এরাও মানুষ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 আধ–বোঁজা চোখে বাতোয়ালা ধূমপান করে চলে। আরামে ছোট ছোট করে টান দেয়, ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরতে ঘুরতে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

 অনেকক্ষণ কেটে যায় এইভাবে।

 ক্রমশ আকাশে সূর্য প্রখর হ’য়ে উঠতে থাকে। বাড়তে থাকে রোদের তেজ। মন্দ লাগে না। প্রতিদিনের অভ্যাসে সয়ে গিয়েছে রোদের ঝাঁঝ। গায়েই লাগে না।

 সামনে তুলোর গাছে মাঝে মাঝে হঠাৎ দমকা হাওয়ায় আলোড়ন জাগে। নরম কচি ডালের কাঁচা সবুজ পাতা শির শির করে ওঠে।

 কোন কোন গাছের ছাল ভেতর থেকে চিড় খেয়ে শুকিয়ে দীর্ণ বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছে; আর তার ভেতর থেকে ফেটে পড়ছে প্রাণ-রস, জমাট-বাঁধা রক্ত অশ্রু-বিন্দুর মত।

 একগাছ থেকে আর এক গাছে সেতু রচনা করে, ঠাসবুনোনি জালের মতন প্রত্যেক গাছকে জড়িয়ে উঠেছে বিচিত্র সব লতা।

 তপ্ত মাটীর শুকনো গন্ধের সঙ্গে, বুনো ঘাস আর পচা জলার ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ মিশে বাতাসকে ভারী করে তোলে। তার ভেতর থেকে নাকে আসে বুনো সব্জীর রোদে-পোড়া গন্ধ।

 চারিদিকের এই ঘন সবুজের ভেতর আত্মগোপন ক’রে আনন্দে ডাকতে থাকে বুনো পাখীর দল। স্বচ্ছ নীল আকাশে ভ্রাম্যমান কৃষ্ণ-বিন্দুর মতন ঘুরে বেড়ায় শব-সন্ধানী শকুনির দল··· দূর থেকে মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসে তাদের বীভৎস চীৎকার। ক্ষীণ অথচ কর্কশ।

 পোম্বা কিম্বা বাম্বার তীর থেকে ভেসে আসে টুকরো টুকরো গানের সুর···কারা যেন গাইছে, “এ হে···ইয়াবা···হো”···

 তার অর্থ হলো, নদীর ধারে, যে কোন জায়গায় হোক, সুরু হয়ে গিয়েছে কাজ···গানের সুর জুগিয়ে চলেছে মেহনতের ছন্দ।

 রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থেমে আসে সব শব্দ। সে শব্দহীনতার একাধিপত্য ভঙ্গ করে শুধু জেগে ওঠে সেই নদী-পারের একঘেয়ে সুর। হঠাৎ গান যখন থেমে যায়, কান পেতে স্পষ্ট শোনা যায়, চারিদিকে তপ্ত রোদের ঝাঁঝে ফেটে পড়ছে গাছের গা···শোনা যায়, সেই সব ক্ষীণতম শব্দ,যা দিয়ে তৈরী হয় মধ্যাহ্নের নীরবতা।

 আবার ভেসে আসে সেই সুর··· এবার যেন ক্ষীণতর।

 এতক্ষণে ইয়াসীগুইন্দজা যথারীতি রান্না করেছে কাসাভাদানার ভাত···সেই সঙ্গে হয়েছে তরকারি, আলু-সিদ্ধ, আর বুনো শাক।

 বাতোয়ালা খেতে বসে, ইয়াসীগুইন্দজা স্বামীর পরিত্যক্ত হুঁকোটি তুলে নেয়···তামাক টানতে টানতে অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে থাকে উনুনের হাঁড়ির দিকে, সেখানে গুটি-পোকার ষ্টু তৈরী হতে থাকে নরম আঁচে।

 তার আটজন সপত্নী-সখী তখন যে-যার কুঁড়ে ঘরের বাইরে নগ্নাবস্থায় দরমার বেড়ায় ঠেস দিয়ে প্রসাধনে ব্যস্ত।

 এর মধ্যে লজ্জা বা সঙ্কোচের কিছুই নেই। পুরুষ আর নারী, পরস্পরের প্রয়োজনের জন্যেই তৈরী হয়েছে। পুরুষ আর নারীর মধ্যে যেটুকু পার্থক্য, সে-পার্থক্যকে যখন অস্বীকার করা কোন মতেই চলে না, তখন তা নিয়ে অকারণে মাথা ব্যথা করে লাভ কি? দেহগত লজ্জার কোন মানেই হয় না। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। শাদা চামড়াওয়ালা মানুষগুলো তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে হরেক রকমের ভণ্ডামি। আরে, মানুষ কোন্ জিনিস লুকোয়? যদি কোথাও কোন আঘাতের দাগ থাকে, যদি কোথাও কোন গোলমাল থাকে, তবেই তাকে মানুষ ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। নইলে, পুরুষই হোক, আর নারীই হোক্, যা তার স্বাভাবিক, যা তার প্রকৃতিগত শক্তি, যা তার সৌন্দর্য, তাকে সে লুকোতে যাবে কেন? হাঁ, এমন যদি কোন উদ্ভট জিনিস থাকে, যা দেখে মানুষ হাসতে পারে বা উপহাস করতে পারে, তা না হয় লুকোন চলে!

 বাতোয়ালা খেতে আরম্ভ করে··· কাসাভা-দানার ভাত শেষ ক’রে গুটি-পোকার ঝোলের বাটিতে হাত দেয়···গুটি পোকা নিঃশেষ করে শেষকালে মুখে দেয় আলু সেদ্ধ। দু’তিন গ্রাস খাদ্যের পর এক-একবার ‘কেনে’র ভাঁড় তুলে নিয়ে চুমুক দেয়··· ‘কেনে’ হলো তাদের দেশের “বিয়ার”, ভুট্টার বীচি পচিয়ে তৈরী করা হয়।

 পরিতৃপ্তভাবে ভোজন শেষ করে বাতোয়ালা ইয়াসী গুইন্দজাকে ঈঙ্গিত করে, তামাকের হুঁকাটা আবার তার কাছে এগিয়ে দেবার জন্যে। মৌজ করে বসে অনেকক্ষণ ধ’রে গড়গড়াটি নিয়ে টানের পর টান দিতে থাকে। দিনটার আরম্ভ মন্দ গেল না, খুসী হয়েই হুঁকোটা নামিয়ে রেখে দেয়। তারপর পা ছড়িয়ে ডান পায়ের আঙুলগুলো নেড়ে-চেড়ে পরীক্ষা ক’রে দেখে, ‘সিগ্‌ড়ে’ অর্থাৎ পোকা-মাকড় কিছু আছে কিনা। এই সিগ্‌ড়ের উৎপাতের জন্যে বেচারা নিগ্রোদের সর্বদাই উদ্‌ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। একদিন যদি অন্যমনস্ক হয়ে পায়ের আঙুলের দিকে নজর না দিয়েছে, তা হলে রাতারাতি আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে সিগ্‌ড়েগুলো হাজার হাজার ডিম পেড়ে বসবে··· একটা সিগ্‌ড়ে যে কত ডিম পাড়তে পারে, তার কোন হিসেব–নিকেষ নেই।

 শাদাচামড়া-ওয়ালা লোকদেরও সিগ্‌ড়েরা ছেড়ে দেয় না। কিন্তু তাদের কথা হলো আলাদা। তাদের চামড়া এমন যাচ্ছেতাই রকম নরম যে একটা সিগ্‌ড়ে গিয়ে বসলেই, তারা জানতে পেরে যায়, ভয়ে ছটফট করতে থাকে। তক্ষুণি বয়কে ডাক পাড়ে। বয় এসে চামড়া থেকে সিগ্‌ড়েটাকে খুঁজে বার করে যতক্ষণ না মেরে ফেলছে, ততক্ষণ তারা চেঁচাতেই থাকবে।

 কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা করে কি লাভ? কে না জানে যে, শাদা লোকগুলোর গায়ের চামড়া নিগ্রোদের মতন শক্ত মজবুৎ নয়?

 নিগ্রোদের গায়ের চামড়া মজবুৎ বলেই শাদা লোকগুলো হাজার রকমে তার সুযোগ নেয়। একটা উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে। ট্যাক্‌স্ আদায় করবার ফিকিরে শাদা লোকগুলো নিগ্রোদের দিয়ে পাহাড়-প্রমাণ বোঝা বইয়ে নেয়। একদিন দুদিন নয়, ক্রমান্বয়ে চার-পাঁচদিন ধরে সমানে এই সব বোঝা কাঁধে করে তাদের চলতে হয়···এই সব বোঝার ওজন যে কত ভারী, একজন মানুষ বইতে পারে কিনা, তা শাদা লোকগুলো একবার ভেবেও দেখে না! রোদ হোক্, বৃষ্টি হোক্‌, গরমে গায়ের চামড়া জ্বলে পুড়ে যাক, তাদের বোঝা বয়ে চলতেই হবে! শাদা লোকগুলোর আর কি···তারা ভুলেও রোদে আসে না···সব সময়ে তারা তাদের ছাউনীর ছায়ার ভেতরে থেকে শুধু হুকুম দিয়েই খালাস···সুতরাং, বুঝছো তো, নিগ্রোদের চামড়া কতখানি শক্ত!

 হায় শাদা-চামড়া! হায় রে শাদা চামড়াওয়ালা!

 মশা দেখলেই তারা ক্ষেপে ওঠে। গালাগাল দিতে শুরু করে। মশার ডাক শুনলেই তাদের মেজাজ বিগড়ে যায়। ভাঙা কুঁড়ে ঘরের ফাটলে কিম্বা পুরানো ভাঙা বাড়ীর পাথরের তলায় যে সব বিছে থাকে, কালো কালো সব “প্রাকঙ্গো”, যমের মতন ওরা তাদের ভয় করে। ঘরের আশে-পাশে বন-জঙ্গলে যে সব মাছি ঘুরে বেড়ায়, তাদের জন্যেও ভয়ে ওদের ঘুম ছুটে যায়। আমাদের আশে-পাশে চারদিকে যে সব ছোট ছোট প্রাণী, খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা মানুষ বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তারা কেন তাদের দেখলে এত ভয় পাবে? কেন তাদের জন্যে রাতদিন এতো দুর্ভাবনা? হায়রে শাদা চামড়া! হায়রে শাদা চামড়াওয়ালার দল!

 শাদা লোকগুলোর পা? জঘন্য! পা, না খেলনা? রাতদিনই বাক্‌সের ভেতর পা দুটোকে বন্ধ করে রেখে দেয়···লাল, নীল, হলদে কত রকমের চামড়া দিয়ে বেঁধে লুকিয়ে রাখে! কেন, পায়ে ঘা হয়েছে নাকি? তাই রাতদিন বেঁধে রাখতে হবে?

 আরে শুধু পা-ই বা কেন? ওদের সারা গা বোধ হয় ঘেয়ো···রাতদিনই ঢেকে রাখে। গা থেকে যেন মড়ার গন্ধ বেরুচ্ছে।

 তাও না হয়, সহ্য করা যায় কিন্তু দোহাই ভগবান্, ভগবানের দেওয়া চোখ দুটোও সব সময় ঢেকে রেখেছে, শাদা, হল্‌দে, নীল কত রকমের কাঁচ দিয়ে! তাতেও কি ক্ষান্ত থাকে? কোথাও কিছু নেই, সারা মাথাটা নানান রকমের ছোট ছোট চুবড়ী দিয়ে ঢেকে রাখে! আশ্চর্য!

 পায়ের আঙুলের পোকা বাছতে বাছতে বাতোয়ালা আপনার মনে ভেবে চলে··· মাঝে মাঝে ঘাড় মুখ বেঁকিয়ে খানিকটা থুতু ফেলে যেন ভেতরকার কতকটা ঘৃণা সেইভাবে বেরিয়ে গেল!

 সত্যিই, এই সাদা লোকগুলোকে সে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। ভয়ও করে। তারা অতিরিক্ত ধূর্ত। তারা জানে না, এমন কিছুই পৃথিবীতে নেই, সেইজন্যেই তাদের এত ভয় করে। ইদানীং এই শাদা লোকগুলোর মধ্যে কেউ কেউ, তাদের দেশ ফ্রান্স থেকে, কাঠের তৈরী একটা আশ্চর্য যন্ত্র নিয়ে এসেছে, তার ভেতর থেকে ঠিক এই শাদা লোকগুলোর মতন কারা সব কথা বলে, গান গায়। বাতোয়ালা ভেবেই ঠিক করে উঠতে পারে না, কি করে তা সম্ভব হয়, আর কেনই বা হয়?

 তা ছাড়া, সে নিজের চোখে দেখেছে, ওরা খাবার-টেবিলে বসে, ছুরি···হাঁ, ছুরি পর্যন্ত গিলে খায়!

 এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই! এ অঞ্চলে হেন লোক নেই, যে সেই ভয়ঙ্কর শাদা লোকটার নাম না জানে··· মারো কাম্‌বা, যে লোকটা আগুন দিয়ে বান্‌ডাদের ঘর দোর সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল··· কে না জানে যে মারো–কাম্‌বা যে-সে সেনাপতি নয়, সে রীতিমত তলোয়ার গিলে খেতে পারতো?

 তাছাড়া ওদের অনেকের কাছেই এমন এক অদ্ভুত যন্ত্র আছে, যা চোখে লাগিয়ে ওরা বারাণ্ডাতে বসেই বহু দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পায়···ঘরে বসেই ওরা দেখতে পায় দূরে বহুদূরে চোখের আড়ালে কি সব ঘটছে···আশ্চর্য নয়? ভয় না করে উপায় কি?

 হাঁ···আর একটা ব্যাপার ওদের ভেতর যারা ওঝা···তাদের ওরা বলে “ডক্‌তোরো”...সেই ডক্‌তোরোগুলো কি সাংঘাতিক লোক···যদি ইচ্ছে করে তোমাকে দিয়ে নীলজল প্রস্রাব করিয়ে দিতে পারে! হাঁ নীল সত্যিকারের নীলজল!

 কিন্তু···তার চেয়েও ভয়ঙ্কর আর এক ব্যাপার আছে।

 কিছুদিন আগে, ফ্রান্স থেকে যে নতুন সেনাপতি এসেছে, সবাই দেখেছে, সে হাসতে হাসতে নিজের হাত থেকে এক পুরু চামড়া তুলে পকেটে রেখে দিল! যদিও সেটা ঠিক, তার, গায়ের সেটা চামড়ার মতন দেখতে নয়···কিন্তু, তাতে কি যায় আসে? যে আসল চামড়া, তাতে কোন সন্দেহ নেই! আসল ব্যাপার হলো, লোকটা যন্ত্রনায় একটুখানিও মুখ বেঁকালো না···হাসতে হাসতে এক পুরু চামড়া খুলে ফেল্লো!

 দরকার হলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের দাঁত পর্যন্ত খুলে ফেলে সামনে রেখে দেয়। শুধু কি দাঁত, এক একটা চোখও তারা হাসতে হাসতে খুলে সামনে রেখে দেয়, আবার দরকার হলে লাগিয়ে নেয়। কি সাংঘাতিক লোক ওরা!

 না, তাদের কোন ওঝাই আজ পর্যন্ত এ-রকম যাদু দেখাতে পারে নি। এ-রকম যাদু-শক্তি তাদের কোন ওঝারই নেই। ভাবতে ভাবতে ঘৃণার পরিবর্তে এক সভয় শ্রদ্ধা তার মনে জেগে উঠতে থাকে···

 সূর্য তখন ঠিক মাঝ-আকাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যথারীতি সে-সংবাদ ঘোষণা ক’রে ডেকে উঠে কালো পাখীর দল। সমস্ত প্রকৃতি রোদে ঝিম্ হ’য়ে নীথর পড়ে আছে। যেন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সব কিছুই ঘুমিয়ে পড়েছে। লম্বা—শীষ-ওয়ালা ঘন ঘাসের বন নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, এতটুকু বাতাসের চিহ্ন তাদের অঙ্গে ধরা পড়ে না। শুধু তিনবার মাত্র, ঠিক এমনি দুপুরের সময় রোজ কোন্ রহস্যলোক থেকে আসে তিন ঝলক দমকা হাওয়া, দুলে উঠে ঘাসের বন, তারপর আবার নিশ্চল নিশ্চুপ! দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে যেমন মনে হয় স্থির অচঞ্চল, তেমনি স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে আছে তূলো-গাছগুলো······একটা পাতাও ভুলে যেন নড়ে না।

 বাতোয়ালা উঠে পড়ে···আর বসে থাকা চলে না। এ-বার সুরু করতে হবে দিনের কাজ ।

 কিছুদূরে মাঠের ধারে একটা ঢিবির মত উঁচু জায়গা ছিল বাতোয়ালা সেই ঢিবির দিকে এগিয়ে চলে। সেই ঢিবির ওপর তিন জায়গায় থাকের পর থাক তার নিজস্ব তিনটে “লিংঘা” ( জয়ঢাক ) ছিল । মাটী থেকে দুটো মুগুর তুলে নিয়ে সবচেয়ে বড় লিংঘাটার ওপর দুবার আঘাত করলো ধীরে, মেপে মেপে ৷ সমস্ত নির্জনতা সে-শব্দে মুখর হয়ে উঠলো ।

 লিংঘার আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত আবার সব চুপ-চাপ আবার মুগুর দুটো তুলে নিয়ে দুবার আঘাত করলো লিংঘায়। গুরুগম্ভীর শব্দে আরার ভরে উঠলো বাতাস। ধীরে ধীরে সে-শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতোয়ালার হাতের স্পর্শে এবার সবগুলো লিংঘা থেকে, গুড়, গুড়, টম্ টম্ শব্দ একসঙ্গে জেগে ওঠে, প্রথমে ধীরে, তারপর দ্রুত, তারপর আরও দ্রুত, শেষকালে সর্বোচ্চ সুর থেকে আবার ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে মৃদু কোমল হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায় ।

 বাতোয়ালা দূরের দিকে চেয়ে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত যেতে না যেতে, মেঘ-গর্জনের মতন, খুব কাছ থেকে, তারপর কিছু দূর থেকে, আরো দূর থেকে, বাঁ দিক থেকে, ডানদিক থেকে, চারদিক থেকে প্রত্যুত্তর আসতে সুরু করলো। ঠিক তারই লিংঘার মতন আওয়াজ দূর থেকে তার কাছে বাতাসে গড়িয়ে গড়িয়ে আসতে লাগলো, তার আহ্বানের প্রত্যুত্তরে। তারা শুনতে পেয়েছে, তারা সাড়া দিয়েছে। বাতোয়ালা সেই শব্দের অরণ্যের মধ্যে প্রত্যেক শব্দটাকে আলাদা বেছে নিতে পারে, কোন শব্দটা ক্ষীণ মৃদু, কোন শব্দটা যেন কুণ্ঠিত, কোনটা যেন অনিশ্চিত, কোনটা যেন স্পষ্ট, উল্লসিত···এক কাগা থেকে আর এক কাগায় তার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে, এমনি তীব্র আর প্রবল। এক নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য দূর-দূরান্তর প্রাণ–সজীব হয়ে উঠে।

 বাতোয়ালার আমন্ত্রণ-ধ্বনির প্রত্যুত্তরে দূর-দূরান্তর গ্রাম থেকে শব্দের সাহায্যে তারা বলে পাঠালো, আমরা শুনেছি···আমরা শুনেছি তোমার ডাক···আমরা সবাই সজাগ হয়ে আছি···বল···কি বলতে চাও? কথা বল!

 দু’বার দূর-দিগন্ত থেকে ঠিক একই রকমের শব্দের তরঙ্গ ভেসে এল। তাদের শেষ আওয়াজটুকু মিলিয়ে গেলে বাতোয়ালা আবার বলতে শুরু করলো। আবার বেজে উঠলো তার লিংঘা।

 প্রথমে বাতোয়ালা ধীরে সুস্থে নিজেদের ছোটখাটো সুখ–দুঃখের কথা জানায়···লিংঘার আওয়াজে থাকে না কোন জোর। প্রতিদিনের সেই একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি আর অবসাদের কথা, নির্জন জীবনের অভ্যস্ত শ্রান্তি···কোন আনন্দের সম্ভাবনা নেই···নতুন কোন বিপদের আতঙ্ক নেই··· যা আছে, মুখ বুজে শুধু তাকে স্বীকার করে নেওয়া···বাতোয়ালার হাতের স্পর্শে তার লিংঘায় জেগে ওঠে সেই অমোঘ ভবিতব্যতার কথা···শ্রান্ত, ক্লান্ত, মন্থর।

 ক্রমশঃ বাতোয়ালার হাতের মুগুর পালা করে তিনটে লিংঘার ওপর সমানে পড়তে থাকে···আওয়াজ ক্রমশ দ্রুততর, উচ্চতর হতে থাকে—যেন ধীরে ধীরে ঝড় জেগে উঠছে···দেখতে দেখতে সমস্ত আকাশ ভরে ওঠে তার শব্দের সঙ্গীতে···হঠাৎ এক জায়গায় এসে থেমে যায় সঙ্গীত···ক্ষণিকের বিরাম···পূর্ণ নিস্তব্ধতা···আবার সুরু হয়, এবার সুরু থেকেই ঝড়ো শব্দের চড়া আওয়াজ···গুরু গম্ভীর গর্জন···গর্জন প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলে···

 বাতোয়ালার সারা অঙ্গ বেয়ে দর-ধারায় ঘাম ঝরে পড়ে। সে উল্লসিত। তার মনের কথা সে স্পষ্ট করে সকলকে জানিয়েছে! হাতের মুগুর চালানোর সঙ্গে সঙ্গে নাচতে সুরু করে দেয়।

 সে আজ তাদের সবাইকে ডাকছে···দূর-দূরান্ত গ্রামে যেখানে তার অনুগতজনেরা আছে, তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বন্ধু-বান্ধব, বন্ধুদের আবার যারা বন্ধু আছে তাদের সকলকেই সে আমন্ত্রণ জানায়। অন্য গ্রামে যারা মোড়ল, যাদের সঙ্গে সে করেছে প্রাণ-বিনিময়, যাদের রক্ত সে পান করে নিজের দেহে নিয়েছে, তার রক্ত যারা পান করে তাদের দেহে নিয়েছে―তাদের প্রত্যেককে দেয় ডাক। ন’ দিনের ভেতর তাদের সকলকে এসে জড় হতে হবে, গান্‌জা-উৎসব উপলক্ষে বিরাট এক ‘ইয়াংবার’ আয়োজন সে করবে, সে–নৃত্য–উৎসবে তাদের সকলেরই নিমন্ত্রণ। সে–বিরাট আয়োজনে তাকে সাহায্য করবার জন্যে, সবাইকে সে আজ ডাক দেয়।

 অদ্ভুত এই লিংঘার আওয়াজ। যুগের পর যুগের চেষ্টায় তারা গড়ে তুলেছে এই বিস্ময়কর ভাষাকে। তারই সাহায্যে বাতোয়ালা আজ এক নিমেষে ছড়িয়ে দিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তার নিমন্ত্রণের সংবাদ। এবং সে-সংবাদের মধ্যে তারা খবর পেয়ে গেল, কি বিরাট উৎসব আর আনন্দেরই আয়োজন সে করছে। খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান, সারাদিন, সারারাত ধরে চলবে উৎসব। যত রকম নাচ আছে, সব নাচেরই আয়োজন সে করবে। হাতী-নাচ, বর্শা-নাচ, যুদ্ধের নাচ, কোন নাচই বাদ যাবে না। সবার ওপরে থাকবে, সকলের চেয়ে সেরা নাচ, ভালবাসার নাচ···কালো কাফ্রী তরুণী মেয়েরা যে-নাচে রেখেছে তাদের মুগ্ধ ক’রে।

 সারাদিন চলবে খাওয়া আর নাচ, নাচ আর খাওয়া, সারারাত চলবে পাত্র ভরে পান আর নাচ, নাচ আর পাত্র ভরে পান। ক্যাসাভা দানার ভাত, আলু, কুমড়ো, ইয়াম্‌, নাড়ালো, ভুট্টা···কি মধুরই না ভুট্টা দানার বিয়ার! জালা ভর্তি থাকবে ভুট্টা দানার বিয়ার! কুমীরের ডিম–সেদ্ধ আর বিয়ার! প্রচুর পরিমাণে থাকবে কুমীরের ডিম, মাছ, মাংস! প্রত্যেককেই আসতে হবে···হাঁ···হাঁ··· সকলের আসা চাই-ই!

 নিমন্ত্রণ শেষ হয়ে গেলে, বাতোয়ালা কয়েক মুহূর্ত ঘাড় উঁচু করে দূরের দিয়ে চেয়ে রইলো···যেন কার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সহসা নীরবতাকে ভঙ্গ করে দূর থেকে আবার ভেসে আসতে সুরু করে সঙ্গীতের মতন বিচিত্র সব আওয়াজ···বাতোয়ালা স্পষ্ট বুঝতে পারে, আলাদা আলাদা করে প্রত্যেক গানের আলাদা লাইন,—

 “শুনলাম, তোমার সব কথাই আমরা শুনেছি···বুঝেছি কি বলতে চাইছো তুমি···তুমি আমাদের সেরা, সকলের সেরা, সকলের সেরা বাতোয়ালা তুমি··· আমরা আসবো··· আমরা আসবো সবাই আসবো তোমার আমন্ত্রণে···নিশ্চয়ই, সঙ্গে নিয়ে যাবো আমাদের বন্ধুদের··· ফুর্তি করবো, নাচবো, গাইবো সারাদিন সারারাত···শাদা লোকদের মত স্পঞ্জের মতন শুষে নেবো তোমার মদের জালা···আমাদের প্রত্যেকের গাঁয়ের হয়ে আমরা প্রত্যেকে কথা দিচ্ছি—আমি ঔরো—আমি ওহৌরো—আমি কাঙ্গা—ইয়াবিংগুই—ডেলেপো—তেঙ্গোমালি—ইয়াবাদা—প্রত্যেক মোড়ল, আমরা কথা দিচ্ছি—আমরা যাবো—আমরা যাবো—”

 ধীরে ধীরে দিগন্ত-রেখায় ক্রমশ মিলিয়ে যায় তাদের কথাবার্তা—বাতোয়ালা লিংঘার কাছ থেকে নেমে আসে— সোজা পথ ধরে এগিয়ে চলে যেখানে বাম্বা আর পোম্বা এক জায়গায় এসে মিশেছে—সেখানে আগের দিন জলের ভেতর বসিয়ে রেখে গিয়েছিল মাছ ধরবার ঝাঁঝরী। দেখতে হবে, কতটা মাছ ধরা পড়লো।

 যাবার সময় সে সঙ্গে দুটো বর্শা, একটা ধনুক, একটা থলে আর একটা ছাগলের চামড়া নিয়ে নিল।

 মানুষ যেখানেই যাক্, যত কাছেই হোক না কেন, সঙ্গে করে একটা থলে নিয়ে যাওয়া চাই-ই। কত না জিনিস তার ভেতর লুকিয়ে রাখা চলে!

 সেই সঙ্গে সে দুটো বিম্বি পাতা নিয়ে নিল। ধনুকের জন্যে তূণে কতকগুলো কাঁটা-ওয়ালা তীর ভরে নিল। আর নিল গোটাকতক ক্যাসভা দানার পিঠে। খাদ্য।

 আর কি দরকার! এই নিয়ে সে জগতের যে-কোন বিপদের সামনে নির্ভাবনায় দাঁড়াতে পারে। আত্মরক্ষার জন্যে রইল তীর, ধনুক আর বর্শা। ক্ষুধার জন্যে রইল ক্যাসাভা-দানার পিঠে। তার ওপর, যদি তেমন কিছু আবার দরকার পড়ে, সঙ্গে তো বিম্বি পাতা আছে। মাছের খলুই-এর ভেতর একটা বিম্বি পাতা ফেলে দিলে, যে কোন মাছই ঠাণ্ডা হিম হয়ে যাবে।

 নিশ্চিন্ত মনে বাতোয়ালা হাঁটতে শুরু করে।

 এক-পা করে পথ চলে আর পায়ের তলার মাটী খুঁটিয়ে দেখে নেয়। চিরকালের অভ্যাস। পিতা-পিতামহদের কাছ থেকে পাওয়া নানান অভ্যাসের মতনই এটাও হয়ে গিয়েছে স্বভাব। যতই বয়স বাড়তে থাকে, ততই বুঝতে পারে, এই সব অভ্যাসের দাম কতখানি।

 শাদা লোকেরা জানে না, পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে মাটীকে খুঁটিয়ে দেখার মূল্য কতখানি। কত সামান্য সামান্য ব্যাপারই তারা জানে না! পায়ে পাথরের কুচি লাগতে পারে। কাদায় পা হড়্কে যেতে পারে, খানায় বা ডোবায় পা মুচ্‌কে যেতে পারে। একটু নজর রাখলেই যদি তা থেকে বাঁচা যায়, নজর রাখতে ক্ষতি কি! তার জন্যে তো আর আলাদা সময় নষ্ট করতে হয় না। তা তাড়া, মানুষের যত বুদ্ধি বাড়ে, মানুষ ততই বুঝতে পারে, সময়ের তো আলাদা কোন দামই নেই···সময়ের মধ্যে যেটুকু পাওয়া যায় সেইটুকুই তো সময়ের দাম! তা ছাড়া, সময়ের আবার দাম কি!

 বাতোয়ালা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাতোয়ালার ঘরে এসে উপস্থিত হয়, বিসিবিংগুই।

 ভরা যৌবন···লিক্‌লিকে ছড়ির মতন দেহ। সবল···সুন্দর।

 বাতোয়ালার ডেরায়, যখনই সে আসুক না কেন, তারজন্যে এক থালা খাবার আর তার শোবার জন্যে একটা বোগ্‌বো সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। বাতোয়ালার সে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাই এই বিশেষ খাতিরটুকু বাতোয়ালা তারজন্যে আনন্দেই বরাদ্দ করে রেখেছে।

 শুধু যে বাতোয়ালাই তাকে এইভাবে স্নেহ করতো, তা নয়। বাতোয়ালা জানে না, তার অসাক্ষাতে তার ন’ জন স্ত্রীর মধ্যে আটজনই বিসিবিংগুইকে তাদের অন্তরের প্রীতির প্রত্যক্ষ নিদর্শন জানাতে দ্বিধা করে নি। একমাত্র এখনো পর্যন্ত এই কার্যে বাদ দিয়েছিল, তার প্রধানা স্ত্রী, ইয়াসী গুইন্দজা। তবে, ইদানীং একটু লক্ষ্য করলেই বেশ বোঝা যায় যে ইয়াসীগুইন্দজা তার মহিমান্বিত স্বামীর আদেশের চেয়ে বিসিবিংগুই-এর আদেশকেই যেন বেশী সমীহ করে চলছে। ইয়াসীগুইন্দজা শুধু অপেক্ষা করে আছে একটা ভাল রকমের সুযোগের জন্যে, যে সুযোগের শুভ-লগ্নে সে তার অন্তরের কামনা বিসিবিংগুইকে নিবেদন করতে পারবে।

 পুরুষের কামনাকে প্রত্যাখ্যান করা নারীর শোভা পায় না। নারীর কামনা সম্বন্ধে পুরুষেরও সেই একই কর্তব্য। এই হলো স্বভাব-ধর্ম। স্বভাব-ধর্মকে মেনে চলাই হলো সর্বোচ্চ আইন। একজন নারীকে যে একজন পুরুষেরই সম্পত্তি হয়ে থাকতে হবে, এমন কোন কথা নেই। তাই স্বামীকে প্রতারণা করার মধ্যে খুব একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি বলে কিছু নেই।[]

