এরাও মানুষ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 বাতোয়ালার চোখ নেশায় লাল হয়েই ছিল, তার ওপর উত্তেজনায় মনে হয় যেন এখুনি রক্ত ফেটে পড়বে। রাগে কথা জড়িয়ে আসে তবুও জোর গলায় সবাইকে ডেকে বলে ওঠে···,

 “শাদা চামড়ারা অপদার্থ···আমাদের জন্যে এতটুকু দরদ তাদের নেই···তারা মনে করে আমরা সবাই মিথ্যুক···হাঁ, আমরা মিথ্যে কথা বলি কিন্তু আমাদের সেই মিথ্যে কারুর ক্ষতি করে না, কাউকে সর্বস্বান্ত না। কালে-ভদ্রে সত্যিকে একটু বাড়িয়ে বলতে হয়···তার জন্যে দু-চারটে মিথ্যে বলতে হয়, নইলে সত্যির স্বাদ থাকে না, ঝোলে নুন না দিলে কি ঝোলের কোন স্বাদ থাকে?”

 “কিন্তু শাদা চামড়ারা তো সেজন্যে মিথ্যে বলে না···তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যে বলে···তাদের সব মিথ্যে হলো ভেবে-চিন্তে তৈরী-করা জিনিস···তাদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্যে···

 “তাই তারা সব ব্যাপারে আমাদের ওপর টেক্কা দিতে পারে”

 “ওরা বলে, আমরা নিগার পরস্পর পরস্পরকে ঘেন্না করি, নিজেদের মধ্যে মারামারি করি···আর ওরা? ওদের কমাণ্ডার-গুলো আর ওদের বন্দুকওয়ালারা সব সময় গলা জড়াজড়ি করে থাকে নাকি? ওদের মধ্যে ওরা মারামারি করে না? আমরাই বা ওদের মতন করতে পারবো না কেন? গায়ের চামড়ার রঙ আলাদা হলে বুঝি মানুষ আলাদা হয়ে যায়? গায়ের চামড়ার রঙ যাই হোক না কেন, আমরা সবাই মানুষ না?

 দূর থেকে যে অস্পষ্ট আওয়াজটা আসছিল, সেটা যেন আরো কাছে এসে পড়ে···মেঘের গুর্ গুর্ আওয়াজের মতন শোনায়···

 বাতোয়ালা হাত-মুখ নেড়ে বলে চলে, “শাদা লোকগুলোর শয়তানীর কথা জীবন থাকতে ভুলবো না···বিশেষ করে তাদের ছলনা তারা একরকম কথা বলে, আর একরকম কাজ করে। তারা কত না কথা আমাদের শুনিয়েছিল? বলেছিল, আমরা একদিন বুঝতে পারবো আমাদের ভালর জন্যেই তারা আমাদের খাটাচ্ছে···গতর দিয়ে খেটে যে-টাকা আমরা রোজগার করছি, সে টাকা নাকি তারা রেখে দিচ্ছে, আমাদের জন্যে ভাল ভাল রাস্তা, বড় বড় সাঁকো তৈরী করবে বলে, আমাদের জন্যে তারা লাইনের-ওপর-দিয়ে-চলা গাড়ী তৈরী করে দেবে, আশ্চর্য গাড়ী, আগুনের আঁচে নাকি যন্তরে চলে! কত আশার কথাই না তারা বলেছিল। কোথায় সে-সব রাস্তা কোথায় সে-সব সাঁকো? আর কোথায় বা সেই যন্তরে-চলা আশ্চর্য গাড়ী? মাতা! নি নি! কিছু না, কিছু না! সব ফাঁকি! এই অজুহাতে আমাদের যথাসর্বস্ব তারা চুরি করে নিচ্ছে, আমরা যা রোজগার করি, তার ক’ ছিদেম আমরা ঘরে রাখতে পাই? তোমরাই বলনা, আমাদের আর কি আছে? দুর্ভাগ্য ছাড়া আমাদের আর কি আছে?

 “জলের দরে ওরা আমাদের কাছ থেকে রবার কেনে। আজ তিরিশ চাঁদ হয়ে গেল, সেই তিন ফ্রাঙ্কে এক কিলো রবার তারা কিনে চলেছে—আর প্রত্যেক চাঁদে ট্যাক্‌স্ বেড়েই চলেছে—এই সেদিন বলা নেই, কওয়া নেই, কেন তা কেউ জানলো না, বাজার দর কমে একেবারে নেমে গেল—আর ঠিক সেই তালে আমাদের গভর্ণর পাঁচ ফ্রাঙ্ক থেকে ট্যাক্‌স্‌ বাড়িয়ে একেবারে দশ ফ্রাঙ্ক করে দিলো—

 “আমরা শুধু হলাম একতাল মাংস, যা নিংড়ে ট্যাক্‌স্‌ আদায় করা যায়···আমরা হলাম শুধু পশু, ওদের মোট বইবার জন্যে! তার চেয়েও জঘন্য, আমরা হলাম কুকুর! স্রেফ রাস্তার কুকুর! কুকুর আর ঘোড়াকে ওরা যে আদর করে, যত্ন করে, আমরা তার শতভাগের একভাগও পাই না—আমরা শুধু পশু নই, পশুর পশু—তাই একটু একটু করে ওরা আমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে—

 বাতোয়ালা আর বুড়ো সর্দাররা যেখানে বসেছিল, পেছন থেকে একদল লোক সেই দিকে ঠেলে আসতে শুরু করে দিল। সুরার উত্তাপে তাদের খালি গা দিয়ে তখন দরধারায় ঘাম ঝরে পড়ছে।

 বাতোয়ালার বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে ব্যর্থ-আক্রোশের অভিশাপ-বাণী জেগে উঠলো। কেউ কেউ বাতোয়ালাকে সাবাস্ দিয়ে উঠলো, ঠিক বলেছো, বিলকুল ঠিক! যখন শাদা লোকগুলো এ-দেশেতে পা দেয় নি, তখন তারা কেমন সুখে ছিল। এমন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হতো না—দরকার মত একটুখানি খাটলেই চলে যেতো, তারপর খাও, দাও, স্ফুর্তি করো, ঘুমোও। মাঝে মাঝে কখনো কখনো লড়াই কাজিয়া করতে হতো। কিন্তু তাতে লাভ ছাড়া লোকসান ছিল না। আজও মনে পড়ে, তখন কি ধূম পড়ে যেতো নিহত শত্রুর দেহ ছিঁড়ে লিভার খাবার জন্যে, সবাই ছুটতো তার অংশের জন্যে, কেননা, শত্রুর যা কিছু সাহস তার লিভারের সঙ্গেই থাকে, তাই সেই কাঁচা লিভার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা সাহসও দেহের ভেতর রক্তের সঙ্গে মিশে যেতো···সে ছিল অতীত যুগের কথা, যখন শাদা লোকগুলো এদেশের মাটিতে পা দেয় নি।

