এরাও মানুষ/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
বনের ভেতর, দুধারে ঘন-ঝোপ, তার মধ্যে দিয়ে সরু পথ। ঠাণ্ডা, শিশির ভেজা। চারদিক থেকে উঠছে একটা ভিজে মিষ্টি গন্ধ···বুনো লতার গন্ধ···পায়ের চাপে নরম কচি ঘাসের গন্ধ। পাতায় পাতায় শিহরণ জাগিয়ে দ্রুত বয়ে চলেছে বাতাস। বাইরে প্রান্তরে বিন্দু বিন্দু গলে পড়ছে কুষাশা···টুপ টাপ। উদয়-সূর্যের দিকে চেয়ে জেগে উঠছে ছোট ছোট গ্রামগুলি, জেগে উঠছে তাদের ঘিরে ঘুমিয়েছিল যে সব ছোট ছোট পাহাড়। প্রভাত এসেছে।
একটু একটু করে দেখা দেয় ধোঁয়া···আসে-যায় টুকরো টুকরো শব্দ···কে কাকে ডাকছে, বাতাসে আসে তার ছেঁড়া ছেঁড়া আওয়াজ···সে আওয়াজ বহন করে আনে জেগে-ওঠার সংবাদ···প্রভাত!
বনেতে জেগে উঠেছে হরেক রকমের পশু···ঝোপের আড়ালে আড়ালে ঘুরছে খাদ্যের অন্বেষণে···ভক্ষিত হবার ভয়ে আবার কেউ কেউ ঢুকেছে যে-যার গর্তে···সেখানে অপেক্ষা করে থাকবে রাত্রির অন্ধকারের জন্যে। মানুষের রাত্রি এলে, আসবে তাদের জেগে-ওঠার লগ্ন···তখন তারা আবার বেরুবে খাদ্যের অন্বেষণে। খাদ্য আর খাদক···অরণ্যে আছে শুধু এই একটি সম্পর্ক।
এমন দিনে কালো নিগ্রোর দল যে-যার অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ে অরণ্যে শিকারের খোঁজে। অরণ্যের মধ্যে তারা হয়ে যায় অরণ্যের সামিল। তারা জানে, শিকার খোঁজাই হলো শিকারের আনন্দ। যারা বীর, তাদের একমাত্র খেলা। বনের পশু আর গাঁয়ের মানুষের লড়াই···যার শক্তি বেশী সে থাকবে বেঁচে।
বিপদ? প্রচুর আছে বিপদ। বিপদ আছে বলেই শিকারের এত দাম। যুদ্ধ করবার আগে তাই শিখতে হয় শিকার করতে; যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে হলে, আগে হতে হবে শিকারী। এই অরণ্যে দুরন্ত বুনো পশুর সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই-এ মানুষ শেখে আত্মরক্ষার হাজার রকম কায়দা, শেখে ধৈর্য, পায় সাহস, আঘাত দেবার আর আঘাত নেবার অভ্যাস।
বনের পথে ভিজে ঘাস মাড়িয়ে চলেছে বিসিবিংগুই আর বাতোয়ালা। শিকারে। তাদের মনের মধ্যে চলেছে তখন আর এক শিকারের তাগাদা। কে আজ কাকে করবে শিকার।
প্রতিহিংসা আগুন, যে-আগুন নেভে না কোন জলে। তাকে নেভাতে হলে, দরকার রক্তের। নইলে সে-আগুন তোমাকেই দেবে জ্বালিয়ে ছাই করে। মনের ভেতর সেই জ্বলন্ত আগুনের শিখা নিয়ে তা আজ চলেছে শিকারে।
একজন চলেছে এগিয়ে, আর একজন চলেছে তার পেছনে। তার পেছনে চলেছে জুমা।
