কমলাকান্তের পত্র/বিজয়া

বিজয়া

সন্ধ্যার পর প্রসন্ন অতি ম্লানমুখে আমার কুটীরের দাওয়ার নীচে আসিয়া দাঁড়াইল, দূরে ঠাকুরবিসর্জ্জনের বাজনা বাজিতেছিল; শানাইয়ের করুণ সুর জনকোলাহল ভেদ করিয়া জানাইতেছিল—এ বৎসরের মত বাঙ্গালীর পূজার অর্থাৎ দুর্গাপূজার উৎসব শেষ হইল।

 প্রসন্ন কোন কথা না কহিয়া অতি ধীরে আমার কাছে আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া একটা গড় করিল! আমি প্রসন্নকে বলিলাম—প্রসন্ন! আজ সব ফ্যাসাদ মিটিয়া গেল ত?

 প্রসন্ন। দেখ, যেদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া উঠানে ঠাকুরপ্রতিমা ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে দেখিলাম সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল, কত আর্ত্তনাদ করিয়া তোমার কাছে ছুটিয়া আসিয়াছিলাম, মনে হইয়াছিল কি বিপদেই পড়িলাম। আজও তোমার কাছে ছুটিয়া আসিয়াছি, কিন্তু আজ বুঝিতে পারিতেছি না—কেন তখন আপনাকে এত বিপন্ন মনে করিয়াছিলাম। আজ ছুটিয়া আসিয়াছি—বাড়ীতে আর থাকিতে পারিতেছি না, আমার ক্ষুদ্র কুটীর যেন কত বড় কত ফাঁকা মনে হইতেছে; মনে হইতেছে যে, গ্রামের সমস্ত লোককে আমার উঠানে জড় করিলেও যেন সে ফাঁক ভরিয়া উঠিবে না। এমন নিস্তব্ধ নির্জ্জন স্থান আমি কখনও কোথাও দেখি নাই। আমি সেখানে কেমন করিয়া থাকিব জানি না।

 আমি। কোন্‌টা নির্জ্জন মনে হচ্ছে ঠিক বুঝতে পাচ্চ কি?—মনের ভিতরটা, না ঘরের ভিতরটা?

 প্রসন্ন। কি জানি! আমার ছেলে নাই মেয়ে নাই—আঁচল দিয়া প্রতিমার চরণ যখন মুছাইয়া লইলাম, তখন আমার বুকের ভিতর যে কি রকম করিয়া উঠিল, তাহা আমি বলিতে পারি না—যেন আমারই মেয়ে আমার গৃহ শূন্য করিয়া স্বামীর বাড়ী চলিয়া যাইতেছে। সে কষ্ট কেমন তাহা, আমি মা নই, ঠিক বলিতে পারি না, তবে আমার মনে হয় ঐ রকমই। আমার মনে হইল, মা’র চোখেও যেন জল দেখিলাম! পাড়ার মেয়ে শ্বশুরঘর করিতে চলিয়াছে, মা’র চোখে জল, মেয়ের চোখে জল, দেখাদেখি আমারও চোখে জল আসিয়াছে, কিন্তু এমনতর কষ্ট তো তখন হয় নাই। এখন বুকটা যেন ফাটিয়া যাইতেছে; সব যেন শূন্য মনে হইতেছে।

 আমি। এতগুলা টাকা যে বাজে খরচ হইয়া গেল, প্রসন্ন! সেটা কি একবারও মনে হচ্ছে না?

 প্রসন্ন। মোটেই না। আমার মনে হইতেছে টাকা দিয়া কেনা যায় না এমন-একটা-কিছু ভাগ্যক্রমে পাইয়াছিলাম, আজ তাহা হারাইয়াছি, আর বুঝি তা কখনও ফিরিয়া পাইব না।

 আমি মনে মনে এই মাতৃপূজার প্রবর্ত্তক মহাপুরুষকে কোটি কোটি প্রণাম করিলাম। বলিহারি তোমার রচনা। এই ‘আভাঙ্গা’ গয়লার মেয়ের মনকে কি আশ্চর্য্য উপায়ে তোমার শিক্ষা-পদ্ধতি তার এই দুনিয়ার চূড়ান্ত ঐশ্বর্য্য ধনসম্পদের আবিল আবর্ত্ত হইতে উত্তোলন করিয়া প্রকৃত ঐশ্বর্য্যের দিকে তুলিয়া লইল; এ গয়লার মেয়ে স্বল্পকালের জন্যও তোমার অদ্ভুত সৃষ্টি কৌশলে এমন এক ভাব রাজ্যে নীত হইল যে, সে আর মণিকে মণি বলিয়া মানিল না, টাকার চেয়েও একটা কিছু বড়—একটা কিছু প্রিয়তর ইষ্টতর জিনিষের ইঙ্গিত পাইল। বলিহারি তোমার কল্পনা। এই পার্থিব জীবনে পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, পুরুষ-নারী সকলেরই তো ঐহিকতার অগ্নিকুণ্ড হইতে পরিত্রাণ আবশ্যক। এই পরিত্রাণের কি অদ্ভুত পথই না তুমি আবিষ্কার করিয়াছ! বেদান্তের গভীর সিদ্ধান্তগুলি হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য প্রত্যেক মানুষকে যদি টোলের প্রথম পাঠ হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্য্যন্ত পৌঁছিতে হইত, তাহা হইলে বাস্তবিকই এই এক জন্মের সাধনায় বর্ণপরিচয়ও শেষ হইত না; কেবল তাই নয়, মানুষ তাহার হৃদয়ের ক্ষুধা নিবৃত্তি করিবার জন্য এক এক করিয়া চতুঃষষ্টিসহস্র যোনি ভ্রমণ করিয়াও বুঝি তৃপ্ত হইতে পারিত না। অথচ তাহার সে ক্ষুধা তাহাকে নিবৃত্ত করিতেই হইবে, নহিলে তাহার মুক্তি নাই। এই মুক্তি যদি তাহাকে বুদ্ধির ধাপে ধাপে উঠিয়া অর্জ্জন করিতে হইত তাহা হইলে তাহা চিরকালই অর্জ্জনের বস্তুই থাকিয়া যাইত, অর্জ্জিত আর হইত না। কেবল বুদ্ধি দিয়াই যদি তাহা অর্জ্জনসাধ্য হইত তাহা হইলে নিত্যানন্দ প্রভু লৌহহৃদয় জগাইমাধাইকে টোলে পড়িবারই পরামর্শ দিতেন, হৃদয়ের তন্ত্রীবিশেষে আঘাত করিয়া সেই লৌহহৃদয়কে কলধৌতে পরিণত করিতেন না। মানব হৃদয়ের সেই নিগূঢ় রহস্যজ্ঞান লইয়া, হে শিল্পী তুমি যে মাতৃমূর্ত্তির কল্পনা করিয়াছ তাহা তুলনাতীত। তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম।