এরাও মানুষ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

 শিকারের মরশুম। আজ কালো মানুষের দল বর্শা হাতে সবাই বেরিয়েছে জঙ্গলে।

 কোসিগাম্বা কাগার একটা সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে বিসিবিংগুই অপেক্ষায় আছে···

 অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে হাই তুলে মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করে নেয়।

 পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচে চেয়ে দেখে, চোখে পড়ে বাম্বার তীরে গ্রিমারি···হলুদরঙা ছোট্ট একটা ক্ষেতের মতন পড়ে আছে। সেই ছোট্ট ক্ষেতের একধারে, চোখে পড়ে কতকগুলো ঘর···সেই ঘর থেকে যে-আদেশ বেরোয়, সে আদেশ যতই কেন বিচিত্র হোক্ না, আশে-পাশের সমস্ত কালো লোকদের জীবন তাতে বাঁধা, সে আদেশ মানতে তারা বাধ্য।

 ঘন গাছের সারি ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে যায় বাম্বার শীর্ণ রেখার ওপর, সেই রেখাকে অনুসরণ করে চলে তার দৃষ্টি। আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে বাম্বা চলেছে গ্রাম ছাড়িয়ে শূন্য মাঠের দিকে।

 সেখান থেকে বিসিবিংগুই দেখতে পায়, সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করছে। তাদের কুচকাওয়াজের শব্দে ছুটে পালায় সিবিবিসের দল, খরগোসের চেয়ে ছোট, ইদুরের চেয়ে বড়। দল বেঁধে ছুটে পালাতে গিয়ে তারা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যায়, আবার উঠে ছুটতে আরম্ভ করে।

 সৈন্যরা মার্চ করে এগিয়ে চলেছে। বাতাসে ভেসে আসে তাদের মার্চের সঙ্গীত। উঁচু থেকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তারা এগিয়ে চলেছে, কোসিগাম্বা ছাড়িয়ে···আরো দূরে, বহু দূরে এগিয়ে চলেছে···

 বিসিবিংগুই অপেক্ষা করে আছে···হঠাৎ তার নজরে পড়ে, পাহাড়ের তলায় সরু আঁকা-বাঁকা পথের ওপর কে যেন একজন এসে দাড়ালো···স্ত্রীলোক···মুখে তামাকের পাইপ, মাথায় একটা চুবড়ী···স্ত্রীলোকটি এগিয়ে আসছে···

 বিসিবিংগুই ক্রমশ আরো স্পষ্ট দেখতে পায়···চিনতে পারে ইয়াসীগুইন্দজা!

 আগের দিন ইয়াসীগুইন্দজার সঙ্গে বিসিবিংগুই-এর হঠাৎ এখানে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তার ফলে ইয়াসী কথা দেয়, এইখানেই তার সঙ্গে গোপনে দেখা করবে এবং তার কথামত ঠিক নির্দিষ্ট সময়েই সে এসে হাজির হয়েছে।

 দূর থেকে তার পোষাক দেখেই বিসিবিংগুই মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে! প্রত্যেক মাসে আটদিন। এই সময়টা তাদের মেয়েরা পোষাকের মধ্যে একটা বিশেষ পরিবর্তনের চিহ্ন ধারণ করে। কপাল ঘিরে মাথায় বাঁধা থাকে একটা লাল সূতো; চূল থাকে এলোনো। এই আটদিন তারা চুলে চিরুনী দেয় না। প্রকৃতির নিষেধ বলে এই চিহ্নকে তারা সম্মান করতে জানে। সেই নিষেধের বিজ্ঞাপন ক্ষুব্ধ করে তোলে অপেক্ষমান বিসিবিংগুই-এর কামাতুর মন।

