কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
তুমি পঞ্চশর?
আমি সেই মনসিজ,
নিখিলের নরনারী হিয়া টেনে আনি
বেদনা বন্ধনে।
কি বেদনা কি বন্ধন
জানে তাহা দাসী। প্রণমি তোমার পদে
প্রভু, তুমি কোন্ দেব?
বসন্ত
আমি ঋতুরাজ।
জর মৃত্যু দুই দৈত্য নিমেষে নিমেষে
বাহির করিতে চাহে বিশ্বের কঙ্কাল;
আমি পিছে পিছে ফিরে’ পদে পদে তা’রে
করি আক্রমণ; রাত্রিদিন সে সংগ্রাম।
আমি অখিলের সেই অনন্ত যৌবন।
চিত্রাঙ্গদা
প্রণাম তোমারে ভগবন্। চরিতার্থ
দাসী দেব-দরশনে।
মদন
কল্যাণি, কি লাগি’
এ কঠোর ব্রত তব? তপস্যার তাপে
করিছ মলিন খিন্ন যৌবন-কুসুম,
অনঙ্গ পূজার নহে এমন বিধান।
কে তুমি, কি চাও ভদ্রে!
চিত্রাঙ্গদা
দয়া কর যদি,
শোন মোর ইতিহাস। জানাব প্রার্থনা
তা’র পরে।
মদন
শুনিবারে রহিমু উৎসুক।
চিত্রাঙ্গদা
আমি চিত্রাঙ্গদা। মণিপুর-রাজ-সুতা।
মোর পিতৃবংশে কভু কন্যা জন্মিবে না—
দিয়াছিলা হেন বর দেব উমাপতি
তপে তুষ্ট হ’য়ে। আমি সেই মহাবর
ব্যর্থ করিয়াছি। অমোঘ দেবতা-বাক্য
মাতৃগর্ভে পশি, দুর্বল প্রারম্ভ মোর
পারিল না পুরুষ করিতে শৈবতেজে,
এমনি কঠিন নারী আমি।
মদন
শুনিয়াছি
বটে। তাই তব পিতা পুত্রের সমান
পালিয়াছে তোমা। শিখায়েছে ধনুর্ব্বিদ্যা
রাজদণ্ডনীতি।
চিত্রাঙ্গদা
তাই পুরুষের
বেশে, যুবরাজরূপে, করি রাজকাজ,
ফিরি স্বেচ্ছামতে; নাহি জানি লজ্জা ভয়,
অন্তঃপুরবাস; নাহি জানি হাব ভাব,
বিলাস-চাতুরী; শিখিয়াছি ধনুর্ব্বিদ্যা,
শুধু শিখি নাই, দেব, তব পুষ্পধনু
কেমনে বাকাতে হয় নয়নের কোণে।
বসন্ত
সুনয়নে, সে বিদ্যা শিখে না কোনো নারী;
নয়ন আপনি করে আপনার কাজ,
বুকে যার বাজে সেই বোঝে।
চিত্রাঙ্গদা
একদিন
গিয়েছিনু মৃগ-অন্বেষণে একাকিনী
ঘন বনে, পূর্ণ নদীতীরে। তরুমূলে
বাঁধি’ অশ্ব, দুর্গম কুটিল বনপথে
পশিলাম মৃগপদচিহ্ন অনুসরি’।
ঝিল্লিমন্দ্রমুখরিত নিত্যঅন্ধকার
লতাগুল্মে-গহন গম্ভীর মহারণ্যে,
কিছুদূর অগ্রসরি’ দেখিনু সহসা
রুধিয়া সঙ্কীর্ণ পথ রয়েছে শয়ান
ভূমিতলে, চীরধারী মলিন পুরুষ।
উঠিতে কহিনু তা’রে অবজ্ঞার স্বরে
সরে যেতে,—নড়িল না, চাহিল না ফিরে’
উদ্ধত অধীর রোষে ধনু-অগ্রভাগে
করিমু তাড়না;—সরল সুদীর্ঘ দেহ
মুহূর্ত্তেই তীরবেগে উঠিল দাঁড়ায়ে
সম্মুখে আমার,—ভস্মসুপ্ত অগ্নি যথা
