিতে হইবে শুভ ও অশুভ নিকৃষ্ট জীবের মধ্যেও আছে। কিন্তু তাহা তুমি কখনই বলিবে না। আর তোমার কথাই ঠিক্। কেননা, যদিও তাহারা সর্ব্বতোভাবে ইন্দ্রিয়-প্রতীতি অনুসারে চলিতে পারে, কিন্তু উহার ফলাফল পর্য্যবেক্ষণ ও বিচার করিতে তাহারা অসমর্থ। এবং ইহাই তাহাদের পক্ষে স্বাভাবিক। তাহারা অপরের সেবার জন্যই রহিয়াছে। তাহাদের নিজের কোন মহৎ উদ্দেশ্য নাই। গর্দ্দভ-জীবনের পরম উদ্দেশ্য কি? পরের ভার বহন করাই তাহাদের একমাত্র কাজ। পরের প্রয়োজনের জন্যই তাহাদের পথ চলিতে হয়। এবং সেই জন্যই সে, ইন্দ্রিয়-প্রতীতি-অনুসারে কাজ করিবার শক্তি পাইয়াছে। তা না হইলে, সে চলিতে পারিত না। কিন্তু তাহার এই পর্য্যন্তই শেষ। কেননা, সেই সঙ্গে ইন্দ্রিয়-প্রতীতির প্রয়োগ সম্বন্ধও যদি তাহার পর্য্যবেক্ষণশক্তি ও বিচারশক্তি থাকিত, তাহা হইলে ন্যায্যতঃ সে আর আমাদের অধীন হইত না, আমাদের সেবায় নিযুক্ত হইত না; তাহা হইলে সে আমাদের সমতুল্য হইত আমাদের সদৃশ হইত।
৩। কেননা, ব্যবহার এক কথা, এবং পর্য্যবেক্ষণ ও অনুশীলন আর এক কথা। ইতর জীবেরা শুধু ইন্দ্রিয়-প্রতীতি অনুসারেই কাজ করিবে, কিন্তু আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় প্রতীতিগুলিকে পর্য্যবেক্ষণ করিব —অনুশীলন করিব, ইহাই ঈশ্বরের অভিপ্রায়। এই জন্য আহার নিদ্রা মৈথুন— এই সকল কাজই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ঈশ্বর আমাদিগকে পর্য্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের শক্তি দিয়াছেন, তাই আমাদের পক্ষে উহা যথেষ্ট নহে। কিন্তু আমরা যদি কোন একটা বিশেষ অনুশাসন ও নিয়ম-অনুসারে বাহ্য প্রকৃতি ও মানব-প্রকৃতির সহিত মিল না রাখিয়া চলি, তাহা হইলে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সাধনে আমরা কখনই সমর্থ হইব না। কেননা, যেখানে দৈহিক প্রকৃতি বিভিন্ন, সেখানে কার্য্য ও উদ্দেশ্যও বিভিন্ন হইবে। যদি কোন দৈহিক প্রকৃতি শুধু ইন্দ্রিয়-প্রতীতি অনুসারে চলিবার উপযোগী হয়, তবে তাহাই তাহার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু যেখানে ইন্দ্রিয়-প্রতীতির ব্যবহার-সম্বন্ধে পর্য্যবেক্ষণ ও অনুশীলন আবশ্যক, সেখানে পর্য্যবেক্ষণ ও অনুশীলন শক্তির যথাযথ প্রয়োগ না হইলে প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। তুমি তবে বলিতে চাহ কি? ঈশ্বর অন্যান্য জীবজন্তুকে বিশেষ বিশেষ কার্য্যের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন,—কাহাকে ভূমি কর্ষণের জন্য, কাহাকে দুগ্ধ দিবার জন্য, কাহাকে বা ভার বহনের জন্য। ইন্দ্রিয়-প্রীতি-সম্বন্ধে পর্য্যবেক্ষণ ও অনুশীলন করা—ভেদাভেদ নির্ণয় করায় তাহাদের প্রয়োজন কি? কিন্তু ঈশ্বর ও তাঁহার রচনার সাক্ষীরূপে—শুধু সাক্ষী নহে—ব্যাখ্যাতারূপে মনুষ্য এই জগতে আসিয়াছে। অতএব মূঢ় ইতর জীবেরা যে সকল কাজ করে—শুধু তাহাতেই শেষ করা মানুষের পক্ষে বিশেষ লজ্জার কথা। ইতর জীবেরা যেখান হইতে আরম্ভ করে, মানুষ ও সেখান হইতে আরম্ভ করুক,—কিন্তু মানব-প্রকৃতির যেখানে শেষ হইয়াছে, সেইখানে গিয়াই যেন মানুষ তাহার কার্য্য শেষ করে। আমাদের প্রকৃতির শেষ কোথায়?