মাঝে মাঝে চলতে চলতে তাদের সঙ্গে দেখা হয় অন্য সব শিকারী-দলের। বাতোয়ালাকে দেখে, সর্দার বলে তারা অভিবাদন জানায়। অপেক্ষা করে থাকবার সময় নেই। সামনে ঝোপে কোথায় ওঠে একটা ঘস্ ঘস্ শব্দ···কান খাড়া করে তারা সেই দিকে ছোটে। সবাই এগিয়ে চলেছে বনের বুকের দিকে, বন্যপশুদের আড্ডার দিকে। সেখানে সকলে একত্র হয়ে ব্যবস্থা ঠিক করে নেয়। এক এক দলের ওপর, এক এক রকম কাজের ভার পড়ে। কেউ রাখে লক্ষ্য, কেউ মাটিতে খুঁজে বার করে বুনো জন্তুদের পায়ের দাগ, কারুর ওপর ভার পড়ে আগুন জ্বালাবার। খুব অল্প লোকই আসল শিকারে নিযুক্ত হয়···উদ্যত বর্শা হাতে বুনো বাঘকে তাড়া করে ছোটে।
দিন বেড়ে ওঠে। নানাদিক থেকে, নানা পথ বেয়ে তারা এসে জড় হয় নদীর ধারে। নদীর ওপারে আসল জঙ্গল। সেই জঙ্গলে শুরু হবে শিকারের খেলা।
তার আগে, তারা নদীর ধারে সকলে একত্র হয়ে বসে। শিকারের দিন হলো উৎসবের দিন। প্রত্যেকের সঙ্গে কিছু না কিছু খাদ্য থাকে। শিকারে ছোটবার আগে, তারা দেহকে সবল করে নেয়। সকলে মিলে গোল হয়ে খেতে বসে। খাবার সময় হয় মজাদার সব গল্প। শিকারের গল্প। পূর্ব-অভিজ্ঞতার গল্প। বুনো জন্তুদের রীতি-নীতি, অভ্যাসের নানান রকম গল্প···
“লোকের ভুল ধারণা যে বামারা–রা সিংহ, দল বেঁধে শিকারের খোঁজে বেরোয়···”
“অবিশ্যি, সিংহ আর সিংহিনী স্বামী-স্ত্রীতে এক সঙ্গেই অনেক সময় শিকারের সন্ধানে বেরোয়। তবে সিংহিনী যখন বাচ্ছা প্রসব করে তখন আর সে শিকারে বেরোতে পারে না···নিজের ঘরে তখন সে বাচ্ছাদের নিয়ে স্তন্যদান করে, স্বামীর ওপর ভার পড়ে সংসারের জন্যে মাংস শিকার করে নিয়ে আসবার।”
“তবে সিংহিনীও ছেলেপুলে নিয়ে খুব বেশীদিন আটক পড়ে থাকে না। যেই দেখলো বাচ্ছারা মজবুত হয়ে উঠেছে, তখনি স্বামী-স্ত্রী বাচ্ছাদের ডেকে নিয়ে সোজা বনের পথ দেখিয়ে দেয়। বাচ্ছারা তখন বাপ-মার কথা ভুলে বনের মধ্যে নিজেদের পথ নিজেরাই করে নিতে বেরিয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রীতে পাশাপাশি একসঙ্গে আবার তারা তখন শিকার করতে বেরোয়।”
“কারুর কারুর ধারণা যে, শিকারের সময় সিংহ গর্জন করে। ভুল! সম্পূর্ণ ভুল ধারণা! আরে, একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, তুমি যখন বর্শা হাতে হরিণের পেছনে ছোট, তখন কি তত শব্দ করো? যত চুপি চুপি যেতে পার তত ভাল। তবে সিংহ কেন গর্জন করবে? সে কি এমন মূর্খ যে, আগে থাকতে গর্জন করে, সমস্ত পশুদের আগে থাকতে সতর্ক করে দেবে? তা কি কখনো কেউ করে? তবে, হাঁ, সিংহ গর্জন করে, কখন? যখন তার আনন্দ হয়। যখন নিহত পশুর বুক চিরে সমস্ত থাবা রক্তরাঙা করে তোলে, তখন আনন্দে সিংহ গর্জন করে ওঠে!”
