কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ


ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

সতী

যেখানে মশা ও হাতী কঙ্কাবতীর প্রতীক্ষায় অবস্থিতি করিতেছিলেন, অবিলম্বে কঙ্কাবতী আসিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলেন। শিকড়লাভে কৃতকার্য্য হইয়াছেন শুনিয়া, মশা ও হাতীর আনন্দের আর অবধি রহিল না। খোক্কোশের বাচ্ছাটিকে পুনরায় তাহার গর্ত্তে ছাড়িয়া, মশা ও কঙ্কাবতী হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও পর্ব্বত অভ্যন্তরস্থিত সেই অট্টালিকার দিকে যাত্রা করিলেন।

 অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া, কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড়টুকু খর্ব্বুরের হস্তে অৰ্পণ করিলেন। খর্ব্বুর তাহার একতোলা ওজন করিয়া সাতটি গোলমরিচের সহিত অতি সাবধানে শিলে বাটিলেন। ঔষধটুিকু বাটা হইলে, ব্যাঙকে তাহা সেবন করাইলেন। ঔষধ সেবন করিয়া

ব্যাঙের হুড়-হুড় করিয়া বমন আরম্ভ হইল। পেটে যাহা কিছু ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া পড়িল। ব্যাঙ বলিলেন,— “ব্যাঙাচি-অবস্থায়, জলে কিলকিল করিতে করিতে আমি যাহা কিছু খাইয়াছিলাম, তাহা পর্যন্ত বাহির হইয়া গিয়াছে, উদরে আর আমার কিছুই নাই।”

 বমনের সহিত সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাগুলি বাহির হইয়া পড়িল। খর্ব্বুর অতি যত্নে তাহাদিগকে বমনের ভিতর হইতে বাছিয়া লইলেন। তাহার পর একটি পিপীলিকা লইয়া, তাহার উদর হইতে অতি সূক্ষ্ম সোন্না-দ্বারা খেতুর পরমায়ুটুকু বাহির করিতে লাগিলেন! এইরূপে খুঁটিয়া খুঁটিয়া সমস্ত পিপীলিকাগুলি হইতে পরমায়ু বাহির করা হইলে, খর্ব্বুর বলিলেন,— “এ কি হইল? পরমায়ু তো অধিক বাহির হইল না! এ যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া কি হইবে? ইহাতে তো কোনও ফল হইবে না?”

 খর্ব্বুর বিষণ্ন চিত্ত হইলেন, মশা হতাশ হইলেন, ব্যাঙের চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল, কঙ্কাবতী নীরবে বসিয়া রহিলেন। অদৃশ্যভাবে অবস্থিত নাকেশ্বরী ও তাহার মাসী পরিতোষলাভ করিল। যাহা হউক, সেই যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া খর্ব্বুর খেতুর নাকে নাস দিয়া দিলেন। খেতু চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কি অঘোর নিদ্রায় আমি অভিভূত হইয়াছিলাম! কঙ্কাবতী! তুমি আমাকে জাগাইতে পার নাই? দেখ দেখি, কত বেলা হইয়া গিয়াছে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সাধ্য থাকিলে আর জাগাইতাম না?”

 খেতু তাহার পর চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, কঙ্কাবতীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছে। খর্ব্বুর, মশা ও ব্যাঙ বিষণ্নবদনে বসিয়া আছেন।

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি কাঁদিতেছ কেন? আর এঁরা কারা?”

 কঙ্কাবতী কোনও উত্তর করিলেন না।

{gap}}খেতু একটু চিন্তা করিয়া পুনরায় বলিলেন,— “আমার সকল কথা এখন মনে পড়িতেছে। আমার মাথায় শিকড় ছিল না বলিয়া আমাকে নাকেশ্বরী খাইয়াছিল। কঙ্কাবতী! তুমি বুঝি ইহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া আমাকে সুস্থ করিয়াছ? তবে আর কান্না কেন? আমি তো এখন ভাল আছি। কেবল আমার মাথা অল্প অল্প ব্যথা করিতেছে! আমি আর একবার শুই! কঙ্কাবতী! তুমি আমার মাথাটি একটু টিপিয়া দাও। আমার মাথা বড় বেদনা করিতেছে! প্রাণ বুঝি আমার বাহির হয়! ওগো! তোমরা সকলে আমার কঙ্কাবতীকে দেখিও! আমার কঙ্কাবতীকে তার মা’র কাছে দিয়া আসিও। হা ঈশ্বর!”

 খেতুর মৃত্যু হইল! ঘাড় হেঁট করিয়া সকলে নীরবে বসিয়া রহিলেন। কাহারও মুখে বাক্য নাই! সকলের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। কেবল কঙ্কাবতী স্থির হইয়া রহিলেন।

 অনেকক্ষণ পরে খর্ব্বুর বলিলেন,— “এইবার সব ফুরাইল। আমাদের সমুদয় পরিশ্রম বিফল হইল। এখন আর কোনও উপায় নাই। তালগাছ হইতে পতনের সময় পরমায়ুর অধিকাংশ ভাগ বাতাসে উড়িয়া গিয়াছিল, কেবল অতি সামান্য ভাগ পিপীলিকাতে খাইয়াছিল। সে পরমায়ুটুকুতে মনুষ্য আর কতক্ষণ বঁচিতে পারে?”

 এই বলিয়া খর্ব্বুর কাঁদিতে লাগিলেন, মশা কাঁদিলেন, ব্যাঙ রুমাল দিয়া চক্ষু মুছিতে লাগিলেন, বাহিরে হাতী শুড় দিয়া ধূলা উড়াইতে লাগিলেন। কেবল কঙ্কাবতী নীরব, কঙ্কাবতীর কান্না নাই। অবশেষে মশা বলিলেন,— “মা, উঠ। বিলাপে আর কোনও ফল নাই। তোমার পতির এক্ষণে আমরা যথাবিধি সৎকার করি। তাহার পর তুমি আমার সহিত রক্তবতীর নিকট যাইবে। রক্তবতীকে দেখিলে তোমার মন অনেক শান্ত হইবে।”

 মশা, খর্ব্বুর ও ব্যাঙ কঙ্কাবতীকে বুঝাইতে লাগিলেন। খর্ব্বুর বলিলেন,— “সংসার অনিত্য। জীবনের কিছুই স্থিরতা নাই। কখন কে আছে, কখন কে নাই। উঠ, মা, উঠ। তোমার পতির যথাবিধি সৎকার হইলে, কিছুদিন তুমি রক্তবতীর নিকটে গিয়া থাক। তাহার পর তোমার মা'র নিকট গিয়া রাখিয়া আসিব।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মহাশয়গণ! আপনারা আমার অনেক উপকার করিলেন। আমার জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করিলেন। আপনাদিগের পরিশ্রম যে সফল হইল না, সে কেবল আমার অদৃষ্টের দোষ। ঈশ্বর আপনাদিগের মঙ্গল করিবেন। আপনারা যখন এত পরিশ্রম করিলেন, তখন এক্ষণে আমার আর একটি যৎসামান্য উপকার করুন। সেইটি করিয়া আপনারা স্ব স্ব গৃহে প্রতিগমন করুন। পতিপদে আমি আমার প্রাণ সমৰ্পণ করিয়াছি। এই— যে আমার শরীর দেখিতেছেন, এ প্রাণহীন জড়দেহ। এক্ষণে আমি পতিদেহের সহিত আমার এই জড়দেহ ভস্ম করিব। সে নিমিত্ত যাহা কিছু প্রয়োজন, আপনার সেই সমস্ত উপকরণের আয়োজন করিয়া দিন।”

 মশা বলিলেন,— “ছি মা ও কথা কি মুখে আনিতে আছে? পতিহারা হইয়া শত শত সতী এ পৃথিবীতে জীবিত থাকে। ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া পরোপকারে জীবন অতিবাহিত করে।”

 খর্ব্বুর ও ব্যাঙ সকলেই কঙ্কাবতীকে সেইরূপ নানা প্রকারে বুঝাইতে লাগিলেন।

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মাসী!”

 মাসী বলিল,— “উ!”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মানুষটাকে সৎকার করিবে যে! তাহা হইলে আর আমরা কি ছাই খাইব?”

 মাসী বলিল,— “হঁ!”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “এই ছুঁড়ির জন্যই যত বিপত্তি। এখন ছুঁড়িও যাতে মরে, এস তাই করি।”

 এই কথা বলিয়া নাকেশ্বরী, খর্ব্বুর প্রভৃতির নিকট আসিয়া আবির্ভূত হইল। নাকেশ্বরী বলিল,— “তোমরা কি পরামর্শ করিতেছ? কঙ্কাবতীকে দেশে লইয়া যাইবে? লইয়া যাও, তাহাতে আমাদের কোনও ক্ষতি নাই। কিন্তু এ ধর্ম্মভূমি ভারতভূমির নিয়ম তোমরা জান না। লোকের এখানে ধর্ম্মগতপ্রাণ। শোকেই হউক আর তাপেই হউক, সহসা যদি কেহ মুখে একবার বলিয়া ফেলে যে, “আমি পতির সঙ্গে যাইব, তাহা হইলে তাহাকে যাইতেই হইবে, সতী হইতেই হইবে। না হইলে পতিকুল, পিতৃকুল, মাতৃকুল, সকল কুল ঘোর কলঙ্কে কলঙ্কিত হইবে। পিতা, মাতা, ভ্রাতা, আত্মীয়বর্গের মস্তক অবনত হইবে। সে কলঙ্কিনী একেবারেই পতিত হইবে। তাহার সহিত যিনি আচার-ব্যবহার করিবেন, তিনিও পতিত হইবেন। তাই বলিতেছি, তোমরা ইহাকে ঘরে লইয়া যাও, তাহাতে আমাদের কিছু ক্ষতি নাই; কিন্তু শুন মশা মহাশয়। শুন খর্ব্বুর মহারাজ। আমি এ কথা তোমাদিগের আত্মীয়-স্বজনকে বলিয়া দিব। তোমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা কিছু তোমাদিগের মত নাস্তিক নন। তাঁরা নিশ্চয় ইহার যথাশাস্ত্র বিচার করিবেন। তখন দেখিব, পুত্র-কন্যার বিবাহ দাও কোথায়?”

 নাকেশ্বরীর কথা শুনিয়া মশার ভয় হইল। আজ বাদে কাল তার রক্তবতীর বিবাহ দিতে হইবে। পাত্র না মিলিলে তাঁকে ঘোর বিপদে পড়িতে হইবে। মশা তাই খর্ব্বুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “সত্য সত্য কি ভারতের এই নিয়ম?”

 খর্ব্বুর উত্তর করিলেন,— “পূর্ব্বে এইরূপ নিয়ম ছিল, সত্য। কিন্তু এক্ষণে সহমরণ উঠিয়া গিয়াছে। সাহেবেরা ইহা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “উঠিয়া গেছে সত্য। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত পুরুষদিগের মত কি জান? পূর্ব্বপ্রথা সমুদয় পুনঃপ্রচলিত করিবার নিমিত্ত তাহারা যথোচিত প্রয়াস পাইতেছেন। শোকবিহ্বলা ক্ষিপ্তপ্রায়া জননী-ভগিনীদিগকে জ্বলন্ত অনলে পোড়াইবার নিমিত্ত আজকালের শিক্ষিত পুরুষেরা নাচিয়া উঠিয়াছেন। এইরূপ ধর্ম্মের আমরা সম্পূর্ণভাবে পোষকতা করিয়া থাকি।”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আমার যাই থাকুক কপালে, আমি কঙ্কাবতীর সহিত আচার-ব্যবহার করিব। তাহাতে আমাকে পতিত হইতে হয় সেও স্বীকার। আত্নীস্বজন আমাকে পরিত্যাগ করেন করুন, তাহাতে আমি ভয় করিব না! তা বলিয়া, অনাথা বালিকাটি যে অসহনীয় শোকে ক্ষিপ্তপ্রায়া হইয়া পুড়িয়া মরিবে, তাহা আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না।”

 মশা বলিলেন,— “আমারও মত, ভীরু কাপুরুষের মত কার্য্য করিতে পারিব না। আমি কঙ্কাবতীকে ঘরে লইয়া যাইব।”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “আমারও ঐ মত। কাপুরুষ হয়, মানুষেরা হউক। আমি হইব না।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “ধর্ম্মের তোমরা কিছুই জান না! ঘোর অধর্ম্মে যে তোমরা পতিত হইবে, সে জ্ঞান তোমাদের নাই। ইনি যদি সতী না হন, তাহা হইলে ইহাকে প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে তবুও ইনি ঘরে যাইতে পাইবেন না। মুর্দাফরাশে ইঁহাকে লইয়া যাইবে, মুর্দ্দাফরাশের রমণী হইয়া ইঁহাকে চিরকাল থাকিতে হইবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন, “এই কথা লইয়া আপনারা বৃথা তর্ক-বিতর্ক করিতেছেন। আমি নিশ্চয় প্রাণত্যাগ করিব। বাঁচিয়া থাকিতে আর আপনারা আমাকে অনুরোধ করিবেন না, যেহেতু আপনাদিগকে কথা আমি রক্ষা করিতে পারিব না। এক্ষণে আমার প্রার্থণা এই যে, সতী হইতে যাহা কিছু আবশ্যক, সেই সমুদয় দ্রব্যের আয়োজন করিয়া দিন। আমার আর একটি কথা আছে আমাদিগের যে ঘাট আছে, সেইখানে আমার শাশুড়ী-ঠাকুরাণীর চিতা হইয়াছিল, সেই স্থানে চিতা করিয়া আমি আমার পতির সঙ্গে পুড়িয়া মরিব।”

 কঙ্কাবতীর দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা দেখিয়া অতি দুঃখের সহিত, অগত্যা এ-কার্য্যে সকলকে সম্মত হইতে হইল।

 মশা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! যদি তুমি নিতান্তই এই দুষ্কর কার্য্য করিবে, তবে আমি আমার বাড়ীতে সংবাদ দিই, আমার স্ত্রীগণ ও রক্তবতী আসিয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করুন।”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আমিও তবে আমার স্ত্রীকে সংবাদ দিই। আমার আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে লইয়া তিনিও আসুন। সহমরণের উপকরণ আনয়ন করুন ও নাপিত, পুরোহিত, ঢাকিঢুলির নিকট সংবাদ পঠাইয়া দিন।”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “আমিও আমার আত্মীয়-স্বজনের নিকট সমাচার পাঠাই।”

 বাহিরে হাতী বলিলেন,— “আমিও আমার জ্ঞাতি বন্ধুদিগকে ডাকিতে পাঠাই।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মাসী! তবে আমরা আর বাকী থাকি কেন? তুমি তোমার ঝুড়িতে গিয়া চড়। পৃথিবীতে যত ভূতিনী-প্রেতিনী আছে, সহমরণ দেখিবার জন্য তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ কর। আজকাল সহমরণ কিছু আর প্রতিদিন হয় না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা সকল ভূতিনী-প্রেতিনীই সহমরণ দেখিয়া পরম পরিতোষ উপভোগ করিবে।”

 এইরূপে সকলেই আপনার আত্মীয়-স্বজনকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাহার পর, খেতু ও কঙ্কাবতীকে লইয়া, সকলে হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। রাত্রি একপ্রহরের সময় সকলে কুসুমঘাটীর ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 কঙ্কাবতী যে-স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন, সেই স্থানে চিতা সুসজ্জিত হইল। এই সময় রক্তবতী ও রক্তবতীর মাতাগণ সেই শ্মশানঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সহমরণের সমুদয় উপকরণ লইয়া নাপিত-পুরোহিত ঢাকী-ঢুলি সঙ্গে করিয়া খর্ব্বুর সপ্তহস্তপরিমিত স্ত্রী ও তাঁহার আত্মীয়-স্বজন আপন আপন বালক-বালিকাগণকে লইয়া সেইখানে আসিলেন। ব্যাঙ ও হস্তীর আত্মীয়বর্গও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নানাদিক হইতে অসংখ্য ভূতিনীগণও আগমন করিল। সেই শ্মশানঘাটে সে রাত্রিতে, মনুষ্য ও ভূত-ভূতিনী ভিন্ন, অপরাপর নানাপ্রকার জীবজন্তুর সমাগম হইল! সে রাত্রিতে কুসুমঘাটীর শ্মশানঘাট জনাকীর্ণ হইয়া পড়িল।

 রক্তবতী কঙ্কাবতীর গলা জড়াইয়া ধরিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে রক্তবতী বলিলেন,— “পচাজল! তুমি কোথায় যাও? আমাকে ছাড়িয়া তুমি কোথায় যাইবে? আমি কখনই তোমাকে যাইবে দিব না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “পচাজল! তুমি কাঁদিও না। সতী হইয়া পতি-সঙ্গে আমি স্বর্গে চলিলাম। সে কার্য্যে তুমি আমাকে বাধা দিও না। কি করিব পচাজল! মন্দ অদৃষ্ট করিয়া এ পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম; এ পৃথিবীতে সুখ হইল না। পতির সহিত এখন স্বর্গে যাই। আশীর্ব্বাদ করি, রাজপুত্র মশা তোমার বর হউক। পতি লইয়া তুমি সুখে ঘরকন্না কর। আমার মত হতভাগিনী যেন শক্রও না হয়।”

 এই বলিলেন,— “ভাই পচাজল! এই তিনছড়া মালা গাঁথ। একছড়া তুমি লাও, আর দুইছড়া আমার জন্য রাখ, প্রয়োজন আছে।”

 সকলে তখন খেতুকে চিতার উপর রাখিলেন। প্রেত-পিণ্ডাদি যথাবিধি প্রদত্ত হইল। নাপিত আসিয়া কঙ্কাবতীর নখ কাটিয়া দিল। তাহার পর কঙ্কাবতী শরীর হইতে সমুদয় অলঙ্কারগুলি খুলিয়া ফেলিলেন। হাতের চুড়ি ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। সেই ভাঙ্গা চুড়ি লোকে হুড়াহুড়ি কাড়াকড়ি করিয়া কুড়াইতে লাগিল। কেন না, কাহাকেও ভূত-প্রেতিনীতে পাইলে, এই চুড়ি রোগীর গলায় পরাইয়া দিলে, ভূত-প্রেতিনী ছাড়িয়া যায়।

 কঙ্কাবতী হাতের নোয় খুলিয়া স্নান করিয়া আসিলেন। খর্ব্বুরপত্নী তখন তাঁহাকে রক্তবর্ণের চেলির কাপড় পরাইয়া দিলেন। রাঙাসূতা দিয়া হাতে আলতা বাঁধিয়া দিলেন। চুলের উপর থরে থরে চিরুণি সাজাইয়া দিলেন। কপাল জুড়িয়া সিন্দুর ঢালিয়া দিলেন।

 এইরূপ বেশভূষা হইলে, কঙ্কাবতী আচমন করিয়া তিল-জল-কুশহস্তে পূর্ব্বমুখে বসিলেন। পুরোহিত তাঁহাকে মন্ত্র পড়াইয়া এইরূপ সঙ্কল্প করাইলেন।

