কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/সপ্তম পরিচ্ছেদ


সপ্তম পরিচ্ছেদ

কঙ্কাবতী

পথে পড়িয়া খেতুর মা কঁদিতেছেন, এমন সময় তনু রায়ের স্ত্রী সেইখানে আসিলেন।

 তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে তিনি বলিলেন,— “দিদি! চুপ কর। চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিলে ছেলের অমঙ্গল হয়।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “সব জানি বোন! কিন্তু কি করি? চক্ষের জল যে রাখিতে পারি না, আপনা-আপনি বাহির হইয়া পড়ে। আমি যে আজ পৃথিবী শূন্য দেখিতেছি! কি করিয়া যে ঘরে যাই? আজ যে আমার আর কোন কাজ নাই। আজ তো আর খেতু পাঠশালা হইতে কালি-ঝুলি মাখিয়া ক্ষুধা ক্ষুধা করিয়া আসিবে না? এতক্ষণ খেতু কতদূর চলিয়া গেল! আহা, বাছার কত না মন-কেমন করিতেছে!

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “চল আহা! খেতু কি গুণের ছেলে! দেশে তবেই তা না হইলে সব বৃথা।”

 এই বলিয়া তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর-মার হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া দুইজনে খেতুর গল্প করিলেন।

 খেতু খাইয়া গিয়াছিল, তনু রায়ের স্ত্রী সেই বাসনগুলি মাজিলেন ও ঘর-দ্বার সব পরিষ্কার করিয়া দিলেন। বেলা হইলে খেতুর মা রাঁধিয়া খাইবেন, সে নিমিত্ত তরকারিগুলি কুটিয়া দিলেন, বাটনটুকু বাটিয়া দিলেন।

 খেতুর মা বলিলেন,— “থাক বোন থাকা! আজ আর আমার খাওয়া-দাওয়া! আজ আর আমি কিছু খাইব না।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “না দিদি! উপবাসী কি থাকিতে আছে? খেতুর অকল্যাণ হইবে।”

 “খেতুর অকল্যাণ হইবে।” এই কথাটি বলিলেই খেতুর মা চুপ! যা’ করিলে খেতুর অকল্যাণ হয়, তা’ কি তিনি করিতে পারেন?

 তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,— “এই সব ঠিক করিয়া দিলাম। বেলা হইলে রান্না চড়াইয়া দিও। কাজ-কর্ম্ম সারা হইলে আমি আবার ও-বেলা আসিব।”

 অপরাহে তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় আসিলেন। কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন।

 খেতুর মা বলিলেন,— “আহা! কি সুন্দর মেয়েটি বোন! যেমন মুখ, তেমনি চুল, তেমনি রং।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “হাঁ! সকলেই বলে, এ কন্যাটি তোমার গর্ভের সুন্দর। তা দিদি! এ পোড়া পেটে কেন যে এরা আসে? মেয়ে হইলে ঘরের মানুষটি আহ্লাদে আটখানা হন; কিন্তু আমার মনে হয় যে, আঁতুর ঘরেই মুখে লুণ দিয়া মারি। গ্রীষ্মকালে একাদশীর দিন, মেয়ে দুইটির যখন মুখ শুকাইয়া যায়, যখন একটু জলের জন্য বাছাদের প্রাণ টা-টা করে, বল দেখি, দিদি! মার প্রাণ তখন কিরূপ হয়? পোড়া নিয়ম! যে এ নিয়ম করিয়াছে, তাহাকে যদি একবার দেখিতে পাই, তো ঝাঁটাপেটা করি। মুখপোড়া যদি একটু জল খাবারও বিধান দিত, তাহা হইলে কিছু বলিতাম না!”

 খেতুর মা বলিলেন,— “আর-জন্মে যে যেমন করিয়াছে, এ-জন্মে সে তার ফল পাইয়াছে; আবার এ-জন্মে যে যেরূপ করিবে, ফিরে-জন্মে সে তার ফল পাইবে।”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “তা বটে! কিন্তু মার প্রাণ কি সে কথায় প্রবোধ মানে গা?”

 তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,— “এক একবার মনে হয় যে, যদি বিদ্যাসাগরী মতটা চলে, তো ঠাকুরদের সিন্নি দিই।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “চুপ কর বোন! ছিঃ। ছিঃ! ও কথা মুখে আনিও না! বিদ্যাসাগরের কথা শুনিয়া সাহেবরা যদি বলেন যে, দেশে আর বিধবা থাকিতে পারে না, সকলেই বিবাহ করিতে হইবে, ছি ছি! ও মা! কি ঘৃণার কথা! এই বৃদ্ধ বয়সে তাহা হইলে যাব কোথা? কাজেই তখন গলায় দড়ি দিয়া কি জলে ডুবিয়া মরিতে হইবে!”

