কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/ষোড়শ পরিচ্ছেদ


ষোড়শ পরিচ্ছেদ

খোক্কোশ

নাকেশ্বরী যখন খেতুকে পাইল, তখন খেতু একেবারে মৃতপ্রায় হইয়া পড়িলেন। জ্ঞান-গোচর আর তাঁহার কিছুমাত্র রহিল না। নিশ্বাস দ্বারা নাকেশ্বরী যে কঙ্কাবতীকে দূরীভূত করিল, খেতু তাহার কিছুই জানেন না।

 খেতুকে মৃতপ্রায় করিয়া নাকেশ্বরী মনে মনে ভাবিল,— “বহুকাল ধরিয়া অনাহারে আছি, ইষ্ট-দেবতা ব্যাঘ্রের প্রসাদে আজ রন্ধন করিয়া খাইতে হইবে। এমন সুখাদ্য একেলা খাইয়া তৃপ্তি হইবে না, যাই, মাসীকে গিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আনি।”

 মাসী আসিতে পাছে খাদ্য পচিয়া যায়, সেজন্য নাকেশ্বরী তখন খেতুকে একেবারে মারিয়া ফেলিল না, মৃতপ্রায় অজ্ঞান করিয়া রাখিল।

 নাকেশ্বরী মাসীকে নিমন্ত্রণ করিতে যাইল। নাকেশ্বরীর মাসীর বাড়ী অনেক দূর, সাত সমুদ্র তের নদী পার, সেই একঠেঙো মুলুকের ওধারে। সেখানে যাইতে, আবার মাসীকে লইয়া আসিতে অনেক বিলম্ব হইল।

 মাসী বুড়োমানুষ। মাসীর দাঁত নাই। খেতুর কোমল মাংস দেখিয়া মাসীর আর আহ্লাদের সীমা নাই। মাসীর মুখ দিয়া লাল পড়িতে লাগিল।

 খেতুর গা টিপিয়া টিপিয়া মাসী বলিলেন,— “আহা! কি নরম মাংস। বুড়ো হইয়াছি, একঠেঙো মানুষের দড়িপনা শক্ত মাংস আর চিবাইতে পারি না। আজ দুঠেঙো মানুষের মাংস দাগা দাগা করিয়া কাটিয়া ভাজা হউক, আঙ্গুলগুলির চড়চড়ি হউক, অন্যান্য মাংস অম্বল করিয়া রাঁধা থাকুক, দুই দিন আহার করা যাইবে, গন্ধ হইয়া যাইবে না।”

 মাসী-বোনঝিতে এইরূপ পরামর্শ হইতেছে, এমন সময় বাহিরে একটি গোল উঠিল। হাতীর বংশীধ্বনি, মশার গুনগুন, মানুষের কণ্ঠস্বর, পর্ব্বতের বাহির হইতে অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিল।

 নাকেশ্বরী ব্যস্ত হইয়া বলিল,— “মাসি! সর্ব্বনাশ হইল। মুখের গ্রাস বুঝি কাড়িয়া লয়! ছুড়ি বুঝি ওঝা আনিয়াছে।”

 মাসী বলিলেন,— “চল চল চল! দ্বারের উপর দুইজনে পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াই!”

 অট্টালিকার দ্বারের উপর নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী পদপ্রসারণ করিয়া দাঁড়াইল। পর্ব্বতের ধারে সুড়ঙ্গের দ্বারে উপস্থিত মশা, কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর হস্তীর পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলেন। হাতি-ঠাকুর-পো বাহিরে দণ্ডায়মান থাকিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া মাছি তাড়াইতে লাগিলেন। কখনও বা শুড়ে করিয়া ধূলারাশি লইয়া আপনার গায়ে পাউডার মাখিতে লাগিলেন। দোল খাইতে ইচ্ছা হইলে কখনও বা মনের সাধে শরীর দোলাইতে লাগিলেন।

 মশা, কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দ্বারে নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসীর পদতল দিয়া সকলকে যাইতে হইল।

 ভিতরে প্রবেশ করিয়া, খেতুর নিকট সকলে গমন করিলেন। সকলে দেখিলেন যে, খেতু মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছেন। অজ্ঞান অচৈতন্য। শরীরে প্রাণ আছে কি না সন্দেহ। নিশ্বাসপ্রশ্বাস বহিতেছে কি না সন্দেহ। কঙ্কাবতী তাঁহার পদপ্রান্তে পড়িয়া পা-দুটি বুকে লইয়া নানারূপ বিলাপ করিতে লাগিলেন। খর্ব্বুর খেতুকে নানা প্রকারে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