ঘৃতাহুতি পেয়ে শিখারূপে উঠে উর্দ্ধে
চক্ষের নিমেষে। শুধু ক্ষণেকের তরে
চাহিল আমার মুখপানে,—রােষদৃষ্টি
পলকে মিলায়ে গেল; গুপ্ত কৌতুকের
মৃদুহাস্যরেখা নাচিল অধরপ্রান্তে,
বুঝি সে বালক-মূর্তি হেরিয়া আমার।
শিখে’ পুরুষের বিদ্যা, পরে’ পুরুষের
বেশ, পুরুষের সাথে থেকে, এতদিন
ভুলে ছিনু যাহা, সেই মুখে চেয়ে, সেই
আপনাতে-আপনি-অটলমূর্তি হেরি,
সেই মুহূর্তেই জানিলাম মনে, নারী
আমি। সেই মুহূর্তেই প্রথম দেখিনু
সম্মুখে পুরুষ মাের।
মদন
সে শিক্ষা আমারি
সুলক্ষণে! আমিই চেতন করে' দিই
একদিন জীবনের শুভ পুণ্যক্ষণে
নারীরে হইতে নারী, পুরুষে পুরুষ।
কি ঘটিল পরে?
চিত্রাঙ্গদা
সভয় বিস্ময়কণ্ঠে
শুধানু “কে তুমি?” শুনিনু উত্তর “আমি
পার্থ, কুরুবংশধর।”
রহিনু দাঁড়ায়ে
চিত্রপ্রায়, ভুলে’ গেনু প্রণাম করিতে।
এই পার্থ? আজন্মের বিস্ময় আমার?
শুনেছিনু বটে, সত্য পালনের তরে
দ্বাদশ বৎসর বনে বনে ব্রহ্মচর্য্য
পালিছে অৰ্জ্জুন। এই সেই পার্থবীর!
বাল্য-দুরাশায় কতদিন করিয়াছি
মনে, পার্থকীর্ত্তি করিব নিস্প্রভ আমি
নিজ ভুজবলে; সাধিব অব্যর্থ লক্ষ্য;
পুরুষের ছদ্মবেশে মাগিব সংগ্রাম
তাঁর সাথে, বীরত্বের দিব পরিচয়।
হারে মুগ্ধে, কোথায় চলিয়া গেল সেই
স্পর্দ্ধা তাের! যে ভূমিতে আছেন দাঁড়ায়ে
সে ভূমির তৃণদল হইতাম যদি,
শৌর্য্যবীর্য্য যাহা কিছু ধূলায় মিলায়ে
দিয়ে, লভিতাম দুর্লভ মরণ, সেই
চরণের তলে!-
কি ভাবিতেছিনু, মনে
নাই। দেখিনু চাহিয়া, ধীরে চলি’ গেলা
বীর বন-অন্তরালে। উঠিনু চমকি;
সেইক্ষণে জন্মিল চেতনা; আপনারে
দিলাম ধিক্কার শতবার। ছি ছি মূঢ়ে,
না করিলি সম্ভাষণ, না শুধালি কথা,
না চাহিলি ক্ষমা ভিক্ষা,—বর্ব্বরের মত
রহিলি দাঁড়ায়ে—হেলা করি’ চলি’ গেলা
বীর। বাঁচিতাম, সে মুহূর্তে মরিতাম
যদি।—
পরদিন প্রাতে দূরে ফেলে দিনু
পুরুষের বেশ। পরিলাম রক্তাম্বর,
কঙ্কণ কিঙ্কিণী কাঞ্চি। অনভ্যস্ত সাজ
লজ্জায় জড়ায়ে অঙ্গ রহিল একান্ত
সসঙ্কোচে।
গােপনে গেলাম সেই বনে।
অরণ্যের শিবালয়ে দেখিলাম তাঁরে।—
মদন
বলে' যাও বালা। মাের কাছে করিয়াে না
লাজ। আমি মনসিজ; মানসের
সকল রহস্য জানি।
চিত্রাঙ্গদা
মনে নাই ভালাে,
তা’র পরে কি কহিনু আমি, কি উত্তর
শুনিলাম। আর শুধায়াে না, ভগবন্!
