কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ


চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

গদাধর-সংবাদ

গদাধর ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী মহাশয়কে কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া অতি দূরে সে মাটিতে বসিল।

 চৌধুরী মহাশয় বলিলেন,— “কেমন হে গদাধর! এ কি কথা শুনিতে পাই? শিবচন্দ্রের ছেলেটা, ঐ খেতা, কি খাইয়াছিল? তুমি কি দেখিয়াছিলে? কি শুনিয়াছিলে? তাহার সহিত তোমার কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল? সমুদয় বল, কোনও বিষয় গোপন করিও না।”

 গদাধর বলিল,— “মহাশয়! আমি মুর্খ মানুষ। অতশত জানি না। যাহা হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতেছি।”

 গদাধর বলিল,— “আর-বৎসর আমি কলিকাতায় গিয়াছিলাম। কোথায় থাকি? তাই রামহরির বাসায় গিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা বাহিরের ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় এক মিন্‌ষে হাড়ী মাথায় করিয়া পথ দিয়া কি শব্দ করিতে করিতে যাইতেছিল। সেই শব্দ শুনিয়া রামহরিবাবুর ছেলেটি বাটীর ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, আর খেতুকে বলিল,— 'ককা, কাকা! কুলকী যাইতেছে, আমাকে কিনিয়া দাও।' খেতু তাহাকে দুই পয়সার কিনিয়া দিলেন। তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'গদাধর! তুমি কুলকী খাইবে?' আমি বলিলাম, ‘না দাদাঠাকুর! আমি কুলকী খাই না।' রামহরিবাবুর ছেলে খেতুকে বলিল,— 'কাকা! তুমি খাইবে না?' খেতু বলিলেন,— 'না, আমার পিপাসা পাইয়াছে, ইহাতে পিপাসা ভাঙ্গে না, আমি কাঁচা বরখ খাইব।' এই কথা বলিয়া খেতু বাহির যাইলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি সাদা ধবধবে কাচের মত ঢিল গামছায় বাঁধিয়া বাটী আনিলেন। সেই টিলটি ভাঙ্গিয়া জলে দিলেন, সেই জল খাইতে লাগিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— 'দাদাঠাকুর ও কি?' খেতু বলিলেন,— 'ইহার নাম বরখ। এই দিনে যখন বড় পিপাসা হয়, তখন ইহা জলে দিলে জল শীতল হয়। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— 'দাদাঠাকুর! সকল কাচ কি জলে দিলে জল শীতল হয়?' খেতু উত্তর করিলেন,— 'এ কাচ নয়, এ বরখ। জল জমিয়া ইহা প্রস্তৃত হয়। ইহা জল। নদীতে যে জল দেখিতে পাও, ইহাও তাই, জমিয়া গিয়াছে এইমাত্র। আকাশ হইতে যে শিল পড়ে, বরখ তাহাই। সাহেবেরা বরখ কলে প্রস্তুত করেন। একটু হাতে করিয়া দেখ দেখি?' এই বলিয়া আমার হাতে একটুখানি দিলেন। হাতে রাখিতে না রাখিতে আমার হাত যেন করাত দিয়া কাটিতে লাগিল। আমি হাতে রাখিতে পারিলাম না, আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর খেতু বলিলেন,— 'গদাধর! একটু খাইয়া দেখ না? ইহাতে কোনও দোষ নাই।' আমি বলিলাম,— 'না দাদাঠাকুর! তোমরা ইংরেজি পড়িয়াছ, তোমাদের সব খাইতে আছে, তাহাতে কোনও দোষ হয় না। আমি ইংরেজি পড়ি নাই। সাহেবেরা যে দ্রব্য কলে প্রস্তুত করেন, সে দ্রব্য খাইলে আমাদের অধর্ম্ম হয়, আমাদের জাতি যায়।”

 চৌধুরী মহাশয়কে সম্বোধন করিয়া গদাধর বলিল,— “ধর্ম্মবতার! আমি যাহা দেখিয়ছিলাম, তাহা আপনাকে বলিলাম। তারপর খেতু আমাকে অনেক সেকালের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, অনেক সেকালের কথাবার্ত্তা হইল, সে বিষয় এখানে আর বলিবার আবশ্যক নাই।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “না না, কি কথা হইয়াছিল, তুমি সমুদয় বল। কোনও কথা গোপন করিবে না।”

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণিকে সম্বোধন করিয়া গদাধর বলিল,— “শিরোমণি মহাশয়! সেই গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা গো।”

 শিরোমণি বলিলেন,— “সে বাজে কথা। সে কথা আর তোমাকে বলিতে হইবে না।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “না না, খেতার সহিত তোমার কি কথা হইয়াছিল, আমি সকল কথা শুনিতে ইচ্ছা করি। গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা আমি অল্প অল্প শুনিয়াছিলাম, গ্রামের সকলেই সে কথা জানে। তবে খেতা তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করিল, আর তুমি কি বলিলে, সে কথা আমি জানিতে ইচ্ছা করি।”

 গদাধর বলিতেছে,— “তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, — 'গদাধর! আমাদের মাঠে সেকালে না কি মানুষ মারা হইত? আর তুমি না কি সেই কাজের একজন সর্দ্দার ছিলে?' আমি উত্তর করিলাম,— 'দাদাঠাকুর! উচঙ্কা বয়সে কোথায় কি করিয়াছি, কি না করিয়াছি, সে কথায় এখন আর কাজ কি? এখন তো আর সেসব নাই? এখন কোম্পানীর কড়া হুকুম।' খেতু বলিলেন,— 'তা বটে, তবে সেকালের ঠেঙ্গাড়েদের কথা আমার শুনিতে ইচ্ছা হয়। তুমি নিজে হাতে এসব করিয়াছ, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। তোমরা দুই-চারি জন যা বৃদ্ধ আছ, মরিয়া গেলে, আর এসব কথা শুনিতে পাইব না। আর দেখ, গ্রামের সকলেই তো জানে যে, তুমি এ কাজের একজন সর্দ্দার ছিলে!' আমি বলিলাম,— 'না দাদাঠাকুর। আপনারা থাকিতে আমরা কি কোনও কাজের সর্দ্দার হইতে পারি? আপনারা ব্রাহ্মণ, আমাদের দেবতা! সকল কাজের সর্দ্দার আপনারা।' তাহার পর খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'তবে তোমাদের দলের সর্দ্দার কে ছিলেন?' আমি বলিলাম,— 'আজ্ঞা! আমাদের দলের সর্দ্দার ছিলেন, কমল ভট্টাচার্য্য মহাশয়! এক সঙ্গে কাজ করিতাম বলিয়া তাঁহাকে আমরা কমল কমল বলিয়া ডাকিতাম। তিনি এক্ষণে মরিয়া গিয়াছেন।' খেতু তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'গদাধর! তোমরা কখনও ব্রাহ্মণ মারিয়াছ?' আমি বলিলাম,— 'আজ্ঞা, মাঠের মাঝখানে যারে পাইতাম, তাহাকেই মারিতাম। তাহাতে কোনও দোষ নাই। পরিচয় লইয়া মাথায় লাঠি মারিতে গেলে আর কাজ চলে না। পথিকের কাছে কি আছে না আছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াও মারিতে গেলে চলে না। প্রথমে মারিয়া ফেলিতে হইত। তাহার পর গলায় পৈতা থাকিলে জানিতে পারিতাম যে, সে লোকটি ব্রাহ্মণ, না থাকিলে বুঝিতাম যে, সে শূদ্র। আর প্রাপ্তির বিষয় যেদিন যেরূপ অদৃষ্ট থাকিত, সেইদিন সেইরূপ হইত। কত হতভাগা পথিককে মারিয়া শেষে একটি পয়সাও পাই নাই। ট্যাকে, কাচায়, কোঁচায় খুঁজিয়া একটি পয়সাও বাহির হয় নাই। সে বেটারা জুয়াচোর, দুষ্ট, বজ্জাৎ। পথ চলিবে বাপু, টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়া চল। তা না শুধু হাতে! বেটাদের কি অন্যায় বলুন দেখি, দাদাঠাকুর? একটি মানুষ মারিতে কি কম পরিশ্রম হয়? খালিহাতে রাস্তা চলিয়া আমাদের সব পরিশ্রম বেটারা নষ্ট করিত।' খেতু আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'হাঁ গদাধর! মানুষের প্রাণ কি সহজে বাহির হয় না?' আমি বলিলাম,— 'সকলের প্রাণ সমান নয়। কেহ বা লাঠি খাইতে না খাইতে উদ্দেশে মরিয়া যায়। কেহ বা ঠুশ করিয়া একঘা খাইয়াই মরিয়া যায়। আর কাহাকেও বা তিন-চারি জনে পড়িয়া পঞ্চাশ লাঠিতেও মারিতে পারা যায় না। একবার একজন ব্রাহ্মণকে মারিতে বড়ই কষ্ট হইয়াছিল।' খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'কি হইয়াছিল?”

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণির পানে চাহিয়া গদাধর বলিল,— “শিরোমণি মহাশয়! সেই কথা গো!”

 শিরোমণি বলিলেন,— “চৌধুরী মহাশয়! আপনার আর ওসব পাপ কথা শুনিয়া কাজ নাই। এক্ষণে ক্ষেত্রচন্দ্রকে লইয়া কি করা যায়, আসুন, তাহার বিচার করি। সাহেবের জল পান করিয়া অবশ্যই তিনি সাহেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই!”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “না না! খেতার সহিত গদাধরের কি কি কথা হইয়াছিল, আমি সমস্ত শুনিতে চাই। ছোঁড়া যে গদাধরকে এত কথা জিজ্ঞাসা করিল, তাহার অবশ্যই কোনও না কোনও দুরভিসন্ধি থাকিবে। গদাধর! তাহার পর কি হইল, বল।”

 গদাধর পুনরায় বলিতেছে,— “খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ব্রাহ্মণ মারিতে কষ্ট হইয়াছিল কেন?' আমি বলিলাম,— 'দাদাঠাকুর, কোথা হইতে একবার তিনজন ব্রাহ্মণ আমাদের গ্রামে গরদের কাপড় বেচিতে আসেন। গ্রামে তাহারা থাকিবার স্থান পাইতেছিলেন না। বাসার অন্বেষণে পথে পথে ফিরিতেছিলেন। আমার সঙ্গে পথে দেখা হইল। একটি পাতা হাতে করিয়া আমি তখন ব্রাহ্মণের পদধূলি আনিতে যাইতেছিলাম। প্রত্যহ ব্রাহ্মণের পদধূলি না খাইয়া আমি কখনও জলগ্রহণ করি না। ব্রাহ্মণ দেখিয়া আমি সেই পাতায় তাঁহাদের পদধূলি লইলাম, আর বলিলাম,— 'আসুন আমার বাড়ীতে, আপনাদিগকে বাসা দিব।' তাহারা আমার বাড়ীতে বাসা লইলেন। আমাদের গ্রামে তিন দিন রহিলেন, অনেকগুলি কাপড় বেচিলেন, অনেক টাকা পাইলেন। আমি সেই সন্ধান কমলকে দিলাম। কমলেতে আমাতে পরামর্শ করিলাম যে, তিনটিকে সাবাড়া করিতে হইবে।' দলস্থ অন্য কাহাকেও কিছু বলিলাম না, কারণ, তাহা হইলে ভাগ দিতে হইবে। কমলকে বলিলাম,— 'তুমি আগে গিয়া মাঠের মাঝখানে লুকাইয়া থাক। অতি প্রত্যুষে ইহাদিগকে আমি সঙ্গে লইয়া যাইব। দুই জনেই সেইখানে কার্য্য সমাধা করিব।” তাহার পরদিন প্রত্যুষে আমি সেই তিন জন ব্রাহ্মণকে পথ দেখাইবার জন্য লইয়া চলিলাম! ভগবানের এমনি কৃপায় যে, সেদিন ঘোর কোয়াসা হইয়াছিল, কোলের মানুষ দেখা যায় না। নির্দ্দষ্ট স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র কমল বাহির হইয়া একজনের মাথায় লাঠি মারিলেন। আমিও সেই সময় আর একজনের মাথায় লাঠি মারিলাম। তাঁরা দুই জনেই পড়িয়া গেলেন। আমরা সেই দুই জনকে শেষ করিতেছি, এমন সময় তৃতীয় ব্রাহ্মণটি পলাইলেন। কমল তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌঁড়িলেন, আমিও আমার কাজটি সমাধা করিয়া তাঁহাদিগের পশ্চাৎ দৌঁড়িলাম। ব্রাহ্মণ গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলেন। শিরোমণি মহাশয়ের বাটীতে গিয়া,— 'ব্রহ্মহত্যা হয়! প্রাণ রক্ষা করুন', —এই বলিয়া আশ্রয় লইলেন। অতি স্নেহের সহিত শিরোমণি মহাশয় তাহাকে কোলে করিয়া লইলেন। শিরোমণি মহাশয় তাহাকে মধুর বচনে বলিলেন,— 'জীবন ক্ষণভঙ্গুর! পদ্মপত্রের উপর জলের ন্যায়। সে জীবনের জন্য এত কাতর কেন বাপু?' এই বলিয়া ব্রাহ্মণকে পাঁজা করিয়া বাটীর বাহিরে দিয়া শিরোমণি মহাশয় ঝনাৎ করিয়া বাটীর দ্বারটি বন্ধ করিয়া দিলেন। কমল পুনরায় ব্রাহ্মণকে মাঠের দিকে তাড়াইয়া লইয়া চলিলেন। ব্রাহ্মণ যখন দেখিলেন যে, আর রক্ষা নাই, কমল তাঁহাকে ধর-ধর হইয়াছেন, তখন তিনি হঠাৎ ফিরিয়া কমলকে ধরিলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত দুই জনে হুটাহুটি হইল। হাতীর মত কমলের শরীরে বল, কমলকে তিনি পরিবেন কেন? কমল তাঁহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিলেন, তাঁহার বুকের উপর চড়িয়া বসিলেন, তাঁহার নাতিকুণ্ডলে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি বসাইয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ-দেবতার এমনি কঠিন প্রাণ যে, তিনি অজ্ঞানও হন না, মরেনও না। ক্রমাগত কেবল এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন,— 'হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর! হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর! বাপসকল! ব্রহ্মহত্যা হয়! কে কোথা আছ? আসিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর!' আমি পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। কোনদিকে ব্রাহ্মণ পলাইয়াছেন, আর কমল বা কোনদিকে গিয়াছেন, কোয়াসার জন্য তাহা আমি দেখিতে পাই নাই। এখন ব্রাহ্মণের চীৎকার শুনিয়া আমি সেইদিকে দৌঁড়িলাম। গিয়া দেখি, ব্রাহ্মণ মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছেন, কমল তাঁহার বুকের উপরে, কমল আপনার দুই হাত দিয়া ব্রাহ্মণের দুটি হাত ধরিয়া মাটিতে চাপিয়া রাখিয়াছেন, কমলের বাম পা মাটিতে রহিয়াছে, দক্ষিণ পা ব্রাহ্মণের উদরে, এই পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘোরতর বলের সহিত ব্রাহ্মণের নাভির ভিতর প্রবেশ করাইতেছেন। পড়িয়া পড়িয়া ব্রাহ্মণ চীৎকার করিতেছেন। কমল আমাকে বলিলেন,— 'এ বামুন বেটা কি বজ্জাৎ! বেটা যে মরে না হে! গদাধর! শীঘ্র একটা যা-হয় কর। তা না হইলে বেটার চীৎকারে লোক আসিয়া পড়িবে। আমার হাতে তখন লাঠি ছিল না, নিকটে একখান পাথর পড়িয়ছিল। সেই পাথরখানি লইয়া আমি ব্রাহ্মণের মাথাটি ছেঁচিয়া দিলাম। তবে ব্রাহ্মণের প্রাণ বাহির হইল। যাহা হউক, এই ব্রাহ্মণকে মারিতে পরিশ্রম হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেবার লাভও বিলক্ষণ হইয়াছিল। অনেকগুলি টাকা আর অনেক গরদের কাপড় আমরা পাইয়াছিলাম। কি করিয়া নশিরাম সর্দ্দার এই কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন। নশিরাম ভাগ চাহিলেন। আমরা বলিলাম,— 'এ কাজে তোমাকে কিছু করিতে হয় নাই, তোমাকে আমরা ভাগ দিব কেন?' কথায় কথায় কমলের সহিত নশিরামের ঘোরতর বিবাদ বাধিয়া উঠিল; ক্রমে মারামারি হইবার উপক্রম হইল। কমল পৈতা ছিড়িয়া নশিরামকে শাপ দিলেন। কমল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ। সাক্ষাৎ অগ্নিস্বরূপ! শিষ্য-যজমান আছে। সেরূপ ব্রাহ্মণের অভিশাপ ব্যর্থ হইবার নহে। পাঁচ-সাত বৎসরের মধ্যেই মুখে রক্ত উঠিয়া নিশিরাম মরিয়া গেল। যাহা হউক, সেইসব কাপড় হইতে একেজোড়া ভাল গারদের কাপড় আমরা শিরোমণি মহাশয়কে দিয়াছিলাম। যখন সেই গরদের কাপড়খানি পরিয়া, দোবজটি কাঁধে ফেলিয়া, ফোঁটাটি কাটিয়া, শিরোমণি মহাশয় পথে যাইতেন, তখন সকলে বলিত,— 'আহা! যেন কন্দৰ্পপুরুষ বাহির হইয়াছেন!’ বয়সকালে মহাশয়ের রূপ দেখে কে? না, শিরোমণি মহাশয়?”

 শিরোমণি মহাশয় বলিলেন,— “গদাধর! গদাধর! তোমার এরূপ বাক্য বলা উচিত নয়। তুমি যাহা বলিতেছ, তাহার আমি কিছুই জানি না। পীড়া-শীড়ায় তোমার বুদ্ধি লোপ হইয়াছে, আমি তোমার জন্য নারায়ণকে তুলসী দিব। তাহা হইলে তোমার পাপক্ষয় হইবে।”

 নিরঞ্জন এই সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিতেছিলেন, মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছিলেন, আর বলিতেছিলেন,— “হা মধুসূদন! হা দীনবন্ধু!”

 জনার্দ্দন চৌধুরী কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার পর কি হইল গদাধৱ?”

 গদাধর উত্তর করিল,— “তাহার পর আর কিছু হয় নাই। খেতু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, অন্যমনস্কভাবে আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'একটু বরফ খাবে গদাধর?' আমি বলিলাম,— 'না দাদাঠাকুর! আমি বরফ খাইব না, বরফ খাইলে আমার অধর্ম্ম হইবে, আমার জাতি যাইবে।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “তবে তুমি নিশ্চয় বলিতেছ যে, খেতু বরফ খাইয়াছে?”

 গদাধর উত্তর করিল,— “আজ্ঞা হাঁ, ধর্ম্মাবতার! আমি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আপনি ব্রাহ্মণ! আপনার পায়ে হাত দিয়া আমি দিব্য করিতে পারি।”