কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ


ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

বিড়ম্বনা

দেখিতে দেখিতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর এক্ষণে কুড়ি বৎসর বয়স। যা কিছু পাশ ছিল, খেতু সব পাশগুলি দিলেন। বাহিরেরও দুই-একটি পাশ দিলেন। শীর্ঘ একটি উচ্চপদ পাইবেন, খেতু এরূপ আশা পাইলেন।

 রামহরি ও রামহরির স্ত্রী ভাবিলেন যে, এক্ষণে খেতুর বিবাহ দিতে হইবে। দিন স্থির করিবার নিমিত্ত তাহারা খেতুর মাকে পত্র লিখিলেন।

 পত্রের প্রত্যুত্তরে খেতুর মা অন্যান্য কথা বলিয়া অবশেষে লিখিলেন,— “তনু রায়কে বিবাহের কথা কিছু বলিতে পারি নাই। আজকাল সে বড়ই ব্যস্ত, তাহার দেখা পাওয়া ভার। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে। মহাসমারোহে শ্রাদ্ধ হইবে, এই কার্য্যে তনু রায় একজন কর্ত্তা হইয়াছেন। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীর ধন্য কপাল! পুত্র দৌহিত্র চারিদিকে জাজ্বল্যমান রাখিয়া, অশীতিপর স্বামীর কোলে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে ইহার চেয়ে স্ত্রীলোকের পুণ্যবল আর কি হইতে পারে? যখন তাঁহাকে ঘাটে লইয়া যায়, তখন আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। সকলে একমাথা সিন্দুর দিয়া দিয়াছে, আর ভাল একখানি কস্তাপেড়ে কাপড় পরাইয়া দিয়াছে। আহা! তখন কি শোভা হইয়াছিল! যাহা হউক, তনু রায়ের একটু অবসর হইলে, আমি তাহাকে বিবাহের কথা বলিব।”

 কিছুদিন পরে খেতুর মা, রামহরিকে আর একখানি পত্র লিখিলেন। তাহার মর্ম্ম এই—

 “বড় ভয়ানক কথা শুনিতেছি। তনু রায়ের কথার ঠিক নাই। তাহার দয়া-মায়া নাই, তাহার ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান নাই। শুনিতেছি, সে না কি জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে। কি ভয়ানক কথা! আর জনার্দ্দন চৌধুরীও পাগল হইয়াছে না কি? পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে বর্ত্তমান। বয়সের গাছপাথর নাই। চলিতে ঠক-ঠক করিয়া কাঁপে। ঘাটের মড়া! তার আবার এ কুবুদ্ধি কেন? বিষয় থাকিলে, টাকা থাকিলে, এরূপ করিতে হয় না কি? তিনি বড়মানুষ, জমীদার, না হয় রাজা! তা বলিয়া কি একেবারে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়? বৃদ্ধ মনে ভাবে না। যে, মৃত্যু সন্নিকট? যেরূপ তাহার অবস্থা, তাহাতে আর কয়দিন? লাঠি না ধরিয়া একটি পা চলিতে পারে না। কি ভয়ানক কথা! আর তনু রায় কি নিকষা! দুধের বাছা কঙ্কাবতীকে কি করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করিবে? কঙ্কাবতীর কপালে কি শেষে এই ছিল? সেই মধুমাখা মুখখানি মনে করিলে, বুক ফাটিয়া যায়। শুনিতে পাই, কঙ্কাবতীর মা না কি রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন। আমি ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু আসেন নাই। বলিয়া পাঠাইলেন যে, দিদির কাছে আর মুখ দেখাইব না, এ কালা মুখ লোকের কাছে আর বাহির করিব না। এই বিবাহের কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আহা! তাহার মা'র প্রাণ! কতই না তিনি কাতর হইয়া থাকিবেন?”

 এই চিঠিখানি পাইয়া রামহরি খেতুকে দেখাইলেন। খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! আমি এইক্ষণে দেশে যাইব।”

 রামহরি বলিলেন,— “জনার্দ্দন চৌধুরী বড়লোক, তুমি সহায়হীন বালক, তুমি দেশে গিয়া কি করিবে?”

 খেতু বলিলেন,— “আমি কিছু করিতে পারিব না সত্য, তথাপি নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নয়। কঙ্কাবতীকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করাও কর্ত্তব্য। কৃতকার্য্য না হই, কি করিব?”

 খেতু দেশে আসিলেন। মা'র নিকট ও পাড়া-প্রতিবেশীর নিকট সকল কথা শুনিলেন। শুনিলেন যে, জনার্দ্দন চৌধুরী প্রথমে কিছুতেই বিবাহ করিতে সম্মত হন নাই। কেবল তাঁহার সভাপণ্ডিত গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া সম্মত করিয়াছেন।

 বৃদ্ধ হইলে কি হয়? জনার্দ্দন চৌধুরীর শ্রী-চাঁদ আছে, প্রাণে সখও আছে। দুর্লভ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মাল্য দ্বারা গলদেশ তাঁহার সর্ব্বদাই সুশোভিত থাকে। কফের ধাতু বলিয়া শৈত্য নিবারণের জন্য চূড়াদার টুপি মস্তকে তাঁহার দিন-রাত্রি বিরাজ করে। এইরূপ বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া নিভৃতে বসিয়া যখন তিনি গোবৰ্দ্ধন শিরোমণির সহিত বিবাহ-বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন তাঁহার রূপ দেখিয়া ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণকেও লজ্জায় অধোমুখ হইতে হয়।

 খেতু শুনিলেন যে, জনার্দ্দন চৌধুরী বিবাহ করিবার জন্য এখন একেবারে পাগল হইয়া উঠিয়াছেন। আর বিলম্ব সহে না। এই বৈশাখ মাসের ২৪শে তারিখে বিবাহ হইবে। জনার্দ্দন চৌধুরী এক্ষণে দিন গণিতেছেন। তাঁহার পুত্রকন্যা সকলের ইচ্ছা, যাহাতে এ বিবাহ না হয়। কিন্তু কেহ কিছু বলিতে সাহস করেন না। তাঁহার বড় কন্যা একদিন মুখ ফুটিয়া মানা করিয়াছিলেন। সেই অবধি বড় কন্যার সহিত তাঁহার আর কথাবার্ত্তা নাই।

 জনার্দ্দন চৌধুরীকে কন্যা দিতে তনু রায়ও প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন যে,— “আমার নববিবাহিতা স্ত্রীকে আমি দশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ দিব, একখানি তালুক দিব, স্ত্রী গা সোনা দিয়া মুড়িব, আর কন্যার পিতাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিব।” তখন তনু রায় আর লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না।

 কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া তবুও তনু রায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু তাহার পুত্র টাকার কথা শুনিয়া, একেবারে উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। বকিয়া-ঝকিয়া পিতাকে তিনি সম্মত করিলেন। টাকার লোভে এক্ষণে পিতাপুত্র দুই জনেই উন্মত্ত হইয়াছেন।

 তবুও তনু রায় স্ত্রীর নিকট নিজে একথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাঁহার পুত্র বলিলেন,— “তোমাকে বলিতে হইবে না, আমি গিয়া মাকে বলিতেছি।”

 এই কথা বলিয়া পুত্র মা'র নিকট যাইলেন। মাকে বলিলেন,— “মা! জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। বাবা সব স্থির করিয়া আসিয়াছেন।”

 মা'র মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল! মা বলিলেন,— “সে কি রে? ওরে, সে কি কথা! ওরে, জনার্দ্দন চৌধুরী যে তেকেলে বুড়ো! তার যে বয়সের গাছপাথর নাই! তার সঙ্গে কঙ্কাবতীর বিবাহ হবে কি রে?”

 পুত্র উত্তর করিলেন,— “বুড়ো নয় তা কি যুবো? না সে খোকা? জনার্দ্দন চৌধুরী তুলো করিয়া দুখ খায় না কি? না ঝুমঝুমি নিয়ে খেলা করে? মা যেন ঠিক পাগল! মা’র বুদ্ধি-সুদ্ধি একেবারে নাই। কঙ্কাবতীকে দশ হাজার টাকা দিয়া যেখানে যা ধরে গহনা দিবে, তালুক-মুলুক দিবে, বাবাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিবে, আবার চাই কি? বুড়ো মরিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর টাকা গহনা সব আমাদের হইবে। থুড়থুড়ে বুড়ো বলিয়াই তো আহ্লাদের কথা। শক্তিসামর্থ্য থাকিলে এখন কত দিন বাঁচিত, তার ঠিক কি? মা! তোমার কিছুমাত্র বিবেচনা নাই।”

 এ কথার উপর আর কথা নাই। মা একেবারে বসিয়া পড়িলেন। অবিরল ধারায় তাহার চক্ষু হইতে অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। মনে করিলেন যে,— “হে পৃথিবী! তুমি দুই ফাঁক হও, তোমার ভিতর আমি প্রবেশ করি।” মেয়ে দুইটিও অনেক কাঁদিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কঙ্কাবতী নীরব। প্রাণ যাহার ধূ-ধূ করিয়া পুড়িতেছে, চক্ষে তাহার জল কোথা হইতে আসিবে?

