কমলাকান্তের পত্র/আবিষ্কার না বহিষ্কার
১১
আবিষ্কার না বহিষ্কার
কত হাজার বছরের কথা—মাটির ভিতর এক রাজার কবর, কবরের ভিতর মণিমাণিক্য খচিত এক স্ফটিকের পেটারি, তা’র ভিতর রাজার নশ্বর দেহ—কত স্নেহের, কত ভক্তির, কত সোহাগের সৌরভে ভরপুর। এক দিন পেটের দায়ে মাটি কাটচে এক চাষা, কোদালের কোণ ঠং করে’ লাগল সেই কবরের গায়; চাষা খুঁড়ে চলল, ভাবলে এইবার যক্ষের ধন বুঝি মিলল; খুঁড়ে বা’র করলে সেই স্ফটিকের পেটারি, খুলে ফেলল তা’র ডালা—কি অপূর্ব্ব সৌরভ, কি অপূর্ব্ব মূর্ত্তি সে সহস্র বৎসরের ঘুমন্ত রাজার, কি অপূর্ব্ব জ্যোতি সে মণিমাণিক্যের—কিন্তু দেখতে দেখ্তে সে সৌরভ উপে গেল, রাজার ঘুমন্ত মূর্ত্তি উপে গেল, মণিমাণিক্য ধূলায় পরিণত হল; স্পর্শ করবার আগেই, আলো লেগে, বাতাস লেগে, চাষার লুব্ধদৃষ্টি লেগে যেন সব গলে’ গেল, বাতাসে মিশিয়ে গেল। চাষা যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখলে মাত্র!
পেটের দায়ে না হ’ক—আর পেটের দায়ে নয়ই বা কেন? একটু ঘুরিয়ে দেখলে, পেটের দায়েই—পুরাতন কবর খুঁড়ে পুরারত্ন বা’র করবার বড় ধুম পড়ে’ গেছে। টাটকা কবর খুঁড়ে মড়া বা’র করে’ যারা উদরস্থ করে, তাদের বলে ghoul. Ghoul এক রকমের প্রেতযোনি, আধা মানুষ আধা ভূত। পুরাতন কবর যারা খোঁড়ে তাদের বলে পুরাতত্ত্ববিৎ—আমি বলি পুরা-ghoul. সত্যিকারের ghoulগুলো মড়া খুঁড়ে বা’র করে’ খায়, পুরা-ghoulগুলো মড়া বেচে, তা’র অস্থি বেচে, তা’র ছাই বেচে টাকা রোজকার করে, আর সেই টাকার বিনিময়ে রুটি ও পনির কিনে খায়, এই তফাৎ। আর রাজার কবরটা—কত স্নেহে স্নিগ্ধ, কত ভক্তিতে সুরভিত, কত মহিমায় মহিমান্বিত—রাজার কবরটা উপে যায়; উপে যায় বই আর কি বলব? সাত সমুদ্র তের নদী পার, কোথায় পুরাতত্ত্ব সংগ্রহের গুদামে খণ্ড খণ্ড, শত খণ্ড হ’য়ে শত গুদামে গস্ত হয়। সে থাকাকে যদি থাকা বল ত’ নিমতলার ঘাটের খেয়া পার হ’লেও, তুমিও থাক আমিও থাকি,সকলেই থাকি। পাঁচ ভূতের সঙ্গে মিশিয়ে থাকি ত?—কিন্তু সে কি তোমার থাকা না আমার থাকা? সে ভূতের থাকা, বলতে পার বটে। তেমনি সে পুরাতাত্ত্বিক গুদামে চারিয়ে পড়ে’ থাকাকে যদি রাজার থাকা বল, আমার আপত্তি নেই।
এই পুরা-ghoulদের উৎপাৎ হয়েছে সব চেয়ে বেশী দুটা দেশে—মিশরে আর ভারতবর্ষে। দুটাই পরাধীন দেশ, সুতরাং ভূতের উৎপাৎ ত হবারই কথা। কিন্তু সেটা যে ভূতের উৎপাত আমি কমলাকান্ত ত বললে কেউ শুন্বে না—বলবে গবেষণা, পুরাবস্তু আবিষ্কার, লুপ্ত-রত্নোদ্ধার ইত্যাদি। কিন্তু আবিষ্কার মানে ত আমি এতাবৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারলুম না। শুনেছি সার উইলিয়ম জোন্স্ কারও কারও মতে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য আবিষ্কার করেছিলেন। সে আবিষ্কারের মানে ঠিক পাতাল খুঁড়ে বা’র করা নয়; তার মানে হচ্চে এই যে, তাঁর পূর্ব্বে ইংলণ্ডে তথা ইউরোপে কারও জানা ছিল না, যে সংস্কৃত বলে’ একটা ভাষা ও সাহিত্য আছে; তিনি জানলেন এবং তাঁর দেশের লোককে জানালেন। কিন্তু জানলেন ও জানালেন বলে’ কি, যত পুঁথি আর পুস্তক জাহাজ বোঝাই করে এদেশ থেকে নিউইয়র্ক, আর লণ্ডন, আর পারিস্, আর বার্লিনে নিয়ে গিয়ে গস্ত করতে হবে? আবিষ্কার মাত্রই বহিষ্কার বা সমুদ্র পারে চালান করে’ দিতে হবে? যদি বল কেউ কি জোর করে’ নিয়ে গেছে? কতক জোর করেই নিয়ে গেছে, কতক চোখে ধুলো দিয়ে নিয়ে গেছে, কতক পয়সা দিয়েও নিয়ে গেছে। আমি সবই জোর করে’ নিয়ে যাওয়ার সামিল মনে করি। বুভুক্ষিতকে উদরের জ্বালা নিবৃত্তির জন্য, দু’ পয়সার ছাতু কিনে দিয়ে, তার কুঁড়ে ঘরে সযত্ন রক্ষিত অমূল্য পুঁথিখানা দেশের কুল রাজ্যের কুলে পাচার করে’ দেওয়াকে আমি জোর করে’ নিয়ে যাওয়াই বলব। জোরটা সরাসরি পুঁথিখানার উপর না পড়ে’ তা’র উদরের উপর অর্থাৎ তার প্রাণের উপর পড়ল, এইমাত্র প্রভেদ। আর ক্ষিদে বহু রকমের হ’তে পারে—পেটের ক্ষিদে, যশের ক্ষিদে, খেতাবের ক্ষিদে ইত্যাদি।
মাটির ভিতর থেকে বা মাটির উপর থেকে পুরাতত্ত্ব আবিষ্কার করায় আবিষ্কারকের কোন স্বত্ব জন্মায় তা আমি মানি না। লড়ায়ে হারলে বিজিতের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠনে বিজেতার স্বত্ব আমি মানি। মিসরবাসী তেল-এল-কেবিরের যুদ্ধে হেরেচে, বাঙ্গালী পলাশির যুদ্ধে হেরেচে; তা’র জন্য বিজেতার দাবী, পরাজিত মিসরবাসী ও বাঙ্গালী তথা ভারতবাসী মান্তে বাধ্য; কিন্তু সে দাবীর কথা না তুলে’ যদি কেহ আবিষ্কারকের দাবীর কথা তুলে, আমি তা’কে প্রতারক বলব। মহমুদ সোমনাথ লুঠ করে’ লুণ্ঠনলব্ধ রত্নসম্ভার গজনি চালান করেছিল, আবিষ্কারকের বুজরুকি করেনি। আর লুণ্ঠনকার্য্যটা জয়ের অব্যবহিত পরেই কর, আর র’য়ে-বসে’ সুবিধামত করতে থাক, একই কথা। কিন্তু সে কথা স্পষ্ট করে’ বল, আমি তোমাকে আশীর্ব্বাদ করব। আর আবিষ্কার করলে যদি স্বত্বই জন্মায়, আমি বলব আবিষ্কার করা ব্যবসাটা ছাড়! এ তোমার মাটি খুঁড়ে কয়লা আবিষ্কার করা নয়; নিয়ে যাও তুমি কয়লা, নিয়ে যাও তুমি সোনা, আর তাঁবা, আর লোহা, আর টিন—তাতে ভারতবর্ষ গরীব হবে না; কিন্তু আবিষ্কার আর পুরাতত্ত্বের নামে কবর খুঁড়ে মহাপুরুষের অস্থি—আর মন্দির হ’তে দেবতার প্রতিমূর্ত্তি,—মন্দিরগাত্র হ’তে অপূর্ব্ব চিত্র আর কারুশিল্পের নিদর্শন জাহাজে বোঝাই দিয়ে নিয়ে যেও না, তা’তে ভারতবর্ষের যে দীনতা আসবে তার সীমা নাই; ঐ অস্থি, ঐ প্রতিমূর্ত্তি, ঐ শিল্প-মহিমা ভারতকে একদিন প্রাচ্যদেশের তীর্থস্থান করেছিল, ভবিষ্যতের সে সম্ভাবনাকে একেবারে অসম্ভব করে’ দিও না।
লর্ড কর্জ্জনের আইন পুরাবস্তুকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেচে; পুরাবস্তু অর্থে মাটির উপর বা গুহার মধ্যে যা কিছু দৃশ্যমান; সেগুলিকে নষ্ট করার বা বিকৃত করার প্রতিষেধক কতগুলি আইনকানুন হয়েচে। তা’তে কবর খুঁড়ে অস্থি বা ভক্তগণ-স্থাপিত-মূর্ত্তিকে, স্থানচ্যূত করে’ গুদামজাত করার কোন প্রত্যবায় হয় নি। ভারুটের বৌদ্ধস্তূপের বিচিত্র শিল্প-সম্পত্তি কলিকাতার যাদুঘরে জমা করা দেখলে, চিৎপুরের ট্রামের ঘর্ঘর, বেচা-কেনার কোলাহল কচকচি, ধূম ও ধুলার অন্ধকারে, খাঁচার ভিতর বন্দী কোকিল বা পাপিয়ার কণ্ঠস্বর মনে পড়ে; মুক্ত বাতাস, মুক্ত আকাশ থেকে বঞ্চিত করে’ যে হৃদয়হীন তা’কে চিৎপুরের জাফ্রিঘেরা বারান্দার ভিতর পিঞ্জরবদ্ধ করেচে তাকে অভিসম্পাত করিতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয় বন্দী পাখীগুলোর মত বন্দী পাথরগুলোর প্রাণ আর্ত্তনাদ করচে! তাই আমি বলি যেখানে যা পাও বা আবিষ্কার কর, সেইখানেই যত্ন করে’ সংরক্ষণ কর; স্থানচ্যুত করে’ সংরক্ষণ, ইতিহাসেরও মাথায় পা দিয়ে ডুবান! খরচে কুলাবে না—পয়সা নেই, সে সব বাজে কথা। যদি সে খরচ না যোগাতে পার, আবার বলি, আবিষ্কার করা ছেড়ে দাও। যেখানকার জিনিষ সেইখানেই থাক, এতদিন ত ছিল, আরও কিছুদিন থাক। ভক্তের আরাধনার বস্তু ভক্ত যেখানে স্থাপন করেছিল—সেই জল স্থল আকাশ নদ নদী বৃক্ষলতা তা’রই মধ্যে থাক; সেখান থেকে তুলে এনে গুদাম ঘরে পুরে রাখলে কি ভক্তের বুকে, আর সেইসঙ্গে ইতিহাসের বুকে ছুরি দেওয়া হয় না? তুমি বলবে ভক্ত কই? সে ঠিক কথা, ভক্ত নেই, ঐতিহাসিক আছে। মুসলমান ভাই সকলের প্রতাপে কোন নিভৃত জঙ্গলের ভিতরকার একটা ক্ষুদ্র দরগার একখানি ইষ্টক সরিয়েছ কি কানপুরী দাওয়াইএর ব্যবস্থা। মুসলমান ভাইগণের এই জবরদস্তি ভাবকে কেউ কেউ fanaticism বলেন; কিন্তু এই fanaticism পুরাবস্তু সংরক্ষণ কল্পে লর্ড কার্জ্জনের আইন অপেক্ষা বলবান। কিন্তু আমরা জবরদস্ত নই—আমরা উদার, আমরা মহান, আমরা সনাতন! ইটালি যখন অস্ট্রীয়ার কুক্ষিগত, গ্রীস যখন বারভূতের সম্পত্তি, তখন ঐ দুই দেশের পুরাবস্তু নিয়ে অনেকেই ছিনিমিনি খেলেছিলেন—যে যা পেয়েচেন লুটে নিয়ে গিয়েছিলেন; ইটালিকে এখন সে সকল art treasure ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্চে; ভারতের লুণ্ঠিত রত্নরাজি ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা কবে হবে? কে করবে?