কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/প্রতিনিধি




প্রতিনিধি

বসিয়া প্রভাতকালে   সেতারার দুর্গভালে
  শিবাজি হেরিলা একদিন—
রামদাস গুরু তাঁর   ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার
  ফিরিছেন যেন অন্নহীন।
ভাবিলা, —এ কি এ কাণ্ড,   গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড
  ঘরে যাঁর নাই দৈন্য লেশ?
সবই যাঁর হস্তগত   রাজ্যেশ্বর পদানত
  তাঁরো নাই বাসনার শেষ?

এ কেবল দিনে রাত্রে   জল ঢেলে ফুটা পাত্রে
  বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে;
কহিলা, দেখিতে হবে   কতখানি দিলে তবে
  ভিক্ষা বুলি ভরে একেবারে।
তখনি লেখনী আনি   কি লিখি দিলা কি জানি
  বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে
গুরু যবে ভিক্ষা আশে   আসিবেন দুর্গ-পাশে
  এই লিপি দিয়ে তাঁর পায়ে।



গুরু চলেছেন গেয়ে,   সম্মুখে চলেছে ধেয়ে
  কত পান্থ, কত অশ্বরথ। —
“হে ভবেশ, হে শঙ্কর,   সবারে দিয়েছ ঘর,
  আমারে দিয়েছ শুধু পথ।
অন্নপূর্ণা মা আমার   লয়েছে বিশ্বের ভার,
  সুখে আছে সর্ব্ব চরাচর,
মোরে তুমি হে ভিখারী   মা’র কাছ হ’তে কাড়ি
 করেছ আপন অনুচর।”


সমাপন করি গান   সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান
  দুর্গদ্বারে আসিলা যখন—
বালাজি নমিয়া তাঁরে   দাঁড়াইল একধারে
  পদমূলে রাখিয়া লিখন।
গুরু কৌতুহলভরে   তুলিয়া লইলা করে,
  পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম   শিবাজি সঁপিছে অদ্য
  তাঁরে নিজ রাজ্য-রাজধানী।


পর দিনে রামদাস   গেলেন রাজার পাশ,
  কহিলেন, “পুত্র কহ শুনি
রাজ্য যদি মোরে দেবে   কি কাজে লাগিবে এবে
  কোন্ গুণ আছে তব, গুণী?”

“তােমারি দাসত্বে প্রাণ।  আনন্দে করিব দান”
   শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে,—
গুরু কহে-“এই ঝুলি   লহ তবে স্কন্ধে তুলি
   চল আজি ভিক্ষা করিবারে।”

শিবাজি গুরুর সাথে  ভিক্ষাপাত্র ল’য়ে হাতে
  ফিরিলেন পুরদ্বারে দ্বারে।
নৃপে হেরি ছেলে মেয়ে   ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে
   ডেকে আনে পিতারে মাতারে।
অতুল ঐশ্বর্য্যে রত   তাঁর ভিখারীর ব্রত,
  এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে,  হস্ত কাঁপে থরথরে,
  ভাবে, ইহা মহতের লীলা।

দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে,  ক্ষান্ত দিয়া কর্ম্মকাজে
  বিশ্রাম করিছে পুরবাসী।
একতারে দিয়ে তান  রামদাস গাহে গান
  আনন্দনয়নজলে ভাসি;—
“ওহে ত্রিভুবনপতি  বুঝি না তােমার মতি
  কিছু ত অভাব তব নাহি,
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু  ভিক্ষা মাগি ফির প্রভু
  সবার সর্ব্বস্বধন চাহি।”

অবশেষে দিবসান্তে   নগরের একপ্রান্তে
   নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি—
ভিক্ষা-অন্ন রাঁধি সুখে   গুরু কিছু দিলা মুখে
   প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি।
রাজা তবে কহে হাসি   “নৃপতির গর্ব্ব নাশি
   করিয়াছ পথের ভিক্ষুক;
প্রস্তুত রয়েছে দাস,—   আরাে কিবা অভিলাষ,
   গুরু কাছে ল’ব গুরু দুখ।”

গুরু কহে “তবে শােন্,   করিলি কঠিন পণ
   অনুরূপ নিতে হবে ভার,
এই আমি দিনু ক'য়ে   মাের নামে মাের হ'য়ে
   রাজ্য তুমি লহ পুনর্ব্বার।
তােমারে করিল বিধি   ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,
   রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন;
পালিবে যে রাজধর্ম্ম   জেনাে তাহা মাের কর্ম্ম,
   রাজ্য ল'য়ে র'বে রাজ্যহীন।—

“বৎস, তবে এই লহ   মাের আশীর্ব্বাদসহ
   আমার গেরুয়া গাত্রবাস;
বৈরাগীর উত্তরীয়   পতাকা করিয়া নিয়াে”
   কহিলেন গুরু রামদাস।

৩২১
5--21

নৃপশিষ্য নতশিরে   বসি রহে নদীতীরে,
   চিন্তারাশি ঘনায় ললাটে।
থামিল রাখাল-বেণু,   গােঠে ফিরে গেল ধেনু
   পরপারে সূর্য্য গেল পাটে।

পূরবীতে ধরি তান   একমনে রচি গান
   গাহিতে লাগিলা রামদাস,—
“আমারে রাজার সাজে   বসায়ে সংসার মাঝে
   কে তুমি আড়ালে কর বাস?
হে রাজা রেখেছি আনি   তােমারি পাদুকাখানি
  আমি থাকি পাদপীঠতলে;
সন্ধ্যা হ'য়ে এল ওই,   আর কত বসে' রই
  তব রাজ্যে তুমি এস চলে।”*

৬ই কার্তিক, ১৩০৪


*অ্যাওয়ার্থ সাহেব কয়েকটি মারাঠী গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহারই ভুমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা “তাগোয়া জেন্দা” নামে খ্যাত।