কবিতাসংগ্রহ/কৃষ্ণপক্ষ

কৃষ্ণপক্ষ
রচনা: ৭ ডিসেম্বর ১৯৯২

শ্রী অঞ্জন সেন
শ্রী নির্মল হালদার
শ্রীমতী নন্দিতা ভট্টাচার্য
প্রীতিভাজনেষু

যখন গন্তব্য নেই, পথের সন্ত্রাসে হারিয়ে গিয়েছে পথিকেরা
এল সেই কৃষ্ণপক্ষ, সেই ছিন্নমস্তা কাল
শূন্যের ভেতরে খাড়া হয়ে উঠছে আরো বেআব্রু শূন্যতা, শূন্য থেকে
শূন্য তুলে নিই তবু রক্তবীজ শূন্যের তরঙ্গ
ঝাপিয়ে পড়েছে আর উপড়ে নিচ্ছে সময়ের শিকড়-বাকড়
এখন গন্তব্য নেই, এখন যাত্রাও নেই কোনো
শুধু হিম শূন্যতায় হারানো পথের ভাষ্য লিখে-যাওয়া
যখন সময় বিষে নীল আর উম্মাননা শেকড় থেকে খসে পড়ছে।
মাটির বিষাদ, এল সেই কৃষ্ণপক্ষ

এই অন্ধকার ছিল না যখন মানুষেরা পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়েছে।
দ্রাবিড়-নিষাদ আর কিরাতের দল
মিশে গেছে শক-হুন-যবনের স্কন্ধাবারে, গান্ধারে-কোশলে
কত স্থাপত্য-সঙ্গীতে মূৰ্ছনা উঠেছে বারবার
রক্ত-ঘাম ঝরাতে ঝরাতে আলোর বুদ্বুদ থেকে পেয়ে গেছে পথিকেরা
বিশল্যকরণী, যাজ্ঞবল্ক্য মিশেছে কপিলে
এই অন্ধকার ছিল না যখন গৌড়বঙ্গে, আরাকানে সহজিয়া
সুর জেগেছিল বিপ্রলম্ভ বিরহের শ্লোকে
গুণরাজ খান আনন্দে মিশেছে দৌলত কাজীর গীতিকায়, চণ্ডীদাসে
কত আলাওল
আর কত শবর ও শবরীর প্রেম ভুসুকুর চর্যাগানে
কাঙাল বাঙালি পেয়েছিল আলোর ইশারা সেই নবম শতকে
আজকের অন্ধকার ছিল না তখন

আজ অন্ধকার লক্ষ কোটি ডানা মেলে উড়ছে
আর বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস অসাড় হয়ে আসছে ক্রমাগত
বোবা ও বধির হচ্ছে প্রাণ
চোখের কোটরে মনি দ্যুতিহীন
যাবতীয় সুখ-অসুখের গেরস্থালি থেকে উঠে এসে অন্ধকার
চেটে-পুটে খাচ্ছে শেকড়ের আলো
তার ডানায়-ডানায় শুধু পথ-হারানোর গভীর দহন

এই প্রাণ পড়ে রইল পথের উপরে, উত্তরপুরুষ, শোনো
এই প্রাণ ধর্ষিত সত্যের
দ্যাখো, থ্যাঁতলানো ঘাসের উপরে তবুও শিশিরবিন্দু, রেখে যাচ্ছি।
দধীচির হাড় নির্লজ্জ বিশ্বাসে

অন্ধকার, আমাকেই বারবার দীর্ঘতম ভেঙে দাও কেন
কেন এত তীক্ষ্ণ আগ্রাসন
অস্থি-মজ্জা চুষে খায় এই লেলিহান রাত, কেন এত হিংস্র
আয়োজন ভেঙে দেয় আমার সমগ্র?
শ্মশানবন্ধুরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে, চিতা কি নিভেছে তবে? কোথাও
জাগে কেউ? নীলকমল না সে লালকমল?
অন্ধকার, স্বজন-হারানো তাপে আর কত অরন্ধন জাগি, মেনে নিই
আর কত সামাজিক বিজ্ঞতার চতুর মুখোশ?