 অবশেষে খর্ব্বুর বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি কাঁদিও না। তোমার পতি এখনও জীবিত আছেন। সত্বর আরোগ্যলাভ করিবেন। আমি এইক্ষণেই এ রোগের প্রতিকার করিতেছি।”

 এই বলিয়া খর্ব্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন, খেতুর শরীরে শত শত ফুৎকার বর্ষণ করিতে লাগিলেন, নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিলেন। কিন্তু কোন ফল হইল না। সংজ্ঞাশুন্য হইয়া খেতু যেভাবে পড়িয়া ছিলেন, সেইভাবেই পড়িয়া রহিলেন। তিলমাত্রও নড়িলেন-চড়িলেন না।

 খর্ব্বুর বিস্মিত হইয়া বলিলেন,— “এ কি হইল! আমার মন্ত্র-তন্ত্র এরূপ। কখনও তো বিফল হয় না! রোগী পুনর্জ্জীবিত হউক না হউক, মন্ত্রের ফল অল্পাধিক অবশ্যই প্রকাশিত হইয়া থাকে। আজ যে আমার মন্ত্র-তন্ত্র শিকড়-মাকড় একেবারেই নিরর্থক হইতেছে, ইহার কারণ কি?”

 খর্ব্বুর সাতিশয় চিন্তিত হইলেন। ভাবিয়া কারণ কিছু স্থির করিতে পারেন না। অবশেষে তিনি বলিলেন,— “মহাপ্রভু! আসুন দেখি, সকলে পুনরায় বাহিরে যাই! বাহিরে গিয়া দেখি, ব্যাপারখানা কি?”

 অট্টালিকা হইতে সকলে পুনর্ব্বার বাহির হইলেন। কঙ্কাবতী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কঙ্কাবতী ভাবিলেন যে, অভাগিনীর কপালে পতি যদি বাঁচিবেন, তবে এত কাণ্ড হবেই বা কেন? তবে এখন তিনি পতিদেহ পাইবেন, অসীম শোকসাগরে ভাসমান থাকিয়াও সে চিন্তাটি কথঞ্চিৎ তাহার শান্তির কারণ হইল।

 একবার বাহিরে যাইয়া, সুড়ঙ্গের পথ দিয়া সকলে পুনরায় ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। অতি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে, আশপাশ, অগ্রপশ্চাৎ, উৰ্দ্ধ-নিম্ন দশদিক সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে পরীক্ষা করিতে করিতে খর্ব্বeর আসিতে লাগিলেন। অট্টালিকার নিকট আসিয়া উর্দ্ধদিকে চাহিয়া দেখেন যে, ভূতিনীদ্বয় পদপ্রসারণ করিয়া দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া আছে। খর্ব্বুর ঈষৎ হাসিলেন; আর মনে মনে করিলেন,— “বটে! তোমাদের চাতুরী তো কম নয়!”

 এবার বাহির হইতে খর্ব্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। মন্ত্রের প্রভাবে ভূতিনীদ্বয় পদ উত্তোলন করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করিল। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া খর্ব্বুর পুনরায় ঝাড়ান-কাড়ান আরম্ভ করিলেন। ক্রমে মন্ত্রবলে নাকেশ্বরী আসিয়া খেতুর শরীরে আবির্ভূত হইল। খেত বক্তা হইলেন, অর্থাৎ কি না খেতুর মুখ দিয়া ভূতিনী কথা কহিতে লাগিল। নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া, নানারূপ মন্ত্র পড়িয়া খর্ব্বুর নাকেশ্বরীকে ছাড়িয়া যাইতে বলিলেন। নাকেশ্বরী কিছুতেই ছাড়িবে না। নাকেশ্বরী বলিল যে,— “এ মনুষ্য ঘোরতর অপরাধে অপরাধী হইয়াছে, আমা-রক্ষিত সঞ্চিত ধন অপহরণ করিয়াছে। সেজন্য আমি ইহাকে কখনই ছাড়িতে পারি না, আমি ইহাকে নিশ্চয় ভক্ষণ করিব।” খর্ব্বুর পুনরায় নানারূপ মন্ত্রাদি দ্বারা নাকেশ্বরীকে অশেষ যন্ত্রণা দিতে লাগিলেন। যাতনা-ভোগে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া, অবশেষে নাকেশ্বরী খেতুকে ছাড়িয়া যাইতে সম্মত হইল। কিন্তু 'যাই যাই' বলে, তবু কিন্তু যায় না। 'এইবার যাই, এইবার চলিলাম' বারবার এই কথা বলে, তবু কিন্তু যায় না। নাকেশ্বরীর শঠতা দেখিয়া খর্ব্বুর অতিশয় বিরক্ত হইলেন। ক্রোধে তাঁহার ওষ্ঠীদ্বয় কাঁপিতে লাগিল, ক্রোধে তাঁহার চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। খর্ব্বুর বলিলেন,— 'যাবে না? বটে! আচ্ছা দেখি, এইবার যাও কি না!' এই বলিয়া তিনি একটা কুষ্মাণ্ড আনয়ন করিলেন, মন্ত্রপূত করিয়া তাহার উপর সিন্দুরের ফোঁটা দিয়া কুমড়াটিকে বলিদান দিবার উদ্যোগ করিলেন। খর্পরে কুমড়াটি রাখিয়া খর্ব্বুর খড়্গ উত্তোলন করিলেন। কোপ মারেন আর কি! এমন সময় নাকেশ্বরী অতি কাতরস্বরে চীৎকার করিয়া বলিল,— 'রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! কোপ মারিবেন না, আমাকে কাটিয়া ফেলিবেন না। আমি এখন সত্য সত্য সকল কথা বলিতেছি।'

