কপালকুণ্ডলা (দ্বিতীয় সংস্করণ)/চতুর্থ খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শয়নাগারে।

রাধিকার বেড়ি ভাঙ, এ মম মিনতি।

ব্রজাঙ্গনা কাব্য।

লুৎফ্-উন্নিসা আগ্রা গমন করিতে, এবং তথা হইতে সপ্তগ্রাম আসিতে প্রায় এক বৎসর গত হইয়াছিল। কপালকুণ্ডলা এক বৎসরের অধিক কাল নবকুমারের গৃহিণী। যে দিন প্রদোষ কালে লুৎফ-উন্নিসা কাননে, সে দিন কপালকুণ্ডলা অন্য মনে শয়নকক্ষে বসিয়া আছেন। পাঠক মহাশয় সমুদ্রতীরে আলুলায়িতকুন্তলা ভূষণহীনা যে কপালকুণ্ডলা দেখিয়াছিলেন, এ সে কপালকুণ্ডলা নহে। শ্যামাসুন্দরীর ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হইয়াছে; স্পর্শমণির স্পর্শে যোগিনী গৃহিণী হইয়াছে; এই ক্ষণে সেই অসংখ্য কৃষ্ণোজ্জ্বল, ভুজঙ্গের ব্যূহতুল্য, আগুল্‌ফলম্বিত কেশরাশি পশ্চাদ্ভাগে স্থূলবেণীসম্বদ্ধ হইয়াছে। বেণীরচনারও শিল্পপারিপাট্য লক্ষিত হইতেছে, কেশবিন্যাসে অনেক সূক্ষ্ম কাৰুকার্য্য শ্যামাসুন্দরীর বিন্যাসকৌশলের পরিচয় দিতেছে। কুসুমদামও পরিত্যক্ত হয় নাই, চতুষ্পার্শ্বে কিরীটিমণ্ডল স্বরূপ বেণী বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। কেশের যে ভাগ বেণী মধ্যে ন্যস্ত হয় নাই তাহা যে শিরোপরি সর্ব্বত্রে সমানোচ্চ হইয়া রহিয়াছে, এমত নহে। আকুঞ্চন প্রযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষ্ণ তরঙ্গলেখায় শোভিত হইয়া রহিয়াছে। মুখমণ্ডল এখন আর কেশভারে অর্দ্ধলুক্কায়িত নহে; জ্যোতির্ম্ময় হইয়া শোভা পাইতেছে, কেবল মাত্র স্থানে স্থানে রন্ধনবিস্রংসী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অলকাগুচ্ছ তদুপরি স্বেদবিজড়িত হইয়া রহিয়াছে। বর্ণ সেই অর্দ্ধপূর্ণশশাঙ্করশ্মিৰুচ। এখন দুই কর্ণে হেমকর্ণভূষা দুলিতেছে; কণ্ঠে হিরণ্ময় কণ্ঠমালা দুলিতেছে। বর্ণের নিকটে সে সকল ম্লান হয় নাই, অৰ্দ্ধচন্দ্রকৌমুদী বসনা ধরণীর অঙ্কে নৈশকুসুমবৎ শোভা পাইতেছে। তাঁহার পরিধানে শুক্লাম্বর; সে শুক্লাম্বর অর্দ্ধচন্দ্রদীপ্ত আকাশমণ্ডলে অনিবিড় শুক্ল মেঘের ন্যায় শোভা পাইতেছে।

 বর্ণ সেইরূপ চন্দ্রাৰ্দ্ধকৌমুদীময় বটে, কিন্তু যেন পূর্ব্বাপেক্ষা ঈষৎ সমল, যেন আকাশ প্রান্তে কোথা কাল মেঘ দেখা দিয়াছে। কপালকুণ্ডলা একাকিনী বসিয়াছিলেন না; সখী শ্যামাসুন্দরী নিকটে বসিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের উভয়ে পরস্পরে কথোপকথন হইতেছিল। তাহার কিয়দংশ পাঠক মহাশয়কে শুনিতে হইবেক।

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “ঠাকুরজামাই আর কত দিন এখানে থাকিবেন?”

 শ্যামা কহিলেন, “কালি বিকালে চলিয়া যাইবে। আহা! আজি রাত্রে যদি ঔষধটি তুলিয়া রাখিতাম, তবু তারে বশ করিয়া মনুষ্যজন্ম সার্থক করিতে পারিতাম। কালি রাত্রে বাহির হইয়াছিলাম বলিয়া নাতি ঝাঁটা খাইলাম; আর আজি বাহির হইব কি প্রকারে?”

 ক। “দিনে তুলিলে কেন হয় না?”

