এরাও মানুষ/প্রথম পরিচ্ছেদ

প্রথম পরিচ্ছেদ

 প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘরের ভেতর যে আগুনের কুণ্ড জ্বালা হয়, সারারাত্রি ধ'রে জ্বলে জ্বলে তা নিভে এসেছে এখন। পড়ে আছে শুধু স্তুপাকার অর্দ্ধদগ্ধ কাঠ-কয়লা, আর ভস্ম, তখনও গরম। ভেতরকার মেটে গোল দেয়াল গরমে ঘেমে উঠেছে। সামনের গর্তের ভেতর দিয়ে একফালি অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে। সেই গর্ত ই হ’ল ঘরের দরজা। খড়ো চালের ভেতর থেকে অনবরত উঠছে একটা খস্ খস্ শব্দ······উইপোকার চলাফেরার শব্দ।

 বাইরে ডেকে ওঠে মুরগীগুলো। তাদের কিরিকিরি আওয়াজের সঙ্গে মিশে যায় ছাগল ছানাদের ডাক··· ঘুম ভেঙ্গে তারা তাদের মায়েদের খুঁজছে। ক্রমশ ডাকতে সুরু করে দেয় লম্বা-ঠুঁটো পাখীগুলো···। তাদের মিলিত কলরবের পেছনে, পাম্বা আর বাম্বার তীরে ঘন সবুজ বন থেকে আসে বাকাউয়ার কর্কশ চীৎকার···আফ্রিকার বুনো বাঁদর, কুকুরের মতন মুখের চোয়াল।

 এই অঞ্চলের প্রধান বাতোয়ালা, তখনও ঘুমের নেশায় আচ্ছন্ন বিছানায় শুয়ে আছে···শেষ ঘুমের ভেতর থেকে স্পষ্ট শুনতে পায় এই সব পরিচিত আওয়াজ। আশে-পাশে পাঁচখানা গাঁয়ের সে ‘মুকুন্দজী’, মোড়ল।

 বিছানায় শুয়েই সে হাই তোলে, এ-পাশ ও-পাশ পাশমোড়া দেয়, হাত-পাগুলো টেনে ঠিক করে নেয়; ভেবে ঠিক করে উঠতে পারে না, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়বে, না আবার আর এক পাল্টা ঘুমিয়ে নেবে।

 ওঠো, জাগো নাকৌরা! কিন্তু কেনই বা উঠতে হবে?

 সে ভাবতেও চায় না···সোজাই হোক্ আর জটীলই হোক্ ভাবনা-চিন্তার ধার সে ধারে না।

 হাঁ, উঠতে তো হবেই কিন্তু ওঠা বল্লেই তো ওঠা হয় না। তার জন্যে রীতিমত খানিকটা মেহনৎ তো করতে হবে! অনেকখানি চেষ্টা। উঠতে হবে, শুনতে খুব সোজাই মনে হয়। কিন্তু তাকে কাজে পরিণত করা রীতিমত একটা কঠিন ব্যাপার···কেননা, সে জানে, আজ তার কাছে জেগে ওঠা মানেই হলো কাজ করা···অন্তত শাদা-চামড়ার লোকগুলো সেই কথাই তাদের শিখিয়েছে।

 কাজ করতে তার যে বিরক্ত লাগতো কোনদিন, তা নয়। পরিশ্রম করবার মতই তার শক্ত দেহ, নিরেট, নিটোল; লম্বা চওড়। বলিষ্ঠ সব পেশী; তার মতন হাঁটতে, ছুরি চালাতে, কুস্তি করতে খুব কম লোকই পারে।

 বাণ্ডাদের সেই বিরাট দেশের একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত পর্যন্ত লোকের মুখে মুখে তার অদ্ভুত শক্তির আশ্চর্য সব কাহিনী রূপকথার গল্পের মতন ইতিমধ্যেই ঘুরে বেড়ায়। নারীদের হৃদয়-জয়ে কিম্বা শত্রুদের দুর্গ-জয়ে, কিম্বা অরণ্যে বুনো জন্তুদের শিকারে তার অসংখ্য কীর্তির কথা ইতিমধ্যেই তার স্বজাতির মনে একটা বিস্ময়ের স্বর্গ-লোক রচনা করেছে। যখন রাত্রিতে বনের মাথার ওপর আইপেন্ (চাঁদ) ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছয়, দূর–দূরান্তের সব গ্রামে, মবিস, ডাক্‌পা, ডাকানো আর লাংবাসীরা তাদের এই সেরা ‘মুকুন্দব্জী' বাতোয়ালার কীর্তির গান গেয়ে ওঠে, গানের সঙ্গে সঙ্গে বাজতে থাকে তাদের হাতের যন্ত্র, বালাফু আর কুন্দে, সঙ্গে তাল দিয়ে চলে তাদের তবলা লিউঘা।

 সুতরাং কাজ করতে তার কোন ভয় ছিল না।

 কিন্তু কথা হলো, শাদা লোকগুলোর ভাষায় এই কাজ কথাটার একটা আলাদা মানে ছিল। আশ্চর্য অদ্ভুত মানে। তাদের ভাষায় কাজ হলো অকারণ ক্লান্তি, উদ্দেশ্যহীন একটা অবসাদ···কাজ মানে হলো অশান্তি, যন্ত্রণা, বেদনা, স্বাস্থ্যক্ষয়, একটা কাল্পনিক লক্ষ্যের পেছনে অকারণে ছুটে চলা।

  উঃ! ঐ শাদা লোকগুলো! কেন তারা, তারা সকলে তাদের নিজের দেশে যে-যার ঘরে ফিরে যায় না? কেন তারা তাদের নিজের ঘর–গেরস্থালির ব্যাপার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না? কেন তারা তাদের নিজেদের জমি–জমার চাষ–বাস নিয়েই থাকে না? তার বদলে কেন তারা অকারণ অপ্রয়োজনীয় কতকগুলো টাকা রোজগারের জন্যে হন্নে হয়ে ঘুরে বেড়ায়?

 এতটুকুতো হলো জীবনের মেয়াদ। যারা এই সত্য না বুঝেছে তারাই অমনিধারা কাজ ক’রে তা অকারণ ক্ষয় ক’রে বেড়ায়। যে মানুষের দৃষ্টি ঘোলাটে নয়, সে জানে কাজ–না–করার মধ্যে কোন গ্লানি নেই। কাজ–না–করা মানে তো অলসতা নয়। বাতোয়ালা স্থির নিশ্চিতভাবে জানে, কিছু–না–করা মানেই হলো যা’ কিছু পেয়েছ স্বাভাবিকভাবে তোমার চারদিকে, তাকেই সুন্দরভাবে উপভোগ করা, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। তার এ সিদ্ধান্ত যে ভুল, তা আজও কেউ তাকে প্রমাণ করে দিতে পারে নি। প্রত্যেকটা দিন আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। যেদিন চলে গেল তার কথা ভাববার কোন দরকার নেই, যেদিন রাত প্রভাতে আসছে তার জন্যে দুশ্চিন্তা করবারও কোন প্রয়োজন নেই। ভাবনা–চিন্তাহীন স্বচ্ছ নিরুদ্বেগ প্রতিদিন বেঁচে থাকা, এই তো চরম বেঁচে থাকা!

  তাছাড়া, বিছানা ছেড়ে ওঠে কি হবে? দাঁড়ানোর চেয়ে বসে থাকা ঢের ভাল, বসে থাকার চেয়ে শুয়ে থাকা ঢের বেশী আরামের। এ তো অতি সোজা কথা···সবাই জানে।

 যে মাদুরটার ওপর সে শুয়ে ছিল, তা থেকে শুকনো লতার একটা সুবাস ওঠে। চমৎকার মসৃণ···সদ্য–নিহত কোন ষাঁড়ের চামড়া এত নরম আর মসৃণ হতে পারে না।

 সুতরাং চোখ বন্ধ ক’রে না ঝিমিয়ে, সে তো আর একবার ঘুমোতে পারে! বেশ ভাল করে আর একবার পরখ করে দেখতে পারে যে ‘বোগ্‌বো’র (মাদুর) ওপর শুয়ে আছে, সত্যি সেটা কতখানি মসৃণ...

 তাহ’লে, আগুনটাকে আবার জ্বালিয়ে তুলতে হয়।

 গোটাকতক শুকনো গাছের ডাল আর একমুঠো খড়, তাতেই হবে। মুখ ফুলিয়ে সে নিভন্ত আগুনে জোর করে ফুঁ দেয়। তখনও ছাই–এর ভেতরে ভেতরে আগুনের কণা লুকিয়ে ছিল। দেখতে দেখতে কাটফাটার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গোলাকারে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকে। দম–বন্ধ–করা তীব্র ধোঁয়া। নিভে যাওয়া আগুনের ভেতর থেকে লক্ লক্ করে জ্বলে ওঠে শিখা...তৈরী হয়ে গিয়েছে আগুন।

 আগুনের দিকে পিঠ করে, সেই মিষ্টি আঁচের আমেজে সে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করে। বনের মধ্যে ইগুয়ানা যেমন নির্ভাবনায় রোদ পোয়ায়, তেমনি নির্ভাবনায় উপভোগ করা এই মধুর উত্তাপ। তার ইয়াসী...অর্থাৎ তার স্ত্রী যা করছে, তাই অনুসরণ করা ছাড়া আপাতত আর কি করবার আছে?

 অনেকদিন হলো এই ইয়াসীর সঙ্গে সে ঘর করছে। শান্ত, নগ্ন নিরুদ্বেগ সে এক পাশে ঘুমিয়ে আছে। একটা কাঠের ওপর মাথা, দুটো হাত পেটের ওপর, পা দুটো ঈষৎ ফাঁক করা, নিরুদ্বেগে নাক ডাকিয়ে চলেছে। পাশেই একটা উনুন, তারই মতন তারও নিভে গিয়েছে আগুন।

 কি চমৎকার সুখেই না সে ঘুমুচ্ছে! ঘুমের মধ্যে কখনো কখনো পেট থেকে হাত তুলে স্তনের ওপর রাখছে...ভেঙ্গে-পড়া, শীর্ণ স্তন, শুকনো তামাক পাতার মতন। কখনো বা ঘুমের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলার সঙ্গে গা-টা একটু চুলকে নিচ্ছে। ঠোঁট দুটো হঠাৎ নড়ে ওঠে এক-একবার। গা এলিয়ে দেয়। তারপর আবার সব স্থির হয়ে আসে, আবার নাক ডাকতে থাকে।

 ঘরের এক ধারে একটা গর্ত্তের ভেতর কতকগুলো রবারের চুবড়ী জমা হয়ে পড়ে আছে। তার ওপর বসে ঝিমোচ্ছে জুমা, ছাই-রঙা তার কুকুরটা... বিষণ্ণ ম্লান মুখ।

 উপবাস-শীর্ণ তার ছোট্ট দেহের মধ্যে চোখে পড়ে শুধু তার লম্বা খাড়া ছুঁচালো কান দুটো, যেন তার ঘুমন্ত দেহের মধ্যে সব সময় সেই দুটো কানই জেগে আছে। হয়ত গায়ে মাছি উড়ে এসে বসলো কিম্বা কোন পোকা কামড়ালো, দেহটা ঝাড়া দিয়ে উৎপাতটাকে দূর করতে চেষ্টা করে। চোখ চেয়ে একবার দেখে নেয়, কাছেই তার মনিবাণী ইয়াসীগুইন্দজা শুয়ে আছে, তার মনিবের সবচেয়ে প্রিয় ইয়াসী, মনিবাণী যখন ঘুমুচ্ছে, তখন সে আর উঠবে কেন? সেইখানেই শুয়ে থাকে, নড়ে না একটুও। কখন বা, স্বপ্নের নিষ্ঠুর পরিহাসে বিচলিত হয়ে শূন্যে মুখ তুলে চীৎকার করতে থাকে···ঘরের নীরবতা আহত হয়ে ওঠে।

 বাতোয়ালা কনুই-এর ওপর ভর দিয়ে ভঙ্গী-পরিবর্তন করে, নেয়। সত্যি, চেষ্টা করে ঘুমানো অসম্ভব! তার বিশ্রাম করার বিরুদ্ধে সবাই যেন আজ যড়যন্ত্র করেছে। কুঁড়ে ঘরের ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে ভোরের কুয়াশা ঢুকছে। সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তাছাড়া, তার ক্ষিদেও পেয়েছে। হায়! দিন এসে গিয়েছে।

 তাছাড়া, এখন কি রকম করেই বা ঘুমাবে? বাইরে ঠাণ্ডায়, ভিজে ঘাসের বনে গেছো-ব্যাঙ আর ষাঁড়-ব্যাঙ স-পরিবারে পাল্লা দিয়ে চীৎকার শুরু করেছে। ভেতরে কুয়াশার হিম, তায় মরে-যাওয়া আগুনে তেমন করে আর আঁচ ওঠে না, তাই মশার দল নির্ভাবনায় আবার সশব্দে ঘুরতে থাকে। ছাগল-ছানাগুলো আপনা থেকে যদিও বেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মুরগীগুলো তখনো রয়েছে, তুমুল সোরগোল তুলেছে।

 এমন কি হাঁসগুলো, স্বভাবতই যারা শান্তশিষ্ট থাকে, ঘুম থেকে উঠে দলপতিকে ঘিরে তারাও কলরব জুড়ে দিয়েছে। কখনো গলাটা বাড়িয়ে ডাইনে বাঁয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কখনো বা সোজা করে তুলে, বিস্ময়ে চারদিকে কিসের যেন সন্ধান করে বেড়ায়।

 তাদের ভঙ্গী দেখলে, স্পষ্ট মনে হয়, যেন তারা এক বিরাট ধাঁধায় পড়ে গিয়েছে। তাদেয় হংস জীবনে যেন এক অভূতপূর্ব নতুন সমস্যার সামনে তারা এসে দাঁড়িয়েছে। ল্যাজ নেড়ে এ-ওকে জিজ্ঞাসা করে, ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে ফিরে আলোচনা করে···যেন একটা মীমাংসায় আসবার জন্যে চঞ্চল হয়ে ওঠে।

 কিছুক্ষণ সেইভাবে ঘুরে ফিরে আলোচনা করার ফলে যেন তারা সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়। তাদের আলোচ্য লক্ষ্যকে যেন সামনে দেখতে পায়, তখন গম্ভীর ভারিক্কি চালে সারি বেঁধে, সেই রবারের ঝুড়িগুলোর চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘরের এককোণে গিয়ে আবার সভা করে বসে। মাঝে মাঝে ঘাড় তুলে দরজার দিকে চেয়ে দেখে।

 হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন সিদ্ধান্ত ঠিক করে ফেলে। গম্ভীরভাবে গুণে গুণে পা ফেলে ঈষৎ-আলোকিত দরজার দিকে অগ্রসর হয়। লাফাবার জন্যে মাটীতে কয়েকবার ডানার ঝাপট দিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয়···তারপর···ডানা মেলে লাফিয়ে ওঠে···বাইরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

 তার দেখাদেখি অন্য সবাই সেই একই পন্থা অনুসরণ করে।

 এতক্ষণে জুমার ঘুম যেন ভাঙ্গে। অবশ্য হাঁসেদের এই গোলমালে তার ঘুম ভাঙ্গে নি। এ গোলমাল তার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল!

 যখন তার মা বেঁচেছিল, অর্থাৎ তার মনিবরা তার মাকে খেয়ে ফেলার আগের দিনে, তখন থেকেই রোজ সকালে এই রকম গোলমাল সে শুনে আসছে।

 মানুষ আর পশু এখানে বাধ্য হয়েই এক ছাদের তলায় একসঙ্গে বাস করে। তাই একসঙ্গে থাকতে থাকতে পরস্পর পরস্পরকে সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

 তবে, প্রথম প্রথম জুমার জীবনটাকে বড়ই কষ্টকর মনে হতো। কুকুর হিসেবে তার কি কি কর্তব্য, তা তখনও ঠিক সে আয়ত্ত করে উঠতে পারে নি। মনিবের পায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে সময় বুঝে ডেকে উঠতে তার মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যেতো।

 বাতোয়ালার অনেক নিষ্ঠুরতা আর ইয়াসীগুইন্দজার অনেক ধমকানি তাকে সহ্য করে বড় হতে হয়েছে। তার ওপর ছিল ছাগল-ছানাগুলোর হরেক-রকম নষ্টামি আর হাঁসগুলোর ঔদ্ধত্য, তাকে মাঝে মধ্যে পাগল করে তুলতো।

 তার ফলে, একটুতেই তার মেজাজ বিগড়ে যেতো। কাজ করতে ডাকলেই সে বিরক্ত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে উঠতো এবং সঙ্গে সঙ্গেই পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করতো। লাথির ভয়ে তার মগজ এমন ধারালো হয়ে উঠেছিল যে, সাদা চামড়ার লোক দেখলেই সে ছুটতে আরম্ভ করে দিতো।

 সুতরাং তার ঘুম যদি ভেঙ্গে থাকে, তা গোলমালের জন্যে নয়। খুব বেশী ঘুমিয়েছে বলেও নয়। ঘুম অফুরন্ত। এ বিষয়ে তার মনিবের সঙ্গে সে একমত। ঘুমিয়ে কেউ ক্লান্ত হয় না।

 সে ঘুম থেকে উঠলো কারণ উঠতে তো হবেই।

 জেগে-ওঠা তার পক্ষে কিন্তু খুব একটা আনন্দের বিষয়ও নয়। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় সে বুঝেছে, বাতোয়ালার কাছে, বাতোয়ালা কেন প্রত্যেক মানুষের কাছেই, একটা কুকুরের জীবনের কি দামই বা আছে?

 মারতে মারতে তাকে তারা মেরেই ফেলে, ক্ষিদে পেলে খেয়ে ফেলে, বিরক্ত হলে কান কেটে ছেড়ে দেয়। এইতো কুকুরের জীবন! তার বদলে কুকুর কি বা করতে পারে? কুকুর করেই বা কি? একরকম নিস্প্রয়োজন বল্লেই হয়। অবিশ্যি যখন বনে আগুন লাগে, তখন কুকুরের খানিকটা দরকার হয়। হাতের কাছ থেকে শীকার যখন পালিয়ে যায়, তখন তার পিছু তাড়া করবার জন্যে দরকার হয়। তা ছাড়া কুকুরের আর কি দরকার? নিষ্প্রয়োজন।

 বহুদিন হলো জুমা মানুষকে পুরোপুরি চিনে নিয়েছে। তাদের সব রকম-সকম তার জানা হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন হলো সে বুঝতে পেরেছে, ঘরে বসে ঘুমুলে, কেউ তার মুখে খাবার এনে দেবে না।

 সুতরাং তাকে জাগতে হয়। সে জানে এই ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লে টাটকা ছাগল-নাদি পাওয়া যায়। ভোরবেলাকার এই নাদিতে তবুও খানিকটা দুধ-দুধ গন্ধ থাকে। যে কুকুরের ভাগ্যে সারাদিনের মধ্যে চিবোতে আর কিছু জুটবে না, তার কাছে এই ভোরের ছাগল–নাদিই পরম উপাদেয় খাদ্য।

 ছাগলের পরিত্যক্ত এই পদার্থ, তাও সংগ্রহ করতে হলে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায় না। সেই ছাগল–নাদির আবার ভাগীদার আছে, গোবুরে–পোকার দল। এত ঠাণ্ডায় কি তারা বেরিয়েছে? বোধহয় না। হঠাৎ কিসের আশায় জুমার বিষণ্ণ মুখে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। হয়ত ভোরবেলায় ঘুরতে ঘুরতে একটা–আধটা মুরগীর ডিমও জুটে যেতে পারে। না, না, এত আশা করা ঠিক নয়···

 জুমা উঠে বসে। জিভ দিয়ে পেট আর পায়ের চেটো ভাল করে চুষে, চেটে নেয়। তারপর ক্লান্ত শীর্ণ দেহ নিয়ে কোন রকমে হেলতে দুলতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়!

 এতদিনের অভিজ্ঞতায় সে শিখেছে কি করে মনের ভাব লুকিয়ে চলতে হয়। তাই দরজার কাছে এমন ভঙ্গী করে দাঁড়ায় যেন সীমাহীন ক্লান্তির অসহ্য জড়তা তাকে পেয়ে বসেছে। যদি সে একটু স্ফূ্র্তির আমেজ দেখায়, তাহলে এক্ষুণি হয়তো বাতোয়ালা তার পিছু নেবে। তখন কোন কিছু যোগাড়ের আর কোন আশা-ভরসাই থাকবে না। সেটি হলে চলবে না।

 বাতোয়ালাও ভাবছিল। একে একে হাঁসগুলো, ছাগলছানারা, মুরগীগুলো, সবশেষে জুমাও বেরিয়ে চলে গেল। তাদের অনুসরণ করাই তার উচিত। তা ছাড়া, লিঙ্গচ্ছেদের উৎসব সামনে রয়েছে। এখনো পর্যন্ত কাউকে নেমন্তন্ন করা হয় নি। আর সময় নেই, তাড়াতাড়ি সেটা সেরে ফেলতে হবে।

 দুচোখ রগড়ে, একবার ভাল করে নাকটা ঝেড়ে নিয়ে উঠে বসলো গা চুলকোতে লাগলো। বগল, উরু, মাথার পশ্চাদদেশ, হাত, কোন অঙ্গই বাদ দিল না। চুলকোনো যে রীতিমত একটা ব্যায়াম। চুলকোনোর ফলেই না শিরায় রক্ত চলাচল আবার দ্রুত হয়। চুল্‌কোতে অবশ্য এক সময় রীতিমত ভালও লাগতো, আজ শুধু অভ্যাস, ঘুম থেকে জেগে ওঠার লক্ষণ।

 আরে, চারিদিকে একটু চেয়ে দেখলেই তো বোঝা যায়! কোন্ প্রাণী ঘুম থেকে উঠে গা চুলকোয় না? সব প্রাণীই তা করে। মানুষ হয়ে তা অনুকরণ করতে দোষ কি? এটা তো একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যে দেখবে ঘুম থেকে উঠে গা চুলকোচ্ছে না, বুঝবে তার ঘুম এখনও ভাল করে ছাড়ে নি।

 তবে চুলকোনো ভাল বটে কিন্তু হাই তোলা আরো ভাল। হাই তোলা মানে হলো, মুখ দিয়ে ভেতরের ঘুমকে পুরোপুরি বার করে দেওয়া!

 এবং সেটা যে সম্ভব তা প্রকৃতির দিকে চাইলে অনায়াসেই বোঝা যায়। শীতের দিনে কে না দেখেছে, দেহের ভেতর থেকে একরকম ধোঁয়া বেরোয়? এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ঘুমটা হলো দেহের ভেতরের একটা গোপন আগুন। এই আগুনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সে একেবারে অভ্রান্ত। তা ছাড়া, ওঝারা হলো সবজান্তা, তাদের কোন ভুলই হতে পারে না। তার বাবার কাছ থেকে এই ওঝাগিরি সে শিখেছে, তার বাবার সব যাদুবিদ্যা সে পেয়েছে। তাইতে তো আজ সে পাঁচখানা গাঁয়ের বাতোয়ালা, সর্দার।

 তা ছাড়া, একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে,―—ঘুম যদি ভেতরকার আগুন না হয়, তা হলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া বেরোয় কি করে? আগুন ছাড়া ধোঁয়া কি কেউ দেখেছে? এ নিয়ে সে যে–কোন লোকের সঙ্গে তর্ক করতে প্রস্তুত···

 তা ছাড়া, প্রথা বলে একটা কথা আছে। পুরানো প্রথা হলো অভ্রান্ত সত্য। বহু দিনের বহু অভিজ্ঞতায় তাদের জন্ম হয়েছে।

 বাতোয়ালা আধ-শোয়া অবস্থায় ভাবে। সে হলো আশেপাশের গাঁয়ের, এতগুলো লোকের বাতোয়ালা, অর্থাৎ তাদের সমস্ত প্রথার সেই হলো রক্ষক। তার নিজের জাতের সম্পদ সে যা পেয়েছে, সারা জীবন ধরে তাকেই সে আগলে ধরে আছে। সেই তার কর্তব্য।

 তার চেয়ে গভীর সে কিছু ভাবতে চায় না। তার কোন দরকারই নেই। প্রথাতে যা প্রতিষ্ঠিত, কোন তর্ক তাকে হটাতে পারে না। অসম্ভব।

 তা না হয় হলো, কিন্তু লিঙ্গচ্ছেদ-উৎসব কোথায় কখন হবে, তাতো বন্ধু-বান্ধবদের আগে থাকতে জানাতে হবে। আপাতত নিভন্ত আগুনটা ঠিক করে নেওয়া দরকার। তার আগুন তাকেই ঠিক করে নিতে হবে। মানুষ যে-যার একলার জন্যেই। অন্তত সেই তত্ত্বই সে শিখেছে।

 আগুন ঠিক করে, সে বেরিয়ে পড়লো।

 অল্পক্ষণ পরেই আবার ফিরে এলো। গ্রীষ্মই হোক আর বর্ষাই হোক, সামান্য একটা কোমর-বন্ধ ছাড়া আর কিছু সে পরতো না। সেই জন্যে শীতের দিনে শীতের কামড় একটু-আধটু সহ্য করতে হতো।

 বাইরের কুয়াশা ঘন হয়ে পড়ছে। এত ঘন যে ঠাওর করে উঠতে পারে না, তার বাকি আটজন স্ত্রীর কুঁড়েঘর ঠিক কোন্ দিকে।

 উহু···হ্···হ্ হিমে দেহ কাঁপতে থাকে··· দাঁতে দাঁত লেগে যায়।

 ঘরে ঢুকে তৈরী আগুনে ফুঁ দেয়। আগুনের আঁচে হিমের জড়তা কেটে যায়। আগুনের ওপর হাতের পাতা মেলে দিয়ে আপনার মনে একটা পুরানো গানের সুর গুণ গুণ করে গেয়ে ওঠে। গুণ গুণ করতে করতে গানের ভাষায় নতুন শব্দ যোজনা করে। কান পেতে শুনলে বোঝা যাবে, তার মধ্যে শাদা-চামড়াওয়ালা মেয়ে-পুরুষদের কথাও আছে।

 বাইরে হাল্‌কা হাওয়া জেগে ওঠে। ভিজে পাতার মধ্যে মৃদু শিহরণ জাগে। ডালগুলো দুলে দুলে এ-ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। বাঁশের উঁচু মাথা নুয়ে প’ড়ে দুলতে থাকে। করুণ দীর্ঘশ্বাসের মতন তাদের বুক থেকে একটা আওয়াজ ওঠে।

 বাতাস ক্রমশ জোরে বইতে থাকে। ঘন কুয়াশা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অবশেষে একটা দমকা হাওয়া এসে তাদের দূরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। মেঘের ভেতর থেকে স্পষ্ট স্বচ্ছ সূর্য ফুটে ওঠে!

 বাতোয়ালা তার কুঁড়ে ঘরের বাইরে, নতুন-জ্বালা অগ্নিকুণ্ডের সামনে এসে বসে। উদাসীন শূন্য মনে সে তার পুরানো গড়গড়াতে তামাক দিয়ে ধীরে ধীরে টানতে আরম্ভ করে···

 বাইরে এসে গিয়েছে দিন।