—না, ধ্যানধারণায়। ইন্দ্রিয়-প্রতীতির সহিত কিসে মিল হয়, আমাদের প্রকৃতি নিয়তই তাহার জন্য চেষ্টা ও অনুশীলন করিতেছে। এই সকল, না দেখিয়া শুনিয়া তোমরা যেন ইহলোক হইতে অপসৃত না হও।
৪। কিন্তু তোমার বলিবার অভিপ্রায় কি? এই সকল ইতর জীবেরাও কি ঈশ্বরের সৃষ্টি নহে? অবশ্যই ঈশ্বরের সৃষ্টি। কিন্তু ঈশ্বরের পরা-সৃষ্টি নহে। উহাদের মধ্যে ঈশ্বরাংশ নাই। কিন্তু তুমি একটি পরম পদার্থ। তুমি ঈশ্বরের একটি অংশ। কোন্ উচ্চকুলে তোমার জন্ম, তাহা কি তুমি জান না? জাননা তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? যখন তুমি অন্নভোজন কর তখন কি তোমার স্মরণ হয় না, কে অন্ন ভোজন করিতেছে?—ভোজন করিয়া কাহাকে তুমি পোষণ করিতেছ? কথায় বার্ত্তায়, আহারে বিহারে, কাজে কর্ম্মে, তুমি যে একটি খণ্ড-ঈশ্বরকে পোষণ করিতেছ,—পরিচালিত করিতেছ, তাহা কি তুমি জান না? হতভাগ্য মনুষ্য! একটি খণ্ড-ঈশ্বরকে তোমার অভ্যন্তরে ধারণ করিয়া, তোমার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব্বত্র লইয়া বেড়াইতেছ;—তুমি তাহা জান না! তুমি কি মনে করিতেছ, আমি কোন স্বর্ণময়, রজতময় ঈশ্বরের কথা বলিতেছি যাহা তোমার বাহিরে অবস্থিত? না, তাহা নহে। তোমার অন্তরেই তুমি তাঁহাকে বহন করিতেছ। অতএব দেখিও যেন তোমার কোন অপবিত্র চিন্তা—কোন জঘন্য কার্য্য তাঁহার সিংহাসনকে কলুষিত না করে। তুমি এখন যাহা করিতেছ ঈশ্বরের কোন প্রতিমূর্ত্তির নিকটেও তুমি তাহা করিতে সাহসী হইতে না। কিন্তু তোমার অন্তরে ঈশ্বর স্বয়ং অধিষ্ঠিত। তিনি সমস্তই দেখিতেছেন, সমস্তই শুনিতেছেন। তাঁহার সমক্ষে তুমি এই সকল চিন্তা বা এই সকল কার্য্য করিতে লজ্জিত হইতেছ না? হে আত্মপ্রকৃতি-অনভিজ্ঞ মনুষ্য সাবধান! ঈশ্বরের রুদ্রমূর্ত্তি যেন তোমায় দেখিতে না হয়।
৫। কেন তবে আমরা যুবকদিগকে বিদ্যালয় হইতে জীবনের কার্য্যক্ষেত্রে পাঠাইতে এত ভয় করি? পাছে তাহারা কোন অন্যায় কাজ করে, বিলাসী ও লম্পট হয়, চীরবস্ত্র পরিধানে হীনতা মনে করে, চারু পরিচ্ছদ ধারণে উদ্ধত হইয়া উঠে,—এইরূপ আমাদের নানা আশঙ্কা হইয়া থাকে। যে এরূপ ভয় করে, সে আপনার ঈশ্বরকে জানে না; জানে না, কাহার সঙ্গে সে যাইতেছে। যদি কেহ আমাকে বলে — “গুরুদেব! তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকিতে, তাহা হইলে কোন ভয় হইত না।” এইরূপ কথায় আমার ধৈর্য্যচ্যুতি হয়। কেন হে বাপু! তোমার ঈশ্বর কি তোমার সঙ্গে নাই? অথবা তাহাকে পাইয়াও অন্যের সঙ্গ তুমি কেন অন্বেষণ করিতেছ?
