কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা

কথা ও কাহিনী

শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা[১]

(অবদানশতক)

“প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,
ওগো পুরবাসী কে রয়েছ জাগি”,—
অনাথ-পিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ-
নিনাদে।
সদ্য মেলিতেছে তরুণ তপন
আলস্যে অরুণ সহাস্য লোচন
শ্রাবস্তিপুরীর গগন-লগন-
প্রাসাদে
বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান,
এখনো ধরেনি মাঙ্গলিক গান,
দ্বিধাভরে পিক মৃদু কুহুতান
কুহরে।



ভিক্ষু কহে ডাকি—“হে নিদ্রিত পুর,
দেহ ভিক্ষা মোরে, কর নিদ্রা দূর”—
সুপ্ত পৌরজন শুনি সেই সুর
শিহরে।
সাধু কহে,—“শুন, মেঘ বরিষার
নিজেরে নাশিয়া দেয় বৃষ্টিধার,
সর্ব্ব ধর্ম্মমাঝে ত্যাগ ধর্ম্ম সার
ভুবনে।”
কৈলাস শিখর হ’তে দূরাগত
ভৈরবের মহা-সঙ্গীতের মত
সে বাণী মন্দ্রিল স্থখ তন্দ্রারত
ভবনে।
রাজা জাগি ভাবে বৃথা রাজ্য ধন,
গৃহী ভাবে মিছা তুচ্ছ আয়োজন,
অশ্রু অকারণে করে বিসর্জন
বালিকা।
যে ললিত সুখে হৃদয় অধীর
মনে হ’ল, তাহা গত যামিনীর
স্খলিত দলিত শুষ্ক কামিনীর
মালিকা।



বাতায়ন খুলে যায় ঘরে ঘরে,
ঘুম-ভাঙা আঁখি ফুটে থরে থরে
অন্ধকার পথ কৌতুহল ভরে
নেহারি’।
“জাগ ভিক্ষা দাও!” সবে ডাকি ডাকি,
সুপ্ত সৌধে তুলি নিদ্রাহীন আঁখি,
শূন্য রাজবাটে চলেছে একাকী
ভিখারী।
ফেলি দিল পথে বণিক-ধনিকা
মুঠি মুঠি তুলি রতন-কণিকা,
কেহ কণ্ঠহার, মাথার মণিকা
কেহ গো!
ধনী স্বর্ণ আনে থালি পূরে পূরে,
সাধু নাহি চাহে, পড়ে’ থাকে দূরে,
ভিক্ষু কহে—“ভিক্ষা আমার প্রভুরে
দেহ গো!”
বসনে ভূষণে ঢাকি গেল ধূলি,
কনকে রতনে খেলিল বিজুলী,
সন্ন্যাসী ফুকারে ল’য়ে শূন্য ঝুলি
সঘনে;–


“ওগো পৌরজন, কর অবধান,
ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ তিনি, বুদ্ধ ভগবান,
দেহ তাঁরে নিজ সর্ববশ্রেষ্ঠ দান
যতনে ৷”
ফিরে যায় রাজা, ফিরে যায় শেঠ,
মিলে না প্রভুর যোগ্য কোনো ভেট,
বিশাল নগরী লাজে রহে হেঁট-
আননে।
রৌদ্র উঠে ফুটে, জেগে উঠে দেশ,
মহানগরীর পথ হ’ল শেষ,
পুরপ্রান্তে সাধু করিলা প্রবেশ
কাননে;
দীন নারী এক ভূতল-শয়ন
না ছিল তাহার অশন ভূষণ,
সে আসি নমিল সাধুর চরণ-
কমলে।
অরণ্য-আড়ালে রহি কোনোমতে
একমাত্র বাস নিল গাত্র হ’তে,
বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে
ভূতলে



ভিক্ষু উৰ্দ্ধভুজে করে জয়নাদ,
কহে “ধন্য মাতঃ, করি আশীর্ব্বাদ,
মহাভিক্ষুকের পূরাইলে সাধ
পলকে ৷”
চলিলা সন্ন্যাসী ত্যজিয়া নগর
ছিন্ন চীরখানি ল’য়ে শিরোপর,
সঁপিতে বুদ্ধের চরণ-নখর-
আলোকে।
{{smaller|৫ই কার্ত্তিক, ১৩১৪

}}

  1. অনাথ-পিণ্ডদ বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন।