কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ


তৃতীয় পরিচ্ছেদ

রাজ-বেশ

কঙ্কাবতী করেন কি? সকলের অনুরোধে তাঁহাদের সঙ্গে চলিলেন। কাঁকড়া মহাশয় আগে, কঙ্কাবতী মাঝখানে, কচ্ছপ পশ্চাতে, এইরূপে তিনজনে যাইতে লাগিলেন।

 প্রথম অনেকদূর জলপথে যাইলেন, তাহার পর অনেকদূর স্থলপথে যাইলেন। পাহাড়, পর্ব্বত, বন, জঙ্গল অতিক্রম করিয়া অবশেষে বুড়ো দরজীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 বুড়ো দরজী চশমা নাকে দিয়া কাঁচি হাতে করিয়া কাপড় সেলাই করিতেছিলেন। দূরে পাহাড়পানে চাহিয়া দেখিলেন যে, তিনজন কাহারা আসিতেছে। মনে মনে ভাবিলেন,— “ও কারা আসে?” নিকটে আসিলে চিনিতে পারিলেন।

 তখন বুড়ো দরজী বলিলেন,— “কে ও কাঁকড়া ডায়া?”

 কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন,— “হাঁ দাদা! কেমন, ভাল আছ তো?”

 দরজী বলিলেন,— “আর ভাই! আমাদের আর ভাল থাকা না থাকা! এখন গেলেই হয়। তোমরা সৌখিন পুরুষ; তোমাদের কথা স্বতন্ত্র। এখন কি মনে করিয়া আসিয়াছ বল দেখি?”

 কাঁকড়া উত্তর করিলেন,— “এই কঙ্কাবতীকে আমরা আমাদের রাণী করিয়াছি। কঙ্কাবতীর জন্য ভাল জামা চাই, তাই তোমার নিকট আসিয়াছি।”

 দরজী বলিলেন,— “বটে! তা আমার নিকট উত্তম জামা আছে। ভাল পাটনাই খেরোর জামা আছে। টকটকে লাল খেরো, রঙ উঠিতে জানে না, আগগোড়া আমি বখে দিয়া সেলাই করিয়াছি। তোমাদের রাণী কঙ্কবতী যদি শিমুলতুলা হয়, তো পরাও, অতি উত্তম দেখাইবে। দামের জন্য আটক খাইবে না। এখন টিপিয়া দেখ দেখি? কঙ্কাবতী শিমুলতুলা কি না?”

 দাড়া দিয়া কাঁকড়া মহাশয় কঙ্কার্যতীর গা টিপিয়া টিপিয়া দেখিলেন। তাহার পর দরজীর পানে চাহিয়া বলিলেন,— “কৈ না! সেরূপ নরম তো নয়!”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “খেরোর খোল পরাইয়া তোমরা আমাকে বালিশ করিবে না কি? এই সকলে মিলিয়া আমাকে রাণী করিলে, তবে আবার বালিশ করিবার পরামর্শ করিতেছি কেন?”

 দরজী উত্তর করিলেন,— “ঈশ! মেয়ের যে আম্বা ভারি! বালিশ হ'বে না তো কি তাকিয়া হইতে চাও না কি?”

 দরজীর এইরূপ নিষ্ঠুর বচনে কঙ্কাবতীর মনে বড় দুঃখ হইল, কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন।

 কাঁকড়া মহাশয় বলিলেন,— “তুমি ছেলেমানুষ! আমাদের কথায় কথা কও কেন বল দেখি? যা তোমার পক্ষে ভাল তাই আমরা করিতেছি, চুপ করিয়া দেখ। চুপ কর; কাঁদিতে নাই।”

 এইরূপ সান্ত্বনা-বাক্য বলিয়া কাঁকড়া মহাশয় আপনার বড় দাড়া দিয়া কঙ্কাবতীর মুখ মুছাইয়া দিলেন। তাঁহাতে কঙ্কাবতীর মুখ ছড়িয়া গেল।

 বুড়ো দরজী বলিলেন,— “তাই তো! তবে এর গায়ের জামা আমার কাছে নাই। এর আমি কাটিতেও জানি না, সেলাই করিতেও জানি না।”

 কাঁকড়া মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তবে এখন উপায়? ভাল জামা কোথায় পাই?”

 বুড়ো দরজী বলিলেন,— “তুমি এক কাজ কর, তুমি খলীফা সাহেবের কাছে যাও। খলীফা সাহেব ভাল কারিগর; খলিফা সাহেবের মতো কারিগর এ পৃথিবীতে নাই, তাহার কাছে

নানাবিধ কাপড় আছে, সে কাপড় পরিলে খাঁদারও নাক হয়।”

 এই কথায় কাঁকড়া মহাশয়ের রাগ হইল। তিনি বলিলেন,— “তুমি কি আমাকে ঠাট্টা করিতেছ না কি? তোমার না হয় নাকটি একটু বড়, আমার না হয় নাকটি ছোট, তাতে আবার ঠাট্টা কিসের?”

 বুড়ো দরজী উত্তর করিলেন,— “না, না! তা কি কখনও হয়! তোমাকে আমি ঠাট্টা করিতে পারি? কেন? তোমার নাকটি মন্দ কি? কেবল দেখিতে পাওয়া যায় না, এই দুঃখের বিষয়।”

 বুড়ো দরজীর এইরূপ প্রিয় বচনে কাঁকড়া মহাশয়ের রাগ পড়িল। সন্তোষ লাভ করিয়া তিনি উত্তর করিলেন,— “তা বটে! তা বটে! আমার নাকটি ভাল, তবে দোষের মধ্যে যে দেখিতে পাওয়া যায় না। কোথায় আছে, আমি নিজেই খুঁজিয়া পাই না। যদি দেখিতে পাওয়া যাইত, তাহা হইলে আমার নাক দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিত, সকলেই বলিত, আহা! কাঁকড়ার কি নাক! যেন বাঁশীর মত। আর যারা ছড়া বাঁধে তারা লিখিত— 'তিল ফুল জিনি নাসা!' 'কিম্বা শুকচষ্ণু মত নাসা!' যা বল, যা কও, আমার অতি সুন্দর নাক।”

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “ব্যাপারখানা কি? আমি দেখিতেছি সব পাগলের হাতে পড়িয়াছি। এ কাঁকড়াটা তো বদ্ধ পাগল। এরে পাগলা গারদে রাখা উচিত।” মুখ ফুটিয়া কিন্তু কঙ্কাবতী কিছু বলিলেন না।

 সকলে পুনরায় সেখান হইতে চলিলেন। আগে কাঁকড়া মহাশয়, তাহার পর কঙ্কাবতী, শেষে কচ্ছপ। এইরূপে তিনজনে যাইতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে অনেকদূর গিয়া অবশেষে

খলীফা সাহেবের ঘরে উপস্থিত হইলেন। খলীফা তখন অন্দরমহলে ছিলেন।

 কাঁকড়া মহাশয় বাহির হইতে ডাকিলেন,— “খলীফা সাহেব! খলীফা সাহেব!”

 ভিতর হইতে খলিফা উত্তর দিলেন,— “কে হে! কে ডাকাডাকি করে?”

 কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন,— “আমি কাঁকড়াচন্দ্র! একবার বাহিরে আসুন, বিশেষ কাজ আছে।”

 খলীফা বাহিরে আসিলেন। কাঁকড়াচন্দ্রকে দেখিয়া অতি সমাদরে তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন।

 খলীফা বলিলেন,— “আসুন, আসুন, কাঁকড়াবাবু আসুন! আর এই যে কচ্ছপবাবুকেও দেখিতেছি! কচ্ছপবাবু! আপনি ঐ টুলটিতে বসুন, আর কাঁকড়াবাবু! আপনি ঐ চেয়ারখানি নিন! এ মেয়েটিকে বসিতে দিই কোথায়! দিব্য মেয়েটি! কাকড়া! এ কন্যাটি কি আপনার?”

 কাঁকড়চন্দ্র উত্তর করিলেন,— “না, এ কন্যাটি আমার নয়, আমি বিবাহ করি নাই। ওঁর জন্যই এখানে আসিয়াছি। ওঁরে আমরা আমাদের রাণী করিয়াছি। এক্ষণে রাজ-পরিচ্ছদের প্রয়োজন। তাই আপনার নিকট আসিয়াছি। ঐর জন্য অতি উত্তম রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিয়া দিতে হইবে।”

 খলীফা উত্তর করিলেন,— “রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিতে পারি। আমার কাছে রেশম আছে, পশম আছে, স্যাটিন আছে, মায় বারাণসী কিংখাপ পর্যন্ত আছে। কিন্তু রাজ-পোষাক তো আর অমনি হয় না? তাতে হীরা বসাইতে হইবে, মতি বসাইতে হইবে। জরি-লেস প্রভৃতি ভাল ভাল দ্রব্য লাগাইতে হইবে। অনেক টাকা খরচ হইবে। টাকা দিতে পরিবেন তো?”

 কাঁকড়াচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন,— “আমাদের টাকার অভাব কি? যত নৌকা-জাহাজ ডুবি হয়, তাহাতে যে টাকা থাকে, সে সব কোথায় যায়? সে সকল আমাদের প্রাপ্য। এক্ষণে আপনার কত টাকা চাই, তা বলুন?”

 খলিফা উত্তর করিলেন,— “যদি দুই তোড়া টাকা দিতে পারেন, তাহা হইলে উত্তম রাজ-পোষাক প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।”

 কাঁকড়া তৎক্ষণাৎ কচ্ছপের পিঠ হইতে লইয়া দুই তোড়া মোহর খলীফার সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন। খলীফা—অনেক রাজার পোষাক, অনেক বাবুর পোষাক, অনেক বরের পোষাক প্রস্তুত করিয়াছিলেন। কিন্তু একেবারে দুই তোড়া মোহর-কেহ কখনও তাঁহাকে দেয় নাই।

 মোহর দেখিয়া কঙ্কাবতী ব্যাকুল হইয়া বলিলেন,— “ও গো! তোমরা এ টাকাগুলি আমাকে দাও। আমি বাড়ী লইয়া যাই। আমার বাবা বড় টাকা ভালবাসেন, এত টাকা পাইলে বাবা কত আহ্লাদ করিবেন। এই ময়লা কাপড় পরিয়াই আমি না হয় তোমাদের রাণী হইব, ভাল কাপড়ে আমার কাজ নাই। তোমাদের পায়ে পড়ি, এই টাকাগুলি আমাকে দাও, আমি বাবাকে গিয়া দিই।”

 কাঁকড়া কঙ্কাবতীকে বকিয়া উঠিলেন। কাঁকড়া বলিলেন,— “তুমি বড় অবাধ্য মেয়ে দেখিতেছি! একবার তোমাকে মানা করিয়াছি যে, তুমি ছেলেমানুষ, আমাদের কথায় কথা কহিও না। চুপ করিয়া দেখ, আমরা কি করি।”

 কি করিবেন? কঙ্কাবতী চুপ করিয়া রহিলেন। মোহর পাইয়া খলীফার আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তিনি বলিলেন, “টাকাগুলি ভিতর রাখিয়া আসি, আর ভাল ভাল কাপড় বাহির করিয়া আনি। এইক্ষণেই তোমাদের রাণীর রাজবন্ত্র করিয়া দিব।”

 বাটীর ভিতর খলীফা দুই তোড়া মোহর লইয়া যাইলেন। আহ্লাদে পুলকিত হইয়া দন্তপাতি বাহির করিয়া একগাল হাসির সহিত সেই মোহর স্ত্রীকে দেখাইতে লাগিলেন।