 খর্ব্বর জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি বলিবে বল? সত্য বল, কেন তুমি ছাড়িয়া যাইতেছ না। সত্য সত্য না বলিলে, এখনি তোমাকে কাটিয়া ফেলিব।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “আমি ছাড়িয়া গেলে হইবে না। রোগী এখনি মরিয়া যাইবে। রোগীর পরমায়ুটুকু লইয়া কচুপাতে বাঁধিয়া তালগাছের মাথায় রাখিয়াছিলাম, মনে করিয়াছিলাম, মাসী আসিলে পরমায়ুটুকু বাটিয়া চাটনী করিয়া দুইজনে খাইব। তা, পরমায়ু-সহিত কচুপাতাটি বাতাসে তালগাছ হইতে পড়িয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র পিপীলিকাতে পরমায়ুটুকু খাইয়া ফেলিয়াছে। এখন আর আমি পরমায়ু কোথায় পাইব যে, রোগীকে আনিয়া দিব? সেইজন্য বলিতেছি যে, আমি ছাড়িয়া যাইলেই রোগী মরিয়া যাইবে।”

 খর্ব্বর গুণিয়া-গাঁথিয়া দেখিলেন যে, নাকেশ্বরী যাহা বলিতেছে, তাহা সত্যকথা,—মিথ্যা নয়। খর্ব্বুর মনে মনে ভাবিলেন যে,— “এইবার প্রমাদ হইল। ইহার এখন উপায় কি করা যায়? পরমায়ু না থাকিলে পরমায়ু তো আর কেহ দিতে পারে না?”

 অনেক চিন্তা করিয়া, খর্ব্বুর নাকেশ্বরীকে আদেশ করিলেন,— “যে ক্ষুদ্র পিপীলিকা ইহার পরমায়ু ভক্ষণ করিয়াছে, তুমি অনুসন্ধান করিয়া দেখ, সে খুদে পিপড়েরা এখন কোথায়?”

 নাকেশ্বরী গিয়া, তালতলায়, পাথরের ফাটালে, মাটির গর্ত্তে, কাঠের কোঠরে, সকল স্থানে সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাদিগের অন্বেষণ করিতে লাগিল। কোথাও আর তাহাদিগকে দেখিতে পাইল না। ডেওপিঁপড়ে, কাটপিঁপড়ে, শুড়শুড়ে-পিঁপড়ে, টোপ-পিঁপড়ে, যত প্রকার পিঁপড়ের সহিত সাক্ষাৎ হয়, সকলকেই নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী জিজ্ঞাসা করে,— “হাগা! খুদে-পিঁপড়েরা কোথায় গেল, তোমরা দেখিয়াছ?' খুদে-পিঁপড়ের তত্ত্ব কেহই বলিতে পারে না। বোনঝির বিপদে মাসীও ব্যথিত হইয়া চারিদিকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই বুড়ীর হাঁপ লাগিল, চলিতে চলিতে নাকেশ্বরীর মাসীর পায়ে ব্যথা হইল। তখন নাকেশ্বরীর মাসী মনে করিল,— “ভাল দুঠেঙো মানুষের মাংস খাইতে আসিয়াছিলাম বটে! এখন আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি!”

 অনুসন্ধান করিতে করিতে অবশেষে কানাপিঁপড়ের সহিত নাকেশ্বরীর সাক্ষাৎ হইল! কানাপিঁপড়েকে নাকেশ্বৱী খুদে-পিঁপড়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। কানা-পিঁপড়ে বলিল— “আমি খুদে-পিঁপড়েদের কথা জানি। তালতলায় কচুপাত হইতে মানুষের সুমিষ্ট পরমায়াটুকু চাটিয়া-চুটিয়া খাইয়া, হাত-মুখ পুঁছিয়া, খুদে-পিঁপড়েরা গৃহে গমন করিতেছিল। এমন সময় সাহেবের পোষাক-পরা একটি ব্যাঙ আসিয়া তাহাদিগকে কুপ-কুপ করিয়া খাইয়া ফেলিল।”

 অট্টালিকায় প্রত্যাগমন করিয়া নাকেশ্বরী এই সংবাদটি খর্ব্বুরকে দিল। ভেকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত খর্ব্বুর পুনরায় নাকেশ্বরীকে পাঠাইলেন। নাকেশ্বরী মনে করিল,— “ভাল কথা? আমার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইবে, আবার সেই কাজে আমাকেই খাটাইবে।” কিন্ত নাকেশ্বরী করে কি? কথা না শুনিলেই খর্ব্বুর সেই কুমড়াটি বলিদান দিবেন। এদিকে তিনি কুমড়াটি কাটিবেন, আর ওদিকে নাকেশ্বরীর গলাটি দুইখানা হইয়া যাইবে।

 বনে বনে, পথে পথে, পর্ব্বতে পর্ব্বতে, খানায় ডোবায়, নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী ভেকের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতে লাগিলেন! কোথায়, কোন গর্ত্তের ভিতর ব্যাঙ খাইয়া-দাইয়া বসিয়া আছেন, তাহার সন্ধান ভূতিনীরা কি করিয়া পাইবে? ব্যাঙের কোনও সন্ধান হইল না। নাকেশ্বরী ফিরিয়া আসিয়া খর্ব্বুরকে বলিল,— “আমাকে মারুন, আর কাটুন, ব্যাঙের সন্ধান আমি কিছুতেই করিতে পারিলাম না।”

 নাকেশ্বরীর কথা শুনিয়া খর্ব্বুর পুনরায় ঘোর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া অবশেষে তিনি একমুষ্টি সর্ষপ হাতে লইলেন। মন্ত্রপূত করিয়া সরিষাগুলিকে ছড়াইয়া ফেলিলেন। পড়া সরিষেরা নক্ষত্রবেগে পৃথিবীর চারিদিকে ছুটিল, দেশ-বিদেশ, গ্রাম-নগর, উপত্যকা-অধিত্যকা, সাগর-মহাসাগর চারিদিকে খর্ব্বুরের সরিষা-পড়া ছুটিল। পণপূর্ণ, পুরাতন, পঙ্কিল পুষ্করিণীর পার্শ্বে, সুশীতল গর্ত্তের ভিতর ব্যাঙ মহাশয় মনের সুখে নিদ্রা যাইতেছিলেন। সরিষাগণ সেইখানে গিয়া উপস্থিত ইহল। সূচের সূক্ষ্ম ধারে চর্ম্ম-মাংস ভেদ করিয়া সরিষাগণ ব্যাঙের মস্তকে চাপিয়া বসিল। ভেকের মাথা হইতে সাহেবী টুপিটি খসিয়া পড়িল। যাতনায় ব্যাঙ মহাশয় ঘোরতর চীৎকার করিতে লাগিলেন। ঠেলিয়া ঠেলিয়া সরিষার তাঁহাকে গর্ত্তের ভিতর হইতে বাহির করিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাঁহাকে অট্টালিকার দিকে লইয়া চলিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাঁহাকে সুড়ঙ্গের পথে প্রবিষ্ট করিল। অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া ব্যাঙ মহাশয় হস্ত দ্বারা দ্বারে আঘাত করিলেন।

 মশা দ্বার খুলিয়া দিলেন, ভেক মহাশয় অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিয়া যেখানে কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর বসিয়াছিলেন, সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কঙ্কাবতী চিনিলেন যে, এ সেই ব্যাঙ! ব্যাঙ চিনিলেন যে, এ সেই কঙ্কাবতী।

 ব্যাঙ বলিলেন,— “ওগো ফুটুফুটে মেয়েটি! তোমার সহিত এত আলাপ-পরিচয় করিলাম, আর তুমি আসিয়া সকলকে আমার আধুলিটির সন্ধান বলিয়া দিলে গা! ছিঃ! বাছা! তুমি এ ভাল কাজ করা নাই। ধনের গল্প গাঁটকাটাদের কাছে কি করিতে আছে? বিশেষতঃ ঐ চেপ্টা গাটকাটার কাছে। আমার আধুলির যাহা কিছু বাকী আছে, সকলে ভাগ করিয়া লও, লইয়া আমাকে এখন ছাড়িয়া দাও। চেপ্টা মহাশয়! আমি দেখিতেছি, এ সরিষাগুলি আপনার চেলা। এখন কৃপা করিয়া সরিষাগুলিকে আমার মাথাটি ছাড়িয়া দিতে বলুন। ইহাদের যন্ত্রণায় আমার প্রাণ বাহির হইতেছে!”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “তোমার আধুলিতে আমাদের প্রয়োজন কি? এ বালিকাটি তোমার পরিচিত। বালিকাটি কি ঘোর বিপদে পতিত হইয়াছে, তাহাও বোধ হয় তুমি জান। ঐ যে মৃত্যুবৎ যুবাটিকে দেখিতেছি, উনিই ইহার পতি। নাকেশ্বরী দ্বারা উনি আক্রান্ত হইয়াছেন। নাকেশ্বরী ওর পরমায়ু লইয়া তালবৃক্ষের মস্তকে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। বাতাসে সেই

পরমায়ুটুকু তলায় পড়িয়া গিয়াছিল। ক্ষুদ্র পিপীলিকারা সেই পরমায়ু ভক্ষণ করে। তুমি সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাদিগকে ভক্ষণ করিয়াছ। এক্ষণে উদরের ভিতর হইতে সেই পিপীলিকাগুলিকে বাহির করিয়া দাও। পিপীলিকাদিগের উদর হইতে পরমায়ুটুকু বাহির করিয়া কঙ্কাবতীর পতির প্রাণরক্ষা করি। পিপীলিকাগুলিকে বাহির করিয়া দিলেই সরিষাগণ তোমাকে ছাড়িয়া দিবে।”

 ব্যাঙ উত্তর করিলেন,— “এই বালিকাটি আমার পরিচিত বটে, যাহাতে ইহার মঙ্গল হয়, তাহা করিতে আমি প্রস্তুত আছি।”

 এই বলিয়া ব্যাঙ গলায় অঙ্গুলি দিয়া উদগিরণ করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু বমন কিছুতেই হইল না। তাহার পর গলায় পালক দিয়া বমন করিতে চেষ্টা করিলেন, তবুও বমন হইল না। অবশেষে খর্ব্বুর তাহাকে নানাবিধ বমনকারক ঔষধ সেবন করাইতে লাগিলেন, কিন্তু ব্যাঙের বমন আর কিছুতেই হইল না।

 খর্ব্বুর ভাবিলেন,— “এ আবার এক নূতন বিপদ! ইহার উপায় কি করা যায়?”

 খর্ব্বুর ব্যাঙের নাড়ী ধরিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। তিনি ভাবিলেন,— “এইবার চাঁদকে আমি পতনে পাইয়াছি।” চাঁদের কথা তাহার মনে পড়িল। চাঁদের মূল-শিকড় এ রোগের অব্যর্থ মহৌষধ; সেবন করাইলে এখনি ভেকের বমন হইবে।

 মশাকে সম্বোধন করিয়া খর্ব্বুর কহিলেন,— “মহাশয়! এ ব্যাঙের বমন হয়, এরূপ ঔষধ পৃথিবীতে নাই। জগতে ইহার কেবল একমাত্র ঔষধ আছে। ঐ যে আকাশে চাঁদ দেখিতে পান, ঐ চাঁদের মূল-শিকড়ের ছাল একতোলা, সাতটি মরিচ দিয়া বাটিয়া খাইলে, তবেই ব্যাঙের বমন হইবে, নতুবা আর কিছুতেই হইবে না।”

 এই কথা শুনিয়া মশা বিমর্ষ হইয়া রহিলেন। কঙ্কাবতী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মশা মহাশয়! খর্ব্বুর মহারাজ! এই হতভাগিনীর জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করিলেন। কিন্তু আপনারা কি করিবেন? এ হতভাগিনীর কপাল নিতান্তই পুড়িয়াছে। আকাশে গিয়া চাঁদের মূল-শিকড় কে কাটিয়া আনিতে পারে? চাঁদের মূল-শিকড়ও সংগ্রহ হইবে না, পতিও আমার প্রাণ পাইবেন না। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন, আমার জন্য বৃথা আর ক্লেশ পাইবেন না। আপনাদিগের অনুগ্রহে আমি যে, আমার পতির মৃতদেহটি পাইলাম, তাহাই যথেষ্ট। পতির পদ আশ্রয় করিয়া আমি এক্ষণে প্রাণ পরিত্যাগ করি। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন।”

 মশা বলিলেন,— “আমি অনেক দূর উড়িতে পারি সত্য। কিন্তু চাঁদ পর্যন্ত যে উড়িয়া যাই, এরূপ শক্তি আমার নাই। সেজন্য আমি দেখিতেছি যে, আমাদের সমুদয় পরিশ্রম বিফল হইল। আহা! রক্তবতী মা আমার পথপানে চাহিয়া আছেন! রক্তবতীকে গিয়া কি বলিব?”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আপনারা নিতান্ত হতাশ হইবেন না। একটি খোক্কোশের বাচ্ছার সন্ধান হয়? তাহা হইলে, তাহার পিছে চড়িয়া অনায়াসেই আকাশে উঠিতে পারা যায়। ধাড়ী খোক্কোশ যে তোমাদিগকে একগালে খাইয়া ফেলিবে? আচ্ছা, যেন পাকে প্রকারে তাহাকে ধরিলে। তাহার পিঠে চড়িয়া আকাশের উপর যায় কে? প্রাণটি হাতে করিয়া আকাশে যাইতে হইবে। আকাশে ভয়ানক সিপাহী আছে, আকাশের সে চৌকিদার। কর্ণে সে বধির! কানে ভাল শুনিতে পায় না বটে, কিন্তু অন্যদিকে সে বড়ই দুৰ্দান্ত সিপাহী। আকাশের লোক তাহার ভয়ে সব জড়সড়। আকাশের চারিদিকে সে পাহারা দিয়া বেড়ায়, তাহার হাতে পড়িলে আর রক্ষা নাই। তাই ভাবিতেছি, চাঁদের মূল-শিকড় কাটিয়া আনিতে আকাশে যায় কে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সেজন্য আপনাদিগের কোনও চিন্তা নাই। যদি খোক্কোশের বাচ্ছা পাই, তাহা হইলে তাহার পিঠে চড়িয়া আমি আকাশে যাইব। আমার আর ভয় কিসের? যদি আকাশে সিপাহীর হাতে পড়ি, সে না হয় আমাকে মারিয়া ফেলিবে, আর আমার সে কি করিতে পারে? পতি বিহনে আমি তো এ প্রাণ রাখিব না, এ তো আমার একান্ত প্রতিজ্ঞা! তবে প্রাণের ভয় আর কি জন্য করিব?”

 এখন খোক্কোশের বাচ্ছা ধরাই স্থির হইল! যে পাহাড়ের ধারে, গর্ত্তের ভিতর খোক্কোশের বাচ্ছা হইয়াছে, ব্যাঙ তাহার সন্ধান বলিয়া দিলেন। মশা বলিলেন,— “কৌশল করিয়া খোক্কোশের বাচ্ছা ধরিতে হইবে।”

 এইরূপ স্থির হইল যে, ব্যাঙ ও খর্ব্বুর অট্টালিকায় খেতুকে চৌকি দিয়া বসিয়া থাকিবেন, আর মশা, কঙ্কাবতী ও হাতি-ঠাকুর-পো খোক্কোশের বাচ্ছা ধরিতে যাইবেন।

 যাত্রা করিবার সময় কঙ্কাবতী, খেতুর পদধূলি লইয়া আপনার মস্তকে রাখিলেন।

 মশা, কঙ্কাবতীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কেমন কঙ্কাবতী। তুমি আকাশে উঠিতে পরিবে তো? তোমার ভয় তো করিবে না?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ভয়? আমার আবার ভয় কিসের? যদি আকাশে একবার উঠিতে পারি, তাহা হইলে দেখি, কি করিয়া চাঁদ আপনার মূল-শিকড় রক্ষা করেন। আর দেখি, আকাশের সেই বধির সিপাহীর কত ঢাল-খাড়া আছে; পতিপরায়ণা সতীর পরাক্রম আজ আকাশের লোককে দেখাইব।”