 ইয়াসীগুইন্দজা কাছে এসে বসে। নীরবে বিসিবিংগুই তাকে অভ্যর্থনা জানায়।

 আপাতত এখন তাদের ভয় করবার কিছুই নেই। গাঁয়ের প্রত্যেক লোক এখন শিকারে ব্যস্ত, উন্মত্ত। সব গাঁ খালি করে পুরুষ নারী সবাই বেরিয়ে পড়েছে বনে জঙ্গলে। ঘরে ঘরে শুধু পড়ে আছে যারা বৃদ্ধ, যারা রুগ্ন অশক্ত, যারা অন্ধ, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আর সদ্য-প্রসূতা নারীরা···আর আছে গৃহপালিত ছাগল আর মুরগীর দল। কুকুরগুলোও যে-যার মনিবের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে জঙ্গলে। সমস্ত গ্রাম নিস্তব্ধ।

 বিসিবিংগুই পার্শ্বোপবিষ্ট নারীর দিকে তপ্ত আগ্রহে চেয়ে দেখে। মনে হয়, তার সারা দেহের মধ্যে যে সব দড়ি আছে, যে নীল দড়ির ভেতর দিয়ে রক্ত-ধারা ছুটে চলে, বাইরের এই সূর্যের আলো যেন সেই নীল দড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে, তার তপ্ত আলো সেখানকার রক্ত-ধারাকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।

 বিসিবিংগুই মুগ্ধ বিস্ময়ে ইয়াসীর দিকে চেয়ে থাকে। ইয়াসীও নীরবে তার বলিষ্ঠ দেহকে দৃষ্টি দিয়ে লেহন করে। সুগঠিত বলিষ্ঠ দেহ, পুরুষালি সৌন্দর্যে ভরা। দু’দিকে কাঁধ সুন্দর রেখায় উঁচু হয়ে আছে, বক্ষপেশী সুকঠিন মাংসে সমুন্নত, সরু কোমর, পেটের চিহ্ন নেই বলতে গেলে, তামার পাতের মতন পাতলা, দীর্ঘ দুটি পা, পাথরের মতন শক্ত, পরিপুষ্ট। সবাই জানে বনের নেকড়েকে সে দৌড়ে গিয়ে ধরে।

 ইয়াসীগুইন্দজা আশে-পাশের অনেক মেয়েদের কথা জানে, যারা বিসিবিংগুই-এর আদরের জন্যে কত কান্নাকাটি করেছে, এমন কি তার কাছ থেকে কত অপমান আর কত নির্যাতন নীরবে সহ্য করেছে।

 আপনার মনে ইয়াসী তার দুঃখের কাহিনী তাকে বলে চলে। বাতোয়ালার বৃদ্ধ পিতার সেই আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে গাঁয়ে রীতিমত পঞ্চায়েৎ বসে! ওঝারা এসে ঘোষণা করে, কোন দুষ্ট লোকের মারণ-ক্রিয়ার ফলেই বৃদ্ধ মারা গিয়েছে। সমাজের ভেতর এমন দুরভিসন্ধি-ওয়ালা কোন্ লোক আছে, তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এই লোককে ধরবার জন্যে, তাদের নানা রকমের পরীক্ষা আছে। ইয়াসী বলে, হায়! বুড়ো ওঝা নাকি বলেছে, আমারই চক্রান্তে বাতোয়ালার বাবা মারা পড়েছে। আমিই তার ঘাড়ে চাপবার জন্যে ভূত পাঠিয়েছি। তাই আমাকে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার জন্যে নানান রকমের বিষ-পরীক্ষা দিতে হবে।

 কাতরভাবে বিসিবিংগুই-এর হাত জড়িয়ে ধরে সে বলে, বিসিবিংগুই একমাত্র তুমি আমাকে বাঁচাতে পার! তুমি শক্তিমান! ওদের হাত থেকে তুমিই আমাকে বাঁচাতে পার! দোহাই তোমার, বাঁচাও আমাকে! বাঁচাও আমাকে বাতোয়ালার আক্রোশ থেকে···

 ইতিমধ্যেই ওঝাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। একটি পরীক্ষায় অবশ্য সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

 সেদিন তার সামনে ওঝারা মন্ত্র পড়ে একটা কালো মুরগীর ছানার গলা কেটে ছেড়ে দেয়। মুরগীর ছানাটা লট্‌পট্ করতে করতে, সৌভাগ্যবশত বাঁদিকে এসে অসাড় হয়ে পড়ে রইলো। যদি ডান দিকে এসে পড়তো, তা হলেই সাব্যস্ত হয়ে যেতো যে সে দোষী।

 ওঝারা বললো, তা হলে ইয়াসীগুইন্দুজা এ ব্যাপারে দোষী নয়···অন্য কোন লোকের কাজ।

 কিন্তু গাঁয়ের বুড়োরা অত সহজে ওঝাদের কথায় সায় দিলো না। তারা অনেক বচসা করার পর ঠিক করলো যে, এ পরীক্ষায় অনেক সময় ঠিক ঠিক ফল পাওয়া যায় না, সুতরাং ইয়াসী-গুইন্দজাকে কঠিনতর পরীক্ষা দিতে···দিতে হবে তাকে বিষ–পরীক্ষা দিতে হবে......

 কাতরভাবে সে এই সব কথা বিসিবিংগুইকে জানায়। বলে, আমি অবশ্য এই বিষ-পরীক্ষা দিতে ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি, এই বিষের প্রতিষেধক কি···সেটা আগে খেয়ে নিলে, তাদের দেওয়া বিষ আমার কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু তাতেও তো তারা আমাকে রেহাই দেবে না! আমি জানি, তার পর তারা যে পরীক্ষা দিতে বলবে, তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তারা আমার চোখে “লাচা” ঢেলে দিয়ে দেখবে, আমি দেখতে পাই কিনা। যদি দেখতে পাই, তাহলে আমি নির্দোষ আর যদি দেখতে না পাই, তা হলেই তারা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। আমি তো লাচার প্রতিষেধক কি জিনিস আছে, তা জানি না। কাজেই দুটি চোখ আমার একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। কিছুই দেখতে পাবো না। তখন তারা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রহার করতে শুরু করবে, ঢিলিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি জানি একদল বুড়ো আমার ওপর ভীষণ রেগে আছে, তাদের কথামত আমি তাদের দেহ দিই নি; তারা সেই রাগের প্রতিশোধ এবার নেবে।

 কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সে আবার বলতে আরম্ভ করে, জানো বিসিবিংগুই, তারা কিভাবে আমাকে নির্যাতিত করবে? গরম ফুটন্ত জলে আমার হাত জোর করে ডুবিয়ে ধরে রাখবে···জ্বলন্ত, টকটকে লাল লোহার শিক দিয়ে কোমরে গর্ত করে দেবে···উঃ! বিসিবিংগুই, কেউ আমার কাছে আসবে না, কাউকে আসতে দেবে না···ক্ষিদেয় আর তেষ্টায় ছটফট করতে করতে মারা যাবো! তারপর তারা বাতোয়ালার বুড়ো বাপকে যেখানে কবর দিয়েছে, সেখানে তার পাশেই মাটির ভেতর আমাকে পুঁতে রাখবে। তবেই নাকি সেই বুড়োর আত্মা তৃপ্ত হবে।

 সেই ভয়াবহ নির্যাতনের আশঙ্কায় সে কেঁপে ওঠে। বিসিবিংগুই-এর দুই হাত জড়িয়ে বলে, বিসিবিংগুই, আমি তোমাকেই চাই! তুমি জান, কতদিন থেকে কিভাবে আমি তোমাকে চাইছি···তোমাকেই শুধু চাই!

 হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে। চমকে ওঠে।

 “জানো, তারা আমাকে সন্দেহ করে। তারা বুঝতে পেরেছে। তাই সদা সর্বদা তারা লুকিয়ে আমার ওপর নজর রাখে। তোমাকেও তারা সন্দেহ করে। তোমারও ওপর নজর রেখেছে। হয়ত এই মুহূর্তে এই বনের ভেতর লুকিয়ে তারা আমাদের দেখছে! কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝখানে তারা যে এইভাবে বাধার বেড়া তৈরী করছে, তাতে কি তারা আমাদের আটকে রাখতে পারবে? জল জলের সঙ্গে মিশবেই। এই তো এতো গাঁ, তারা কি পেরেছে পাম্বা আর বাম্বার মিলনকে বাধা দিতে? সমস্ত বন, পাহাড়, জঙ্গলের বাধা এড়িয়ে নদীর জল ঠিক এসে মিশবে আর এক নদীর সঙ্গে···তুমি আমাকে কতখানি ভালবাস, তা আমি জানি না, কিন্তু আমি বলছি তোমাকে, এই ক’দিন কেটে গেলেই আমি এসে মিলবো তোমার সঙ্গে। বিসিবিংগুই, তুমি আমার, তুমি আমার!”

 বন্য নারীর অন্তরে দুরন্ত ঝর্ণার বেগে নেমে আসে কামনার ঢল। বাসনা আর বাঞ্ছিতের মাঝখানে কোন বাধাকেই সে স্বীকার করে না।

 সেদিন মেঘে ঢাকা থাকার দরুণ সূর্যের তেজ তেমন জোরালো ছিল না।

 ইয়াসীগুইন্দজা তার প্রাণের সমস্ত গোপন আকুতি বিসিবিংগুই-এর কাছে নিবেদন করে সমর্থনের জন্যে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে সমর্থনের চিহ্ন সে দেখতে পায় না।

 দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষুব্ধ অন্তরে বলে, তাহলে তুমি সত্যি আমাকে ঘৃণা করো? কিন্তু আমি কি করবো? আমি যে নিরুপায়। স্ত্রীলোকের রক্তের ওপর ঐ আকাশের চাঁদ যে প্রভাব বিস্তার করে, তুমি তো জান না, তা রোধ করবার ক্ষমতা মেয়েদের নেই! তাই আমার সরল প্রাণের উচ্ছ্বাস শুনে হয়ত তুমি মনে মনে হাসছো···কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি!

 তবু বিসিবিংগুই তার কথায় কোন সাড়া দেয় না। সহজ পথ ছেড়ে দিয়ে তখন নারী তার গোপন অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে। সেখানে সব দেশেই তারা সমান।

 ইয়াসীগুইন্দজা বলে, বুঝেছি, বাতোয়ালার ভয় করছো তুমি!

 —বিসিবিংগুই অট্টহাস্য করে ওঠে।

 ইয়াসী বলে, চল আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই···এই মুহূর্তে। তোমার কোন ভাবনা ভাবতে হবে না, আমি তোমার জন্যে নতুন ঘর তৈরী করবো, তোমার ঘর-দোর পরিষ্কার করে রাখবো···তোমার জন্যে মাঠে গিয়ে জমিতে চাষ করবো, তুমি খাবে বলে নিজের হাতে শস্য কেটে ঘরে নিয়ে আসবো! বিসিবিংগুই অমন করে তুমি হেসো না। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, চাঁদের আলো যদি একবার আমাদের রক্তে এসে লাগে, আমরা অসহায় কতখানি। আমি কি করে নিজেকে ধরে রাখবো বলো? আমার রক্ত যে ভেতর থেকে আমাকে টেনে আনছে তোমার কাছে!

 বিসিবিংগুই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হাঁ, যাবো!

 ইয়াসী বলে, যাবো নয়, এক্ষুনি চলো···তোমার ভয় কি? তুমি বাংগুই শহরে সেখানকার শাদা ক্যাপ্‌টেনের কাছে সোজা চলে যাবে···তোমার বয়স কম···মজবুৎ তোমার চেহারা···এমন চেহারা কোন সৈনিকের নেই···হায় বিসিবিংগুই, তুমি বিশ্বাস করো, এমন চেহারা কারো নেই! একবার তুমি তুরুগু (সৈন্য) হলে আর তোমাকে কোন কালো আদমী ছুঁতে পারবে না, তোমার বিরুদ্ধে তখন কোন নালিশই টিকবে না, এমন কি বাতোয়ালারও নয়! দোহাই তোমার আমাকে বাঁচাও! আমি কিছুতেই বিষ মুখে নিতে পারবো না, কিছুতেই পারবো না ফুটন্ত জলে হাত ডুবিয়ে মরতে! আমার যৌবন এখনো রয়েছে ভরা, আমি বাঁচতে চাই। আর বাঁচতেই যদি হয়, তাহলে যাকে আমার মন চায় তার সঙ্গে না থাকলে বাঁচারই বা কি মানে থাকে?