মাথায় পড়িল ভেঙে লজ্জা বজ্ররূপে
তবু মােরে পারিল না শতধা করিতে-
নারী হ'য়ে এমনি পুরুষপ্রাণ মাের!
নাহি জানি কেমনে এলেম ঘরে ফিরে'
দুঃস্বপ্নবিহ্বলসম। শেষ কথা তাঁর
কর্ণে মাের বাজিতে লাগিল তপ্ত শূল-
“ব্রহ্মচারীব্রতধারী আমি। পতিযােগ্য
নহি বরাঙ্গনে।”
পুরুষের ব্রহ্মচর্য্য!
ধিক্ মােরে, তাও আমি নারিনু টলাতে।
তুমি জান, মীনকেতু, কত ঋষি মুনি
করিয়াছে বিসৰ্জ্জন নারীপদতলে
চিরার্জ্জিত তপস্যার ফল। ক্ষত্রিয়ের
ব্রহ্মচর্য্য!–গৃহে গিয়ে ভাঙিয়ে ফেলিনু
ধনুঃশর যাহা কিছু ছিল; -কিণাঙ্কিত
এ কঠিন করতল—ছিল যা’ গর্ব্বের
ধন এতকাল—লাঞ্ছনা করিনু তা'রে
নিষ্ফল আক্রোশভরে। এতদিন পরে
বুঝিলাম, নারী হ'য়ে পুরুষের মন
যদি জিনিতে পারি বৃথা বিদ্যা যত।
অবলার কোমল মৃণাল বাহুদুটি
এ বাহুর চেয়ে ধরে শতগুণ বল।
ধন্য সেই মুগ্ধ মূর্খ ক্ষীণ-তনুলতা
পরাবলম্বিতা, লজ্জাভয়ে লীনাঙ্গিনী
সামান্য ললনা, যার ত্রস্ত নেত্রপাতে
মানে পরাভব বীর্য্যবল, তপস্যার
তেজ!—হে অনঙ্গদেব, সব দম্ভ মাের
একদণ্ডে লয়েছ ছিনিয়া—সব বিদ্যা
সব বল করেছ তােমার পদানত।
এখন তােমার বিদ্যা শিখাও আমায়,
দাও মােরে অবলার বল, নিরস্ত্রের
অস্ত্র যত।
মদন
আমি হ’ব সহায় তােমার।
অয়ি শুভে, বিশ্বজয়ী অর্জ্জুনে করিয়া
জয়, বন্দী করি’ আনিব সম্মুখে তব।
রাজ্ঞী হ’য়ে দিয়ে তা'রে দণ্ড পুরস্কার
যথা ইচ্ছা! বিদ্রোহীরে করিয়াে শাসন।
চিত্রাঙ্গদা
সময় থাকিত যদি একাকিনী আমি
তিলে তিলে হৃদয় তাঁহার করিতাম
অধিকার, নাহি চাহিতাম দেবতার
সহায়তা। সঙ্গীরূপে থাকিতাম সাথে,
রণক্ষেত্রে হতেম সারথি, মৃগয়াতে
রহিতাম অনুচর, শিবিরের দ্বারে
জাগিতাম রাত্রির প্রহরী, ভৃত্যরূপে
করিতাম সেবা, ক্ষত্রিয়ের আর্ত্তত্রাণ-
মহাব্রতে হইতাম সহায় তাঁহার।
একদিন কৌতূহলে দেখিতেন চাহি,
ভাবিতেন মনে মনে “এ কোন্ বালক,
পূর্ব্বজনমের কোন্ চিরদাস, সঙ্গ
লইয়াছে এ জনমে সুকৃতির মত।”
ক্রমে খুলিতাম তাঁর হৃদয়ের দ্বার,
চিরস্থান লভিতাম সেথা। জানি আমি
এ প্রেম আমার শুধু ক্রন্দনের নহে;
যে নারী নির্ব্বাক্ ধৈর্য্যে চিরমর্ম্মব্যথা
নিশীথনয়নজলে করয়ে পালন,
দিবালােকে ঢেকে রাখে ম্লান হাসিতলে,
আজন্মবিধবা, আমি সে রমণী নহি;
আমার কামনা কভু না নিস্ফল হবে!
আপনারে একবার দেখাইতে পারি
যদি, নিশ্চয় সে দিবে ধরা। হায় বিধি,
সেদিন কি দেখেছিল! সরমে কুঞ্চিত
এক শঙ্কিত কম্পিত নারী, আত্মহারা
প্রলাপবাদিনী। কিন্তু আমি যথার্থ কি
তাই? যেমন সহস্র নারী পথে গৃহে
চারিদিকে, শুধু ক্রন্দনের অধিকারী,
তা'র চেয়ে বেশি নই আমি? কিন্তু হায়
আপনার পরিচয় দেওয়া, বহু ধৈর্য্যে
বহুদিনে ঘটে, চিরজীবনের কাজ,
জন্মজন্মান্তের ব্রত। তাই আসিয়াছি
দ্বারে তােমাদের, করেছি কঠোর তপ।
হে ভুবনজয়ী দেব, হে মহাসুন্দর
ঋতুরাজ, শুধু এক দিবসের তরে
ঘুচাইয়া দাও, জন্মদাতা বিধাতার
বিনাদোষে অভিশাপ, নারীর কুরূপ।
কর মােরে অপূর্ব্ব সুন্দরী। দাও মােরে
সেই এক দিন—তা’র পরে চির দিন
রহিল আমার হাতে।—যখন প্রথম
তা'রে দেখিলাম, যেন মুহূর্তের মাঝে
অনন্ত বসন্ত পশিল হৃদয়ে। বড়
ইচ্ছা হয়েছিল, সে যৌবন-সমীরণে
সমস্ত শরীর যদি দেখিতে দেখিতে
অপূর্ব্ব পুলকভরে উঠে প্রস্ফুটিয়া
লক্ষীর চরণশায়ী পদ্মের মতন।
হে বসন্ত, হে বসন্তসখে! সে বাসনা
পূরাও আমার শুধু দিনেকের তরে!
মদন
তথাস্তু!
বসন্ত
তথাস্তু। শুধু একদিন নহে,
এক বর্ষ ধরি’ বসন্তের পুষ্পশােভা
ঘেরিয়া তােমার তনু রহিবে বিকশি'।
মণিপুর—অরণ্যে শিবালয়
অর্জ্জুন
অর্জ্জুন
কাহারে হেরিনু? সে কি সত্য, কিম্বা মায়া?
নিবিড় নির্জ্জন বনে নির্ম্মল সরসী;—
এমনি নিভৃত নিরালয়, মনে হয়
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সেথা বনলক্ষীগণ
স্নান করে’ যায়; গভীর পূর্ণিমারাত্রে,
সেই সুপ্ত সরসীর স্নিগ্ধ শস্পতটে
শয়ন করেন সুখে নিঃশঙ্ক বিশ্রামে
ঙ্খলিত অঞ্চলে।
সেথা বনঅন্তরালে
অপরাহ্ন বেলা, ভাবিতেছিলাম কত
আশৈশব জীবনের কথা; সংসারের
মূঢ় খেলা দুঃখ সুখ উলটি পালটি;
জীবনের অসন্তোষ; অসম্পূর্ণ আশা
অনন্ত দারিদ্র এই মর্ত্ত্য মানবের।
হেন কালে ঘনতরু অন্ধকার হ'তে
ধীরে ধীরে বাহিরিয়া, কে আসি দাঁড়াল,
সরােবর-সােপানের শ্বেত শিলাপটে।
কি অপূর্ব্ব রূপ! কোমল চরণতলে
ধরাতল কেমনে নিশ্চল হ'য়ে ছিল?
ঊষার কনক মেঘ, দেখিতে দেখিতে
যেমন মিলায়ে যায়, পূর্ব্ব পর্ব্বতের
শুভ্র শিরে অকলঙ্ক নগ্ন শােভা করি’
বিকাশিত, তেমনি বসনখানি তা'র
অঙ্গের লাবণ্যে মিলাতে চাহিতেছিল
মহাসুখে। নামি’ ধীরে সরােবরতীরে
কৌতূহলে দেখিল সে নিজ মুখচ্ছায়া;
উঠিল চমকি’। ক্ষণপরে মৃদু হাসি’
হেলাইয়া বাম বাহুখানি, হেলাভরে
এলাইয়া দিল কেশপাশ; মুক্তকেশ
পড়িল বিহ্বল হয়ে চরণের কাছে।
অঞ্চল খসায়ে দিয়ে হেরিল আপন
অনিন্দিত বাহুখানি—পরশের রসে
কোমল কাতর, প্রেমের করুণামাখা।
নিরখিলা নত করি’ শির, পরিস্ফুট
দেহতটে যৌবনের উন্মুখ বিকাশ।
দেখিলা চাহিয়া নব গৌরতনুতলে
আরক্তিম আলজ্জ আভাস; সরােবরে
পা দুখানি ডুবাইয়া দেখিলা আপন
চরণের আভা।—বিস্ময়ের নাই সীমা।
সেই যেন প্রথম দেখিল আপনারে।
শ্বেত শতদল যেন কোরক বয়স
যাপিল নয়ন মুদি’,—যেদিন প্রভাতে
প্রথম লভিল পূর্ণ শােভা, সেইদিন
হেলাইয়া গ্রীবা, নীল সরােবরজলে
প্রথম হেরিল আপনারে, সারাদিন
রহিল চাহিয়া সবিস্ময়ে। ক্ষণপরে,
কি জানি কি দুখে, হাসি মিলাইল মুখে,
ম্লান হ’ল দুটি আঁখি; বাঁধিয়া তুলিল
কেশপাশ; অঞ্চলে ঢাকিল দেহখানি;
নিশ্বাস ফেলিয়া, ধীরে ধীরে চলে' গেল;
সােনার সায়াহ্ন যথা ম্লান মুখ করি’
আঁধার রজনীপানে ধায় মৃদুপদে।
ভাবিলাম মনে, ধরণী দেখায়ে দিল
ঐশ্বর্য্য আপন। কামনার সম্পূর্ণতা
ক্ষণতরে দেখা দিয়ে গেল।—ভাবিলাম
কত যুদ্ধ, কত হিংসা, কত আড়ম্বর,
পুরুষের পৌরুষগৌরব, বীরত্বের
নিত্য কীর্ত্তিতৃষা, শান্ত হ'য়ে লুটাইয়া
পড়ে ভূমে, ওই পূর্ণ সৌন্দর্য্যের কাছে;
পশুরাজ সিংহ যথা সিংহবাহিনীর
ভুবনবাঞ্ছিত অরুণ-চরণতলে।
আর একবার যদি -কে দুয়ার ঠেলে!