 মা ও প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে খেতু এই সকল কথা শুনিলেন।

 খেতু প্রথম তনু রায়ের নিকট যাইলেন। তনু রায়কে অনেক বুঝাইলেন। খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! এরূপ অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন না। আমার সহিত বিবাহ না হয় না দিবেন, কিন্তু একটি সুপাত্রের হাতে দিন। মহাশয় যদি সুপাত্রের অনুসন্ধান করিতে না পারেন, আমি করিয়া দিব।”

 এই কথা শুনিয়া তনু রায় ও তনু রায়ের পুত্র খেতুর উপর অতিশয় রাগান্বিত হইলেন। নানারূপ ভর্ৎসনা করিয়া তাঁহাকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দিলেন।

 নিরঞ্জনকে সঙ্গে করিয়া খেতু তাহার পর জনার্দ্দন চৌধুরীর নিকট গমন করিলেন। হাতযোড় করিয়া অতি বিনীতভাবে জনার্দ্দন চৌধুরীকে বিবাহ করিতে নিষেধ করিলেন। প্রথমতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তাহার পর খেতু যখন তাঁহাকে দুই-একবার বৃদ্ধ বলিলেন, তখন রাগে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার শ্লেষ্মার ধাত, রাগে এমনি তাঁহার ভয়ানক কাসি আসিয়া উপস্থিত হইল যে, সকলে বোধ করিল, দম আটকাইয়া তিনি বা মরিয়া যান!

 কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন,— “গলাধাক্কা দিয়া এ ছোঁড়াকে আমার বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দাও!”

 অনুমতি পাইয়া পারিষদগণ খেতুর গলাধাক্কা দিতে আসিল। খেতু জনার্দ্দন চৌধুরীর লাঠিগাছটি তুলিয়া লইলেন। পারিষদবৰ্গকে তিনি ধীরভাবে বলিলেন,— “তোমরা কেহ আমার গায়ে হাত দিও না। যদি আমার গায়ে হাত দাও, তাহা হইলে এই দণ্ডে তোমাদের মুণ্ডপাত করিব।”

 খেতুর তখন সেই রুদ্রমূর্ত্তি দেখিয়া, ভয়ে সকলেই আকুল হইল। গলাধাক্কা দিতে আর কেহ অগ্রসর হইল না।

 নিরঞ্জন উঠিয়া, উভয়পক্ষকে সান্ত্বনা করিয়া খেতুকে সেখান হইতে বিদায় করিলেন। খেতু চলিয়া গেলেন। তবুও জনার্দ্দন চৌধুরীর রাগও থামে না, কাসিও থামে না। রাগে থরথর করিয়া শরীর কাঁপিতে লাগিল, খক-খক্‌ করিয়া ঘন ঘন কাসি আসিতে লাগিল।

 কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন,— “ছোঁড়ার কি আস্পর্দ্ধা! আমাকে কি না বুড়ো বলে।”

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি বলিলেন,— “না না! আপনি বৃদ্ধ কেন হইবেন? আপনাকে যে বুড়ো বলে, সে নিজে বুড়ো।”

 ষাঁড়েশ্বর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “হয়তো ছোকরা মদ খাইয়া আসিয়াছিল! চক্ষু দুইটা যেন জবাফুলের মত, দেখিতে পান নাই?”

 নিরঞ্জন বলিলেন,— “ও কথা বলিও না! যারা মদ খায়, তারা খায়। কে মদ-মুরগী খায়, তা সকলেই জানে। পরের নামে মিথ্যা অপবাদ দিও না।”

 ষাঁড়েশ্বর উত্তর করিলেন,— “সকলে শুনিয়া থাকুন, ইনি বলিলেন, —'যে, আমি মদ-মুরগী খাই।' আমি ইহার নামে মানহানির মকদ্দমা করিব। এ'র হাড় কয়খানা জেলে পচাইব।”

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি বলিলেন,— “ক্ষেত্রচন্দ্র মদ খান, কি না খান, তাহা আমি জানি না। তবে তিনি যে যবনের জল খান, তাহা জানি। সেই যারে বলে 'বরখ', সাহেবেরা কলে যাহা প্রস্তুত করেন, ক্ষেত্রচন্দ্র সেই বরখ খান। গদাধর ঘোষ ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি কি? কি বলিলে?”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “সর্ব্বনাশ! বরফ খায়? গোরক্ত দিয়া সাহেবেরা যাহা প্রস্তুত করেন? এবার দেখিতেছি, সকলের ধর্ম্মটি একেবারে লোপ হইল। হায় হায়! পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম্ম একেবারে লোপ হইল।”

 নিরঞ্জন বলিলেন,— “ষাঁড়েশ্বরবাবু! একবার মনে করিয়া দেখ, খেতুর বাপ তোমার কত উপকার করিয়াছেন। খেতুর অপকার করিতে চেষ্টা করিও না।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “ওসব বাজে কথা এখন তোমরা রাখ। গদাধর ঘোষকে ডাকিতে পাঠাও।”

 গদাধর ঘোষকে ডাকিতে লোক দৌড়িল।