এই কৃষ্ণপক্ষ এল হরপ্পার ধুলো মেখে, অন্ধ মানুষের চোখে
এই কালো রাত নাম-গোত্রহীন, কণিষ্কের
কবন্ধ-শরীর থেকে পলাশীর মাঠ জুড়ে শুধু আঁধি দ্যাখে আর্যাবর্ত
সিস্টুরে-রাঙানো পটচিত্র থেকে লাফ দিয়ে নামে
সাধের দেবতা সূর্যকে বগলে পুরে, কিংবদন্তি থেকে উঠে আসে
মোহিনী আড়াল, গায়ে তার রামনামাবলী
এই রাতে হালেবিদ থেকে মথুরা অবধি মুছে গেছে স্থাপত্যের আলো
এই রাতে স্তোত্রপাঠ করে শুধু শববাহকেরা
এখন, পশ্চিমে শান্তি
এখন, দক্ষিণে শান্তি
আর শান্তি পুবে ও উত্তরে কারণ শ্মশানে-শ্মশানে
জ্বলছে চিতা
আর কবরে-কবরে দাফনের লাশ শুধু
নামাজ-এ-জানাজা।
অর্থাৎ এখন শান্তি কল্যাণ হয়েই আছে।
অন্ধকার, যদি ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি হয়ে নামলে এভাবে
বাবু আর বিবিদের মদির নয়নে কাজল পরাও।
নামুক, নামুক তন্দ্রা, শান্ত ও নিস্পন্দ ঘুমে পার হোক রাত
শান্তি-সুখের নিদ্রা মোদের ধনমনিকে দিয়ে হে অন্ধকার

শিবা ও শকুনের উল্লাসে নাহয় কেঁপে উঠুক ইন্দ্রপ্রস্থ
সাকেত শহরে খিলখিলিয়ে নাহয় হাসুক পদ্ম
আর হাসতে-হাসতে ছুরি আমূল বসিয়ে দিক ঐ
মহেঞ্জোদাড়োর বুকে
হত্যার ভাস্কর্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ুক কামরূপ থেকে দ্বারকায়
এই তন্দ্রাতুর কৃষ্ণপক্ষে
খলবলিয়ে উঠুক পদ্মের তুমুল মুখোস রূপ কোঁয়রের দেশে
সারি-সারি চিতার আগুনে

বেওয়ারিশ লাশের কবরে
অজস্র মণিকর্ণিকা জাগুক ইতিহাসের ঐ ধ্বংসস্তূপে
মহল্লা কাঁপিয়ে হরিধ্বনি দিক
শববাহকেরা, গায়ে শুধু থাক রামনামাবলী

এখন মুষলপর্ব, প্রতি হাতে কুশ হয়ে উঠছে শানিত বল্লম
প্রতিটি আস্তিনে লুকিয়ে রয়েছে বাঘনখ
এখন মুষলপর্ব, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার ফোঁটা বিষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত
প্রতিটি পথের বাঁকে ওঁৎ পেতে আছে গুপ্তঘাতকেরা
নতুন প্রভাসে এখন পদ্মবীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে মহামারী
এখন রাতের আজান থেকে মাথা চাড়া দিচ্ছে।
হিংসার স্থাপত্য
এখন সময় ক্রমাগত হাঁটছে পেছনের দিকে
যেখানে অন্ধ তমসাবৃত অসূর্যার দেশ
যেখানে শুধু আত্মহনন
অর্থাৎ এখন কল্যাণ শান্তি হয়েই আছে
আজ অন্ধ মানুষেরা খোঁজে অন্ধতর মানুষের প্রস্তাবনা
আজ নুলো মানুষেরা খুঁজে নেয় আরো-নুলো মানুষের ভিড়
এই চমৎকার সংঘের শরণ ভালো আজ
এই নিরপেক্ষ ধর্মের শরণ নিয়ে ভালো দখলের পতাকা উড়ানো
আকাশে-বাতাসে শুনছি জয়জয়কার
অশোকের লিপিমালা থেকে মুছে দিচ্ছি মহেন্দ্রের যাত্রাবিবরণ
মুছে দিচ্ছি উদয়নকথা পুরোনো ভূগোল থেকে
ফুটে উঠছে আহা নতুন প্রতীক আর টীকা-ভাষ্য আর্য উপনিবেশে
এই কৃষ্ণপক্ষে রামানন্দ-কবিরের দোঁহা মুছে দিয়ে
লিখে নিচ্ছি নয়া কালাপাহাড়ের চরিতমানস, যেমন মিথিলা পুড়ে
ছাই হয়ে গেলে জনক জানান পোড়ে নি কিছুই
তেমনি নতুন বেদান্ত শিখি ভাঙনের আর রক্তমাখা ত্রিপিটক ছিঁড়ে
টুকরো-টুকরো ইটে লিখি রাম-নাম