( দ্বার খুলিয়া )
এ কি! সেই মূর্তি! শান্ত হও হে হৃদয়
কোনাে ভয় নাই মােরে বরাননে! আমি
ক্ষত্রকুলজাত, ভয়ভীত দুর্ব্বলের
ভয়হারী।
চিত্রাঙ্গদা
আর্য্য, তুমি অতিথি আমার।
এ মন্দির আমার আশ্রম। নাহি জানি
কেমনে করিব অভ্যর্থনা, কি সৎকারে
তােমারে তুষিব আমি।
অর্জ্জুন
অতিথিসৎকার
তব দরশনে, হে সুন্দরি! শিষ্টবাক্য
সমূহ সৌভাগ্য মাের। যদি নাহি লহ
অপরাধ, প্রশ্ন এক শুধাইতে চাহি,
চিত্ত মাের কুতূহলী।
চিত্রাঙ্গদা
শুধাও নির্ভয়ে।
অর্জ্জুন
শুচিস্মিতে, কোন্ সুকঠোর ব্রত লাগি'
হেন রূপরাশি জনহীন দেবালয়ে
হেলায় দিতেছ বিসর্জ্জন, হতভাগ্য
মর্ত্ত্যজনে করিয়া বঞ্চিত।
চিত্রাঙ্গদা
গুপ্ত এক
কামনা সাধনাতরে, এক মনে করি
শিবপূজা।
অর্জ্জুন
হায়, কারে করিছে কামনা
জগতের কামনার ধন।—সুদর্শনে,
উদয়শিখর হ’তে অস্তাচলভূমি
ভ্রমণ করেছি আমি; সপ্তদ্বীপ মাঝে
যেখানে যা কিছু আছে দুর্লভ সুন্দর,
অচিন্ত্য মহান, সকলি দেখেছি চোখে;
কি চাও, কাহারে চাও, যদি বল মোরে
মাের কাছে পাইবে বারতা।
চিত্রাঙ্গদা
ত্রিভুবনে
পরিচিত তিনি, আমি যারে চাহি।
অর্জ্জুন
নর কে আছে ধরায়! কার যশােরাশি
অমরকাঙিক্ষত তব মনোেরাজ্যমাঝে
করিয়াছে অধিকার দুর্লভ আসন।
কহ নাম তা'র, শুনিয়া কৃতার্থ হই।
চিত্রাঙ্গদা
জন্ম তাঁর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নরপতিকূলে,
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীর।
অর্জ্জুন
মিথ্যা খ্যাতি বেড়ে ওঠে
মুখে মুখে কথায় কথায়; ক্ষণস্থায়ী
বাষ্প যথা ঊষারে ছলনা করে’ ঢাকে
যতক্ষণ সূর্য নাহি ওঠে। হে সরলে,
মিথ্যারে কোরাে না উপাসনা, এ দুর্লভ
সৌন্দর্যসম্পদে। কহ শুনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ
কোন্ বীর, ধরণীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কুলে।
চিত্রাঙ্গদা
পরকীর্ত্তি-অসহিষ্ণু কে তুমি সন্যাসি!
কে না জানে এ ভুবনে কুরুবংশ সর্বব-
রাজবংশচূড়া।
অর্জ্জুন
কুরুবংশ!
চিত্রাঙ্গদা
সেই বংশে
কে আছে অক্ষয়যশ বীরেন্দ্রকেশরী
নাম শুনিয়াছ?
অর্জ্জুন
বল, শুনি তব মুখে।
চিত্রাঙ্গদা
অর্জ্জুন, গাণ্ডীবধনু, ভুবনবিজয়ী।
সে অক্ষয় নাম, সমস্ত জগৎ হ'তে
করিয়া লুণ্ঠন, লুকায়ে রেখেছি যত্নে
কুমারী-হৃদয় পূর্ণ করি। ব্রহ্মচারি,
কেন এ অধৈর্য তব?
তবে মিথ্যা এ কি
মিথ্যা সে অৰ্জ্জুন নাম? কহ এই বেলা
মিথ্যা যদি হয় তবে হৃদয় ভাঙিয়া
ছেড়ে দিই তা'রে, বেড়াক সে উড়ে উড়ে
মুখে মুখে বাতাসে বাতাসে, তা'র স্থান
নহে নারীর অন্তরাসনে।
অর্জ্জুন
বরাঙ্গনে,
সে অৰ্জ্জুন, সে পাণ্ডব, সে গাণ্ডীবধনু,
সেই ভাগ্যবান চরণে শরণাগত।
নাম তা'র, খ্যাতি তা'র, বীর্য তা’র, মিথ্যা
হােক সত্য হােক, যে দেবদুর্লভ লোকে
করেছ তাহারে স্থান দান, সেথা হ'তে
আর তা'রে কোরাে না বিচ্যুত, ক্ষীণপুণ্য
হৃতস্বর্গ হতভাগ্যসম।
চিত্রাঙ্গদা
তুমি পার্থ?
আমি পার্থ, দেবি, তােমার হৃদয়দ্বারে
প্রেমার্ত্ত অতিথি।
চিত্রাঙ্গদা
শুনেছিনু ব্রহ্মচর্য্য
পালিছে অৰ্জ্জুন দ্বাদশবরষব্যাপী।
সেই বীর কামিনীরে করিছে কামনা
ব্রত ভঙ্গ করি’! হে সন্ন্যাসি, তুমি পার্থ?
অর্জ্জুন
তুমি ভাঙিয়াছ ব্রত মাের। চন্দ্র উঠি'
যেমন নিমেষে ভেঙে দেয় নিশীথের
যােগনিদ্রা-অন্ধকার।
চিত্রাঙ্গদা
ধিক্, পার্থ, ধিক্!
কে আমি, কি আছে মোর, কি দেখেছ তুমি,
কি জান আমারে। কার লাগি আপনারে
হতেছ বিস্মৃত। মুহূর্ত্তেকে সত্য ভঙ্গ
করি’, অৰ্জ্জুনেরে করিতেছ অনৰ্জ্জুন
কার তরে? মাের তরে নহে। এই দুটি
নীলােৎপল নয়নের তরে; এই দুটি
নবনীনিন্দিত বাহুপাশে সব্যসাচী
অর্জ্জুন দিয়াছে ধরা দুই হস্তে ছিন্ন
করে' ফেলে’ সত্যের বন্ধন। কোথা গেল
প্রেমের মর্যাদা? কোথায় রহিল পড়ে'
নারীর সম্মান? হায়, আমারে করিল
অতিক্রম আমার এ তুচ্ছ দেহখানা,
মৃত্যুহীন অন্তরের এই ছদ্মবেশ
ক্ষণস্থায়ী। এতক্ষণে পারিনু জানিতে
মিথ্যা খ্যাতি, বীরত্ব তােমার।
অর্জ্জুন
খ্যাতি মিথ্যা,
বীর্য্য মিথ্যা আজ বুঝিয়াছি। আজ মােরে
সপ্তলােক স্বপ্ন মনে হয়।শুধু একা
পূর্ণ তুমি সর্ব্ব তুমি, বিশ্বের ঐশ্বর্য্য
তুমি, এক নারী সকল দৈন্যের তুমি
মহা অবসান, সকল কর্মের তুমি
বিশ্রামরূপিণী। কেন জানি অকস্মাৎ
তােমারে হেরিয়া—বুঝিতে পেরেছি আমি
কি আনন্দকিরণেতে প্রথম প্রত্যুষে
অন্ধকার মহার্ণবে সৃষ্টিশতদল
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মােষিত হ'য়ে
এক মুহূর্তের মাঝে। আর সকলের
পলে পলে তিলে তিলে তবে জানা যায়
বহুদিনে;—তােমাপানে যেমনি চেয়েছি
অমনি সমস্ত তব পেয়েছি দেখিতে
তবু পাই নাই শেষ। -কৈলাসশিখরে
একদা মৃগয়াশ্রান্ত তৃষিত তাপিত
গিয়েছিনু দ্বিপ্রহরে কুসুমবিচিত্র
মানসের তীরে। যেমনি দেখিনু চেয়ে
সেই সুর-সরসীর সলিলের পানে
অমনি পড়িল চোখে অনন্ত অতল।
স্বচ্ছ জল, যত নিম্নে চাই। মধ্যাহ্নের
রবিরশ্মিরেখাগুলি স্বর্ণনলিনীর
সুবর্ণ মৃণাল সাথে মিশি’ নেমে গেছে
অগাধ অসীমে কাঁপিতেছে; আঁকিবাঁকি
জলের হিল্লোলে, লক্ষকোটি অগ্নিময়ী
নাগিনীর মত। মনে হ’ল ভগবান
সূর্য্যদেব সহস্র অঙ্গুলি নির্দ্দেশিয়া
দিলেন দেখায়ে, জন্মশ্রান্ত কর্ম্মক্লান্ত
মর্ত্ত্যজনে, কোথা আছে সুন্দর মরণ
অনন্ত শীতল। সেই স্বচ্ছ অতলতা
দেখেছি তােমার মাঝে। চারিদিক হতে
দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায়ে দিতেছে
মােরে, ওই তব অলােক আলােকমাঝে
কীর্ত্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণনির্ব্বাপন।
চিত্রাঙ্গদা
আমি নহি, আমি নহি, হায়, পার্থ, হায়
কোন্ দেবের ছলনা! যাও যাও ফিরে
যাও, ফিরে যাও বীর! মিথ্যারে কোরাে না
উপাসনা। শৌর্য্য বীর্য্য মহত্ত্ব তােমার
দিয়াে না মিথ্যার পদে। যাও, ফিরে যাও!