 অপরের সম্পত্তি সাময়িক ভাবে ভোগ করার দরুণ যদি ক্ষতিপূরণের কথা একান্তই ওঠে তা হলে আসল মালিককে ক্ষতি—পূরণ বাবদ গোটাকতক মুরগী ও ছাগল ছানা বা দরকারী কাপড়–চোপড় দিয়ে পুষিয়ে দিলেই হলো। তারপর সবই ঠিক হ’য়ে যাবে।

 অবশ্য, সব ক্ষেত্রে যে এইভাবে মীমাংসা হ’য়ে যাবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অন্তত বাতোয়ালার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না, তাতে কোন সন্দেহই ছিল না। সেখানে সে দুর্দান্ত ক্ষমাহীন, কোন প্রতিদ্বন্দীকেই সে সহ্য করবে না, করতে পারে না। যাই বলুক লোকাচার, আর যাই হোক না কেন সনাতন সামাজিক রীতিনীতি, তার সম্পত্তির ওপর যারা হাত দেবে, তাদের ধ্বংস করে ফেলতে তার এতটুকুও কোথাও বাধবে না। রীতিমত চড়া দাম দিয়ে সে ইয়াসীগুইন্দজাকে কিনে এনেছিল —সে জমির ষোল আনা মালিক সে—সেখানে তারই একমাত্র অধিকার বীজ বপন করবার। ইয়াসীগুইন্দজা সে–কথা ভাল করেই জানতো! তাই সে এতদিন পর্যন্ত নিজের স্বভাব-ধর্মকে দমন করেই রেখেছে।

 গত দু’ তিন চাঁদ ধরে ইয়াসীগুইন্দজা লক্ষ্য করে দেখেছে, বিসিবিংগুই ইদানীং যাওয়া-আসা খুবই কমিয়ে দিয়েছে। তাই আজকে তার হঠাৎ আবির্ভাব তাকে উতলা করে তোলে।

 একদিন ঘোর বর্ষার মধ্যে বিসিবিংগুই জন্মেছিল। তারপর  থেকে ষোলটা বর্ষা চলে গিয়েছে। আজ সেই ষোল বর্ষার জল তাকে যৌবনে ভরপুর করে তুলেছে। ঠিক এই বয়সে, মানুষের মত তাজা মানুষ যারা, তারা চব্বিশ ঘণ্টা শীকার করে বেড়ায়·· স্ত্রীলোককে। ঠিক যেমন তাদের চোখের সামনে বনে শীকার করে ঘুরে বেড়ায় নেকড়ে বাঘ তরুণী হরিণীর খোঁজে।

 দেখতে দেখতে চোখের সামনে বিসিবিংগুই পাতার আড়ালে লুকানো ফলের মতন পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তার দেহের প্রত্যেক পেশী সে-সংবাদ সগর্বে ঘোষণা করছে। তবে, তাকে হরিণীর পেছনে ছুটতে হয় না, হরিণীরাই তার খোঁজে ছুটে বেড়ায়। কালো ইয়াসী, আর বুনো হরিণী, দুই-ই এক। তবে নেকড়ের কাছে ধরা দিতে হরিণীর কোন আনন্দ নেই। কিন্তু ইয়াসীরা আনন্দে ধরা দেয় তার কাছে। শ্রদ্ধা করে তার সম্পূর্ণ বলিষ্ঠতাকে, পরিপূর্ণতাকে। তার জন্যে অনেক ঘরে অনেক দম্পতীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে, অনেক ঝগড়া বাদবিতণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ক্রমশ ব্যাপার এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে, লোকে তার নামে কমাণ্ডারের কাছে নালিশ করতে বাধ্য হয়। নালিশের পর নালিশ পেয়ে একদিন কমাণ্ডার তাকে ডেকে পাঠিয়ে শাসিয়ে দেয়, ফের যদি তার সন্বন্ধে এই নালিশ আসে, তাহলে তাকে ধরে জেলে আটক করে রাখা হবে।

 তার ফলে তরুণী ইয়াসীদের মহলে তার খ্যাতি আরো বেড়েই যায়।

 তাই বহুদিন পরে বিসিবিংগুই–এর অকস্মাৎ আবির্ভাবে বাতোয়ালার কুটীরবাসিনীরা আনন্দমুখর হয়ে উঠলো। সকলেই ছুটে এল সাদর অভিবাদন জানাবার জন্যে। প্রত্যেকের মুখেই প্রশ্ন, কোথায় ছিলে? কি করছিলে? এখানে সেই যে শেষ এসেছিলে, তারপর কত নতুন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলো? তাদের নাম কি? শুনলাম, অমুক মেয়ের সঙ্গে···সে কি সত্যি? এই ধরণের শত অন্তরঙ্গ প্রশ্ন চারদিক থেকে তাকে আক্রমণ করল।

 কোন রসিকতাতেই হাঁ কি না, কোন সাড়া না দিয়ে সে হাসতে হাসতে বাতোয়ালার পরিত্যক্ত হুঁকোটা তুলে নিল, ঘন করে তামাক পাতা ঠেসে একটা জ্বলন্ত কাঠকয়লা তার ওপর তুলে দিল।

 পাতা ধরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাদুরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মনের সুখে হুঁকোতে টান দিল। ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী গোল হয়ে বাতাসে মিশে যেতে লাগলো।

 ইয়াসীগুইন্দজা গম্ভীর চালে বলে ওঠে, মেয়েমানুষদের নিয়ে এ-রকম খেলা ভাল নয়···তোমার ভালোর জন্যেই বলছি, তাদের সম্বন্ধে একটু সাবধানেই চলো। কোন্‌দিন দেখবো, সারা অঙ্গে ঘা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো!

 ইয়াসীগুইন্দজার কথায় তার আটজন সপত্নী হি–হি করে হেসে ওঠে।  —এ-হি···হি···হি···ইঃ···ইয়াবোয়া······ইয়াসীগুইন্দজের কথা শোন···এ-হি··· হি··· হি···”

 উপযুক্তভাবে হয়ত সাবধান করা হলো না, মনে করে ইয়াসী গুইন্দজা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করে, “কাসিরি ঘা তো তবু ভালো···তার চেয়েও ভয়ংকর জিনিস আছে বন্ধু! সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ হবে··· নেকড়ের মত···মাংস খসে খসে পড়বে···অমন যে দাঁত, তার একটীও থাকবে না···ময় মাথার চুল, হাতের আঙুল পর্যন্ত! মনে নেই, ইয়াকেন্–লেপিনের কথা? এই তো তিন চাঁদ, কি চার চাঁদ আগেও তো সে বেঁচে ছিল!”

 আবার তারা সকলে অট্টহাস্য করে উঠলো।

 তারা হাসছিল, এমন সময় বাতোয়ালা এসে হাজির হয়। হাসির কারণ বাতোয়ালাকে তারা জানিয়ে দেয়।

 বাতোয়ালা তাদের হাসিতে যোগদান করে। সবাই মিলে অট্টহাস্য করে ওঠে। আলাপে, রসিকতায় মশগুল হয়ে যায়। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে···গড়াগড়ি দেয়···চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

 —“এ-হে-হে···হিঃ-হিঃ···হিঃ···বাতোয়ালা গো···ও হো-হো ···ওঃ···ওঃ···”

 ক্রমশ সূর্য অস্তে বসে।

 একটু একটু করে নীড়ে ফিরে–আসা পাখীর কাকলী ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে···দূরে কোথাও শেষ শকুনি আকাশ থেকে নেমে শেষ চীৎকারে অরণ্যের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

 গ্রামের মাথার ওপর ধীরে নেমে আসে কুয়াশার অবগুণ্ঠন।

 সূর্য ডুবে যায়।

 মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ছাগল, হাঁস, মুরগীর দল যে-যার আশ্রয়ে ফিরে আসে আবার।

 আকাশ জুড়ে এল পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। সে-মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল রক্ত সূর্য-যেন একটা পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত আফ্রিকার রক্ত-অরণ্য-পুষ্প। মেঘের আড়াল ভেদ করে তীরের মতন দেখা যায় শুধু তার কিরণের ছটা। তাকে তখন গ্রাস করে নিয়েছে কুমীরের মতন অন্ধকার, মহাশূন্য।

 ধীরে ধীরে মহাশূন্যের বুকে একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসে রক্ত-আলোকের ছটা। ক্রমশ রক্তহীন বিবর্ণ হয়ে তারা মিশে যায় আকাশের সঙ্গে··· হারিয়ে যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে নিঃসীম মহাশূন্যতায়। অন্ধকার আকাশ ঘোষণা করে সূর্যের মৃত্যু। প্রতিদিন আকাশে এইভাবে মৃত্যু ঘটে প্রতিদিনের সূর্যের। তার অন্তিম মুহূর্তের মৃত্যু-বেদনার ওপর নেমে আসে সুগম্ভীর নীরবতা। সে-নীরবতা দেখেছে শত লক্ষ সূর্যের দৈনন্দিন মৃত্যু। অবর্ণনীয় তার সুবিশাল মৌনতা।

 ম্লান বিবর্ণ আকাশে বেদনার প্রদীপ হাতে মৌন-বিষাদে একে একে দেখা দেয় তারকার দল। অন্ধকারের একাধিপত্যে আবার সুরু হয় বিন্দু বিন্দু আলোর অভিযান, চিহ্নিত হয়ে ওঠে নিশ্চিহ্ন মহাশূন্য।

 সারাদিনের রৌদ্রদগ্ধ ধরণীর অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে উত্তপ্ত বাষ্প।

 দিক-বিদিকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে রাত্রির হিমেল সুবাস। অন্ধকারে জন্ম নেয় শিশির-বিন্দু। বিদায়ী দিনের উত্তাপ আর আগত রাত্রির হিম-স্পর্শ মিলে গিয়ে ঝরে পড়ে শিশিরে শিশিরে। ভিজে ওঠে শুকনো মাটী। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বুনো লতার স্নিগ্ধ মৃদু গন্ধে। অন্ধকার ভরে যায় নামহীন পতঙ্গের অবিচ্ছেদ গুঞ্জনে।

 কাছে কোথাও কুটীর-প্রাঙ্গণে কালো কাফ্রী-রমণী গম পিষছে। তার শব্দের সঙ্গে মিশে যায় বাজনার টম্ টম্ আওয়াজ।

 ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে উনুনের আগুন। ধোঁয়ার কুণ্ডলী জানিয়ে দেয়, সেখানে আছে মানুষের থাকবার কুঁড়ে ঘর।