 শ্যা। “দিনে তুলিলে ফল্‌বে কেন? ঠিক দুই প্রহর রাত্রে এলো চুলে তুলিতে হয়। তা ভাই মনের সাধ মনেই রহিল।”

 ক। “আচ্ছা, আমি ত আজি দিনে সে গাছ চিনে এয়েছি, আর যে বনে হয় তাও দেখে এসেছি। তোমাকে আজি আর যেতে হবে না, আমি একা গিয়া ঔষধ তুলিয়া আনিব।”

 শ্যা। “এক দিন যা হইয়াছে তা হইয়াছে। রাত্রে তুমি আর বাহির হইও না।”

 ক। “সে জন্য তুমি কেন চিন্তা কর? শুনেছ ত রাত্রে বেড়ান আমার ছেলে বেলা হইতে অভ্যাস। মনে ভেবে দেখ আমার সে অভ্যাস না থাকিলে তোমার সঙ্গে আমার কখন চাক্ষুষও হইত না।”

 শ্যা। “সে ভয়ে বলি না। কিন্তু একা রাত্রে বনে বনে বেড়ান কি গৃহস্থের বউ ঝির ভাল। দুই জনে গিয়াও এত তিরস্কার খাইলাম, তুমি একাকিনী গেলে কি রক্ষা থাকিবে?”

 ক। “ক্ষতিই কি? তুমিও কি মনে করিয়াছ যে আমি রাত্রে ঘরের বাহির হইলেই কুচরিত্র হইব?”

 শ্যা। “আমি তা মনে করি না। কিন্তু মন্দ লোকে মন্দ বল্‌বে।”

 ক। “বলুক, আমি তাতে মন্দ হব না।”

 শ্যা। “তা ত হবে না―কিন্তু তোমাকে কেহ কিছু মন্দ বলিলে আমাদিগের অন্তঃকরণে ক্লেশ হবে।”

 ক। “এমত অন্যায় ক্লেশ হইতে দিও না।”

 শ্যা। “তাও আমি পারিব। কিন্তু দাদাকে কেন অসুখী করিবে?”

 কপালকুণ্ডলা শ্যামাসুন্দরীর প্রতি নিজ স্নিগ্ধোজ্জ্বল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন। কহিলেন, “ইহাতে তিনি অসুখী হয়েন, আমি কি করিব? যদি জানিতাম যে স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।”

 ইহার পর আর কথা শ্যামাসুন্দরী ভাল বুঝিলেন না। আত্মকর্ম্মে উঠিয়া গেলেন।

 কপালকুণ্ডলা প্রয়োজনীয় গৃহকার্য্যে ব্যাপৃত হইলেন। গৃহকার্য্য সমাধা করিয়া ওষধির অনুসন্ধানে গৃহ হইতে বহির্গত। হইলেন। তখন রাত্রি প্রহরাতীত হইয়াছিল। নিশা সজ্যোৎস্না। নবকুমার বহিঃকক্ষ্যায় বসিয়াছিলেন, কপালকুণ্ডলা যে বাহির হইয়া যাইতেছেন তাহা গবাক্ষপথে দেখিতে পাইলেন। তিনিও গৃহ ত্যাগ করিয়া আসিয়া মৃণ্ময়ীর হাত ধরিলেন। কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “কি?”

 নবকুমার কহিলেন, “কোথা যাইতেছ?” নবকুমারের স্বরে তিরস্কারের সূচনা মাত্র ছিল না।

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “শ্যামাসুন্দরী স্বামীকে বশ করিবার জন্য ঔষধ চাহে, আমি ঔষধের সন্ধানে যাইতেছি।”

 নবকুমার পূর্ব্ববৎ কোমল স্বরে কহিলেন, “ভাল; কালি ত এক বার গিয়াছিলে? আজি আবার কেন?”

 ক। “কালি খুঁজিয়া পাই নাই; আজি আবার খুঁজিব।”

 নবকুমার অতি মৃদুভাবে কহিলেন, “ভাল দিনে খুঁজিলেও ত হয়?” নবকুমারের স্বর স্নেহ পরিপূর্ণ।

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “দিবসে ঔষধ ফলে না।”

 নব। “কাজই কি তোমার ঔষধ তল্লাসে? আমাকে গাছের নাম বলিয়া দাও। আমি ওষধি তুলিয়া আনিয়া দিব।”

 ক। “আমি গাছ দেখিলে চিনিতে পারি, কিন্তু নাম জানি না। আর তুমি তুলিলে ফলিবে না। স্ত্রীলোকে এলোচুলে তুলিতে হয়। তুমি পরের উপকারের বিঘ্ন করিও না।”

 কপালকুণ্ডলা এই কথা অপ্রসন্নতার সহিত বলিলেন। নবকুমার আর আপত্তি করিলেন না। বলিলেন, “চল আমি তোমার সঙ্গে যাইব।”

 কপালকুণ্ডলা গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “আইস আমি অবিশ্বাসিনী কি না স্বচক্ষে দেখিয়া যাও।”

 নবকুমার আর কিছু বলিতে পারিলেন না। নিশ্বাস সহকারে কপালকুণ্ডলার হাত ছাড়িয়া দিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। কপালকুণ্ডলা একাকিনী বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন।