কবিতাসংগ্রহ/কিংবদন্তির ভোর/পালকের ছায়া

পালকের ছায়া


তোমার মোহর তুমি রেখে গেছ নির্জনতা জুড়ে

ভোরের প্রথম আলো, সূর্যাস্তের ক্লান্ত ছায়া
তোমাকে ফিরিয়ে আনে
প্রতিদিন

সমস্ত ধ্বনির মূলে তুমি সেই
গভীর ওঙ্কার
আজ শুধু নীরবতা দিয়ে গড়ি
তোমার প্রতিমা

সমস্ত নির্মাণে তুমি রেখে গেছ তোমার মোহর


প্রতিদিন ভোরের আজানে শুনি
তোমার মূৰ্ছনা
মাতৃহারা প্রহরের শোক জেগে থাকে
প্রতিটি সন্ধ্যায়

দিন চলে যায় দিনের নিয়মে

নিঃসঙ্গ রাতের কান্না শুনে
একা-একা ঝরে যাচ্ছে।
স্মৃতির গ্রন্থনা


পাখি-মা কুলায় ভেঙে উড়ে গেছে
পড়ে আছে পালকের ছায়া।

এই সত্য মেনে নিতে বলে বিবেচক
পাখির সমাজ
খড়কুটো জুড়ে আছে যত উড়ালের স্মৃতি
সমস্ত অতীত

পালকের ছিল মেঘ ছিল আলো
ছিল তার
স্বপ্ন আর যন্ত্রণা মেশানো দীর্ঘতর
পরম্পরা

পাখি জানে আকাশের রেখা যত বড়ো
তত দূর অশ্রুর সীমানা
তাই খোঁজে পাখি-মাকে কনীনিকা থেকে
কুয়াশা ঝরিয়ে

8
স্মৃতির ভাড়ার থেকে খুঁটে-খুঁটে তুলে নিচ্ছি
অনুপুঙ্খগুলি
প্রচ্ছদের ভার রয়ে গেছে শুধু স্নায়ুহীন
শূন্যের বিস্তারে



শৈশবের চিতা জ্বলে লেলিহ আগুনে
পান্থপাদপের ছায়া মায়ের শরীরে পুড়ে যায়
পুড়ে যায় চোখের পাতায় বরাভয়, চন্দনের মতো
শান্ত ও মধুর ছোঁয়া, সর্বাঙ্গে জড়ানো ওম

সমিধ করেছি আজ শিশুকাল, কৈশোরের দুরন্ত বিকেল
তার হাতে তুলে-দেওয়া দুধভাত, ক্ষমা ও কল্যাণ
সব ছন্দ সব গান সব ভাষা সমস্ত উত্থান পুড়ে যায়
ধিকিধিকি ছাইয়ের আগুন নেভাই উৎসারে

মাটির কলস ভেঙে ফিরে আসি কাঙালের মতো
অস্থি-অবশেষ নিয়ে রিক্ত জ্যোৎস্নায়
ক্লান্ত শরীর তখনো ঘিরে রাখে মায়ের আঁচল

কিছুই পোড়েনি তবু, কিছুই পোড়ে না।


সবশেষে পড়ে থাকে নাভিপিণ্ড, নিরাকার ছাই
শ্মশানবন্ধুরা সব জানে
মাটিতে মিশিয়ে দেয় দ্রুত অবাস্তব অনুষঙ্গ যত
ঘড়া-ঘড়া জল ঢেলে ধুয়ে দেয়
চিতা-অবশেষ, দার্শনিক শঙ্করের ভাষ্য দিয়ে বলে
সব কাজ প্রথামতো করো!

মাটির কলস ঠুনকো হাতে ভেঙে দিয়ে কাঁধে রাখে
সামাজিক হাত, বিজ্ঞ উচ্চারণে
শেখায় অভ্যাসের গাথা: শেকড়ের ঋণ ভুলে যাও
দ্যাখো না পেছন-ফিরে

পড়ে রইল চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যাওয়ার
শৈশব, কৈশোরের ছায়াতরু
পড়ে রইল কুয়াশা-সরানো রোদে সহজ মায়ার
আঁকিবুকি, দুধের সরের মতো স্মৃতি

