কবিতাকুসুমাঞ্জলি/সংস্কৃত ভাষা

সংস্কৃত ভাষা।

হে মাতঃ সংস্কৃত ভাষা মধুর ভাষিণি!
কোথায় জনম তব, কেবা প্রসবিনী?
ভুবন মোহিনীকন্যা এ ভুবনে আর
আছে কি তোমার মত তোমার মাতার?
তব সুললিত কথা অমিয় সমান,
অপার আনন্দ তার, যেই করে পান।
সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী সর্ব্ব গুণ বিভূষিতা
সর্ব্ব মনোহরা তুমি সর্ব্ব সুপূজিতা
এই গুণে সর্ব্ব জনে সর্ব্বত্র তোমায়
সর্ব্বোপরি সিংহাসনে সর্ব্বদা বসায়।
শোক-তাপ-জরা-জীর্ণ কাতর হৃদয়
তব কথামৃত পানে সজীবন হয়।
কি আশ্চর্য্য, কেহ কেহ তথাচ তোমায়
মৃত ভাষা বলে, শুনে অঙ্গ জ্বলে যায়।
পূর্ব্বকালে তব পদ পূজে ছিল যারা,
আর্য্য জাতি বলে লোকে চিরপূজ্য তারা।
চিরকাল কেহ যদি সেবয়ে তোমারে,
তবু যেতে নারে তব শব্দসিন্ধু পারে।

মনোহর অলঙ্কার যেমন তোমার,
জ্ঞান হয়, নাহি আর তেমন কাহার।
কখন না পাই হেন দেখিতে বিষয়,
তোমার কথায় যাহা প্রকাশ না হয়।
অসামান্য রূপ তব করি দরশন,
দেববাণী বলে লোকে করে সম্বোধন।
তোমার প্রাচীন নব[১] সেবকে সেরিয়া,
বিক্রমাদিত্যের যশ জগৎ জুড়িয়া।
পূর্ব্বে অতি দুরাচার যবনের ভয়ে,
কেহ না সেবিত পদ অভয় হৃদয়ে।
জাতি কুল মান লয়ে ব্যস্ত সবে ছিল,
তাই তব পূজা দেশে বিরল হইল।
মন্দ ভাগ্য ভারতের কিছু পুণ্যবল
ছিল বুঝি, তাই হোল যবন দুর্ব্বল।
অধুনা গুণজ্ঞ সভ্য ভূপের শাসনে,
সেবিছে তোমারে মাতঃ নিজ শিষ্যগণে।

কিন্তু মাতঃ! হইতেছে সংশয় আমার,
ভারতে যথার্থ পূজা হইবে কি আর?
তোমার মধুর ভাব বুঝিয়াছে যারা,
এখন সেবিছে সুখে তব পদ তারা।
অবয়বে সংবাদিনী, সুদূর বাসিনী,
প্রাচীন, সুন্দরাকৃতি, মধুর ভাষিণী।
আছে এক নারী,[২] নব-সুতা[৩] প্রসবিনী,
কেহ কেহ কহে তাঁরে তোমার ভগিনী।
নানা দেশবাসী শত শত শিষ্যগণ,
সদা সেবা করে তাঁর তোমার মতন।
তোমাদের জননী কে জান নাহি যায়,
অন্বেষি-নয়ন তাঁরে খূঁজিয়া না পায়।
সকল বিষয়ে কিন্তু সম ভাগ্যবতী,
তোমার সমান কেহ নাহি গুণবতী।
তোমার তুলনা তুমি, নাই উপমান,
কাহারে ও নাহি হেরি তোমার সমান।

নয়নে দেখেছি এক কুরূপ কামিনী,—
অতিমন্দ দশা তার, বঙ্গনিবাসিনী।
রূপ গুণ কিছু তার ছিলনা কখন,
পেতেছে কৃপায় তব চারুতা এখন;
বয়সে সুষমা ধরে শিখিনী যেমন,
দিন দিন সেই রূপ হতেছে শোভন।
ভারতের গৌরবের তুমি মা নিদান,
পুরাতন সভ্যভাব তোমারি সন্তান।
তব গুণে পুণ্যভূমি এ ভারতভূমি,
পবিত্র মুখের হও পুণ্য উৎস তুমি।
তুমি বসন্তের ফুল শরদের জল,
তুমিই বিতর দেবি আনন্দ বিমল।
তুমি ভারতের ধন, অমূল্য রতন,
তুমিই মা মর্ত্ত্য লোকে সজ্জনজীবন।
তারতনিবাসী যত তোমার তনয়,
তব কথামৃতপানে যেন রত রয়।


  1. এস্থলে নব শব্দ নুতনার্থক হইলে প্রাচীন-শব্দার্থের সহিত বিরোধ হয়, কিন্তু হুয়া নুতনার্থক নহে, নব শব্দের প্রতিপাদ্য কালিদাসাদি নয় জন, সুতরাং বিরোধের পরিহার হওয়াতে বিরোধাভাস অলঙ্কার হইল।
  2. এখানে এক নারীশব্দ ল্যাটীন ভাষাকে বুঝাইতেছে।
  3. নবসুতা শব্দার্থ ইংরাজী ভাষা।