 স্ত্রী অবাক! কি আশ্চর্য্য! “আজ সকালবেলা আমরা কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম?” খলীফানী এইরূপ ভাবিতে অবশেষে প্রকাশ্যে খলীফানী বলিলেন,— “এবার কিন্তু আমাকে ডায়মনকাটা তাবীজ গড়াইয়া দিতে হইবে।”

 তাহার পর খলীফা কঙ্কাবতীকে বাটীর ভিতর লইয়া গেলেন। স্ত্রীকে বলিলেন,— “ইনি রাণী। এঁর নাম কঙ্কাবতী। এঁর জন্য রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিতে হইবে। অতি সাবধানে তুমি ইহার গায়ের মাপ লও!”

 খলীফানী কঙ্কাবতীর গায়ের মাপ লইলেন। অনেক লোক নিযুক্ত করিয়া অতি সত্বর খলীফা রাজবন্ত্র প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন। খলীফা-রমণী যত্নে সেই পোষাক কঙ্কাবতীকে পরাইয়া দিলেন। রাজ-পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া কঙ্কাবতীর রূপ ফাটিয়া পড়িতে লাগিল।

 খলীফা-রমণী বলিলেন,— “আহা! মরি কি রূপ!”

 খলীফা বলিলেন,— “মরি কি রূপ!”

 সকলেই বলিলেন,— “মরি কি রূপ!”

 রাজ-পরিচ্ছদ পরা হইলে কাঁকড়া ও কচ্ছপ, কঙ্কাবতীকে লইয়া পুনরায় গৃহাভিমুখে চলিলেন। অনেক স্থল অনেক জল অতিক্রম করিয়া তিন জনে পুনরায় নদীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। সেখানে উপস্থিত হইলে, কঙ্কাবতীর মনোহর রূপ, মনোহর পরিচ্ছদ দেখিয়া, সকলেই চমৎকৃত হইল। সকলেই 'ধন্য ধন্য’ করিতে লাগিল। সকলেই বলিল,— “আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা কঙ্কাবতী হেন রাণী পাইলাম।”

 এক্ষণে একটি মহা ভাবনার বিষয় উপস্থিত হইল। জলচর জীবগণের এখন এই ভাবনা হইল যে, রাণী থাকেন কোথায়? যে-সে রাণী নয়, কঙ্কাবতী রাণী! যেরূপ জগৎসুশোভিনী মনোমোহিনী কঙ্কাবতী রাণী, সেইরূপ সুসজ্জিত, অলঙ্কৃত, মনোমোহিত অট্টালিকা চাই। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া অবশেষে সকলে স্থির করিলেন যে, রাণী কঙ্কাবতীর নিমিত্ত মতিমহলাই উপযুক্ত স্থান। যাহাকে মতি বলে, তাহাকেই মুক্তা বলে। মুক্তার যথায় উৎপত্তি, মুক্তার যথায় স্থিতি, সেই স্থানকে 'মতিমহল’ বলে।

 রুই প্রভৃতি মৎস্যগণ যোড়হাত করিয়া কঙ্কাবতীকে বলিলেন,— “রাণী ধিরাণী মহারাণী! মতিমহল আপনার বাসের উপযুক্ত স্থান, আপনি ঐ মতিমহলে গিয়া বাস করুন।”

 এইরূপে সসন্ত্রমে সম্ভাষণ করিয়া মাছেরা কঙ্কাবতীকে একটি ঝিনুক দেখাইয়া দিল। ঝিনুকের ভিতর মুক্ত হয় বলিয়া, ঝিনুকের নাম মতিমহল। কঙ্কাবতী সেই ঝিনুকের ভিতর প্রবেশ করিলেন। ঝিনুকের ভিতর বাস করিয়া কঙ্কাবতী মাছেদের রাণীগিরি করিতে লাগিলেন।