 তনু রায়ের স্ত্রী হাসিয়া বলিলেন,— “দিল্লি তুমি কলিকাতায় ছিলে, কিন্তু তুমি কিছু জান না। বিদ্যাসাগর মহাশয় বুড়োহাবড়া সকলেই ধরিয়া বিবাহ দিতে চান নাই। অতি অল্পবয়সে যাহারা বিধবা হয়, কেবল সেই বালিকাদিগের বিবাহের কথা তিনি বলিয়া ছিলেন। তাও যাহার ইচ্ছা হবে, সে দিবে; যাহার ইচ্ছা না হবে, না দিবে।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “কি জানি, ভাই। আমি অতশত জানি না।”

 তনু রায়ের স্ত্রীর দুইটি বিধবা মেয়ে, তাহাদের দুঃখে তিনি সদাই কাতর। সেজন্য বিধবাবিবাহের কথা পড়িলে তিনি কান দিয়া শুনিতেন। কলিকাতায় বাস করিয়া খেতুর মা যাহা না জানেন, তাহা ইনি জানেন।

 তনু রায় পণ্ডিত লোক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতটি যেই বাহির হইল, আর ইনি লুফিয়া লইলেন।

 তিনি বলিলেন,— “বিধবা-বিবাহের বিধি যদি শাস্ত্রে আছে, তবে তোমরা মানিবে না কেন? শাস্ত্র অমান্য করা ঘোর পাপের কথা। দুইবার কেন? বিধবাদিগের দশবার বিবাহ দিলেও কোন দোষ নাই, বরং পুণ্য আছে। কিন্তু এ হতভাগ্য দেশ ঘোর কুসংস্কারে পরিপূর্ণ, এ-দেশের আর মঙ্গল নাই।”

 তনু রায়ের মত নিষ্ঠাবান লোকের মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া প্রথম প্রথম সকলে কিছু আশ্চর্য্য হইয়াছিল। তারপর সকলে ভাবিল,— “আহা। বাপের প্রাণ। ঘরে দুইটি বিধবা মেয়ে, মনের খেদে উনি এইরূপ কথা বলিতেছেন।”

 কেবল নিরঞ্জন বলিলেন,— “হা, বিধবা-বিবাহটি প্রচলিত হইলে তনু রায়ের ব্যবসাটি চলে ভাল!"

 এই কথা শুনিয়া সকলে নিরঞ্জনকে ছি-ছি করিতে লাগিল। সকলে বলিল,— “নিরঞ্জনের মনটি হিংসায় পরিপূর্ণ। তা না হইলেই বা ওঁর এমন দশা হইবে কেন? যার দুই শত বিঘা ব্রহ্মোত্তর ভূমি ছিল, আজ সে পথের ভিখারী; কোনও দিন অন্ন হয়, কোনও দিন অন্ন হয় না।”

 খেতুর মাতে আর তনু রায়ের স্ত্রীতে নানারূপ কথাবার্ত্তা হইতে লাগিল।

 খেতুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তোমার এ মেয়েটি বুঝি এক বৎসরের হইল?”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “হা! এই এক বৎসর পার হইয়া দুই বৎসরে পড়িবে।”

 খেতুর মা পূনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মেয়েটির নাম রাখিয়াছ কি?”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “ইহার নাম হইয়াছে, কঙ্কাবতী।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! দিব্য নামটি তো? মেয়েটিও যেমন নরম নরম দেখিতে, নামটিও সেইরূপ নরম নরম শুনিতে।”

 এইরূপ খেতুর মাতে, আর তনু রায়ের স্ত্রীতে ক্রমে ক্রমে বড়ই সদ্ভাব হইল। অবসর পাইলে তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর মার কাছে আসেন, আর খেতুর মাও তনু রায়ের বাটীতে যান। মাঝে মাঝে তনু রায়ের স্ত্রী কঙ্কাবতীকে খেতুর মার কাছে ছাড়িয়া যান।

 মেয়েটি এখনও হাঁটিতে শিখে নাই; হামাগুড়ি দিয়া চারিদিকে বেড়ায়, কখনও বা বসিয়া খেলা করে, কখনও বা কিছু ধরিয়া দাঁড়ায়। খেতুর মা আপনার কাজ করেন ও তাহার সহিত দুটি-একটি কথা ক'ন্। কথা কহিলে মেয়েটি ফিক ফিক করিয়া হাসে, মুখে হাসি ধরে না। মেয়েটি বড় শান্ত, কাদিতে একেবারে জানে না।