এরাও মানুষ/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ
স্থানীয় কালো লোকদের কাছে তুরুগু হওয়ার একটা প্রবল আকর্ষণ থাকে। বিসিবিংগুই সেই আকর্ষণে মত্ত হয়ে উঠেছিল।
তারা বলে তুরুগু, শাদা লোকগুলো বলে মিলিটারীম্যান। সৈনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি পাবে রাইফেল, টোটা, চামড়ার বাকস্ ভর্তি টোটা···বুকের সঙ্গে থাকবে আঁটা···কোমরে ঝুলবে লম্বা একটা ছুরি···রীতিমত ধারালো ছুরি। পায়েতে উঠবে জুতো···রীতিমত শক্ত চকচকে চামড়ার জুতো···কাঁধেতে থাকবে তামার তক্মা···তার ওপর, রীতিমত মাসে মাসে পাবে মাইনে।
প্রত্যেক রবিরার, ক্যাপটেন সবাইকে ডেকে বলে দেবে ছুটি, তখন সেই পোষাকে রাইফেল উঁচিয়ে গাঁয়ের ভেতর গিয়ে যখন ঢুকবে, চারদিক থেকে মেয়েরা আসবে ছুটে···ঘিরে দাঁড়াবে তোমাকে···সকলের দৃষ্টি থাকবে তোমার ওপর···শুধু তোমারই ওপর।
এ সব সুবিধে তো হাতে-হাতে সামনা-সামনিই পাওয়া যায়, তাছাড়া পেছন দিক থেকে আরো আছে হাজার মজা। তুরুগু হলে তোমাকে আর ট্যাক্স দিতে হবে না, উল্টে তুমিই লোকের কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে আসবে ট্যাক্স। তোমার খাতির কত?
যে সব গাঁয়ের ট্যাক্স বাকি পড়বে, বাকি পড়বেই কোন না কোন গাঁয়ের, তোমারই ওপর হুকুম হবে তাদের জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে আসবার···সেই সঙ্গে আশে-পাশে দু' এক ঘর যারা হয়ত ট্যাক্স দিয়েছে, লুটের হাত থেকে তারাও বাঁচবে না। লুটের মাল কি সবই সরকারের সিন্দুকে যাবে? মোটেই না।
তুরুগুদের ওপরই ভার পড়বে, রবার সংগ্রহ করে নিয়ে আসবার। তারাই জোগাড় করবে রবারের ঝুড়ি বইবার লোক। এই তো হলো তুরুগুদের কাজ। তাদের সঙ্গে গোপন খাতির রাখবার জন্যে বড় বড় সর্দাররা পর্যন্ত উপহার, বক্শিস নিয়ে ছুটে আসবে। কারুর সাধ্যি নেই তুরুগুদের চটায়। তা ছাড়া, তুরুগুদের মাথার ওপর যে শাদা সেনা-নায়ক থাকে, সে তাদের ভাষা জানে না। সেটা কম সুবিধে? তুরুগুরা যা বোঝাবে শাদা ক্যাপ্টেনরা তাই শুনতে বাধ্য। সেটা কি কম সুবিধের কথা? ধর, তারা এসে ক্যাপটেনকে খবর দিলো, অমুক গাঁয়ের লোকেরা ভয়ানক অবাধ্য হয়েছে···যা হোক একটা গল্প বানিয়ে বলতে কি আর কষ্ট! ক্যাপ্টেন অক্ষরে অক্ষরে তাদের কথা বিশ্বাস করে, হুকুম দেয় গ্রেফ্তার করো! তখন তুরুগুরা রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং গাঁকে গাঁ গ্রেফ্তার করে নিয়ে আসে, ছাগল, মুরগী, মানুষ, ছেলেপুলে, স্ত্রীলোক সবশুদ্ধ গ্রেফ্তার করে নিয়ে আসে। এমন কি, যার যার গোলায় যা কিছু শস্য মজুৎ থাকে, তাও বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে আসে।
বিচার হয়···অনেক সময় বিচারের ফলে গ্রেফ্তারী মাল নীলামে বিক্রী হয়ে যায়···মুরগী, ছাগল আর গমের দানার সঙ্গে নীলামে স্ত্রীলোক আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েও বিক্রী হয়ে যায়···সেই বিক্রয়-লব্ধ অর্থ ট্যাক্স হিসাবে সরকারী তহবিলে জমা পড়ে।
অনেক সময় গ্রেফ্তারী মুরগী আর ছাগল, তুরুগুরা নিজেদের মধ্যেই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। কেউ কেউ আবার সেই সব মুরগী আর ছাগল খোদ বড়কর্তাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। বড়কর্তা এই সব প্রীতির নিদর্শন স্মরণ করে রাখেন, প্রমোশন দেবার সময়।
সুতরাং তুরুগু হওয়ার প্রলোভন কালো নিগ্রোদের কাছে কম প্রবল নয়। তাই বিসিবিংগুই-ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, সে-ও তুরুগু হবে···
অন্ধকার রাত্রির মধ্যে সেই কথা ভাবতে ভাবতে বিসিবিংগুই একা এগিয়ে চলে···
পিঠে ঝোলান ধনুক, তূণ-ভর্তি বাণ, হাতে লম্বা একটা বর্শা···আলাদাভাবে তৈরী বিরাট বর্শা···একটার জায়গায় তিনটে ফলক। দুই কোমরে গোঁজা দুটো লম্বা ছোরা···ছুঁড়ে মারবার ছোরা। পিঠে ঝোলানো পেট-মোটা একটা থলে···খাবারে ভর্তি, বাঁ হাতের অপর দিকে চামড়ার তাগায় বাঁধা আর একটা ছোৱা।
বিসিবিংগুই এগিয়ে চলে অন্তহীন ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে···শঙ্কাহীন শান্ত পদক্ষেপে, ধীরে। কিন্তু বিন্দুমাত্র শব্দ হলে, চমকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ আর কান খাড়া হয়ে ওঠে তার। হাতে জ্বলন্ত একটা মশাল। কতক্ষণ এইভাবে সে চলেছে? তার কোন আন্দাজ তার নিজেরই ছিল না। সময়কে ঘণ্টায়, মিনিটে, সেকেণ্ডে ভাগ করে দেখবার কায়দা তারা জানে না। সে কায়দা জানে একমাত্র শাদা মনিবেরা। তারাও আবার আন্দাজে তা জানতে পারে না। তার জন্যে তারা একটা ছোট বাক্সের মত যন্ত্র ব্যবহার করে, তার ভেতরে ছোট ছোট সূঁচের মত দুটো কি তিনটে করে কাঁটা থাকে, সেই কাঁটাগুলো নম্বর-দেওয়া ঘর ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে, তাই থেকে তারা নাকি বুঝতে পারে কতটা সময় কেটে গেল।
বিসিবিংগুই এগিয়ে চলে···সামনেই পড়ে একটা ছোট্ট গাঁ, কোসিগাম্বা কাগা, তার পাশে ছোট্ট একটা নদী বোবো, কতদিন এই নদীর জলে অনায়াসেই না সে সাঁতার কেটেছে। এসে পড়ে বড় রাস্তায়, সে-রাস্তা চলে গিয়েছে শান্ত্রীদের পাহারা-ঘরের দিকে; আরো একটু এগিয়ে এসে পড়ে পাঁচিল-ঘেরা একটা বিরাট জমিতে, সেখানে শাদারা তাদের মড়াদের কবর দেয়; ক্রমশ দেখা দেয় বাম্বা; বাম্বার ওপরে সাঁকো; সাঁকো পেরিয়ে কমাণ্ডারের ঘাঁটি···তার চারপাশে চাষের জমি, কমাণ্ডারের শাক-সব্জীর বাগান; তার একধারে একটা মস্ত বড় ছাউনী, যেখানে রবারের বেচা-কেনার সময় সর্দাররা আর তাদের লোকজন এসে জড় হয়।
আরো এগিয়ে যায়। পোম্বোর তীর ধরে এগিয়ে চলে। বাতোয়ালার গাঁয়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলে, নির্জন মাঠের মাঝখানে একটা কুঁড়ে ঘর···সেইখানে গিয়ে থামে। সেই অঞ্চলের জেলে মাকুদে সেইখানে বাস করে, তারই কুঁড়ে ঘর।
মাকুদের কাছে সে জানতে পারে, বাতোয়ালা এখন কোথায় আছে। সেই সন্ধান নিয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ে। বেরুবার মুখে মাকুদে তাকে সাবধান করে দেয়···কি এক মহা-অনর্থের সম্ভাবনা ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়। সেই ইঙ্গিতের অস্পষ্টতা থেকেই বিসিবিংগুই বুঝতে পারে, তার জীবন কতখানি বিপন্ন। বাতোয়ালা প্রতিহিংসার জন্যে ক্ষিপ্ত হায়েনার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর বিলম্ব করা উচিত নয়। বাতোয়ালা কিছু করবার আগেই, তাকে তার কর্তব্য শেষ করে ফেলতে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব।
সে নিমন্ত্রণ পেয়েছে, বিশেষ নিমন্ত্রণ বাতোয়ালার কাছ থেকে। একবার ভাবে, সে-নিমন্ত্রণ যদি সে গ্রহণ না করে? তারপর ভাবে, যদি অনুপস্থিত থাকে, লোকে অন্য রকম ভাবতে পারে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই যদি যায়, তাতে কি যায় আসে? সেখানে তার এমন কি বিপদ হবে? বাতোয়ালার আপনার লোকজনের মধ্যে বাতোয়ালার সামনা-সামনি হওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? এক পা ভুল ফেললেই, সব গোলমাল হয়ে যাবে।
হঠাৎ উত্তর দিক থেকে হাওয়া এসে গায়ে লাগে। শুভ লক্ষণ। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসে মাদলের গুরু-গম্ভীর আওয়াজ···আগুনে পোড়া কাঠ ফাটছে, তার শব্দ···লিংঘার ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি।
তাকে একটা যা হোক সিদ্ধান্ত করতে হবে। হয় মারতে হবে, নয় মরতে হবে। কিন্তু সে মারবে কি করে? কোথায়? কখন?
এগিয়ে চলে। মন্দ লাগে না! মাদলের আওয়াজ স্পষ্টতর হয়। একদল বাদুড় উড়ে চলে গেলো। প্যাঁচা ডাকছে। জোনাকীরা জ্বলছে। দূরে, সামনেই চোখে পড়ে আগুন। মাথার ওপরে আকাশ তারায় তারায় ভরা। শিশির পড়ছে। টুপ্ টাপ্, টুপ্ টাপ্,
চমৎকার! চমৎকার রাত্রি!
তাতো হলো, কিন্তু···কি সিদ্ধান্ত সে ঠিক করলো? আজকের রাত্রিতেই কি সে খুন হয়ে যাবে? না, না, তা হতে পারে না। চারদিকে সাক্ষী রেখে কেউ কাউকে খুন করে না।
সে কথা ঠিক। সে সম্বন্ধে আর কোন ভুল নেই। কিন্তু, তার নিজের দিক থেকে, বাতোয়ালাকে কি করে সে সাবাড় করবে?
হুঁ! একটুখানি বিষ, সেঁকো বিষ। খাবার সময় বাতোয়ালার খাদ্যে যদি মিশিয়ে দিতে পারে! অবশ্য অন্য পন্থাও নিতে পারে, নেকড়ে যে পন্থা নেয়, তার একটা আলাদা আকর্ষণও আছে। কিন্তু তাতে একটা অসুবিধা থেকে যায়, প্রমাণ থেকে যেতে পারে। কিন্তু সেঁকো বিষ···সোজা···কোন প্রমাণ থাকে না।
পাছে অন্ধকারে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে, কিংবা কোন বড় নুড়িতে হোঁচট লাগে, তাই মাটির দিকে মাথা করে এগিয়ে চলে···
হাতের মশাল নিভে গিয়েছে···অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে।
গাঁয়ের চারদিকে বনের শুকনো পাতা আর শুকনো ঝোপে তারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। গোল হয়ে আগুনের শিখা ওপরের দিকে উঠছে। তার আঁচ এসে পড়ছে সামনের পথের ওপর।
সে শুধু ভাবে, একটি মাত্র চিন্তা, কি করে সে বাতোয়ালাকে বধ করবে! বধ তাকে করতেই হবে। অরণ্যের নিয়ম। নইলে তাকে নিহত হতে হবে।
অপেক্ষা করে থাকবে সুযোগের জন্যে? না। সময় দেওয়া চলবে না। ইচ্ছে করে বাতোয়ালাকে ক্ষেপিয়ে দেবে? তাই করতে হবে! কিন্তু কি···করেই বা সেটা করা যায়? ভাবনার কথা।
কিন্তু মারতেই হবে। নইলে মরতে হবে। মরার চেয়ে মারা ঢের ভাল। এই অল্প বয়সে পরিপূর্ণ যৌবনের মধ্যে কে মরতে চায়? জীবনে আজও রয়েছে পরিপূর্ণ মধুর স্বাদ এবং নারীরা স্বেচ্ছায় সে-মাধুরীকে করে তোলে মোহনীয়। না, না, সে কিছুতেই মরবে না।
চারদিকে একবার চেয়ে দেখে। চারদিকে আগুন। গাঁ যেন মশালের মতন জ্বলছে।
সে সঙ্কল্প স্থির করে ফেলে, বাতোয়ালাকে সে হত্যা করবেই।
ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে! শীকারের সময়! শীকারের সময় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে! এ-রকম দুর্ঘটনা তো শিকারের সময় প্রায়ই হয়···তার জন্যে কে আর মাথা ঘামায়?
চমৎকার ব্যবস্থা! শিকারকে লক্ষ্য করে বাণ ছুঁড়েছি···বিষ-মাখা বাণ···লেগে গেলো একজন মানুষের গায়! ভবিতব্যতা! সব মানুষই যে তীর ছোঁড়ায় অভ্রান্ত হবে, এমন কোন কথা নেই! সকলের তাক্ সমান হতে পারে না! সবচেয়ে যে ভাল তীরন্দাজ, তারও তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়! যায় না? তবে?
আর ঐ দাবানল!
প্রত্যেক বছরই কত হতভাগা এই বুনো আগুনে পুড়ে মরে! আগুনের তো কোন বিচার শক্তি নেই! তার খাদ্যাখাদ্য বিচারও নেই! মানুষ কি গাছ, কাকে পোড়াচ্ছে সে কথা ভেবে দেখবার তার কোন প্রয়োজন নেই। বনের ভেতর হয়ত কেউ নেশায় ঘুমিয়ে পড়েছে···গভীর ঘুম···চারদিক থেকে আগুন এসে তাকে বেষ্টন করেছে···ব্যস্! আগুন কাউকেই রেহাই দেয় না কিছুকেই নয়···একমাত্র শুধু জলকে···
তাহলে ব্যাপারটা দাড়ালো কি? হয় একটা বুনো-আগুন, না হয়, শিকারের সময়।
কিসের যেন শব্দ হলো? সে থমকে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে পথের প্রত্যেকটা বাঁক মারাত্মক···প্রত্যেক বাঁকের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মৃত্যু! সাবধান হতে দোষ কি? যার বুদ্ধি থাকে, সেই সাবধান হয়।
ইস্, একটা পিঁপড়ের ঢিপি! তার ডানদিকে সারি সারি আরো অনেক ঢিপি। তাহলে ডানদিকেই যেতে হবে! লক্ষণ!
কয়েক পা এগুতেই দেখে, কাঁধ বরাবর একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়েছে, বাঁ দিকে···পায়ের কাছে একটা কাঠ, হাঁ, সেটাও বাঁ দিকে···একটা ঝোপ···সেটাও বাঁ দিকে···তাহলে এবার বাঁ দিকেই যেতে হবে। অরণ্যের এই সব ইঙ্গিত জানা চাই। অরণ্য কথা বলে। সারাদিন ধরে বৃদ্ধা পিতামহীর মতন অরণ্য কত কথা বলে! শাদা লোকরা তার কিছুই জানে না। তারা মনে করে, অরণ্য বুঝি মৃত। কি ভুলই না তাদের!
মাথার ওপরে একটা পাখী ডেকে গেল···আকাশে আগুনের শিখা ডানদিকে হেলছে, না বাঁ দিকে হেলছে? গাছের শুকনো পাতা তোমার ডানদিকে পড়লো, না বাঁ দিকে পড়লো···গাছের দু'টো ডাল একটার ঘাড়ে আর একটা এসে পড়েছে···পথ চলতে একটা গাছের ডাল মাথায় এসে লাগলো···শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়লো···এ-সবের প্রত্যেকের একটা করে আলাদা মানে আছে ···যারা জানে, তারা বুঝতে পারে বনের এই মূক ভাষা। অরণ্য-ভরা কথা···জীবন্ত কথা! মার মতন স্নেহে তাই নির্বাক ভাষায় রাত্রি-দিন অরণ্য আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে···
বিসিবিংগুই পথ চলে আর ভাবে, কি করে, কখন, কোথায়,বাতোয়ালার সঙ্গে সে শেষ-মীমাংসা করবে!
ক্রমশ সে বাতোয়ালার আস্তানার কাছ-বরাবর এসে উপস্থিত হয়। কানে আসে কুকুরের ক্রুদ্ধ চীৎকার। চোখে পড়ে মশালের আলো। স্পষ্ট হয়ে ওঠে দুটো কণ্ঠ, সুরায় জড়িত। বাতোয়ালা আর তার বৃদ্ধা মা। কুকুরটা আর কেউ নয়, জুমা, বাতোয়ালার কুকুর।
বিসিবিংগুই-এর তন্দ্রা ভেঙে যায়। বুঝতে পারে, সে এসে পড়েছে।
কিন্তু মনের মধ্যে তখনও চলেছে সেই ভাবনা। দুটো প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শিকারের সময় দুর্ঘটনা, না, বুনো আগুন? বাতোয়ালাকে হত্যা করবার জন্যে কোনটির আশ্রয় সে নেবে?
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আঘাত করার চেয়ে, সেই মুহূর্তে, তার কাছে ঢের বেশী প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা ভাবা। চারদিক থেকে নানা রকমের লক্ষণ তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল কিন্তু সে কোন লক্ষণকেই মানে নি, ভাবনার ঘোরে সে শত্রুর ডেরার মধ্যেই এসে পড়েছে। হয়ত তার জন্যে তৈরী ফাঁদে সে নিজেই এসে পা দিয়েছে। সুতরাং এখন আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথাই ভাবা তার পক্ষে বৃদ্ধিমানের কাজ।
অচিরকালের মধ্যেই বিসিবিংগুই বুঝতে পারে, ঝোঁকের মাথায় কি নির্বুদ্ধিতার কাজই সে করে ফেলেছে! এরকমভাবে বাতোয়ালার ডেরায় তার আসা উচিত হয় নি।
তার সামনে বাতোয়ালা, সুরায় উন্মত্ত হয়ে আছে। যে কোন আঘাতের জন্যে তৈরী। হয়ত তাকে বধ করবার জন্যে যে ফাঁদ বাতোয়ালা পেতে রেখেছে, তার মধ্যে সে নিজেই এসে পড়েছে। এসব কথা আগে থাকতেই তার ভেবে দেখা উচিত ছিল। এখন ভাববার সময় নেই।
যদি সেইখানেই বাতোয়ালা তাকে হত্যা করে? সাক্ষী থেকে যাবে? কি করে? সাক্ষীর মধ্যে তো দুটী প্রাণী বাতোয়ালার বুড়ো মা, আর তার কুকুর। কিন্তু সাক্ষী হিসাবে দুজনেই নিরর্থক। কোন মূল্য নেই তাদের অস্তিত্বের। কোন মা তার নিজের ছেলেকে ধরিয়ে দেয় না, যদি ছেলে তার বেজন্মা না হয়। আর জুমা? আজও পর্যন্ত কেউ কখনো শোনে নি যে, কুকুর কথা বলেছে। অতএব, তাদের দুজনের থাকা আর না-থাকায় কিছুই যায় আসে না।
অতএব বিসিবিংগুই, আজ রাত্রি তোমার জীবনের শেষ রাত্রি। স্পষ্ট করে দু’চোখ চেয়ে আশে-পাশের পৃথিবীকে ভাল করে দেখে নাও!
মাটির ওপরই বসে পড়লো। পাশে মাটিতেই বর্শাটি পুঁতে রাখলো, কোমর থেকে ছোরাটা আল্গা করে নিলো।
অতিথি সৎকারে বাতোয়ালার ত্রুটী হয় না। বিসিবিংগুইকে খেতে দেয়। সঙ্গে দেয় ভুট্টা দানার বিয়ার। বিসিবিংগুই গ্রহণ করে না! খাদ্যও নয়, বিয়ারও নয়। প্রত্যাখ্যানে বাতোয়ালা অসন্তুষ্ট হয়···মুখ ভার করে থাকে। বিসিবিংগুই ইচ্ছে করেই তা লক্ষ্য করে না। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক দেখাবার চেষ্টা করে।
খাদ্য গ্রহণ না করবার ওজুহাত দেখিয়ে সে বলে, আসবার সময় মাকুদের ওখান থেকে খেয়ে আসছি। এক পেট ভরে খাইয়ে দিলো, আলু সেদ্ধ, পোড়া মাছ আর কেনে। জালা ভর্তি করে খেয়েছি। বিশ্বাস না হয়, টিপে দেখো। এক দানা খাবার যাবার আর জায়গা নেই। ফেটে পড়ছে।
পরিচিত লোক দেখে জুমা বিসিবিংগুই-এর কাছে আসে, জিভ দিয়ে পা চাটে। বিসিবিংগুই আদর করে তার গায়ে হাত বুলোয়। আনন্দে ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে দিতে হর্ষধ্বনি করে ওঠে। ছুটে এসে খেলা-ছলে বিসিবিংগুই-এর আঙুল কামড়ে ধরে, আবার ছুটে গিয়ে ধূলোয় গড়াগড়ি দেয়। ভেতরকার খবর সে কিছুই জানে না। বাইরে যেটুকু চোখে দেখে, সেইটুকুই তার সব।
কিন্তু, হাজার হোক্, আর দশটা কুকুরের মত, জুমা একটা কুকুর ছাড়া আর কিছু তো নয়! অর্থাৎ, তাকে নিয়ে মেতে থাকবার কিছু নেই। কিছুক্ষণ পরেই বিরক্ত হয়ে ওঠে বিসিবিংগুই, কুকুরের খেলায় মন দেবার মতন মনের অবস্থা তার নয়। লাথি মেরে জুমাকে তাড়িয়ে দেয়। দূরে দাঁড়িয়ে জুমা ভাবে, হঠাৎ এ আবার কি হলো?
ইতিমধ্যে বাতোয়ালা গ্লাসের পর গ্লাস পান করে নেশায় টইটম্বুর হয়ে উঠেছে। আপনার খেয়ালে নাচতে আরম্ভ করে দেয়। কয়েক পা নাচে আবার পান করে। আবার কয়েক পা নাচে। পূর্ণিমা-রাতের প্রণয়-নাচের ছন্দ।
বাতোয়ালার ধারণা, সে নাচছে, ঠিক মতই নাচছে। কিন্তু আসলে সে শুধু দাঁড়িয়ে টলতে থাকে, এ-দিকে ও-দিকে বিবশের মত শুধু অঙ্গ দোলায়। সমস্ত দেহ যেন সীসের মতন ভারি; জমাট হয়ে গিয়েছে মস্তিষ্ক; পা দুটো যেন দেহের ভার বইতে পারে না; চোখ ফেটে যেন রক্ত পড়বে এখুনি। হঠাৎ নাচতে নাচতে একটা কাঠে ঠোক্কর লেগে পড়ে যায়। সটান মাটিতে শুয়ে পড়ে।
জুমা দূর থেকে মনিবের নাচ দেখছিল। হঠাৎ মনিবকে ধরাশায়ী হয়ে যেতে দেখে, ছুটে তার কাছে চলে আসে। মনিবের অবশ দেহকে বেষ্টন করে ঘুরতে থাকে আর চীৎকার করে। তার ধারণা, তার মনিব তার সঙ্গে খেলা করছে। তার চীৎকারে হয়ত এখুনি আবার উঠে দাড়াবে।
সত্যিই বাতোয়ালা উঠে দাঁড়ায়। জড়িতকণ্ঠে বলে, বহু···বহুকাল আগে একবার ঠিক এইরকম অবস্থায় পড়েছিল ইলিঙ্গো···
আপনার খেয়ালে অট্টহাস্য করে ওঠে। আবার বলতে আরম্ভ করে, ইলিঙ্গোকে চিনতে পারলে না, না? আচ্ছা দাঁড়াও, তার সম্বন্ধে সব কথা আমি বলছি। তুমি জান না তো? তবে শোন।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন, পৃথিবীতে আজকের মতন এত সব ঘর বাড়ী, দেশদেশান্তর কিছুই ছিল না···অনেকদিন আগে···শুধু ছিল মানুষ, অনেকদিন আগেকার মানুষ। কিন্তু একটা ছিল অসুবিধা, ভীষণ অসুবিধা। তখন ছিল ভয়ানক ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডার জন্যেই মানুষের মনে বড় অশান্তি ছিল। সে রকম ঠাণ্ডা না থাকলে, মানুষের আর কোন অসুবিধাই ছিল না। ঠাণ্ডায় হাত-পা অবশ হয়ে যেতো। প্রাণভয়ে মানুষ ঘুমোতে পর্যন্ত পারতো না। এই নিয়ে মানুষ রাতদিন ওজর-আপত্তি করতে শুরু করে দিলো। সেই ওজর শুনতে শুনতে, আকাশে ছিল আইপু-চাঁদ, মানুষকে আশ্বাস দিলো, এই অশান্তির হাত থেকে সে মানুষকে বাঁচাবে। আইপু তার জন্যে ইলিঙ্গোকে ডেকে পাঠালো, এই ইলিঙ্গোরই আর একটা নাম হচ্ছে সেলাফু। ইলিঙ্গোর ওপর ভার দিলো, পৃথিবীতে গিয়ে মানুষকে আগুন ব্যবহার করতে শেখাতে। সেই কাজের ভার নিয়ে ইলিঙ্গো এলো পৃথিবীতে···দীর্ঘ তার কাহিনী···
বাতোয়ালা বলতে শুরু করে সেই পুরাণ-কাহিনী···
বাতোয়ালা বলতে আরম্ভ করে সেই পুরাণ কাহিনী, কি করে ইলিঙ্গো পৃথিবীতে নিয়ে এলো আগুন, মানুষকে শেখালো আগুনের ব্যবহার।
আইপু মনস্থ করলো, পৃথিবীর মানুষের সেই হিম-যন্ত্রণা দূর করবার জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইলিঙ্গোকে সেখানে পাঠাবেন। তার জন্যে তিনি একটা লম্বা দড়ি ইলিঙ্গোর কোমরে বেঁধে পৃথিবীতে নামিয়ে দিলেন। দড়ির সঙ্গে একটা লিংঘা বেঁধে দিলেন। কাজ শেষ হয়ে গেলে যখন ইলিঙ্গো ফিরে আসতে চাইবে, তখন সেই লিংঘায় আওয়াজ করলেই আইপু জানতে পারবে। তখন আবার দড়ি ধরে তাকে ওপরে টেনে নেবে।
ইলিঙ্গো পৃথিবীতে এসে মানুষকে শেখালো কি করে আগুন ব্যবহার করতে হয়। মানুষ ক্রমশ জানতে পারলো যে, আগুনের আঁচে শুধু যে হিমই দূর হয় তা নয়, আগুনের আঁচে তাদের হাত-পা সুস্থ সবল হয়, আগুনের আঁচে তারা রান্না তৈরী করতে পারে, ঘরের অন্ধকার দূর করতে পারে।
এইভাবে ইলিঙ্গোর কাছ থেকে আগুনের ব্যবহার শিখতে শিখতে, পৃথিবীর মানুষ ইলিঙ্গোর প্রেমে পড়ে গেলো। তারা বুঝলো, তার মতন বন্ধু তাদের আর কেউ নেই। যা কিছু তারা বুঝতে পারে না, যা কিছু তাদের কাছে রহস্যময় জটিল বোধ হয়, ইলিঙ্গোকে জিজ্ঞাসা করে! ইলিঙ্গো তার জবাব দেয়।
একটা জিনিস পৃথিবীর মানুষকে সব চেয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল। তারা প্রায়ই দেখতো, তাদের আশে-পাশে যে সব জন্তু ঘুরতো ফিরতো, হঠাৎ একদিন তারা অবশ হয়ে শুয়ে পড়তো, আর উঠতো না। ক্রমশ তাদের সামনে থেকে তারা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতো। কোথায় যায় এই সব জন্তু অদৃশ্য হয়ে? কেন যায়? এ প্রশ্নের কোন উত্তরই তারা খুঁজে পায়না। তার জন্যে একটা অনিশ্চিত ভয় তাদের দেহের ভেতর তাদের স্নায়ুর সঙ্গে তাদের পাক-যন্ত্রের সঙ্গে যেন জড়িয়ে যায়। সেই যে জন্তুটা ঘুরছিল ফিরছিল ডাকছিল, সে কেন হঠাৎ এই রকম চুপ হয়ে গেলো? তখন তাদের যতই ডাকো, তারা আর সাড়া দেয় না। তখন তাদের যতই আদর করো, তারা আর নড়ে না, চড়ে না। যতই কেন তাদের খোসামোদ করো, তারা আর কোন উচ্চবাচ্য করে না। পড়ে থাকে অনড় অচল, শব্দহীন, স্থির। মাছিরা এসে তাদের নাকের ফাঁকের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে। কোন প্রতিবাদ করে না। তারপর দেখতে দেখতে একদিন গলে পচে যায়। পোকা-মাকড় আর মাছি কিলবিল করে সেই পচাদেহের ওপর। কেন এমন হয়? কোন উত্তর না পেয়ে একটা আতঙ্ক তাদের পেয়ে বসে। তারা সকলে মিলে ইলিঙ্গোকে চেপে ধরে, এ রহস্যের সমাধান তাকে করে দিতেই হবে। সে অনেক বিষয় জানে। নিশ্চয় এ বিষয়ও তার জানা আছে। উত্তর দিয়ে মানুষের এই আতঙ্ক তাকে দূর করতেই হবে। কিন্তু ভীত সন্ত্রস্ত মানুষদের এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে তা ইলিঙ্গো ঠিক করে উঠতে পারে না। বলে, আমার রাণী আইপুকে জিজ্ঞাসা করে এসে তোমাদের বলবো।
এই স্থির করে ইলিঙ্গো আবার আইপুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। বলে, একটা ব্যাপার নিয়ে বড়ই মুশকিলে পড়েছি। পৃথিবীর মানুষরা একটা সমস্যা নিয়ে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়েছে। তারা মৃত্যুকে ভয় করে। তারা জানতে চায়, পশু-পাখীরা যেমন মৃত্যুর অধীন, মানুষও কি তেমনি মৃত্যুর অধীন?
আইপু বলে, তুমি ফিরে গিয়ে পৃথিবীর মানুষদের জানাও, এতে ভীত হবার কিছু নেই। আমি আমার দেহ থেকেই তাদের তৈরী করেছি। আমিও মৃত্যুর অধীন। তবে আমি আবার জন্মগ্রহণ করি। প্রত্যেক মৃত্যুর আট রাত্রির পর আমি আবার জন্মগ্রহণ করি। তাই মৃত্যুতে আমি অদৃশ্য হয়ে যাই বটে; তবে আবার নবজন্ম নিয়ে ফিরে আসি। মানুষদের জানিয়ে দিও, আমার এই কথা। তারা যেন ভোলে না এই কথা। যাতে তারা আমার এই কথায় বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, তার জন্যে আজ থেকে তোমাকে মানুষদের মধ্যে গিয়েই বাস করতে হবে।
সেই কথা বলে আইপু আবার সেই লিংঘা-শুদ্ধ দড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে ইলিঙ্গোকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়।
দু’হাত দিয়ে দড়িটা বেশ শক্ত করে ইলিঙ্গো ধরে থাকে। নামবার সময় নানান রকমের চিন্তায় তার মন এমন ভরে থাকে যে, এক সময় তার ধারণা হয় যে সে মাটিতে পৌঁছে গিয়েছে। সেইজন্যে অন্যমনস্কভাবে দড়ি ছেড়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ সে শূন্য থেকে সজোরে এসে মাটিতে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলো। সেইদিন থেকে পৃথিবীতে অন্য সব জীব-জন্তুর মতন মানুষও মরতে লাগলো। সেইদিন থেকে যে মানুষ জন্মায়, সে মানুষই আবার মরে যায়। মৃত্যুর হাত থেকে কারুরই রেহাই নেই।”
বিসিবিংগুই একমনে বাতোয়ালার কথা শোনে। এই গল্প কেন আজ বাতোয়ালা তাকে শোনালো? সে কি এই গল্পের ভেতর দিয়ে তার আসন্ন মৃত্যুর কথাই ইঙ্গিত করছে? মনে তার ঘোরতর সন্দেহ জেগে ওঠে। হয়ত কয়েক মুহূর্ত পরেই তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। হয়ত বাতোয়ালা তার সব আয়োজনই করে রেখেছে।
কিন্তু বিসিবিংগুই-এর মনে আর এক পুরাণ কাহিনী জেগে ওঠে। আর এক জাতের পুরাণ কাহিনী। বাতোয়ালাকে প্রতিবাদ করে সে বলে, তুমি বল্লে, আইপুর আদেশেই ইলিঙ্গো এসেছিল পৃথিবীর মানুষকে আগুনের ব্যবহার শেখাতে? কিন্তু নিয়োন্বাঙ্গুই নদীর ধারে যে-সব জাতের লোক বাস করে তারা অন্য কথা বলে। তারা বলে, এই তোমার কুকুর, তোমার জুমার পূর্ব পুরুষরাই নাকি পৃথিবীতে প্রথম আগুন নিয়ে এসেছিল।
শোন তাহলে, আমি বলছি সে-কাহিনী। বহু···বহুদিন আগেকার কথা। পৃথিবীতে প্রথম যে কুকুর জন্মেছিল, সে একদিন খেলা করছিল, পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। খেলার ছলে, এইভাবে সে রীতিমত একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলেছিল। হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে খুঁড়তে খুঁড়তে সে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠলো। একটা পা তার জখম হয়ে গেল। সেই পাটা উঁচু করে সে যন্ত্রণায় লাফাতে লাগলো। সেই অবস্থায় তার মনিবের সামনে গিয়ে সে চীৎকার করতে লাগলো এবং মনিবকে টেনে সেই গর্তের কাছে নিয়ে এলো। গর্তের কাছে এসে মনিব দেখে, গর্তের ভেতরে কি যেন জ্বলছে! হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে, তার হাতটাও পুড়ে গেলো। সেই মানুষ সর্বপ্রথম আগুনের সন্ধান পেলো।”
বিসিবিংগুই বলে, ওদের দেশে নদীতে যে সব বুড়ো মাঝি চলা-ফেরা করে, তাদের কাছে এই গল্প সে শুনেছে!
বাতোয়ালা সে-কাহিনীকে স্বীকার করতে পারলো না। বলে, তুমি নিয়োন্বাঙ্গুই নদীর ধারে যে জাতের লোকদের কথা বলছো, তাদের আমি বেশ ভাল করেই চিনি···তারা হলো মিথ্যাবাদী। তাদের পুরাণ হলো মিথ্যার ঝুড়ি। অবিশ্বাস্য।
শুরু হয়ে যায়, দুজনার তুমুল তর্ক।
বাতোয়ালা আর বিসিবিংগুই, দুজনেই অন্তরের আসল কথা চাপা দিয়ে, জাতির পুরাণের গল্প নিয়ে বচসা করতে শুরু করে দেয়। বাতোয়ালা দেখাতে চায়, যেহেতু সে সর্দার, সেহেতু জাতির পুরাণ ব্যাখ্যা করবার অধিকার তারই বেশী এবং তার পিতার কাছ থেকে বংশ-পরম্পরায় সে এইসব জ্ঞান অর্জন করেছে। এইসব জ্ঞান বাইরে থেকে পাবার কোন উপায় নেই। প্রত্যেক বংশের কর্তার কাছে এই জ্ঞান থাকে। তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী তার জমি-জমার সঙ্গে সঙ্গে এইসব জ্ঞানেরও উত্তরাধিকার পেয়ে থাকে। সেইজন্যে তাদের মধ্যে বংশ মর্যাদার এতখানি মূল্য।
বিসিবিংগুই জানে সে আজ এসে পড়েছে বাতোয়ালার ফাঁদের মধ্যে। তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবার যে বাসনা বাতোয়ালার মনে জেগেছে, বাইরে তার কোন লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে না উঠলেও, বিসিবিংগুই জানে, সে-প্রতিশোধের-বহ্নি বাতোয়ালার অন্তরে তেমনি জ্বলছে। তাদের মনে একবার যে জিঘাংসা জাগে, রক্ত না দেখার আগে তা আর প্রশমিত হয় না! বাতোয়ালার কাহিনী সে অন্যমনস্কভাবে শুনে চলে কিন্তু তার মনের ভেতর একটি কথাই শুধু বড় হয়ে থাকে, আজ রাত্রির শেষে প্রভাত-সূর্যকে কে দেখবে? সে, না বাতোয়ালা?
বিসিবিংগুই-এর কাহিনীর প্রতিবাদ করে বাতোয়ালা বলে, তুমি যে ইয়াকোমাদের কথা বলছো, তারা একটা নিরেট মূর্খ জাত···তারা এইসব পুরাণ কাহিনীর কিছুই জানে না। আমার কাছ থেকে তুমি তার সত্য বিবরণ শুনতে পাবে। আমি এই-মাত্র যে ইলিঙ্গোর কাহিনী বল্লাম, জেনে রেখো সেই কাহিনীই হলো সত্য। পৃথিবীতে আজ মানুষ যে আগুন ব্যবহার করছে, তা একমাত্র ইলিঙ্গোর জন্যেই সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া, একথা বোধহয় তুমি জান না যে, এই যে আমাদের সব গ্রাম, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত সে-সবই সেই ইলিঙ্গোর কীর্তি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাতোয়ালা বলে ওঠে, বিসিবিংগুই, যতটুকু তোমার জানা দরকার, তার বেশী জানতে চেষ্টা করো না। আর একথা মনে রেখো, তুমি যতটুকু জান, আমি তার চেয়ে ঢের বেশী জানি···সেই সঙ্গে একথাও তোমাকে জানানো আমার দরকার, যতটুকু জানলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না, তুমি তার চেয়ে অনেক বেশী জেনে ফেলেছ···সেটা ভাল নয়।
বিসিবিংগুই চমকে ওঠে। এ কথাগুলোর মধ্যে সে যেন স্পষ্ট একটা আঘাতের সম্ভাবনার সুর শুনতে পায়। চারদিকে চেয়ে দেখে, সে একা। এ অবস্থায় বাতোয়ালাকে প্রতিবাদ করা তার পক্ষে উচিত হবে না। তাদের জাতের পুরাণ কাহিনী বাস্তোয়ালা একাই কি সব জানে? বাতোয়ালার ভুল ধারণা। দম্ভ! বাতোয়ালার চেয়ে ঢের বেশী কাহিনী সে জানে। কিন্তু এখন সেকথা উত্থাপন করা ঠিক হবে না। হয়ত এই পথ ধরেই বাতোয়ালা তার সঙ্গে বাগড়া বাধাতে চায়। আজ, এই নির্জন নিশুতি রাতে, সে একলা···কিছুতেই আজ সে বাতোয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করবে না···কাল, শিকারের সময়···
হঠাৎ জুমা চীৎকার করে উঠলো···যেন অন্ধকারে কি দেখতে পেয়েছে! ছুটে খানিকটা দূর এগিয়ে যায়, আবার চীৎকার করতে করতে ফিরে আসে। বিসিবিংগুই চেয়ে দেখে, অন্ধকারের ভেতর থেকে একদল লোক আসছে। পথিক···হয়ত পথ ভুলে গিয়েছে···তাদেরই স্বজাত···
হঠাৎ অন্ধকারের গহ্বর থেকে সেই লোকগুলোকে আসতে দেখে, বিসিবিংগুই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এমন করে মানুষের সঙ্গ সে আর কোনদিন কামনা করে নি।
তাড়াতাড়ি উঠে লোকগুলোকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসে। নতুন করে একটা আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে তারা বসে।
আগুনের আঁচে বিসিবিংগুই লক্ষ্য করে বাতোয়ালার চোখ দুটো যেন বাঘের চোখের মতন জ্বলছে। জ্বলুক···আজ আর তার ভয় নেই! আজকের রাত সে বেঁচে থাকবে···তারপর কাল দেখা যাবে; পৃথিবীতে কে বেঁচে থাকে, বাতোয়ালা না সে!
বাতোয়ালা আবার গল্প বলতে আরম্ভ করে। আকাশের গায়ে তখন অসংখ্য তারা ফুটে উঠেছে। সেইদিকে চেয়ে বাতোয়ালা বলে, এই যে আমার মাথার ওপরে রূপোর টাকার মতন অসংখ্য “আম্বি রেপি” জ্বলছে···মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য চোখ পিট্ পিট্ করছে, ওগুলো আসলে কি, তা জানো? ওগুলো আসলে হচ্ছে, আকাশের গায়ে অসংখ্য ছেঁদা, সেই সব ছেঁদা দিয়ে বৃষ্টির দিনে পৃথিবীতে বৃষ্টি পড়ে!
প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিসিবিংগুই আবার থেমে যায়। বাতোয়ালা নিজের জ্ঞান জাহির করবার জন্যে বলতে আরম্ভ করে, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা জানতেন কি করে বৃষ্টিকে ডেকে আনতে পারা যায়! বিশেষ করে চাষ-বাসের মাসে, যে বছরে বৃষ্টি হতো না সে বছরে তাঁরা মন্তর পড়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি টেনে আনতেন। মাঠের ওপর একটা মাটির সরায় মুঠো মুঠো নুন রেখে তারা আম্বি রেপিদের মন্তর পড়ে নেমন্তন্ন করতো। সেই মন্তর-পড়া নুনের লোভে দেখতে দেখতে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়তো।আজকাল আমরা সে-সব মন্ত্র ভুলে গিয়েছি। এই সব নোংরা শাদালোকগুলোর সংস্পর্শে এসে আমরা আমাদের পুরানো সব বিদ্যা ভুলে যাচ্ছি। এই বিসিবিংগুই-এর মতন যারা আজকালকার ছোকরা, তারা নিজেদের জাতের ধর্ম-কর্ম ভুলে শাদা লোকদের অনুকরণ করতে ছুটছে···সমস্ত জাতটাকে মেরে ফেলছে···
বিসিবিংগুই হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। মাটিতে শোয়ান বর্শাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে, তার চারদিকে লোক। এত লোককে সাক্ষী রেখে, কোন কিছু করা ঠিক নয়। সে নিজেকে আবার সংযত করে নেয়। রাতটা শেষ হোক্!