 ঘরের চারদিক ঘিরে গান সুরু করে দেয় আফ্রিকার বুনো ব্যাঙের দল। এক এক দলের এক এক রকম আওয়াজ। বাতোয়ালার ঘরে দিনের সফর শেষ করে ফিরে এসেছে জুমা, বাতোয়ালার পালিত কুকুর। ব্যাঙেদের একঘেয়ে ডাকের প্রতিবাদে সে মাঝে মাঝে চীৎকার করে ওঠে।

 তাছাড়া, আর কোথাও কোন জীবনের চিহ্ন নেই। একটা মৌন বেদনা আর মথিত অসহায়তাকে ঢেকে রাখবার জন্যেই যেন নেমে এসেছে রাত্রির অন্ধকার।

 কিছুক্ষণ পরে আকাশে দেখা দেয় আইপু[], ধীরে ধীরে মেঘের পাশ কাটিয়ে চলেছে, যেমন কচুরী–পানার পাশ কাটিয়ে নদীর ওপর দিয়ে চলে নৌকো।

 ইতিমধ্যেই ছ’ রাত হয়ে গিয়েছে চাঁদের বয়স।

 “গান্‌জা” উৎসবের ঠিক তিন দিন আগে হঠাৎ প্রবল এক ঘূর্ণী ঝড়ে সমস্ত গাঁ যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এর আগে থাকতে অতি-বৃষ্টির দরুণ যে ক্ষতি একটু একটু করে জমা হচ্ছিল, ঝড় এসে তা সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেল।

 এত বড় যে একটা ঝড় হয়ে যাবে, তার কোন লক্ষণই আগে থাকতে কিছুই দেখা যায় নি। রোজ যেমন সকাল হয়, সূর্য ওঠে, তেমনি সেদিনও গ্রিমারী গাঁয়ে ভোর হয়েছে, সূর্য উঠেছে। প্রথমটা যেমন একটু ধোঁয়াটে থাকে, তারপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিব্যি ফর্সা হয়ে ওঠে, সেদিনও তেমনি রোদে-পোড়া স্বচ্ছ দিনই প্রথম দিকটায় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল।

 মাঝামাঝি দিনে, প্রতিদিন যেমন নরম হাওয়া ওঠে, তেমনি নরম হাওয়ায় ঘন সবুজ বনের বুকটা দুলে উঠলো···নরম হাওয়া, ঠাণ্ডাও নয়, গরমও নয়। গাছের পাতার আড়ালে “গোলোকোতো” পাখীর দল কুজন করতে থাকে, তাদের সঙ্গে যোগদান করে বৌ কৌ দৌ বা আর লিহৌয়া পাখীর দল। দেখতে চেহারায় প্রায় একই রকমের। লিহৌয়াদের সঙ্গে তফাৎ শুধু পুচ্ছের সবুজ রঙে।

 ভুট্টা আর জনার ক্ষেত্রের ওপরে, ঘন গাছের জঙ্গলের ওপরে, গাঁয়ের ওপরে আকাশে দেখা যায়, একটি দুটি ক’রে ক্রমশ অসংখ্য শব-ভুক শকুনি···গোল হয়ে উড়তে থাকে। হঠাৎ মাটীতে খাদ্যের সন্ধান পেয়ে তাদের মধ্যে কেউ কেউ তীরের মতন নীচে ছুটে আসে, খাদ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আবার আকাশে দলে যোগদান করে।

 দিনটা খুব গরমও নয়···বিশেষ ঠাণ্ডাও কিছু নয়।

 বাম্বা আর পোম্বোর তীরে বানরের দল যথারীতি গাছ থেকে গাছে ঘুরে বেড়ায়। তাদের দুরন্তপনার আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে আফ্রিকার জঙ্গলের টাগাউয়াদের অদ্ভুত ডাক কানে আসে, ঠিক যেন ছোট ছেলে কাঁদছে।

 চারদিক থেকে আসে মৌমাছিদের গুঞ্জন। একটা মধু-চোর পাখী মৌচাকে মধু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, ঝাঁকের পর ঝাঁক মৌমাছি পাখীটাকে তাড়া করে ছোটে। তাদের ক্রুদ্ধ গুঞ্জনে বাতাস ভরে যায়। ক্রমশ দূরে তাদের শব্দ মিলিয়ে গেলেও, বাতাসে পাতার মৃদু-মর্মর ধ্বনিতে মনে হয় যেন এখনও সেই মৌমাছিরাই গুঞ্জন করছে।

 গাঁয়ের ভেতর থেকে আসে গম-পেষার শব্দ। বেলা বেড়ে চলে।  হঠাৎ সেদিন মাকৌদা বাতোয়ালার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসে। সম্পর্কে বাতোয়ালার ভাই। মাছ ধরে, জেলে। অনেকদিন পরে বাতোয়ালার সঙ্গে দেখা করতে এলো। দুটো বড় মাছ তার জালে ধরা পড়েছে। তাই ভাইকে নেমন্তন্ন করতে এসেছে। সেখানে বিসিবিংগুইকে দেখতে পেয়ে, তাকেও নেমন্তন্ন করে।

 সাধারণত ওদের সমাজে একটা মানুষ, যদি তার সামর্থ থাকে, তাহলে অনেকগুলি মেয়েকেই বিয়ে করতে পারে এবং প্রত্যেক স্ত্রীর ছেলেপুলে নিয়ে এক বৃহৎ সংসার গড়ে ওঠে। মাকৌদা আর বাতোয়ালার মধ্যে কিন্তু আরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। একই বাপ আর একই মায়ের সন্তান তারা।

 মাকৌদার আমন্ত্রণে তারা তিনজনেই বেরিয়ে পড়ে। হাঁসের মতন একজনের পেছনে আর একজন চলে। পথ চলবার এই নিয়ম। রাস্তায় পাশাপাশি কখনো হাঁটতে নেই। অনাদিকাল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। তাদের জাতের মতন পুরানো এইসব নিয়ম।

 পেছনে জুমাও অনুসরণ করে চলে, দু’ কান খাড়া করে···

 বাড়ীতে বাতোয়ালার স্ত্রী-মহলে কথা ওঠে। ইন্দৌভৌরা, বাতোয়ালার অন্যতমা গৃহিণী, মুখ ভার করে বলে, একজাতের মানুষ আছে, নিজের দেমাক্ নিয়েই সারা!

 স্বভাবতই ইন্দৌভৌরা একটু বেশী হিংসুটে, রক্তের তেজ তার কমেনি। তাকে পরিত্যাগ করে বিসিবিংগুই যে ইয়াসী–গুইন্দজার পেছনে ঘুরছে, এ ব্যাপারটা সে কিছুতেই হজম করতে পারে না।

 তার কথার ইঙ্গিত বুঝে সপত্নীদের মধ্যে একজন জবাব দেয়, সত্যি, দেমাক্ দেখাতেই যেন তাদের সব সুখ!

 “তাতে অবিশ্যি, কার কি যায় আসে? সেদিকে চেয়ে না দেখলেই হলো! কিন্তু কথাটা কি জানিস্, যাদের কোন দেমাক্ নেই, অনায়াসেই লোকে তাদের ঘাড়ে চাপে। কি বলো গো ইয়াসীগুইন্দজা?”

 সকলে খিল খিল করে হেসে ওঠে। ইয়াসীগুইন্দজাকে তারা কেউই দেখতে পারতো না।

 সপত্নীর প্রশ্নে ইয়াসীগুইন্দজা বলে ওঠে, তা যা বলেছিস্, সত্যি! কিন্তু কার কথা তুই বলছিস্, আমি তো ভাই বুঝতে পারছি না! সেই 'নাংগাপৌ' মাগীটার কথা বলছিস্···সেদিন’ একজন বড় মোড়লের সঙ্গে যার বিয়ে হলো?

 ‘নাংগাপৌ’ কথাটার মধ্যে একটা গোপন আঘাত ছিল। অতি নীচ জাত তারা এবং ইন্দৌভৌরা সেই নীচ জাতেরই মেয়ে। ইন্দৌভৌরা তৎক্ষণাৎ ধরে নেয় যে, তাকেই গালাগাল দিয়ে একথা বলা হলো। রাগে তার ভেতরে এক নিমেষে আগুন জ্বলে ওঠে।

 সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে ইয়াসীগুইন্দজা বলে, তা ভাই দেমাক্ হবে না? ওতো আবার শাদা চামড়ারও ঘর করে এসেছে!

 শেষোক্ত কথাটাও যে তাকে আঘাত করবার জন্যেই বলা হলো, সেকথা বুঝতে ইন্দৌভৌরার দেরি লাগে না। হাত-পা ছুঁড়ে চীৎকার করে উঠলো, বলি ও বুড়ো মাগী···আমি কি বুঝতে পারছি না, যে তুই আমাকেই অপমান করে এই সব কথা বলছিস্? আমারও জানতে বাকি নেই তোর গুণের কথা। বাজারের মড়া, আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল, ফের যদি ও সব কথা বলবি তো গলা টিপে মেরে ফেলবো!

 ইয়াসী—বলি, চেঁচাচ্ছো কেন বাপু? আস্তে কথা বলো না···আমি তো আর কালা নই!

 ইন্দৌ—তা হবি কেন? বালাই ষাট···বড় দেমাক হয়েছে, না? এই হামানদিস্তে দিয়ে তোর মুখ থেতো করে দেবো! আসুক না বাতোয়ালা বাড়ী ফিরে, আমি সব বলে দেবো···লুকিয়ে বিসিবিংগুই-এর সঙ্গে মজা করা! আমি সব বলে দেবো···

 ইয়াসী—বলি হঠাৎ এত রাগের কি হলো? ওহো-ওঃ···বুঝেছি···বুঝেছি···অনেক বর্ষা একসঙ্গে কাটিয়েছি কিনা, তাই ভুলে গিয়েছিলাম যে তুমিও সেই নাংগাপৌ জাত থেকে এসেছো, তুমিও শাদা–চামড়ার ঘর করে এসেছো!

 এরপর আর কথা-কাটাকাটি করার দরকার হয় না! আহত বাঘিনীর মতন ইন্দৌভৌরা ইয়াসীগুইন্দজার দিকে তেড়ে যায়। যদি তার সপত্নীরা মাঝপথে তাকে ধরে না ফেলতো, তাহলে হয়ত ইয়াসীগুইন্দজাকে সে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতো। মনের ঝাল মেটাতে না পেরে যা খুশী গালাগাল দিয়ে চলে। দরকার হলে সে কমাণ্ডারের কাছে গিয়ে নালিশ করবে। সকলকে ডেকে সে জানিয়ে দেবে, কি করে “ইয়ারো” খেয়ে সে পেটের ছেলে নষ্ট করে ফেলে, পঞ্চায়েৎ ডেকে সে গাঁয়ের বড়ো মোড়লদের কাছে তার বিচার দাবী করবে। বিসিবিংগুইকে নিয়ে ইয়াসীগুইন্দজা যা খুশী তাই করুক না কেন! বিসিবিংগুই-এর মতন লোককে সে এক কাণাকড়িও মূল্য দেয় না! যে বেটাছেলের গায়ে কাসিবি ঘা ভর্তি, কি দরকার তার সঙ্গে ওঠা-বসার?