জয় হে জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা, পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠায়
উথ্‌লে উঠছে শান্তির জলধিতরঙ্গ
মিলিন্দের প্রজ্ঞা থেকে ফুটছে ঐ সোনালি কমল, আরো একবার
জাগল জাগল ডাকিনী-যোগিনী
জানাজার আয়োজন থেকে, জয় জয় বলো নিরপেক্ষ ধর্মের শরণে।
মঠ আর গির্জার চূড়োয় নামুক নামুক অন্ধকার

আরো এক কালো রাত ছিল গোহপুরে, আগুনে দিয়েছি শিশুদের নারীদের
অভুক্ত শরীর স্বাহা অগ্নয়ে
ছিল আরো এক কালো রাত আরোয়ালে, দেওরালা গ্রামের মোচ্ছবে
নেচেছি গেয়েছি ইতি অগ্নয়ে
এই রাত নামল আবার আর্যাবর্ত জুড়ে, দিই তুলে যত আছে
কাঙালের খুদ ওম্‌ অগ্নয়ে
নামল এই রাত আসামের নির্জন পল্লীতে, মুম্বইয়ের বস্তিতে-বস্তিতে পোড়ে
মানুষের স্বপ্ন-সাধ স্বধা অগ্নয়ে
এই রাতে গান গায় রাইফেল, সাঁজোয়া গাড়ির পাহারায় পদ্ম ফোটে
ছাইরেণু মেখে ওম্ অগ্নয়ে
এই রাতে নেই তুলসীদাসের দোঁহা, নেই গুহক চাঁড়াল, নেই
অমৃতসমান কথা ইতি অগ্নয়ে
এই রাতে বন্ধু ভোলে সহজ বন্ধুতা, ভাই হাতে তুলে নেয়
ভাইয়ের মৃত্যু-পরোয়ানা স্বাহা অগ্নয়ে

যাব কোন্ দিকে? কোন দৃশ্যে ঢুকে পড়ব আমি?
যে-আমি মঞ্চের বাইরে ও ভেতরে
যে-আমি দৃশ্যের বস্তু ও আঙ্গিক
আমাকে স্বপ্নের কথা বলে যেতে দাও, বলে যেতে দাও
লোভ আর বিস্মৃতির কথা প্রতিদিন
কতবার হেরে যাই নিজের কাছেই, নিরুপায় টুকরো হতে হতে
প্রতিদিন খুঁজি ওষধির ঘ্রাণ এই সব বিপন্নতা
বলে যেতে দাও এখনো স্বপ্নের কাছে কেন ফিরে আসি?
যাব কোন্‌ দিকে? মুখোসে-মুখোসে ক্লান্ত হয়ে দেখি
আর কোনো মুখ নেই কোনোখানে
নিরুত্তর প্রশ্নের আঘাতে ভেঙে যাই, ভেঙে যাচ্ছি ক্রমাগত
ভেঙে যেতে-যেতে
আঁকড়ে ধরছি কবিতার এই তুচ্ছ খড়কুটো

বারুদের কটু গন্ধ নিয়ে জাগে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দিন
যাব কোন্ দিকে? আগুনের গান শুনি
জলের গভীরে অর্থাৎ এখন
প্রত্যেকের মহান ভারতে তৃষ্ণার সন্ততি নেই কোনো, তৃষ্ণা আজ
ক্ষণিক প্রপঞ্চ
মুহুর্মুহু দৃশ্যের বদল হচ্ছে
মুহুর্মুহু ভেঙে যাচ্ছে বিশ্বাস, বন্ধুতা
গোপন কোটর থেকে ফনা তুলছে হাজার নাগিনী

ছোবলে-ছোবলে
বিষ ঢেলে দিচ্ছে অন্ধকার
প্রতিটি অঙ্কুর ঝরে যাচ্ছে ভালবাসা থেকে আর প্রত্যেকের
ভূমিকা বদলে যাচ্ছে হিম শূন্যতায়
যাব কোন দিকে? আগুনের গান শুনি
জলের গভীরে

তেলের শিশি ভেঙেছে বলে খুকুর ওপরে আর রাগ করি না কেউ
ভেঙে-চুরে তছনছ করি জাতককথার পরম্পরা

সাগর-পেরিয়ে-আসা খোককসের কাছে চেয়ে নিই পক্ষিরাজ ঘোড়া
রুপোর কাঠির ছোঁয়া নিয়ে ঘুমোক নাহয় দশদিক
যতদিন বাঁচি সুখে বাঁচি কৌপিন-পরানো ভাগ্যের লীলায়
খোক্কসের দেশ থেকে নিয়ে আসি থোকা-থোকা
পদ্মেতে-লুকোনো সুতো-শঙ্খ সাপ, নিদালির রাতে পাকে-পাকে
জড়ালে জড়াক আছে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী
এসো, পাশ ফিরে শুই
স্মৃতির ভারত ভেঙেছে ভাঙুক আছে পক্ষিরাজ
এসো, পাশ ফিরে শুই
যত রবি জলুক না দাউদাউ অযোধ্যায় কে বা আঁখি মেলে
পোড়ে তো পুড়ুক বুক
পিঠ এখনো রয়েছে। এসো, পাশ ফিরে শুই
ছাই-ফেলতে ভাঙা কুলো তুলে আনি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে
খাণ্ডব-দহন হবে খোক্কসের বরে