৬। প্রসিদ্ধ ভাস্কর “ফিডিয়াসের” নির্ম্মিত কোন দেবমুর্ত্তি যদি তুমি হইতে, তাহা হইলে আপনার সম্বন্ধেও একটু বিবেচনা করিয়া চলিতে, তোমার নির্ম্মাতা ভাস্করের সম্বন্ধে ও একটু বিবেচনা করিয়া চলিতে। আর, যদি তোমার চৈতন্য থাকিত, তাহা হইলে, তোমার নির্ম্মাতার অযোগ্য কোন কাজ করিতে না, কোন প্রকার অশোভন পরিচ্ছদ ধারণ করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিতে না। কিন্তু তোমাকে যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন সেই ঈশ্বরের নিকটে তুমি কি ভাবে আইস সে বিষয়ে তুমি ভ্রুক্ষেপ মাত্র কর না। অথচ, এই যে শিল্পী ইনি কি অপর শিল্পীর মত? ইঁহার রচনা কি অপর শিল্পীর রচনার মত? সে কি অপূর্ব্ব রচনা। —যাহাতে রচয়িতার রচনা-শক্তি সেই রচনার মধ্যেও বিদ্যমান! অপর ভাস্করেরা পাষাণ ও ধাতুর দ্বারা মূর্ত্তি গঠন করে। ফিডিয়াস “বিজয়লক্ষ্মীর”র যে মূর্ত্তি গড়িয়াছেন সে এক স্থানেই দাঁড়াইয়া থাকে। কিন্তু ঈশ্বরসৃষ্ট মূর্ত্তিদিগের গতিক্রিয়া আছে, শাসোচ্ছ্বাস আছে—তাহারা ইন্দ্রিয়প্রতীতির ব্যবহার ও বিচার করিতে সমর্থ। এরূপ শিল্পী—যাঁহার তুমি রচনা—তুমি কি তাঁহার অবমাননা করিবে? শুধু যে তিনি তোমাকে রচনা করিয়াছেন তাহা নহে, তোমার হস্তেই আপনাকে ন্যস্ত করিয়াছেন—সমর্পণ করিয়াছেন। এ কথাটাও কি তুমি স্মরণ করিবে না? যাঁহার তুমি রক্ষণভার গ্রহণ করিয়াছ তাঁহাকে অবহেলা করিবে? মনে কর, ঈশ্বর যদি কোন অনাথকে, তোমার হস্তে সমর্পণ করিতেন, তাহা হইলে তুমি কি তাহাকে অবহেলা করিতে? এখন তোমায় তিনি আপনাকে দান করিয়া এই রূপ বলিতেছেন:— “তোমা অপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য লোক আমার আর কেহই নাই; এই মানুষটিকে প্রকৃতি যেরূপ ভাবে গড়িয়াছেন, ইহাকে তুমি ঠিক সেইভাবে রক্ষা করিবে;— ইহাকে ভক্তিমান, শ্রদ্ধাবান্, উন্নত, শান্ত, দান্ত, নির্ভয় করিয়া রাখিবে। কিন্তু তুমি তাহা কিছুতেই করিবে না। কি আক্ষেপের বিষয়!