শিকার আরম্ভ হবার আগে নদীর ধারে সকলে একত্র জটলা করে বসে। খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে চলে গাল-গল্প। শিকারের গল্প।
ক্রমশ মাথার ওপরে সূর্য ঠিক মাঝ-আকাশে এসে পৌঁছায়। এমন সময় বনের চারদিক থেকে ওঠে গুর্ গুর্ গুম্ গুম্ আওয়াজ। বাজনদার-রা শুরু করে তাদের কাজ। বাজনার শব্দে বনের পশুদের বিভ্রান্ত করে তোলা হলো তাদের কাজ।
কিছুক্ষণ পরেই নদীর ওপারে বনের ধার থেকে ওঠে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সারা বনকে বেড়ে তারা শুকনো ঝোপে লাগিয়ে দেয় আগুন।
এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসে বাতাসে অসংখ্য কণ্ঠে আওয়াজ, ইয়াহো!
ইয়াহো! শিকার আরম্ভের সঙ্কেত।
সেই শব্দ, সেই বাজনা, আর সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী জানিয়ে দেয়, শিকারের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত।
ইয়াহো।! নদী পেরিয়ে বর্শা হাতে ছুটে চলে আসল শিকারীর দল। রোদে ঝিক্মিক্ করে ওঠে কোমরের ছোরা।
ইয়াহো! তৈরী হয়েছে বন···হয়েছে সময়···এইবার শিকারের পেছনে যে-পারে সে ছুটবে···সমস্ত অরণ্য এখন মুক্ত শিকারীদের জন্যে···যার হাতের বর্শায় আছে জোর···শিকার তার।
দেখতে দেখতে সমস্ত বনকে ঘিরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে ধোঁয়া···ধোঁয়ার রঙ একটু একটু করে হয়ে আসে ফিকে···তারপর লক্ লক্ করে হাজার জিহ্বায় জ্বলে ওঠে দাবানল···সমস্ত বনকে ঘিরে জ্বলে ওঠে অগ্নি-বলয়···সে-অগ্নির আতঙ্কে পশুরা বিবর ছেড়ে ছুটতে আরম্ভ করে···দগ্ধ হয়ে যায় সাপেরা···ঝোপের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পড়ে শাবকদের নিয়ে সিংহিনী···পুড়ে ছাই হয়ে যায় লতা-গুল্ম, তৃণ-কণ্টক।
এই আগুন না হলে হয় না শিকারের উৎসব। শিকারকে উপলক্ষ্য করে অরণ্যকে দগ্ধ করার মধ্যে শুধু যে পশুদের আতঙ্কিত করাই উদ্দেশ্য, তা নয়; এর সঙ্গে সংযুক্ত আদিম অরণ্যবাসীদের জীবন-যাত্রা-চক্র। এইভাবে অরণ্যকে দগ্ধ করে আগুন মাটিকে করে উর্বর, দগ্ধ লতা-গুল্মের ভস্মে মাটি পায় তার প্রয়োজনীয় আহার্য। শিকারের উৎসবের পরেই আসে জমি-চযার উৎসব। দগ্ধ মাটির ওপর চলে হলকর্ষণ। জন্মায় শস্য। এইভাবে শিকারের এই বার্ষিক উৎসবের সঙ্গে গাঁথা তাদের জীবন-যাত্রা-চক্র।
তাই আগুন হলো এই অরণ্যচারী মানুষদের বন্ধু। তাদের শিকারের সহায়, সঙ্গী। তাদের অন্নদাতা। অন্ধকার নিষ্প্রদীপ ঘন তামসী রাত্রে তাদের ভয়ত্রাতা। শীতের কুহেলি-আচ্ছন্ন রাত্রে তাদের নগ্ন নিরাবরণ দেহের উত্তাপ-রক্ষক।