 “অদ্য ভদ্রমাসে, কৃষ্ণপক্ষে, তৃতীয়া তিথিতে ভরদ্বাজ গোত্রের আমি শ্রীমতী কঙ্কাবতী দেবী,—বশিষ্ঠকে লইয়া অরুদ্ধতী যেরূপ মহামান্যা হইয়াছিলেন,— আমিও যেন সেইরূপ, মানুষের শরীরে যত লোম আছে, তত বৎসর স্বর্গে পতিকে লইয়া সুখে থাকিতে পারি। আমার মাতৃ-পিতৃ ও শ্বশুরকুল যেন পবিত্র হয়। যতদিন চতুৰ্দশ ইন্দ্রের অধিকার থাকিবে, ততকাল পর্যন্ত যেন অন্সরাগণ, আমাদিগের স্তব করিতে থাকে। পতির সঙ্গে যেন সুখে থাকি। ব্রহ্মহত্যা, মিত্রহত্যা ও কৃতঘ্নতাজন্য যদি পতির পাপ হইয়া থাকে, আমার স্বামী যেন সে পাপ হইতে মুক্ত হন। এই সকল কামনা করিয়া আমি পতির জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিতেছি।”

 এইরূপে পুরোহিত কঙ্কাবতীকে সঙ্কল্প করাইলেন। তাহার পর সূর্য্যার্ঘ্য দিয়া দিকপালগণকে সাক্ষী করিলেন। সে মন্ত্রের অর্থ এই—

 “অষ্ট-লোকপাল, আদিত্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, ভূমি, জল, হৃদয়স্থিত অন্তর্য্যামী পুরুষ, যম, দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, ধর্ম্ম, তোমরা সকলে সাক্ষী থাক, আমি জ্বলন্ত চিন্তারোহণ করিয়া স্বামীর অনুগমন করিতেছি।”

 লোকপালদিগকে সাক্ষী মানা হইলে, কঙ্কাবতী আঁচলে খই, খণ্ডের পরিবর্ত্তে বাতাসা ও কড়ি লইয়া, সাতবার চিতাকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন, আর সেই খই-কড়ি ছড়াইতে লাগিলেন। বালক-বালিকাগণ হুড়াহুড়ি করিয়া খই-কড়ি কুড়াইতে লাগিল। কেন না, এই খই বিছানায় রাখিলে ছারপোকা হয় না।

 উপস্থিত রমণীদিগের মধ্যে একজন সতীর নিকট হইতে তাঁহার কপালের একটু সিন্দুর চাহিয়া লইলেন। সেই রমণীর পুত্রবধু নিতান্ত শিশু, এখনও পতিভক্তি তাহার মনে উদয় হয় নাই। তাহার কপালে এই সিন্দুর পরাইয়া দিলে সে অবিলম্বে পতিপরায়ণা হইবে।

 চিতা প্রদক্ষিণ করা হইলে, পুরোহিত কঙ্কাবতীকে ঋঙ্ঘত্র পড়াইলেন। শেষে কঙ্কাবতী রক্তবতীর নিকট হইতে নক্ষত্রের মালা দুইছড়া চাহিয়া লইলেন। চিতার উপর আরোহণ করিয়া একছড়া মালা খেতুর গলায় দিলেন, একছড়া মালা আপনি পরিলেন। তাহার পর, চিতার উপর স্বামীর বামপার্শ্বে শয়ন করিলেন।

 গাছের কাঁচা ছাল দিয়া, সকলে তাঁহাকে সেই চিতার সহিত বাঁধিয়া দিলেন। তাহার পর চিতার চারিদিকে সকলে আগুন দিয়া দিলেন। আগুন দিয়া, বড় বড় কঞ্চির বোঝা, বড় বড় শরের বোঝা, বড় বড় পাটকাটির বোঝা, চারিদিক হইতে সকলে ঝুপঝাপ করিয়া চিতার উপর ফেলিতে লাগিলেন! বাদ্যকরদিগের ঢাক-ঢালের কোলাহলে সকলের কর্ণে তালি লাগিল। চিতা ধূ-ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। আকাশ প্রমাণ হইয়া অগ্নিশিখা উঠিল।

 কঙ্কাবতী অঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন! অতি সুখনিদ্রা! অতি শান্তিদায়িনী নিদ্রা!!