নিভে গেছে চিতা, তবুও আগুন জ্বলে
পল-অনুপল

কোলাহল শেষ করে উঠে যায় রুদালিরা
অশ্রুহীন চোখ মুছে নিয়ে
নির্বোধ আঙুল শুধু ছুঁতে চায় মায়ের চিবুক
কপালের ভাজ, অপার্থিব হাসি
নোলকের মতো তিল ছুঁয়ে ভাবি, একবার
এ আঙুল যদি হত ঘুম-ভাঙানিয়া
সোনার কাঠির মতো, প্রিয় তিলে চুমু খাই
যদি ভাঙে নিদালির ঘোর
তবু জাগে না জাগে না স্থির আঁখিতারা

মায়ের ঠোঁটের কোনে হাসির উদ্ভাস, তবু
একে কেউ বলে না বাস্তব
শবাধারে গাঢ়তর হয় শুধু মৃত্যুর হিমানি

উচ্ছল জ্যোৎস্নাকে মুচড়ে দেয়
তীব্র হরিধ্বনি, কালরাত্রি নেমে আসে।
সন্তানের নিদ্রাহীন চোখে
চিতার আগুনে জ্ঞাতিকাষ্ঠ দিয়ে ঘরে ফেরে নিরুদ্বিগ্ন
ব্যস্ত প্রতিবেশী
সমস্ত স্থাপত্য ভেঙে হাহাকারে ফেটে যায় প্রতিধ্বনিহীন
ফিরে আয় ফিরে আয় ধ্বনি...


দিনলিপি জুড়ে শুধু ছিদ্রহীন অসূর্যার অন্ধ অনুভব
এলিয়ে পড়েছে কথকতা
লাবণ্যের ভাষা শুষে নিয়ে রেখে গেছ নিথর মুহূর্ত শুধু
এই বার্তা তোমাকে জানাই

বেঁচে আছি তোমাকে ছাড়াই, এই ক্রুর উচ্চারণ
বড়ো হন্তারক বিষ-গুল্মময়
তোমার সমস্ত আলো অরুণ-বরুণ-কিরণমালাকে দিয়ে
মিশে গেছ অন্ধকারে, পারাপারহীন

অমোঘ বিদায় আজ যাপনের অনুপুঙ্খ হলো
তুমি আছ চিরদিন তবু নেই নেই নেই।
নেই?
কেন নেই তুমি?


সমস্ত রূপক ভেঙে দিচ্ছে অন্ধকার
সব ভাষা, সব আলো
গিলে খাচ্ছে তোমার এমন চলে-যাওয়া

পড়ে আছে স্পর্শধন্য অনুপুঙ্খগুলি
ভোরের আলোর মতো মায়ায় জড়ানো।
স্মৃতি, তোমাতে বিলীন আজ

বাচাল শব্দের আয়তন ভেঙে দিয়ে
গভীর নৈঃশব্দ্যে মিশে যায়
একাঘ্নী বিষাদ

শূন্যের বাস্তব শুষে নিচ্ছে রূপকের আয়ু

১০
তোমার অস্তিত্ব আজ আশ্বিনের রোদ
তোমার ভূবন মানে শস্যের বিস্তার
তোমার সহজ আজ প্রাণময় কোষ
তোমার চোখের মায়ায় আদিগন্ত নীল

প্রত্যেক মায়ের চোখে দেখি আজ
তোমার নীলিমা
প্রতিটি ফুলের প্রতিটি পাতার একান্ত উপমা
তোমাকেই জানে

তোমার অস্তিত্ব মানে টোড়ি ও ললিতে ভোর প্রতিদিন।
তোমার তুলনা খুঁজে-খুঁজে শব্দেরা নিঃশব্দ হলো আজ

১১
কথা নয়, কথা নয় কোনো
অশ্রুর তর্পণে
আজ ধুয়ে যাক সব বাচালতা,
পাতার মর্মরে
জেগে থাক আমার মায়ের হাসি
পদ্মের কোরক
ঘিরে থাক রোজ মায়ের প্রতিমা
লাবণ্য জাগুক
প্রতীকের আড়ম্বর মুছে দিয়ে
বালকবেলার
অনুপুঙ্খগুলি আজ ধুয়ে যাক তাঁর
চোখের জ্যোৎস্নায়

১২
তোমার একান্ত মায়া গভীর গভীরতর
হয়ে এল
খণ্ডিত বসুধা জুড়ে, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে
বিষাদ সহজ
হয়ে গেলে কেউ কেউ ফিরে যায়
অভ্যাসের
নিপুন বয়নে, কখনো বা গাছের কোটরে
বলে যায়
মেনে নিতে হবে এই রূঢ় অবসান
নিয়মের
পাঁজি পুথি জেনে, আর কেউ কেউ
দেখে শুধু
অনুপুঙ্খময় ছায়ার সঞ্চার