কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/একাদশ পরিচ্ছেদ


একাদশ পরিচ্ছেদ

সম্বন্ধ

কঙ্কাবতীর যত বয়স হইতে লাগিল, ততই তাঁহার রূপ বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর রূপে দশদিক আলো, কঙ্কাবতীর পানে চাওয়া যায় না। রংটি উজ্জ্বল ধবধবে, ভিতর হইতে যেন জ্যোতিঃ বাহির হইতেছে, জল খাইলে যেন জল দেখা যায়। শরীরটি স্থূলও নয়, কৃশও নয়, যেন পুতুলটি, কি ছবিখানি। মুখখানি যেন বিধাতা কুদে কাটিয়াছেন। নাকটি টিকোলোটিকোলো, চক্ষু দুটি টানা, চক্ষুর পাতা দীর্ঘ, ঘন ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চক্ষু কিঞ্চিৎ নীচে করিলে পাতার উপর পাতা পড়িয়া এক অদ্ভুত শোভার আবির্ভাব হয়। এইরূপ চক্ষু দুইটির উপর যেরূপ সরু সরু কালো কালো, ঘন ভুরুতে মানায়, কঙ্কাবতীর তাঁহাই ছিল। গাল দুটি নিতান্ত পূর্ণ নহে, কিন্তু হাসিলে টোল পড়ে। তখন সেই হাসিমাখা টোল-খাওয়া মুখখানি দেখিলে শত্রুর মনও মুগ্ধ হয়। ঠোঁট দুটি পাতলা। পান খাইতে হয় না, আপনা-আপনি সদাই টুকটুক করে। কথা কহিবার সময় ঠোঁটের ভিতর দিয়া, সাদা দুধের মত দুই-চারিটি দাঁত দেখিতে পাওয়া যায়, তখন দাঁতগুলি যেন ঝকঝক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীর খুব চুল, ঘোর কালো, ছাড়িয়া দিলে, কোঁকড়া কোঁকড়া হইয়া পিঠের উপর গিয়া পড়ে। সম্মুখের সিঁথিটি কে যেন তুলি দিয়া ঈষৎ সাদা রেখা টানিয়া দিয়াছে। স্থূলকথা, কঙ্কাবতী একটি প্রকৃত সুন্দরী, পথের লোককে চাহিয়া দেখিতে হয়, বার বার দেখিয়াও আশা মিটে না। সমবয়স্ক বালিকাদিগের সহিত কঙ্কাবতী যখন দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করেন, তখন যথার্থই যেন বিজলী খেলিয়া বেড়ায়!

 এখন কঙ্কাবতীর বয়স হইয়াছে। এখন কঙ্কাবতী সেরূপ আর দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলিয়া বেড়ান না। তবে কি জন্য একদিন একটু ছুটিয়া বাড়ী আসিয়াছিলেন। শ্রমে মুখ ঈষৎ রক্তবর্ণ হইয়াছে, গাল দিয়া সেই রক্তিমা আভা যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছে, সমস্ত মুখ টলটল করিতেছে, জগতে কঙ্কাবতীর রূপ তখন আর ধরে না।

 মা, তাহা দেখিয়া, তনু রায়কে বলিলেন,— “তোমার মেয়ের পানে একবার চাহিয়া দেখ! এ সোনার প্রতিমাকে তুমি জলাঞ্জলি দিও না। কঙ্কাবতী স্বয়ং লক্ষ্মী। এমন সুলক্ষণা মেয়ে জনমে কি কখনও দেখিয়াছ? মা যদি এই অভাগা কুটীরে আসিয়াছেন, তো, মাকে অনাস্থা করিও না। মা যেরূপ লক্ষ্মী, সেইরূপ নারায়ণ দেখিয়া মা'র বিবাহ দিও। এবার আমার কথা শুনিও।”

 তনু রায় কঙ্কাবতীর পানে একটু চাহিয়া দেখিলেন, দেখিয়া চকিত হইলেন। তনু রায়ের মন কখনও এরূপ চকিত হয় নাই। তনু রায় ভাবিলেন,— “এ কি? একেই বুঝি লোকে অপত্যস্নেহ বলে?”

 স্ত্রীর কথায় তনু রায় কোনও উত্তর করিলেন না।

 আর একদিন তনু রায়ের স্ত্রী স্বামীকে বলিলেন,— “দেখ, কঙ্কাবতীর বিবাহের সময় উপস্থিত হইল। আমার একটি কথা তোমাকে রাখিতে হইবে। ভাল, মনুষ্য-জীবনে তো আমার একটি সাধও পূর্ণ কর!”

 তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি তোমার সাধ?”

 স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “আমার সাধ এই যে, ঝি জামাই লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করি। দুই মেয়ের তুমি বিবাহ দিলে, আমার সাধ পূর্ণ হইল না, দিবারাত্রি ঘোর দুঃখের কারণ হইল। যা হউক, সে যা হইবার তা হইয়াছে; এখন কঙ্কাবতীকে একটি ভাল বর দেখিয়া বিবাহ দাও। মেয়ে দুইটি বলে যে, আমাদের কপালে যা ছিল, তা হইয়াছে, এখন ছোট বোনটিকে সুখী দেখিলে আমরা সুখী হই।”

 স্ত্রী বল, পুত্র বল, কন্যা বল, টাকার চেয়ে তনু রায়ের কেহই প্রিয় নয়। তথাপি, কঙ্কাবতীর কথা মনে পড়িলে, তাহার মন কিরূপ করে। সে কি মমতা, না আতঙ্ক? দেবীরূপী কঙ্কাবতীকে সহসা বিসৰ্জ্জন দিতে তাহার সাহস হয় না। এদিকে দুরন্ত অর্থলোভও অজেয়। ত্রিভুবনমোহিনী কন্যাকে বেচিয়া তিনি বিপুল অর্থলাভ করিবেন, চিরকাল এই আশা করিয়া আছেন। আজ সে আশা কি করিয়া সমূলে কাটিয়া ফেলেন? তনু রায়ের মনে আজ দুই ভাব। এরূপ সঙ্কটে তিনি আর কখনও পড়েন নাই।

 কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তনু রায় বলিলেন,— “আচ্ছা! আমি না হয়, কঙ্কাবতীর বিবাহ দিয়া টাকা না লইলাম! কিন্তু ঘর হইতে টাকা তো আর দিতে পারিব না? আজকাল যেরূপ বাজার পড়িয়াছে, টাকা না দিলে সুপাত্র মিলে না। তার কি করিব?”

 স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “আচ্ছা! আমি যদি বিনা টাকায় সুপাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারি, তুমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে কি না, তা আমাকে বল?”

 তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কোথায়? কে?”

 স্ত্রী বলিলেন,— “বৃদ্ধ হইলে চক্ষুর দোষ হয়, বুদ্ধি-শুদ্ধি লোপ হয়। চক্ষুর উপর দেখিয়াও দেখিতে পাও না?”

 তনু রায় বলিলেন,— “কে বল না শুনি?”

 স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “কেন খেতু?”

 তনু রায় বলিলেন,— “তা কি কখনও হয়?

 বিষয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই; এরূপ পাত্রে আমি কঙ্কাবতীকে কি করিয়া দিই। ভাল, আমি না হয় কিছু না লইলাম, মেয়েটি যাহাতে সুখে থাকে, দু’খানা গহনা-গাঁটি পরিতে পায়, তা তো আমাকে করিতে হইবে?”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “খেতুর কি কখনও ভাল হইবে না? তুমি নিজেই না বল যে 'খেতু ছেলেটি ভাল, খেতু দু’পয়সা আনিতে পরিবে?' যদি কপালে থাকে তো খেতু হইতেই কঙ্কাবতী কত গহনা পরিবে। কিন্তু, গহনা হউক আর না হউক, ছেলেটি ভাল হয়, এই আমার মনের বাসনা। খেতুর মত ছেলে পৃথিবী খুঁজিয়া কোথায় পাইবে, বল দেখি? মা কঙ্কাবতী আমার যেমন লক্ষ্মী, খেতু তেমনি দুর্লভ সুপাত্র। এক বোঁটায় দুইটি ফুল সাধ করিয়া বিধাতা যেন গড়িয়াছেন!"

 তনু রায় বলিলেন,— “ভাল, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে। এখন তাড়াতাড়ি কিছু নাই।”

 আরও কিছুদিন গত হইল। কলিকাতা হইতে খেতুর মা’র নিকট একখানি চিঠি আসিল। সেই চিঠিখানি তিনি তনু রায়কে দিয়া পড়াইলেন। পত্রখানি রামহরি লিখিয়াছিলেন। তাহার মর্ম্ম এই—

 “খেতুর বিবাহের জন্য অনেক লোক আমার নিকট আসিতেছেন। আমাকে তাহারা বড়ই ব্যস্ত করিয়াছেন। আমার ইচ্ছা যে, লেখাপড়া সমাপ্ত হইলে, তাহার পর খেতুর বিবাহ দিই। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তিগণ সে কথা শুনিবেন কেন? তাঁহারা বলেন, কথা স্থির হইয়া থাকুক, বিবাহ না হয় পরে হইবে। আমি অনেকগুলি কন্যা দেখিয়াছি। তাহাদিগের মধ্যে জন্মেজয়বাবুর কন্যা আমার মনোনীত হইয়াছে। কন্যাটি সুন্দরী, ধীর ও শান্ত। বংশ সৎ, কোনও দোষ নাই। মাতা-পিতা, ভাই-ভগিনী বর্ত্তমান। কন্যার পিতা সঙ্গতিপন্ন লোক। কন্যাকে নানা অলঙ্কার ও জামাতাকে নানা ধন দিয়া বিবাহ কার্য্য সমাধা করিবেন। এক্ষণে আপনার কি মত জানিতে পারিলে কন্যার পিতাকে আমি সঠিক কথা দিব।”

 পত্রখানি পড়িয়া তনু রায় অবাক। দুঃখী বলিয়া যে খেতুকে তিনি কন্যা দিতে অস্বীকার, আজ নানা ধন দিয়া সেই খেতুকে জামাতা করিবার নিমিত্ত লোকে আরাধনা করিতেছে।

 খেতুর মা রামহরিকে উত্তর লিখিলেন,— “আমি স্ত্রীলোক, আমাকে আবার জিজ্ঞাসা কর কেন? তুমি যাহা করিবে, তাহাই হইবে। তবে আমার মনে একটি বাসনা ছিল, যখন দেখিতেছি, সে বাসনা পূর্ণ হইবার নহে, তখন সে কথায় আর আবশ্যক নাই।”

 এই পত্র পাইয়া, রামহরি খেতুকে সকল কথা বলিলেন, আর এ বিষয়ে খেতুর কি মত, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! মা’র মনের বাসনা কি, তাহা আমি বুঝিয়াছি। যতদিন মা’র সাধ পূর্ণ হইবার কিছুমাত্রও আশা থাকিবে, ততদিন কোনও স্থানে আপনি কথা দিবেন না।”

 রামহরি বলিলেন,— “হাঁ, তাহাই উচিত। তোমার বিবাহ বিষয়ে আমি এক্ষণে কোন স্থানে কথা দিব না।”

 খেতুর অন্য স্থানে বিবাহ হইবে, এই কথা শুনিয়া কঙ্কাবতীর মা একেবারে শরীর ঢালিয়া দিলেন। স্বামীর নিকট রাত্রি-দিন কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন।

 এদিকে তনু রায়ও কিছু চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, “আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। দুইটি বিধবা গলায়, পুত্রটি মূর্খ। এখন একটি অভিভাবকের প্রয়োজন। খেতু যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করিতেছে, খেতু যেরূপ সুবোধ, তাহাতে পরে তাহার নিশ্চয় ভাল হইবে। আমাকে সে একেবারে এখন কিছু না দিতে পারে, না পারুক; পরে, মাসে মাসে আমি তাহার নিকট হইতে কিছু কিছু লইব।”

 এইরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন,— “তুমি যদি খেতুর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ স্থির করিতে পার, তাহাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি খরচপত্র কিছু করিতে পারিব না।”

 এইরূপ অনুমতি পাইয়া তনু রায়ের স্ত্রী, তৎক্ষণাৎ খেতুর মা'র নিকট দৌড়িয়া যাইলেন, আর খেতুর মা'র পায়ের ধুলা লইয়া তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন।

 খেতুর মা বলিলেন,— “কষ্কাবতী আমার বৌ হইবে, চিরকাল আমার এই সাধ। কিন্তু বোন! দুই দিন আগে যদি বলিতে? অন্য স্থানে কথা স্থির করিতে আমি রামহরিকে চিঠি লিখিয়াছি। রামহরি যদি কোন স্থানে কথা দিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কথা আর নড়িবার নয়। তাই আমার মনে বড় ভয় হইতেছে।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “দিদি। যখন তোমার মত আছে, তখন নিশ্চয় কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হইবে। তুমি একখানি চিঠি লিখিয়া রাখ। চিঠিখানি লোক দিয়া পঠাইয়া দিব।”

 তাহার পরদিন খেতুর মা ও কঙ্কাবতীর মা দুই জনে মিলিয়া কলিকাতায় লোক পাঠাইলেন। খেতুর মা রামহরিকে একখানি পত্র লিখিলেন।

 খেতুর মা লিখিলেন যে,— “কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হয়, এই আমার মনের বাসনা। এক্ষণে তনু রায় ও তাঁহার স্ত্রী, সেইজন্য আমার নিকট আসিয়াছেন। অন্য কোনও স্থানে যদি খেতুর বিবাহের কথা স্থির না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা কঙ্কাবতীর সহিত স্থির করিয়া তনু রায়কে পত্র লিখিবে।”

 এই চিঠি পাইয়া রামহরি, তাঁহার স্ত্রী ও খেতু, সকলেই আনন্দিত হইলেন। খেতুর হাতে পত্রখানি দিয়া বলিলেন,— “তোমার মার আজ্ঞা, ইহার উপর আর কথা নাই।”

 খেতু বলিলেন,— “মার যেরূপ অনুমতি, সেইরূপ হইবে। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই নাই। তনু কাকা তো মেয়েগুলিকে বড় করিয়া বিবাহ দেন। আর দুই-তিন বৎসর তিনি অনায়াসেই রাখিতে পরিবেন। ততদিনে আমার সব পাসগুলিও হইয়া যাইবে। ততদিনে আমিও দু’পয়সা আনিতেও শিখিব। আপনি এই মর্ম্মে তনু কাকাকে পত্র লিখুন।”

 রামহরি তনু রায়কে সেইরূপ পত্র লিখিলেন। তনু রায় সেকথা স্বীকার করিলেন। বিলম্ব হইল বলিয়া তাহার কিছুমাত্র দুঃখ হইল না, বরং তিনি আহ্লাদিত হইলেন।

 তিনি মনে করিলেন,— “স্ত্রীর কান্নাকাটিতে আপাততঃ একথা স্বীকার করিলাম। দেখি না, খেতুর চেয়ে ভাল পাত্র পাই কি না? যদি পাই—। আচ্ছা, সেকথা তখন পরে বুঝা যাইবে।”

 খেতুর মা, নিরঞ্জনকে সকল কথা বলিয়াছিলেন, নিরঞ্জন মনে করিলেন,— “বৃদ্ধ হইয়া তনু রায়ের ধর্ম্মে মতি হইতেছে।”

 কঙ্কাবতী আজ কয়দিন বিরস-বদনে ছিলেন। সকলে আজি কঙ্কাবতীর হাসি-হাসি মুখ দেখিল। সেইদিন তিনি মেনীকে কোলে লইয়া বিরলে বসিয়া কত যে তাহাকে মনের কথা বলিলেন, তাহা আর কি বলিব! মেনী এখন আর শিশু নহে, বড় একটি বিড়াল। সুতরাং কঙ্কাবতী যে তাহাকে মনের কথা বলিলেন, তাহার আর আশ্চর্য্য কি?