 ইন্দৌ—কথায় বলে না, পেট যার ভর্তি থাকে, সেই বলে আমার আর ক্ষিদে নেই!

 স্থির কণ্ঠে ইয়াসাগুইন্দজা জবাব দেয়, বলি, হিংসে এমনি জিনিস! কই, আমার কাছ থেকে তুই যখন বিসিবিংগুইকে নিয়েছিলি, আমি কি তোর মতন চেঁচিয়েছিলাম?

 ইন্দৌ—কেন, বিসিবিংগুই কি তোর সম্পত্তি নাকি? লোভ দেখ।

 যেমন হঠাৎ ঝড় ওঠে, তেমনি হঠাৎ আবার থেমে যায়।

 সপত্নীরা দু’পক্ষকেই থামিয়ে দেয়।

 ইয়াসীগুইন্দজা হাসতে হাসতে বলে, খুব হলো, আর নয়! একদিনের পক্ষে খুব যথেষ্টই হলো। আয়, সবাই মিলে এখন খানিকটা গলায় ঢালা যাক্! শোবার মাদুর, পেটপুরে খাওয়া, খানিকটা বিয়ার, মিষ্টি পিঠে, নাচ-গান, আর হুঁকো ভর্তি তামাক—এ ছাড়া দুনিয়ায় চাইবার আর কি আছে?

 সবাই মিলে হুল্লোড় করে ইয়াসীগুইন্দজার প্রস্তাবকে গ্রহণ করলো।

 কয়েক মুহূর্ত আগে, সেখানে যে ঝড় বয়ে চলেছিল, তার কোন চিহ্নই রইলো না।

 আবার সেই প্রতিদিনকার অভ্যস্ত জীবনের পরিচিত ধারা।

 এমন সময় সহসা বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসে। কোথা থেকে উড়ে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি, মাছি···অফুরন্ত, অগণিত···সব জায়গা ছেয়ে ফেলে।

 একটি একটি করে নিস্তব্ধ হয়ে আসে পাখীর দল। একটি একটি করে আকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় শকুনিরা।

 দেখতে দেখতে গাঁয়ের পেছন দিক থেকে প্রকাণ্ড মেঘের দল মাথা তুলে জেগে ওঠে। থাকের পর থাক জমা হতে হতে ক্রমশ তাদের রঙ বদলাতে শুরু করে। এলোমেলো ঝড় এসে তাদের আকাশময় টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়। কি এক অদৃশ্য মায়াশক্তি তাদের নদীর দিকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে।

 ক্রমশ তাদের গতি স্পষ্ট দ্রুত হয়ে ওঠে; সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলে কয়লার মত কালো হয়ে যায়। বনেতে আগুন লাগলে কালো বুনো ষাঁড়ের দল যেমন দিকবিদিক–জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে, তেমনি ধারা কি এক অজানা ভয়ের তাড়নায় তারা আকাশময় ছুটে বেড়ায়।

 দেখতে দেখতে বিদ্যুৎ এসে তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। গুরু গুরু গর্জনে কেঁপে ওঠে আকাশ।

 ঘরের বাইরে যে সব মাদুর আর হাঁড়িকুড়ি পড়েছিল, তাড়াতাড়ি সেগুলোকে ঘরের ভেতর তুলে আনা হয়। কুঁড়ে ঘরের ছাদের ভেতর দিয়ে নীল-নীল ধোঁয়া কিছুটা ওপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে, কিছুটা ঘরের বাইরে চারিদিকে অচল অনড় ঝুলে থাকে যেন।

 থম্‌থমে হয়ে আসে সব। বাম্বা, ডেলা, ডেকা, গ্রাম প্রান্তবর্তী ছোট ছোট নদীর ওপর নিথর স্থির দাঁড়িয়ে থাকে পুঞ্জ পুঞ্জ ঘন কালো মেঘ। নিথর দাঁড়িয়ে থাকে তারা আফ্রিকার ছোট ছোট বুনো গাঁয়ের মাথার ওপর। মাটীর ওপর যা কিছু সবুজ, সেই কালো মেঘের ছায়ায় ক্রমশ সব হয়ে আসে গাঢ় ঘন। মেঘেতে ছোট হয়ে আসে দিন, অকস্মাৎ ছেদ পড়ে প্রতিদিনের জীবনে। মূর্তিমান ভয়ের মতন, গম্ভীর মুখে আকাশে অপেক্ষা করে থাকে মেঘের দল, আক্রমণের আদেশে যেমন অপেক্ষা করে সৈনিকরা···

 কিছু দূরে ঐ সৌমানা গাঁ আর ইয়াকিজি গাঁয়ের মাঝখানে কে যেন ঝুলিয়ে দিল আকাশ থেকে মাটী পর্যন্ত পাতলা একটা আবছা পর্দা···বৃষ্টি···বৃষ্টি নেমেছে ওখানে।

 হঠাৎ দূর অদৃশ্য লোক থেকে এক ঝলক তীব্র গরম হাওয়া ছুটে আসে···কলাগাছের পাতায় পাতায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়···চারদিক থেকে আবার ওঠে বিচিত্র সব ব্যাঙের আওয়াজ···বৃষ্টিকে তারা ডাকছে।

 দেখতে দেখতে চারদিক থেকে এলোমেলো বাতাস ফুলে ফেঁপে ছুটতে আরম্ভ করে। গাছ-পালা, লতা-গুল্ম, ভেঙ্গে ছিড়ে তছনছ ক’রে ফেলে; গাঁয়ের পথের যত মেটে–ধূলো বাতাসের সঙ্গে মিশে আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলে; এক নিমেষে সমস্ত অন্ধকার করে দিয়ে যেখান থেকে এসেছিল, তারা আবার সেখানে চলে যায়! এরা দুর্বল। এরা শুধু জানিয়ে গেল, আসছে সে, যে মহাপ্রবল, প্রলয়ের রাজা।

 আবার কিছুক্ষণের জন্যে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিশ্চল, নিথর নিস্তব্ধতা।

তারপর সহসা বজ্রভেরী বাজিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি। বাতাস ভরে যায় ভিজে মাটির মিষ্টি গন্ধে। আকাশ ছিঁড়ে নামে ঝড়ের মাতন। কাছে কোথাও বাজ পড়লো।

 প্রত্যেক মুহূর্তের সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতর হয়ে ওঠে ঝড়। তীরের মতন অবিরাম অজস্র ধারায় পড়ে বৃষ্টি। দেখতে দেখতে ঝড়ের কশাঘাতে ক্ষেপে ওঠে শান্ত গ্রাম্য নদী। দুই তীর ছাপিয়ে নদীর জল কুল্ কুল্ রবে ছুটতে আরম্ভ করে গাঁয়ের দিকে। ডুবে যায় শস্যক্ষেত, প্রান্তর। অদৃশ্য হয়ে যায় লতা-গুল্ম। প্রমত্ত ঝড় একটি একটি করে, সমস্ত পাতা ছিঁড়ে উপড়ে ফেলে গাছ থেকে, ভেঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চাল,···মাথায় হাত দিয়ে ছাদহীন ঘরে বসে বসে ভেজে গৃহস্থরা, নিভে যায় উনুন, ভেঙ্গে পড়ে মাটির দেয়াল, এক হয়ে যায় নদ-নদী, মাঠ আর ঘাট, ঘর আর উঠান; কুকুর, মুরগী, ছাগল, মানুষ, একই অবস্থায় একই ভাবে ঝড়ের নির্দয় খেলার পুতুল হয়ে বসে থাকে।

 সারাদিন, সারা রাত ধ’রে সমানে চল্‌লো সেই ঝড় আর বৃষ্টি। তার পরের দিন দুপুর পর্যন্ত···

 তখন একটু একটু ক’রে ঝড়ের বেগ কমে আসে। কিন্তু বৃষ্টি থামে না। তবে তারও মাত্রা কমে আসে। ঝির ঝির করে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি সমানে তখনও ঝরতে থাকে।

 মাঠে আর মাটিতে চারিদিকে ছিল যে-সব উঁচু-নীচু রেখা, অথই জলের মধ্যে ডুবে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সব। আনন্দে গান গেয়ে ওঠে শুধু ব্যাঙের দল। রীতিমত কোরাস্।

 সন্ধ্যের দিকে বৃষ্টি থেমে আসে। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ আবার থেমে যায়। কখন যে গোধূলি এলো গেল, তা কেউ জানতে পারে না। একেবারে নেমে আসে রাত্রির অন্ধকার।

 বাতোয়ালা গালে হাত দিয়ে ভাবে, সামনের গান্‌জার উৎসব তবে কি এইরকম বৃষ্টির জলে ভেসে যাবে?

 দেখতে দেখতে আকাশে ভাঙ্গা চাঁদ পুরো হয়ে এলো। এলো উৎসবের রাত। গান্‌জার উৎসব শুরু হয়ে গেল।

 বরাৎ ভাল, হপ্তাখানেক হল গ্রিমারী[] ছেড়ে কমাণ্ডার বাইরে চলে গিয়েছে। বাড়ী থেকে বেড়াল দূর না হলে, ইঁদুররা নিশ্চিন্তে কি করে খেলতে বেরোয়? বামুন গেল ঘর, তো লাঙ্গল তুলে ধর! তাই তারা সবাই ছুটলো কমাণ্ডারের অফিসের সামনের মাঠে। সারা গাঁয়ের মধ্যে এমন সুন্দর আর এত বড় খোলা জায়গা আর একটিও নেই। গান্‌জার সময় যে যুদ্ধের নাচ হবে, এমনি বড় জায়গা না পেলে কি করে তা হবে?