 আজ তারা শুধু ক্রীতদাস; তারা বুঝে নিয়েছে ঐ হৃদয়হীন শাদা জাতের কাছ থেকে তাদের আশা করবার কিছু নেই। শাদা লোকগুলো তাদের ঘরের মেয়েদের জোর করে দখল করে, ভোগ করে, আর তার ফলে, তাদের নিজেদের মধ্যেই বিভেদের সৃষ্টি হয়। তাদের ভোগ মিটে গেলে শাদা লোকগুলো তাদের কালো মেয়েমানুষগুলোকে পরিত্যাগ করে, তাদের গর্ভে যেসব ছেলেমেয়ে হয়, তাদের স্বীকার করে না। আর এই সব বেজন্মা ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজেদের জাত-ভাইদেরই ঘৃণা করতে শেখে, তাদের বাপের শাদা চামড়া ছিল, এই গর্বে তারা নিজেদের স্বজাতের সঙ্গে মেশে না। এইভাবে এই বেজন্মাগুলো সমাজের ভেতরে থেকে সমাজের পাপই বাড়িয়ে চলে, সবাইকে তারা ঘৃণা করে, হিংসা করে, তাদেরকেও সবাই তেমনি ঘৃণার চোখে দেখে। আল্‌সে, কুঁড়ে, বদমায়েস, এই বেজন্মাগুলো শুধু ব্যভিচারকেই বাড়িয়ে চলে।

 বাতোয়ালার দম তখনো ফুরোয় নি।

 সে আবার উঠে বলতে আরম্ভ করে, আর শাদা লোকগুলোর সঙ্গে যেসব শাদা চামড়াওয়ালা স্ত্রীলোকগুলো থাকে, তাদের কথা না বলাই ভাল। প্রথম-প্রথম আমরা মনে করতাম, তারা বুঝি একটা আলাদা জাতের মানুষ, আশ্চর্য কোন সৃষ্টি! দেবতার মতন তাই দূর থেকে তাদের ভয় করতাম, সম্মান দিতাম। আজ সে ভুল আমাদের ভেঙ্গে গিয়েছে! কালো নিগ্রো মেয়েকে যত সহজে পাওয়া যায়, তার চেয়ে সহজে পাওয়া যায় ঐ শাদা চামড়াওয়ালা স্ত্রীলোকগুলোকে···আমাদের মেয়েদের চেয়ে ঢের বেশী কামুক ওরা! তাদের যে–সব দোষ আছে, আমাদের কালো মেয়েদের তা নেই···কালো মেয়েরা তা জানে না পর্যন্ত! তবু···শাদা চামড়াওয়ালীরা চায়, আমরা সব সময় তাদের সমীহ করে চলি···”

 বাতোয়ালার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা হাত তুলে ইঙ্গিত করতেই সব গোলমাল থেমে গেল, বুড়োর কথা শোনবার জন্যে সবাই একেবারে চুপ হয়ে গেলো। সেই নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে শুধু শোনা যাচ্ছিল, সেই দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজ।

 বুড়ো বলতে শুরু করলো,

 “তোরা যা বল্লি, তা সবিই সত্যি! তবে সেই সঙ্গে এইটে শুধু মনে রাখতে হবে, আমাদের করবার কিছু নেই। কাজেই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দাও! যখন বনের ভেতর “বামারা” গর্জে ওঠে, তখন তার কাছে কোন হরিণই যায় না, যাওয়া উচিত নয়। আজ আর তোমরা বলশালী নও। তোমাদের চেয়ে ওরা ঢের বলশালী। তাই, চুপ করে সহ্য করে যাও!

 “তাছাড়া আজকে আমরা এখানে ওদের গালাগাল দেবার জন্যে জড় হই নি। আমার বয়স হয়েছে, বুড়ো হয়ে গিয়েছি, তাই গালাগালের উত্তেজনায় আমারও জিভ, আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই, বলচি একটু কম চেঁচিয়ে, গলায় ঢালো বেশী। শাদা লোকগুলো কাঠের বিছানা আর কাঠের লম্বা লম্বা চেয়ার-ছাড়া আর যত কিছু জিনিস তৈরী করেছে, তার মধ্যে সেরা হলো, তাদের তৈরী মদ!

 “অবশ্য, আমার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে আমি সামনে কতকগুলো আব্‌সাঁথের বোতল দেখতে পাচ্ছি। বাতোয়ালা, বোতলগুলো খুলবে নাকি?”

 বাতোয়ালার বক্তৃতায় যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, বুড়োর কথায় তা নিভে গেল। আবার উৎসবের আনন্দে সবাই প্রাণ খুলে হেসে উঠলো। বাতোয়ালা বৃদ্ধ পিতার ঝাপসা দৃষ্টিশক্তির তারিফ করতে করতে আব্‌সাঁথের বোতলগুলো এগিয়ে দিলো।

 দূরের শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয়, তাদের গাঁয়ের কাছ-বরাবর আওয়াজটা এগিয়ে আসছে। আরো কাছে এগিয়ে আসছে। পোয়াবা আর পাঙ্গাকৌরার রাস্তার মোড়ে যেন এসে পড়েছে। ক্রমশ আরো কাছে এগিয়ে আসছে, কমাণ্ডারের আস্তাবল যেখানে আছে, সেখান থেকে যেন শব্দটা আসছে। এইবার যেন বাম্বার পোল পেরিয়ে শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে···এই দিকেই আসছে···

 এবারে আর শব্দ নয়।

 শব্দ মূর্তি ধরে সামনে এগিয়ে আসে। একদল তরুণ–তরুণী নাচতে নাচতে আর গাইতে গাইতে উৎসব–প্রাঙ্গণের দিকে এগিয়ে আসে।

 তাদের সর্বাঙ্গ নগ্ন। নগ্ন গা পা থেকে মুখ পর্যন্ত ভস্মের প্রলেপে শাদা করা হয়েছে। এই হলো তাদের রীতি, ধর্মের অনুশাসন।

 একদল গাইছে, আর তার তালে তালে আর একদল নাচছে। তারা সচরাচর যে ভাষায় কথা বলে, এই গানের ভাষা কিন্তু তা নয়। একটা বিচিত্র অনুনাসিক শব্দের মালা, কখনও বা গলার ভেতর থেকে নানা রকমের আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। এই ভাষার নাম হলো শামালী, তাদের ধর্ম-কর্মের ভাষা। নাচতে নাচতে তারা যেন ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

 ভাদের দেখতে পেয়ে উৎসব–প্রাঙ্গণের বিরাট জনতা সমস্বরে এক বিপুল আওয়াজে অভিনন্দন করে উঠলো। সে বিপুল ধ্বনি বাম্বা আর পোম্বার চন্দ্রালোকিত তীর বেয়ে দূরে দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়লো, সে-ধ্বনিতে হঠাৎ নদীর ধারের বক-পাখীদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তারাও যেন চীৎকার করে প্রত্যাভিবাদন জানিয়ে উঠলো।

 হঠাৎ জনতার মধ্যে একটা তীব্র আনন্দের উত্তেজনা জেগে উঠলো। যোদ্ধারা তাদের বর্শা তুলে নিয়ে উঠে দাড়ালো। কুকুরগুলো চীৎকার করে ডেকে উঠলো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কলরব করে উঠলো, মেয়েরা বিয়ার আর ‘কেনে’র মাদকতায় মাটীতে প। ঠুকে উল্লাসে চীৎকার করে উঠলো,

 “গান্‌জা—গান্‌জা—গান্‌জা—”

 সঙ্গে সঙ্গে লিংঘা গুলো থেকে গুরু-গুরু···গুর্–গুর্ আওয়াজ জেগে উঠলো।

 চোখের সামনে ভোজবাজীর মতন যেন সব শাদা হয়ে গেল। ভস্মমাখা কালো মেয়ের আর কালো ছেলের সর্বাঙ্গ আজ শাদা, শাদা চাঁদের আলো···তার মধ্যে কালো শুধু গাছগুলো···মাটী লেপে শাদা করা হয়েছে···চাঁদের আলো এসে সারা গাঁকে চূণকাম করে দিয়েছে··· শাদা ফিতের মতন চলে গিয়েছে পথগুলো···পোম্বা আর বাম্বার জল আজ গলানো চাঁদের আলোর মতন শাদা।

 যোদ্ধারা যে-যার বর্শা তুলে নিয়ে বড় বড় টানে ঢালের আড়ালে অপেক্ষা করে থাকে···

 এমন সময় দম্-দম্ করে বাজনা বেজে ওঠে···যোদ্ধারা লাফিয়ে বাম্বার দিকে এগিয়ে চলে···মাথার ওপরে ঢাল তুলে হাতের বর্শা ঘোরাতে ঘোরাতে উন্মাদ নৃত্যে তারা এগিয়ে চলে। কিছুদূর গিয়ে আবার তারা তেমনিভাবে নাচতে নাচতে ফিরে আসে। চীৎকার করতে করতে ফিরে আসে।

 শুরু হয়ে যায় গান্‌জার নাচ। চারদিক থেকে বেজে ওঠে বাজনা···চারদিক থেকে ওঠে গান···সে সমবেত শব্দে যেন কেঁপে ওঠে চাঁদ।

 এলোমেলো উল্লাসের মধ্যে একটা বন্দোবস্ত ঠিক করা হয়। কার পর কি হবে, তার একটা ক্রম নির্দিষ্ট হয়। সমস্ত খেলাধূলার ভার যাদের ওপর, তাদের নাম হলো মুকৌন্দজীইয়াংবা। তাদের দেখলেই বোঝা যায়, স্ফূর্তিতে ঝলমল করছে। তাদের পোষাকও আলাদা। মাথার চুলের সঙ্গে পাখীর লম্বা লম্বা রঙীন পালক গোঁজা; কোমরে, হাঁটুতে, হাতের কব্জীতে ঘণ্টা বাঁধা।

 তাদের ভেতর থেকে তিনজন বেরিয়ে এসে একটা যুযুৎসু ধরণের নাচ নাচলো। হাতের সঙ্গে পা জড়িয়ে নানা রকমের কসরৎ দেখালো। দর্শকেরা উল্লাসে বাহবা দিয়ে উঠে।

 ক্রমশ প্রত্যেক দলই উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে···হাততালি আর বাহবার ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে মুকৌন্দজী-ইয়াংবাদের ঘণ্টার আওয়াজ। এইবার শুরু হবে শেষ নাচ···আসল নাচ···

 জনতার ওপর দিয়ে যেন একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়···সামনে নাচবার জায়গা খালি করে তারা গোল হয়ে পিছিয়ে আসে···সেই অবকাশে একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সেই শূন্য যায়গায় গিয়ে নাচতে সুরু করে দেয়।

 তারা ক্লান্ত হয়ে আবার জনতার মধ্যে ফিরে আসে এমন সময় মেয়েরা আসে এগিয়ে···পরিপূর্ণ নগ্ন দেহে···নাচবার জন্যে···

 এইবার মেয়েরা নাচতে শুরু করলো। পরিপূর্ণ নগ্নদেহ···মাথার চুল আজ রেড়ীর তেলে সুচিক্কণ···নাকের ডগায়, কানে, ঠোটে নানা রঙের আংটির মতন গোল গয়না বিদ্ধ হয়ে ঝুলছে পার্শ্ববর্তিনীর···হাতে পায়ে কোমরে পেতলের বালা। কাঁধে হাত দিয়ে লাইন ধরে সারিসারি তারা এগুতে আরম্ভ করে।

 হঠাৎ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তারা গোল হয়ে ঘুরে দাড়ায়···

 পেছনের বাদ্য-যন্ত্র বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অঙ্গ দুলে ওঠে। বাদ্য-যন্ত্রের তালের সঙ্গে হাত আর পা দিয়ে তাল দিতে দিতে তারা গান ধরে। গোল হয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

 সামনের দল নাচতে নাচতে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে ভেঙ্গে যায়, তার মাঝখানে একটি মেয়ে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। দুই চোখ বন্ধ করে সে নাচতে থাকে, উত্তপ্ত নগ্ন দেহে ফুটে ওঠে সুমধুর আমন্ত্রণ···বিভোর হয়ে সে নাচতে থাকে, যদি পড়ে যায় পেছনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা ধরবে।

 নাচ থামিয়ে মেয়েটি মেপে মেপে তিন পা এগিয়ে যায়, এক, দুই, তিন···সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে করতালি ওঠে। তিন পা এগিয়ে যাবার পর সে দেহকে এমনভাবে এলিয়ে দেয়, যেন তাকে গ্রহণ করবার জন্যে সামনে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে···হঠাৎ আবার মুখভার করে তিন পা পিছিয়ে আসে, এক, দুই, তিন···যেন তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

 আবার তেমনি মেপে মেপে তিন পা এগিয়ে যায়, আবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসে। বারবার এইভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে ক্লান্ত অবশ অঙ্গে নিদারুণ লজ্জায় ঢলে পড়ে।

 তার সঙ্গিনীরা তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে ফেলে। কাকুতি-মিনতি করে আবার তাকে দাঁড় করায়। আর সে এগিয়ে যায় না, সেই অর্দ্ধচন্দ্রের মধ্যে বাঁ দিকের একেবারে শেষ ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকের শেষাংশ থেকে আর একজন সঙ্গিনী ঠিক তেমনি তিন-পা মেপে এগিয়ে আসে। যে অদৃশ্য প্রেমিক তার সঙ্গিনীকে প্রত্যাখ্যান করে ফিরিয়ে দিয়েছে, তাকে ভোলাবার জন্যে আবার সে চেষ্টা করে।

 ক্রমশ এইভাবে আসে পুরুষদের পালা। তখন চারদিকে জমে উঠেছে পরিপূর্ণ উন্মাদনা। যেদিকে চাও সেদিকে শুধু ঘর্মাক্ত মাংসপেশী আর তাণ্ডব আর্তনাদ। পায়ের তলায় মাটি যেন সে-উন্মাদ তাণ্ডবে ফেটে যাবে।

 সঙ্গে সঙ্গে কি অট্টহাসি, কি চীৎকার। সেই অগণিত নর–নারীর মিলনে, বিয়ার আর কেনের প্রেরণায়, উল্লাসে আর নৃত্যে জেগে ওঠে উন্মাদ আত্মহারা কামনার চঞ্চলতা···

 সামনে এগিয়ে আসে দশজন পুরুষ···প্রায় নগ্ন দেহ।

 সেই দশজনের মধ্যে, সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে বিসিবিংগুইয়ের ওপর···সকলের চেয়ে সুগঠিত দেহ, সবচেয়ে সুন্দর। দুটো চোখ জ্বলছে, যেমন জ্বলে ওঠে রাত্তিরে বনের আগুন। প্রত্যেক মাংশপেশী পাথর দিয়ে তৈরী, আপনা থেকে যেন দুলে দুলে উঠছে। সরু কাঁচা বেতের মতন লিকলিকে দেহ নিয়ে সে লাফিয়ে ওঠে, দলের আর সবাইকে সে-ই চালিয়ে নিয়ে চলে।

 তারা প্রত্যেকেই লাল–চন্দন আর তেল দিয়ে সারা দেহকে করেছে চিত্রিত। শরীরের মধ্যে যেখানে সুবিধা পেয়েছে সেই–খানেই ঝুলিয়েছে ঘণ্টা, এমন কি মাথায়–গোঁজা পালকের সঙ্গেও ঝুলিয়েছে ঘণ্টা। নড়তে গেলেই টুং টাং বেজে ওঠে দেহ।

 গায়ের ওপর আঁকা রঙীন নক্‌সা ঘামে গলে যাচ্ছে···গা থেকে উঠছে আগুনের মতন উত্তাপ। কিন্তু বিন্দুমাত্র ক্লান্তি কেউ বোধ করে না। তাদের দেহ মন আজ এই ইয়াংবাতে তারা সঁপে দিয়েছে।

 কত ছোট মানুষের এই জীবন। দেখতে দেখতে কখন এসে যায় সেই দিন, যেদিন মৃত্যু এসে অশুচি করে দেয় দেহকে। প্রতিদিন সূর্য যখন ডুবে যায়, চুরি করে নিয়ে যায় সেই অল্প পুঁজি থেকে একটা করে দিন। তাই যতক্ষণ আছে সূর্য, ভোগ করে নাও যা ভোগ করতে পারে এই দেহ-মন।

 সর্ব বাঁধন হারা তারা নাচতে শুরু করে দেয়।

 মাটির দিকে মাথা নুইয়ে, দু’হাত মাটিতে ঠেকিয়ে, উঁচুতে পা তুলে তারা নানারকমের কসরৎ দেখায় প্রথমে। তারপর তারা দু’হাত মেলে উঠে দাঁড়ায়, সামনে পিছু, ডাইনে বাঁয়ে দু’হাত দিয়ে বাতাসকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চলে, যেন ডানা মেলে বাজপাখীর দল উড়ে চলেছে শীকার লুণ্ঠন করে নিয়ে।

 চারদিক থেকে আবার বাজনা বেজে ওঠে, সেই সঙ্গে সুরু হয় গান্‌জার গান···

 “গান্‌জা···গান্‌জা···গান্‌জা

 এখুনি আরম্ভ হবে গান্‌জা!

 শিশু হবে মানুষ···

 এখুনি শুরু হবে গান্‌জা···

 এগিয়ে আসে একদল তরুণ কিশোর। তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ছুরি হাতে দুজন বৃদ্ধ ওঝা, সর্বাঙ্গ ভরা মাদুলিতে। মেয়েদের সামনে এগিয়ে আসে একজন বৃদ্ধা। তরুণ কিশোরেরা নাচতে সুরু করে, উন্মাদ্‌ নৃত্য, এখুনি তাদের অঙ্গে আঘাত করবে সুপবিত্র ছুরি—গান্‌জার ছুরি—তারা হবে মানুষ, পুরো মানুষ···

 চারদিক থেকে ওঠে গান্‌জার গান,

“গান্‌জা···গান্‌জা···গান্‌জা
আজ রাত্তিরে তারা হবে পুরো স্ত্রীলোক,
আজ রাত্তিরে হবে তারা পুরো পুরুষ,
গান্‌জার ছুরির আঘাতকে আনন্দে সহ্য করে
তারা হবে আজকের উৎসবের মালিক। ”

 বৃদ্ধ ওঝা দুজন ছুরি হাতে নিয়ে মন্ত্র বলে,

 “এক চাঁদ, দু চাঁদ ধরে, বনের গভীর নির্জনতায় তোমরা উপবাস দিয়ে নিজেদের তৈরী করেছ গান্‌জার জন্যে,

 “এক চাঁদ, দু চাঁদ ধরে, লোকের কুৎসিত দৃষ্টির আড়ালে তোমরা তোমাদের দেহকে করে রেখেছো শুভ্র সুপবিত্র, যাতে মৃত্যু তোমাদের জব্দ করতে না পারে।

 “এক চাঁদ, দু চাঁদ ধরে, তোমরা কোন অপবিত্র কথা বলো নি! শুধু আমাদের জাতির পবিত্র ভাষা উচ্চারণ করেছো। লোকের পাপ-দৃষ্টির আড়ালে তোমরা শুধু ফল মূল খেয়ে জীবন ধারণ করেছো।

 “এক চাঁদ, দু চাঁদ ধরে, তোমরা যেখানে খুশী, যেভাবে খুশী শুয়ে রাত কাটিয়েছো! এক চাঁদ, দু চাঁদ ধরে তোমরা কোন খেলা, কোন হাসি, কোন রঙ্গতামাসায় নিজেদের কর নি নষ্ট।

 “ভগবান নাঙ্গাকৌরা তাই তোমাদের ওপর হয়েছেন সন্তুষ্ট। দু চাঁদ ধরে এই কঠিন পরীক্ষায় তোমরা উত্তীর্ণ হয়েছো। এখন তোমরা সকলের সামনে হাসতে পার, খেলতে পার, নাচতে পার, এখন তোমরা যে-যার বোগ্‌বো শুতে পারো।

 “এখুনি তোমরা পুরুষ হবে। এখুনি তোমরা স্ত্রীলোক হবে। গান্‌জার ছুরি এখুনি তোমাদের সে-গৌরব এনে দেবে।

 “তাই নাচো, গাও, উৎসব করো।”

 চারদিক থেকে ওঠে উন্মাদ রব,

 গান্‌জা, গান্‌জা, গান্‌জা···

 গান্‌জার লগ্ন এগিয়ে আসে। ওঝারা ছুরিতে শাণ দিয়ে ঠিক করে নেয়। আঘাত গ্রহণ করবার জন্যে গান্‌জার উদ্দিষ্ট তরুণ-তরুণীরা প্রস্তুত হয়। বালাফোন, লিংখা, কৌন্দে, তাদের যত রকমের বাজনা ছিল, সব একসঙ্গে তারস্বরে বেজে ওঠে। যেন যন্ত্রণার চীৎকার সেই শব্দের মধ্যে ডুবে যায়।

 শুরু হয়ে যায়, লিঙ্গচ্ছেদের অনুষ্ঠান।

 একটা বড় পাথরের ওপর থুতু ফেলে, পুরোহিতেরা শেষবারের মত ছুরি শাণ দিয়ে ঠিক করে নেয়।

 পুরোহিতদের সাহায্যকারীরা হাতে ছড়ি নিয়ে এগিয়ে আসে। যাদের লিঙ্গোচ্ছেদ হবে তাদের পিঠে নিয়মিতভাবে প্রহার করে চলে। সেই প্রহারের ফলে তারা ক্রমশ অচৈতন্য হয়ে আসে। যদি কেউ যন্ত্রণায় চীৎকার করে ওঠে, অথবা পড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, মানুষ হবার অযোগ্য সে। তার বেঁচে থাকবার কোন দরকার নেই। সেইখানেই প্রহারে প্রহারে তার অবশিষ্ট প্রাণটুকু কেড়ে নেওয়া হয়। এই লোকাচার···অনাদিকাল থেকে চলে আসছে।

 যে-তরুণর্টির ওপর সর্ব প্রথম এই পরীক্ষা চলছিল, সে উন্মাদ চঞ্চলতায় মৃত্যুকে তুচ্ছ করে উল্লম্ফন করতে থাকে, জনতা উল্লাসে বাহবা দিয়ে ওঠে, মানুষ হবার যোগ্য সে।

 প্রত্যেক লাফের সঙ্গে তার রক্তাক্ত দেহ থেকে রক্ত ছিটকে গিয়ে পড়ে নিকটবর্তী জনতার গায়ে। তাকে দেখাতে হবে, তার কোন যন্ত্রণাই হচ্ছে না। আনন্দে নাচতে নাচতে তাকে গাইতে হবে

‘গান্‌জ··· গান্‌জা···গান্‌জা···
জীবনে শুধু একবার···′

 বৃদ্ধ ওঝা দুজন চারিদিকের উন্মাদ কলরবের মধ্যে সম্পূর্ণ নিস্পৃহভাবে নিজেদের কাজ করে চলে। যন্ত্রচালিতের মত তাদের হাতের কাঁচা চামড়া কেটে চলে, তারা যেন কিছুই শুনতে না, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পাচ্ছে মাঠে যখন শস্য পেকে ওঠে, চাষী যেমন কাস্তে দিয়ে তা কেটে চলে, তেমনি ধারা তারাও ছুরি নিয়ে কেটে চলে।

 মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ নাচতে নাচতে ম্লান বিবর্ণ, অবশ হয়ে ওঠে। কোথা থেকে একটা অসহনীয় ভয় তাদের সর্বাঙ্গকে যেন হিম করে দিয়ে যায়।

 বৃদ্ধা পুরোহিত-নারী এগিয়ে এসে প্রথমে একজন মেয়েকে ডাক দেয়, জোর করে তাকে জড়িয়ে ধ′রে ছুরি নিয়ে অবলীলাক্রমে তার কাজ করে চলে। কাটা শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয় জনের ডাক পড়ে। নাচতে নাচতে আর গাইতে গাইতে সে এগিয়ে আসে,

গান্‌জা···গান্‌জা···গান্‌জা···

 জীবনে তো একবার মাত্র এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে,

তারপর, সারা জীবন ভ’রে,
তুমি থাকবে আমার পাশে,
ওগো, তরুণ-বীর, যে আজ উত্তীর্ণ হলে
এই গান্‌জার পরীক্ষায়।’

 ক্রমশ কলরব আরো বাড়তে থাকে।

 এরপর যে কলরব আরম্ভ হবে, তার কাছে এখনকার এই আওয়াজ কিছুই নয়। কারণ, এই সব অনুষ্ঠান শেষ হবে গিয়ে, উৎসবের প্রধানতম ব্যাপারে, প্রণয় নৃত্যে। এই প্রণয়-নৃত্যের রাতের জন্যে সারা বছর তারা অপেক্ষা করে থাকে। বছরে একদিন মাত্র আসে এই প্রণয়-নৃত্যের রাত। এই রাতে তারা অবাধে ছেড়ে দেয় তাদের মনের সমস্ত কামনা, বাসনা আর প্রবৃত্তিকে। এই রাতে অসংযম আর অনিয়ম পায় সামাজিক অনুমোদন। অপরাধহীন অনাচারের মধু রাত

 দেখতে দেখতে প্রত্যেক বাদক যে-যার যন্ত্র নিয়ে অপরের সঙ্গে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। এতক্ষণ পরে যোগ দেয়, বৃহৎ-আকার সব শিঙ্গা। তাদের তুমুল চীৎকারে বাতাস কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে চীৎকারে শিকারী পাখীরা নীড় ছেড়ে উৎসব-ক্ষেত্রের ওপর ঝাঁক বেঁধে ঘুরতে থাকে।

 সেই তুমুল যন্ত্র-কোলাহলের মধ্যে, দুটি নারী এগিয়ে আসে, একজন ইয়াসীগুইন্দজা, বাতোয়ালার প্রধানা মহিষী, আর একজন তরুণী, এখনো কোন পুরুষের স্বামীত্বের চিহ্ন তার দেহের ওপর পড়েনি।

 দুজনেই নগ্ন, পরিপূর্ণ নগ্ন দেহ। সারা অঙ্গে শুধু কাঁচের নানা রকমের গহনা, গলায়, কোমরে, হাতের কব্জীতে, পায়ে। সারা অঙ্গে মেটে লাল রঙের প্রলেপ।

 এ ছাড়া ইয়াসিগুইন্দজার অঙ্গে একটা লাল রঙের কাঠের প্রতীক চিহ্ন, কোমরে গহনার সঙ্গে ঝুলতে থাকে। আজকের এই নাচের উৎসবে সে যে প্রধানা, তারই চিহ্ন।

 ইয়াসীগুইন্দজা নাচতে শুরু করে। প্রথমে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কোমর আর উরুদেশ নাচাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে দুলতে থাকে সেই কাঠের প্রতীক।

 তারপর ধীর পদক্ষেপে সে অপেক্ষমান তরুণীটির দিকে এগিয়ে আসে। তাকে হাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাতে, তরুণীটি কয়েক পা পিছনে সরে যায়। প্রত্যাখ্যান। তরুণী তার ভঙ্গী দিয়ে জানিয়ে দেয়, এমনিভাবে পুরুষের কামনার আগুনে নিজেকে আহুতি দিতে সে চায় না। নানা অঙ্গভঙ্গী করে সে লাফাতে থাকে। যেন সে ভীত। ইয়াসীগুইন্দজা যেন তার প্রণয়-প্রার্থী পুরুষ।

 তরুণীর প্রত্যাখ্যানে প্রণয়ী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দুরন্তভাবে মাটীতে পা ঠুকে ঠুকে সে তার অন্তরের ক্ষোভকে নিবেদন করে। তরুণীটির ভয় যেন একটু একটু করে ভেঙ্গে যায়। দূর থেকে সে নিজেকে সমর্পণ করবার ভঙ্গী করে।

 দ্রুত ছুটে যায় প্রণয়ী তার কাছে, তাকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করে। কিন্তু তরুণী কপট লজ্জায় তখনও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে থাকে। শুরু হয়, শিকার। শিকারী তেড়ে যায়, শিকার ছুটে পালায়। থমকে দাঁড়ায়, দু পা এগোয়, আবার ছুপা পিছিয়ে যায়। শিকারী ক্রমশ উন্মাদ হয়ে ওঠে। উন্মাদ আক্রমণে শিকারকে জড়িয়ে ধরে, নিজের দেহের সঙ্গে যেন পিষে ফেলে। চোখে, মুখে ফুটে ওঠে কামনার বীভৎস নিলর্জতা। শিকার আত্মসমর্পণ করে।

 সঙ্গে সঙ্গে তুমুল শব্দে বেজে ওঠে বাজনা। বিদ্যুৎ-আহতের মতন নিমেষের মধ্যে জনতা ক্ষিপ্ত উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পুরুষেরা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তাদের ক্ষীণ কটীবাস। মেয়েরা ছিঁড়ে ফেলে দেয় সামান্য লজ্জা-বস্ত্র। সমস্ত উৎসব-অঙ্গন এক সঙ্গে নেচে ওঠে। নাচতে নাচতে প্রত্যেকে বেছে নেয় তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে। সমস্ত উৎসব-ক্ষেত্র টলমল করে ওঠে কামনার সেই উম্মাদ নৃত্যে।

 ইয়াসীগুইন্দজা আর তার নৃত্য-সঙ্গিনীকে কেন্দ্র করে, প্রত্যেক পুরুষ তার নৃত্য-সঙ্গিনীকে বেছে নেয়, জোড়ায় জোড়ায় তারা নাচতে শুরু করে।

 সুরা আর ঘন-সান্নিধ্যের গন্ধে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চারদিক থেকে কানে আসে অস্ফুট চীৎকার, আক্রান্তের আর্তনাদ, দেহ-পীড়িতের মধুর প্রতিবাদ···

 প্রকাশ্যে, সকলের সামনে, অরণ্যের বন্য পশুর মতন বাধা-বন্ধহারা প্রচণ্ড উল্লাসে তারা মেতে ওঠে, অরণ্য পশুর মতন সংস্কারবিহীন মুক্ত। কামনার মদিরকে দ্বিগুণিত করে তোলে ফেনিল সুরার পাত্র···

 ক্রমশ বাজনা থেমে আসে। যন্ত্রীর দল তাদের বাজনা দিয়ে যে উন্মত্ত আকাঙ্খাকে জাগিয়ে তুলেছিল, উত্তুঙ্গ করে তুলেছিল, তাতে তাদেরও ন্যায্য অংশ গ্রহণ করবার জন্যে বাজনাকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে আসে। যদিও অন্য সব দলের মতন তেমন নিপুণভাবে তারা নাচড়ে পারে না, তবুও সেই নৃত্যের উত্তাল তরঙ্গে তারা নিজেদের ভাসিয়ে দেয়, কারণ আজিকার দিনের এই নৃত্য, প্রণয়-নৃত্য, তাদের উৎসব-জীবনের সর্বোত্তম অনুষ্ঠান, আদিম কাল থেকে এই নৃত্য দিয়ে এসেছে তাদের জীবনে নিবিড় আনন্দের প্রেরণা···অস্তিত্বের স্বাদ···

 তারা নেচে চলে। অবিশ্রান্ত···অবিরাম। গ্রীষ্ম দিনের পর যখন প্রথম বর্ষার ধারা মাটিতে এসে পড়ে, সেই সময় জলের সংযোগে তপ্ত মাটি থেকে যে-রকম বাপু ওঠে, তেমনিধারা একটা বাষ্প যেন তাদের অঙ্গ থেকে সমস্ত বাতাসকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

 সহসা সেই উন্মাদ নৃত্য-উৎসবের মধ্যে, কারা দুজন মাটিতে পড়ে গেল···বাতোয়ালা ক্ষিপ্ত শার্দুলের মতন তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে···হাতে ঝক্‌মক্‌ করে ওঠে শাণিত ছুরিকা···

 উত্তেজিত ঘোড়ার মতন সফেন হয়ে ওঠে মুখ।

 আঘাত করবার জন্যে হাত তোলে।

 কিন্তু হাত তোলা আর আঘাত করার মধ্যে যেটুকু অবকাশ, তার ভেতর, যে দুজন পড়ে গিয়েছিল, তারা উঠে বাতোয়ালার হাতের বাইরে গিয়ে দাড়ায়, ইয়াসীগুইন্দজা আর বিসিবিংগুই।

 তারা উৎসবক্ষেত্র থেকে ছুটে পালায়।

 বাতোয়ালা তাদের পেছনে তাড়া করে ছোটে···

 এত বড় আস্পর্দ্ধা! কুকুরের বাচ্ছা, ঐ বিসিবিংগুই আর ইয়াসীগুইন্দজা, তার চোখের সামনে এই রকম ভাবে···

 পথ-কুক্কুরী ঐ স্ত্রীলোক···জ্যান্ত তার গায়ের চামড়া সে খুলে নেবে!

 আর বিসিবিংগুই-এর দেহ এমন বিকৃত করে দেবে যে, মেয়েরা দেখলে হাসবে!

 ঐ ইয়াসীগুইন্দজা! রীতিমত মূল্য দিয়ে তাকে সে কিনে নেয় নি? সাত সাতখানা কটিবাস, এক বাক্স নূন, তিনটে পেতলের গলার হার, চারটে হাঁড়ি, দুটা মুরগী, কুড়িটা ছাগলের বাচ্ছা, চল্লিশ ঝুড়ি ভুট্টার দানা আর একটা ক্রীতদাসী···এতখানি মূল্য দিয়ে বাতোয়ালা তাকে কিনেছিল!

 যেমন কাজ, তেমনি তার শাস্তি হবে। তাকে যদি আবার গ্রহণ করতে হয়, তাকে পরীক্ষা দিতে হবে···বিষ খেয়ে তাকে পরীক্ষা দিতে হবে···তাকে বাতোয়ালা বাধ্য করাবে সেই বিষ-পরীক্ষা নিতে!

 অকস্মাৎ সেই ব্যাপারে চারদিক থেকে একটা তুমুল কলরব জেগে উঠলো···কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কার হুকুমে সমস্ত কলরব নিমেষে স্তম্ভিত হয়ে গেল···প্রস্তর-নীরব।

 সেই প্রস্তর-নীরবতাকে ভেদ করে রূঢ় কণ্ঠে কে ঘোষণা করে উঠলো, কমাণ্ডার···ঐ কমাণ্ডার আসছে!

 চারদিক থেকে ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে আর্তনাদ পড়ে গেল, কমাণ্ডার···ঐ কমাণ্ডার আসছে! যে যেদিকে পারলো আতঙ্কে ছুটে পালাতে লাগলো···কয়েক মুহূর্তের ভেতর শূন্য হয়ে গেল উৎসব-ক্ষেত্র···পড়ে রইলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত খাবারের স্তুপ···শূন্য বোতল···পরিত্যক্ত কটিবাস···বাসন-পত্র···আর তার মাঝখানে পলায়নে-অক্ষম এক বৃদ্ধ সুরার কৃপায় একটা বাদ্য-যন্ত্রের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে···সুগভীর নিদ্রায় অচেতন। কে বলবে এক মুহূর্ত আগে এখানে উঠেছে কামনার উন্মাদ কলরব!

 “ইনে···দিয়েই···ইনে···দিয়েই···ইনে দিয়েই! ডাইনে! হল্‌ট্!”

 সৈন্যরা মার্চ করে এগিয়ে আসে। মাটীতে বন্দুক ঠোকার আওয়াজ হয়। কমাণ্ডারের সৈন্যরা ফিরে এসেছে।

 সার্জেণ্ট সিল্লাতিগুই কোনাতে-র পুরুষ-কণ্ঠে আদেশ শোনা যায়, ইক্‌সে!

 সৈন্যরা সঙ্গীন পাশে নিয়ে স্থির হয়ে দাড়ায়।

 ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে ফরাসী কমাণ্ডার এগিয়ে আসে!

 সার্জেণ্ট কোনাতে আবার হেঁকে ওঠে···ডাইনে···মুখ ফিরিয়ে সোজা···

 সৈন্যরা ঘুরে দাড়ায়

 কমাণ্ডার সার্জেণ্টের দিকে চেয়ে কৈফিয়ৎ চায়, চারদিকে এ সব জঞ্জাল কি? এর মানে কি? কিছুক্ষণ আগে দূয় থেকে যে গোলমাল কানে আসছিল তারই বা মানে কি?

 সার্জেণ্ট জবাব দেয়, পথে আসতেই খবর পেলাম, এখানকার লোকগুলো আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে এই মাঠে এসে মদ খেয়ে হৈ-হল্লা করেছে!

 কমাণ্ডার তৎক্ষণাৎ আদেশ দেয়, বেশ কথা···কিন্তু এই অপরাধের জন্যে এই অঞ্চলের প্রত্যেক সর্দারকে এক শো ফ্রাঙ্ক করে জরিমানা দিতে হবে এবং তা দিতে হবে আজকে রাত্রি শেষ না হতেই। যদি না দেয়, তাহলে সোজা ফাঁড়ি, হাতে পায়ে বেড়ি আর উত্তম মধ্যম বেত!

 সার্জেণ্ট অভিবাদন জানিয়ে বলে, এখুনি তার ব্যবস্থা করছি, হুজুর!

 হঠাৎ, সেই পরিত্যক্ত জিনিস-পত্রের মধ্যে কমাণ্ডারের দৃষ্টি সেই নিদ্রিত বৃদ্ধের ওপর গিয়ে পড়ে।

 সামনে ঐ ডার্টি নিগার···ও বেটা কে ওখানে শুয়ে?

 সার্জেণ্ট কাছে গিয়ে জবাব দেয়, বাতোয়ালার বাবা!

 সার্জেণ্ট কোনাতে একদিন এখানকারই অধিবাসীদের একজন ছিল। তাই সবাইকেই চেনে।

 কমাণ্ডার গর্জে ওঠে, ওখানে কি করছে হারামজাদা?

 সার্জেণ্ট জবাব দেয়, হুজুর, একটু বেশী খেয়ে ফেলেছে তাই বেসামাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে!

 কমাণ্ডার সেইদিকে চেয়ে বলে ওঠে, বেটার পাশে···ওগুলো আমাদের ফরাসী মদের বোতল না?

 —আজ্ঞে, হুজুর!

 এইবার খোঁজ পড়ে ষ্টেশন-প্রহরীর, যার জিম্মায় এই মাঠ ছিল।

 কমাণ্ডার জিজ্ঞাসা করে, আর সেই শূয়োরের বাচ্ছা বৌলা···সেই খোঁড়া কুকুরটা কোথায়? এই যে, একেবারে হুজুরে হাজির দেখছি! গুড মর্নিং খোঁড়া কোলা ব্যাঙ!

 বৌলা কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দেয়, গুড মর্নিং স্যার!

 কমাণ্ডার তেমনি ব্যঙ্গের সুরে আদেশ দেয়, আমার অবর্তমানে যাতে অতঃপর আপনি ষ্টেশনের চৌকিদারী কাজে আরো একটু তৎপর হতে পারেন, তার জন্যে আপনাকে পনেরো দিন ঠাণ্ডা গারদে বাস করতে হবে এবং এক সপ্তাহের মাইনে কাটা যাবে। বুঝলেন? দাঁড়িয়ে দেখছিস্ কি? দূর হও···দূর হও আমার সামনে থেকে! নিতান্ত ভাগ্য ভাল যে এত কমে এবারের মতন তোমাকে রেহাই দিলাম···

 তারপর সার্জেণ্টের দিকে চেয়ে আদেশ দিলো, সিল্লাতিগুই! আজকের মতন সৈন্যদের সকলকে ছুটি দাও! বিশ্রাম! আজ রবিবার···সবাই বিশ্রাম করুক! বুঝলে? যাও, এদের ছুটি দিয়ে দাও!  দেখতে দেখতে সৈন্যরা চলে যায়। কিন্তু সেই ঘুমন্ত বৃদ্ধ তখনও একলা পড়ে থাকে···তখন ভোর হয়ে আসছে···গ্রীষ্মদিনের রাত-প্রভাতের প্রথম প্রহর···ঘন কুয়াসার মধ্যে ডেকে উঠছে দু'একটা পাখী···

 একদিন ভোজ, সারা বছর উপবাস। রৌদ্র-শুষ্ক বসন্ত দিনের পর আসে বর্ষার ভিজে দিন···উল্লাসের সর-সঙ্গীতের পর আসে কান্নার সুর···হাসির পর আসে অশ্রু।

 উৎসব যখন পুরো মাত্রায় চলেছিল, বাতোয়ালার বৃদ্ধ পিতা তখন অতিরিক্ত সুরা পানে উৎসব প্রাঙ্গনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ঘুমের ভেতর দিয়ে বৃদ্ধ তখন যাত্রা করে চলেছিল, নিবিড় ঘন-অন্ধকার লতা-গুল্মের ভেতর দিয়ে সেই দূরতম গাঁয়ে যেখান থেকে আজও পর্যন্ত কেউ আর ফিরে আসতে পারে নি। তার চারপাশে তখন চলেছিল উন্মাদ-নৃত্য। কেউ দেখেনি, বৃদ্ধ চিরকালের মতন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

 মদের পেয়ালায় মৃত্যু! এর চেয়ে সুখের মরণ আর কি হতে পারে! শেষ মুহূর্তের অনুশোচনা, অন্তিমের অসহায় বিলাপ আর বেদনা, সমস্ত ঢাকা পড়ে যায় ফেনিল নেশায়। ঘুম থেকে মৃত্যু, শুধু একটা ছোট্ট ধাপ। কোন চেষ্টা নেই, কোন পরিশ্রম নেই, কোন যাতনা নেই। শুধু অন্ধকার ছায়ায় নিঃশব্দে আর একটু গড়িয়ে যাওয়া। ভাববার কিছু থাকে না। মধুর মরণ! সারা জীবনের ক্লান্তির শেষে বিশ্রাম নাঙ্গাকৌরার বিশাল স্বর্গ-রাজ্যের একপ্রান্তে এক ধারে কোথাও বিশ্রাম···চির বিশ্রাম।

 সেখানে কোন মশার উৎপাত নেই, কোন পোকার কামড় নেই, কোন কুয়াশার জ্বালা নেই, কোন হিমের কাঁপুনি নেই। কোন কাজ করবার তাগাদা নেই। কোন খাজনা দিতে হবে না, কোন বোঝা বইতে হবে না। কেউ কম দামে জিনিস ঠকিয়ে নেবে না, খেসারতের দাবীর জন্যে কেউ সৈন্য পাঠাবে না। পরিপূর্ণ শান্তি···অবাধ আরাম! কোন কিছু পাবার জন্যে মেহনত্ও করতে হবে না, অপূর্ণ বাসনার জ্বালাও ভুগতে হবে না। না চাইতেই সেখানে সব পাওয়া যায়, অমনি, বিনা মূল্যে···এমন কি স্ত্রীলোক পর্যন্ত।

 যেদিন থেকে তাদের দেশে বিদেশী সৈনিকরা এসে বসেছে, সেদিন থেকে ভালমানুষ নিগ্রোদের একমাত্র কামনার বস্তু হয়ে উঠেছে, মরণ, এই দেশ ছেড়ে সেই নাঙ্গাকৌরার দেশে যাওয়া। দাসত্বের যন্ত্রণা থেকে একমাত্র মুক্তির উপায়।

 সেদিন থেকে তাদের একমাত্র আনন্দ পাবার জায়গা হলো ঘন-অন্ধকার লতাগুল্মের ওপারে সেই সুদূর সব-পাওয়ার দেশ, যেখানে তারা শুনেছি শাদা-লোকদের প্রবেশ নিষেধ।