ইতিহাস গোলকধাঁধার মতো পথিক ভোলায় গিরি-মরু-জলপথে
কারা আগে এসেছিল, কারা এল পরে?
লোহা দিয়ে তামাকে হটিয়ে কোন্ পুরন্দর কত রাজত্ব গড়েছে
কত রক্ত ঝরেছিল হরপ্পার প্রাচীন ধুলোয়
কান পেতে শোনো, কত অনার্য নারীর লুণ্ঠিত যৌবন হাহাকার
করেছিল লুঠেরা আর্যের পায়ে, কত শিশু
দাস হয়েছিল জন্ম জন্ম ধরে, পরিত্রাণহীন, বিজেতার বিলাসী বৈভবে
ডুবে গিয়েছিল মানুষের আদি-পরিচয়
গোলকধাঁধায় কবে ওরা হারিয়ে গিয়েছে, মিশে গেছে লোকায়ত
মুগ্ধবোধ আর যন্ত্রণার নিঃসঙ্গ সময়
কেউ জানে কবে কোন্ জৈন তীর্থঙ্কর আর শ্রমণের মাধুকরী পথে-পথান্তরে
ছড়িয়ে গিয়েছে? তিব্বতী লামার কালচক্রযানে

কতটা মিশেছে কৈবর্ত বিদ্রোহ? ঐ শৈব আগমের রহস্যমণ্ডল কাকে চায়?
পদ্মবীজ একথা জানে না, শুধু মুচড়ে ওঠে
ঘৃণায় -আক্রোশে তার রক্তাক্ত শরীর, ছেড়াখোঁড়া
ইতিহাস থেকে তুলে আনে
ক্রোধ ও হিংসার নষ্ট কথামালা

অন্ধ, জাগো, আর কত অন্ধকার চাই? প্রতিদিন
মৃত্যুর গরল মেনে নিয়ে
তর্ক-ছলে আর কত নিজেকে ভোলাবে? প্রতি রাতে
কাঁটাতার-ঘেরা এই অপমান ভুলে
স্মৃতির উজানে যদি যেতে চাও, কেন চাও? কতটুকু
আলো পেলে আঁধার শনাক্ত করা যাবে?

আলো, জন্মান্ধের কাঙাল বাসনা
আলো, বিনিদ্র রাতের ইস্তাহার
আলো, শেকল-ছেড়ার অফুরান পুনর্বিবেচনা
আলো, ধর্মাধর্মহীন ভাষার প্রণাম

ঘৃণায় উচ্ছিষ্ট হলো দিন
আক্রোশে উচ্ছিষ্ট হলো রাত
এই ঘৃণা শুধু ঘৃণা, তার কোনো প্রতিশব্দ নেই।
ক্রোধ আজ শুধু ক্রোধ, আর কোনো রূপক চাইনা
আক্রোশে উচ্ছিষ্ট হলো রাত
ঘৃণায় উচ্ছিষ্ট হলো দিন।

উদ্দালক যেমন জেনেছে।
আর জেনেছে গৌতম
কেন অন্ধ সে-কথা জানো না অন্ন পথ, অন্নই পাথেয়
অন্ন ছাড়া সত্যের স্ফুরণ নেই।
এই অন্ন রামে নেই, নেই রহিমেও
এই অন্ন চেয়েছিল ঈশ্বরী পাটনী অন্ন সাধ্য, অন্নই সাধন
ডিহিদার খুশি হলে অন্ন দেয়
কিংবা বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে যায়
মুকুন্দরামের শিশু কাঁদে আজও
ওদনের তরে, সেই অশ্রু অন্নদা দেখে না অন্ন ভূমা, অন্নই দর্শন
শতাব্দীর রাক্ষসীবেলায়

খোক্কসের সেনাপতি নিদালি ছড়ায়
নিরন্ন ভারতে, ঘৃণায়-বিদ্বেষে
ক্ষুধাকে ভোলাতে অন্ন রাম, অন্নই রহিম
আর কত অন্ধকার চাই? অন্ধ, জাগো
অন্নের বন্দনা করো

কোন্ পথে শাক্যমুনি গিয়েছেন মহানিষ্ক্রমণে? কোন্ পথে
আত্মদীপ সারিপুত্র, লালন ফকির? শ্রীজ্ঞান অতীশ
আর পণ্ডিত রাহুল কোন্ পথে আলো জ্বেলে মানুষের সীমা
আরো বহুদূর বাড়িয়ে গেছেন? তবে এই কৃষ্ণপক্ষ কেন
নালন্দার দেশে? কেন এই হনন-রৌরব?
এখনো তো কবি অনাঘ্রাত ফুল খুঁজে পান পাথরে-মরুতে
এখনো তো জীবনের মথিত গোপন থেকে
জেগে ওঠে ভালবাসা, ভোরের ওঙ্কার।
সেই পথ তবে কোথায় হারাল গভীর গভীরতর এই অন্ধকারে?
কেন বা হারাল? কেন বন্ধু
ভুলেছে বন্ধুতা, সেঁকো বিষ তুলে দিচ্ছে কেন চুম্বনের ছলে?
পথ-ভোলা এই কৃষ্ণপক্ষে কোথায় নেমেছে, প্রীতিহীন?

জাগো সাত ভাই চম্পা, জাগো রে কিরণমালা
জাগো যৌথ উষ্ণতার স্বপ্নে, নতুন নির্মাণে জাগো
প্রতিটি অঘ্রান হোক নবান্নের
বর্ণমালা শিখে নিক শাকম্ভরী গান
যদি জাগো, অঙ্কুরিত হবে প্রাণের পিপাসা।
আর স্বপ্নের আকাশ
যদি জাগো, বিচ্ছেদের বারমাস্যা থেকে সরে যাবে
ছায়া, আলোর সংকেতে
ঝড় ও আকাশ থেকে ভাষা নিয়ে জাগো
মৃত্যু ও আগুন থেকে জাগো, নতুন প্রতীক

ক্ষয় কী প্রকৃত সত্য? ক্ষয় কী আকাশ?
মেঘে-মেঘে ক্ষয়ের বীজাণু ঝরে পড়ে?
ঘাসে ক্ষয়ে, ফুলে ক্ষয়, ভ্রূণেও কী ক্ষয়ের সংকেত?
ঘৃণা কী একান্ত সত্য? ক্ষয় নেই শুধুই হিংসার?
কথা বলো সাত ভাই চম্পা, অঙ্কুরিত হোক প্রাণ
শস্যের ফাল্গুন, কথা বললা, আলোর বিন্যাসে
এই চূর্ণ সময়ের ঘোর থেকে জাগাও জিজ্ঞাসা

মানুষের ভাষা আজ কার কাছে নতজানু হবে?

বিষে-নীল এই মন্বন্তর, নিরঙ্কুর বীজে রাত গুল্মময় তবু
নিঃস্ব খামারের বুক চিরে জেগে ওঠে নিরীশ্বর চাদ!
ঝসে-যাওয়া ফসলের মাঠে কোন্ আলো খোঁজো, পূর্বমেঘ?
পাঁজরে মশাল জ্বেলে সময় সমিধ হলো, দ্যাখো!

অন্ধকার ঢেলেছি আখরে, অন্ধকারে দোহার খুঁজেছি
আতুরের পদাবলী থেকে কীভাবে জাগাব কাল-পুরুষের তরবারি?

কোথায় আমার হারিয়ে-যাওয়া পথ, ঝরে-যাওয়া স্বপ্ন
কোথায় তুমি, ঝরা পাতার ব্যুৎসব?
কোথায় আমার নিরবধি কাল, কুলশীলহীন অন্ধকার
কোথায় তুমি জলঝর্নার ধ্বনি?
কোথায় আমার অসমাপ্ত রূপকথা, ব্যক্তিগত বিষাদের ভার
কোথায় তুমি, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ?
কোথায় আমার সময়-পেরোনো দোঁহাকোষ, অনিঃশেষ
লোকায়ত সুখ
কোথায় তুমি আলোহীনতার অভিমান, কবিতার
কুশপুত্তলিকা?

এই কৃষ্ণপক্ষে এসো খুঁজি কোথায় মানুষ...
ধর্মের কুহকে নয়, ঘনকালো রাত্রির আবরণে নয়
যেখানে স্বপ্নের স্থাপত্য গড়েছে মানুষের ভাষা
সেখানেই বিনিময় করি হাসি, অশ্রু আর ক্ষমা চাই
মানুষের কাছে যে-মানুষ আলোর সন্তান...