 কমাণ্ডারের বাংলো থেকে বাম্বার তীর পর্যন্ত এই মাঠ চলে গিয়েছে। কমাণ্ডারের বাংলোর পাশেই তাঁর অফিস, সামরিক তাঁবু আর ফাঁড়ি। রক্ষী হিসাবে আছে মাত্র একজন সৈনিক, বুড়ো বৌলা। বৌলা মাইডিয়ার লোক, তাকে ভয় করবার কিছুই নেই।

 পুরো দমে চলে উৎসবের আয়োজন। নাচের সঙ্গীতের জন্যে পর পর বারোটা জায়গায় বারোটা লিংঘা বসানো হয়েছে। পুরানো পোকায় কাটা যন্ত্র নয়···গান্‌জার জন্যে তৈরী নতুন বাদ্য-যন্ত্র···কাদা আর ময়দা আর রঙ গুলিয়ে প্রত্যেকটিকে চিত্র-বিচিত্র করা হয়েছে।

 মাঠের একধারে নানারকমের সব খাদ্য ঝুড়ির পর ঝুড়ি সাজিয়ে রাখা হলো—কোন ঝুড়িতে ভুট্টার খই, কোনটাতে সবজীর পিঠে, কাঁদি কাঁদি কলা, বুনো টমাটো, বড় বড় মাটির ডিস ভর্তি শুঁয়ো পোকা, ডিম, মাছ। আগে থাকতেই চাঁই চাঁই হরিণ আর হাতীর মাংস রোদে শুকিয়ে আর আগুনে পুড়িয়ে তৈরী করে রাখা হয়েছিল। বুনো ষাঁড়ের আস্তো ঠ্যাং আগুনে সেঁকে ঝুলিয়ে রাখা হলো। সেই সঙ্গে মজুত রইলো ঝুড়ি ঝুড়ি নানা রকমের বুনো আলু, শাদা চামড়াওয়ালারা এ-সব আলু মুখে তোলে না! তার স্বাদ জানবে কি করে! একপাশে বড় বড় মাটির কলসীতে মুখ পর্যন্ত ভর্তি করে রাখা হলো তাদের নিজের হাতে চোলাই–করা মদ। আয়োজনকে সম্পূর্ণ করবার জন্যে বাতোয়ালা কয়েক বোতল বিদেশী মদও জোগাড় করে রাখতে ভুললো না। অবশ্য, সে-বোতলগুলো মজুত রইলো শুধু বড় বড় সর্দার আর পঞ্চায়েতের মাথাদের জন্যে। আয়োজন দেখে সবাই বুঝলো, গান্‌জা জমবে ভাল।

 মাঠের চারদিক থেকে কাঁচা কাঠের আগুনের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী লক্ষ্য করে দূর দুরান্ত গাঁ থেকে তারা আসতে আরম্ভ করে ছেলে, বুড়ো, যুব, যুবতী, কুলী, মজুর, এমন কি তাদের সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ের কুকুরগুলোও পিছু পিছু চলে।

 তাদের “কাগা” ছেড়ে, জঙ্গল ছেড়ে, বুনো জলা ছেড়ে, দলে দলে তারা আসতে আরম্ভ করে···তারা আসছেই আসছে···হাতে বর্শা, পিঠে···ধনুক দলের মোড়লদের হাতে একটা করে জ্বলন্ত কাঠ···বনের অন্ধকারে সেই জ্বলন্ত কাঠের মশালে পথ দেখে দেখে তারা এগিয়ে চলে···

 মেয়েরা এসেই ভোজের আয়োজনে যোগদান করে। বড় বড় কাঠের জাঁতায় তারা গম আর বুনো ভুট্টা পিষতে সুরু করে দেয়। পেষবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই মিলে শুরু করে দেয় গান।

 এক এক কলি গান শেষ হয় আর হাসির হর্‌রা ওঠে। হাসতে হয় বলে তারা হাসে। কথা বলতে হবে বলে তারা কথা বলে, তা সে কথার কোন মানে থাক আর নাই থাক। ক্রমশ তাদের হাসি আর কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, চোলাইকরা ‘কেনে’র কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। যে যখন পাড়ছে, ভাঁড় ভর্তি করে গলায় ঢালছে।

 দেখতে দেখতে মাঠ ভরাট হয়ে ওঠে। ম্‌বিসেরা এসেছে, নাংগাপুরা এসেছে, ডাকারা এসেছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে এসেছে তাদের মোড়লরা।

 সর্দাররা মাঠের মাঝখানে একটা জায়গায় গোল হয়ে সকলে একসঙ্গে বসেছে। বাতোয়ালার বুড়ো মা-বাপ সর্দারদের সঙ্গেই বসেছে।

 কথাবার্তা হচ্ছে···

 বাংগুইতে নাকি কারা জনকয়েক শাদা লোককে মেরে ফেলেছে···

 গভর্ণর সেইজন্যে শিগগিরই বান্‌ডোরোতে যাবে···

 ফ্রান্সে কোথায় নাকি ম্‌-পুতু বলে জায়গা আছে, সেখানে শাদা জার্মাণদের সঙ্গে তাদের শাদা মনিবদের লড়াই হচ্ছে···

 কথার সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে হাতে হুঁকো চলে কোন কল্‌কেতে গাঁজা···কোন কল্‌কেতে তামাক···

 হুঁকোতে বেশ ভাল করে গোটাকতক টান দিয়ে পাঙ্গাকৌরা বলে ওঠে, শুনছো বাতোয়ালা তোমাকে একটা কথা বলি শোন! এই আমি বাইরে ক্রেবেজি শহর থেকে ঘুরে আসছি! বাইৱে ঘুরে বেড়ালে অনেক নতুন জিনিস শেখা যায়। তোমরা ভাব, শাদা লোকগুলো বুঝি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে না···আরে ছোঃ! মোটেই তা নয়। শোন, একটা ব্যাপার বলি,— নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

 ···একজন পর্তুগীজের বিরুদ্ধে আমার নিজের নালিশ নিয়ে কমাণ্ডারের সঙ্গে দেখা করি। কমাণ্ডারকে আমরা নাম দিয়েছি কেতোয়া, জালার মতন এই বড় তার পেট! কমাণ্ডারকে আমার অভিযোগের কথা জানালাম, অবিশ্যি একটু আধটু এ-দিক ও-দিক করেই বলতে হলো। মনে মনে ভাবছি, হাজার হোক পর্তুগীজরা হলো শাদা চামড়া, আমার কথা কি কমাণ্ডার শুনবে? আরে, শোন ব্যাপার, কমাণ্ডার কি বল্লো জানো? আমাকে ডেকে বললো, পাঙ্গাকৌরা, তুমি হচ্ছো যাকে বলে অপদার্থের অপদার্থ! তোমার মত মূর্খ আমি আর একটিও দেখিনি! তুমি কি জান না যে, পুর্ত্রিকিস্‌দের আমরা থোড়াই কেয়ার করি? পুর্ত্রিকিস্‌ আবার মানুষ নাকি! শোন তাহলে বলি। শাদা লোকদের যিনি ভগবান, তিনি যখন মানুষ তৈরী করতে বসলেন, তখন হাতের কাছে যত সব ভাল জিনিস পেলেন তাই দিয়ে তিনি আমাদের তৈরী করলেন। সমস্ত ভাল জিনিস যখন ফুরিয়ে গেল, তখন যে-সব ময়লা আর নোংরা জিনিস পড়েছিল, তাই দিয়ে তখন তোমাদের মতন ডার্টী নিগারদের তৈরী করলেন। এইভাবে ভালমন্দ সব জিনিসই যখন ফুরিয়ে গেল, তখন ভগবানের নজর পড়লো এই পুর্ত্রিকীস্‌দের তৈরী করার ওপর! তখন আর কি দিয়ে তৈরী করবেন? অগত্যা নিগ্রোদের পরিত্যক্ত মল-মূত্র থেকে তিনি পুর্ত্রিকীস্‌দের তৈরী করলেন। বুঝলে এখন?”

 পাঙ্গাকৌরার অভিজ্ঞতার গল্পে সবাই অট্টহাস্য করে ওঠে।

 বাতোয়ালা জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, রবারের দাম যে এই রকম পড়ে গিয়েছে, তাতে কি মনে কর, আমাদের কোন সুবিধে হবে?

 পাঙ্গাকৌরা বলে, তার জন্যেই তো আজ আমরা নিশ্চিন্তে এই উৎসবে জমায়েত হতে পেরেছি। শাদা লোকগুলো সব ছুটছে রবার কিনতে। আমাদের কিনতে হলে যেখানে পাঁচ ফ্রাঙ্ক দিতে হয় সেখানে শাদা লোকগুলো তার দশ ভাগেরও কম দাম, দেয়।

 ইয়াকিজী বলে ওঠে, তুমি ঠিক করেছে। বাতোয়ালা! বাধ্য হয়েই এখন ব্যবসায়ী বেটারা সব ক্রেবেজীতে গিয়ে ধন্না দিয়েছে!

 কে একজন বলে ওঠে, ব্যাটারা কবে মরবে? বুক পর্যন্ত কাদায় ডুবে, মুখ হাঁ করে কবে মরবে বেটারা?

 কে একজন উত্তর দিয়ে ওঠে, তার জন্যে ভাবনা কি! দেখছো না, বন্দুকওয়ালা শাদা সেপাইগুলো জাহাজ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে···শাদা জার্মাণদের সঙ্গে আমাদের শাদা মনিবদের বোধ হয় ঝগড়া বেঁধে গিয়েছে!

 —হাঁ, হাঁ···যত বেটা বুলেটওয়ালা, দেখছো না চলে যাচ্ছে। ওদের দেশের ম্-পুতু শহরে যুদ্ধ হচ্ছে!

 —বোধহয়, আমাদের এখানকার কর্তাদেরও যেতে হবে।

 বাতোয়ালার বৃদ্ধ পিতা সায় দিয়ে ওঠে, ইয়াবায়ো! আমাদের এই গাঁ আর নদী যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি হবে তোমার কথা!

 একজন বৃদ্ধ সর্দার প্রতিবাদ করে ওঠে,—এখানকার ফ্রেঞ্চগুলোকে দেখলে কি মনে হয় যে তারা এদেশ ছেড়ে চলে যাবে? মোটেই না! আরে, সেখানে গেলে বিপদ আছে! কেন সেখানে এরা মরতে যাবে? নিজের চামড়া সবাই বাঁচাতে চেষ্টা করে?

 তার কথায় সবাই আবার হেসে ওঠে।

 —ঠিক বলেছ বুড়ো সর্দার! তোমার কথা মিথ্যে হয় না। কিন্তু আমার কি ইচ্ছে জানো? জার্মাণরা যেন এই ফ্রেঞ্চদের বেশ করে হারিয়ে দিতে পারে! বেশ উত্তম-মধ্যম দেয়!

 বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তুমি তো বলছো বটে ইয়াবাদা, কিন্তু জার্মাণই হোক আর ফ্রেঞ্চই হোক, তারা সবাই সাদা! তাহলে, একজনের বদলে আর একজনকে চেয়ে কি লাভ? আমরা ফরাসীদের পায়ের তলায় পড়ে আছি। একটা সুবিধে, অনেকদিন একসঙ্গে থেকে তাদের ভালটা যেমন জানি, তাদের মন্দটাও তেমনি। নিয়ু যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলা করে, তারা আমাদের নিয়ে তেমনি খেলা করবেই!

 ইয়াবাদা জবাব দেয়, শুধু খেলা করতে তো কিছু যায় আসে না। নিয়ুর খেলা যে বড় সাংঘাতিক, খেলার পরিণাম হল, খেয়ে ফেলা, নিয়ু ইঁদুর নিয়ে খেলতে খেলতে ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।

 বৃদ্ধ হেসে বলে, সুতরাং আমাদের যখন খেয়েই ফেলবে, মরতেই যখন আমাদের হবে, তখন যে-নিয়ু আছে, তার বদলে নতুন নিয়ু এলে আমাদের কিছুই লাভ হবে না।

 অন্য আর একজন সমর্থন করে,—বুনো ষাঁড়ের শিং থেকে ক্ষেপা নেকড়ের মুখে গিয়ে পড়া!

 সকলেই বৃদ্ধকে সমর্থন করে ওঠে।

 —“বুড়ো সর্দার ঠিকই বলেছে। মনিব বদল করে কি লাভ? বদলে যে মনিব আসবে, সে হয়ত আরো খারাপ হবে!”

 সকলেই আলোচনায় যোগদান করে।

 “—ওরা আমাদের একটুও ভালবাসে না।”

 —ওরা যেমন আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করে, আমরাও ঠিক সেইরকম করবো!

 —ওদের খুন করে মেরে ফেলা উচিত!

 —ঠিক বলেছো!

 —একদিন, আজ না হোক, দুদিন পরে, আমরা—

 —হাঁ, আমরা, বান্‌জিরি, ইয়াকোহামা, গৌব, সাংবা, ডাক্‌বা বিভিন্ন সম্প্রদায়, নিজেদের মধ্যে পুরানো ঝগড়া, দলদলি আর রেষারেষি ছেড়ে দিয়ে, সকলে মিলে যখন এক হব···তখন···

 এই ক্রমবর্ধমান উচ্ছ্বাসের স্রোতে বাধা দিয়ে একজন বলে ওঠে, তখন বাম্বা উল্‌টো দিকে···তার আগে আর আমরা এক হতে পারবো না···

তাকে সমর্থন করে আর একজন বলে ওঠে, তখন মাছ-ধরার হাঁড়িতে মাছের বদলে আকাশের চাঁদ ধরা পড়বে!

 সকলে আবার হেসে ওঠে। এবং এতক্ষণ ধরে সবাই মিলে এতই হাসতে থাকে যে, দূরের একটা আওয়াজ তাদের কানেই এসে পৌঁছয় না।

 বাতোয়ালা তখন ‘কেনে’তে টই-টুম্বুর। নেশায় দুই চোখ লাল হয়ে উঠেছে। উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে ওঠে, হয়, তোমরা সবাই কুকুরের বাচ্ছা, না হয়, তোমরা আমার চেয়ে ঢের বেশী মদ খেয়েছো। আমি জানতে চাই, তোমরা মানুষ কি না? মানুষের বাচ্ছা কি না? তোমাদের ছেলেবেলায় কি দেবতার নামে ওঝারা তোমাদের লিঙ্গচ্ছেদ করে নি? আলবৎ করেছে! তবে? আমার কথা হচ্ছে, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, শাদা চামড়াকে কিছুতেই ভুলবো না!

 নেশার প্রেরণায় বাতোয়ালার মনের বাঁধন খুলে যায়। সে বলতে সুরু করে,—আমার মনে আছে, একদিন নিউবাংগুই নদীর ধারে, বেসোকেমো আর কেমো-আউদার মাঝখানে বিরাট জায়গায় ম্-বিস্‌রা কি সুখে, কি শান্তিতে বাস করতো···তারপর যেই এল শাদা লোকগুলো, অমনি ঘর-বাড়ী ছেড়ে, বাপ-পিতামোহের ভিটে ছেড়ে দলে দলে আমাদের সরে পালিয়ে আসতে হল; সঙ্গে মুরগী, ছাগল, হাঁড়ি-কুঁড়ি, ঠাকুর-দেবতা, ছেলেপুলে, স্ত্রীলোক সব নিয়ে পালিয়ে আসতে হল। হাঁ, আমার স্পষ্ট মনে আছে···যদিও তখন আমি বালক মাত্র।

 আমরা সরে এসে ক্রেবেজ শহরের আশে-পাশে এসে বসলাম। কিন্তু সেখানেও এলো বাধা। অনেক হলো লড়াই।  তারি মধ্যে নতুন করে ঘর বেঁধে, মাটি চষে বেঁচে রইলাম কোন রকমে কিন্তু শেষকালে ক্রেবেজও নিয়ে নিল শাদারা।

 আবার সেখান থেকে সরতে হলো! হাঁটতে হাঁটতে গ্রিকো-তে এসে পৌঁছলাম। পছন্দ হলো জায়গাটা। গ্রিকোতেই আবার ঘর বাঁধলাম। কম হাঙ্গামা? সেই নতুন করে আবার সব গড়তে হলো।

 ভাবলাম, এবার হয়ত শান্তিতে থাকতে পারবো। হায়, তা কি হয়? সেখানেও তারা ঘাড়ে এসে পড়লো···মার, ধোর, আগুন, গুলী···

 আবার, তল্পি-তল্পা নিয়ে পালাতে হলো···

 গ্রিমারি! অবশেষে গ্রিমারীতে এসে পৌঁছলাম। বাম্বা আর পোম্বার মাঝখানে একটা ভাল জায়গা দেখে আবার ঘর-বাড়ী তুল্লাম···

 ঘর-বাড়ী তৈরী শেষ হতে না হতেই এখানেও ঘাড়ে এসে পড়লো নেকড়ের দল···

 আর কতক্ষণ যোঝা যায়! মন ভেঙ্গে পড়েছে সকলের। একটু একটু করে জাতের অধিকাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার মতন হয়েছে। তাই, আর গ্রিমারি থেকে নড়তে পারলাম না···শাদা চামড়ার শাসন মেনে নিয়ে এখানেই পড়ে রইলাম ··যতদূর পারা যায়, তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে···নইলে জাতটা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়!

 দূরে যে শব্দ হাসির মধ্যে শোনা যায় নি, ক্রমশ সেটা যেন আরো কাছে আসতে থাকে।

 “কিন্তু আমরা যে এই বশ্যতা স্বীকার করে নিলাম, তাতে কি তারা আমাদের ওপর খুশী হলো? তাদের মন পেলাম না তাতেও। আমাদের আচার-অনুষ্ঠান তো সব বন্ধই করে দিয়েছে, বাপ-পিতামোর আচার-অনুষ্ঠান! কিন্তু তাতেও তারা সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় তাদের আচার-অনুষ্ঠান আমাদের ঘাড়ে চাপাতে! যখন খুশী যা আদেশ দেবে, তা মানতেই হবে। হুকুম হলো টাকা-পয়সা নিয়ে “পাতারা” খেলতে পারবে না! আমাদের নাচ-গান শুনলে তারা চটে যায়, তাদের সামনে নাচগান চলবে না! তবে, হাঁ, যদি পয়সা দিই, তা হলে তারা অনুমতি দিতে পারে! অতএব, পয়সা দাও! অনবরত, খাজনা দাও, আর খাজনা দাও! তাদের সিন্দুক ভর্তি আর হয় না।

 যদি এই হতভাগা শাদা জাতের লোকগুলোর মধ্যে কোন মতিস্থির থাকতো কিম্বা তাদের কথাবার্তার মধ্যে কোন বিচার–বুদ্ধি থাকতো, তা হলে না হয় কোন রকমে তাদের মেনে চলা যেতো। কিন্তু তাদের কথাবার্তা কিম্বা কাজ-কর্মের মধ্যে কোন সঙ্গতিই নেই। এই তো দু’ চাঁদ আগেকার ঘটনা, ঐ বুনো জানোয়ার, ঔরো, মদ খেয়ে নেশা করে তার ইয়াসীটাকে কুকুর–ঠেঙ্গানো ঠাঙ্গালো, এমন মার মারলে যে মেয়েটা হাড়-গোড় ভেঙ্গে তাল হয়ে পড়ে রইলো!

 কিন্তু সেটা এমন কি একটা সর্বনেশে কাণ্ড? আমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে বলতে পারে, তার ইয়াসীকে কখনো মারে নি?

 বোকা মেয়েটা সোজা গিয়ে কমাণ্ডারের কাছে নালিশ করে দিলো। তখন হবি তো হ', কমাণ্ডার তার শাদা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। সাধারণত লোকটা ঠাণ্ডা মেজাজেরই লোক কিন্তু সেদিন কি যে হলো, ভীষণ রেগে গেল। একজন দেশী পুলিশকে ডেকে হুকুম দিলো, তক্ষুণি ঔরোকে ধরে নিয়ে কারাগারে বেঁধে রাখতে। লোকটা হুকুম তামিল করতে একটু ইতস্তত করে, তাই না দেখে, কমাণ্ডার তার হাতের কাছের একটা খালি মদের বোতল তুলে সোজা তার মাথায় বসিয়ে দিলো। ব্যাপার দেখ! মাথা কেটে চাপ চাপ রক্ত বেরুলো, লোকটা বেহুঁস হয়ে সেইখানেই পড়ে গেল। আর তাই না দেখে, শাদা লোকগুলো হেসে কুটি-কুটি, যেন কি মজাই না হয়ে গেল!

 এই তো ব্যাপার, ওদের কাছ থেকে আমরা সব বিষয়েই এইরকম ব্যবহার পেয়ে আসছি। আমার কথা যে কতখানি সত্যি, তা যদি নিজের চোখে দেখতে চাও ইয়াবাদা, তা হলে কমাণ্ডার যাতে দেখতে পায়, এমনি কোন জায়গায় বসে ‘পাতারা’ খেলায় তুমি দুটো ফ্রাঙ্ক ফেলে দেখ···তা হলেই দেখতে পাবে···খুব কম শাস্তি যদি হয়, তা হলে হাতে-পায়ে বেড়ী! জুয়ো খেলবে শুধু শাদা চামড়ার লোকেরা···”

  1. পাঠকদের অবগতির জন্যে স্পষ্ট করে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা লেখকের মত বা সিদ্ধান্ত নয়। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা যে-ভাবে এই প্রশ্নকে দেখে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই তাদের কথাই এখানে বলা হয়েছে।
  2. চাঁদ।
  3. বাতোয়ালাদের গাঁয়ের নাম, স্থানীয় ফরাসী শাসনকর্তার হেডকোয়ার্টার।