তরুতলে চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
হায়, হায়, সে কি ফিরাইতে পারি! সেই
থরথর ব্যাকুলতা বীর হৃদয়ের,
তৃষ্ণার্ত্ত কম্পিত এক স্ফুলিঙ্গনিশ্বাসী
হােমাগ্নিশিখার মত; সেই, নয়নের
দৃষ্টি যেন অন্তরের বাহু হ'য়ে, কেড়ে
নিতে আসিছে আমায়; উত্তপ্ত হৃদয়
ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্ব্বাঙ্গ টুটিয়া,
তাহার ক্রন্দনধ্বনি প্রতিঅঙ্গে শুনা
যায় যেন! এ তৃষ্ণা কি ফিরাইতে পারি?
(বসন্ত ও মদনের প্রবেশ)
হে অনঙ্গদেব, এ কি রূপ-হুতাশনে
ঘিরেছ আমারে, দগ্ধ হই, দগ্ধ করে’
মারি।
মদন
বল, তম্বি, কালিকার বিবরণ।
মুক্ত পুষ্পশর মাের কোথা কি সাধিল
কাজ শুনিতে বাসনা।
চিত্রাঙ্গদা
কাল সন্ধ্যাবেলা,
সরসীর তৃণপুঞ্জ তীরে, পেতেছিনু
পুষ্পশয্যা, বসন্তের ঝরা ফুল দিয়ে।
শ্রান্ত কলেবরে, শুয়েছিনু আপনার
মনে, বাম বাহুপরে রাখিয়া অলস
শির; ভাবিতেছিলাম দিবসের কথা,
শুনেছিনু যেই স্তুতি অর্জ্জুনের মুখে
স্মরিতেছিলাম তা'র প্রতি ক্ষুদ্র কথা
একাকিনী শুয়ে শুয়ে; পূর্ণ দিবসের
সঞ্চিত অমৃত হ’তে বিন্দু বিন্দু ল'য়ে
করিতেছিলাম পান; ভুলিতেছিলাম
পূর্ব ইতিহাস, গতজন্মকথাসম;
যেন আমি রাজকন্যা নহি; যেন মাের
নাই পূর্ব্বপর; যেন আমি ধরাতলে
একদিনে উঠেছি ফুটিয়া, অরণ্যের
পিতৃমাতৃহীন ফুল; একটি প্রভাত
শুধু পরমায়ু, তারি মাঝে শুনে নিতে
হবে—ভ্রমর গুঞ্জনগীতি, বনান্তের
আনন্দমর্ম্মর; তার পরে নীলাম্বর
হ’তে নামাইয়া আঁখি, নুমাইয়া গ্রীবা,
বায়ুস্পর্শভরে টুটিয়া লুটিয়া যাব
ক্রন্দনবিহীন, মাঝখানে ফুরাইবে
কুসুমকাহিনীটুকু আদি অন্তহারা।
বসন্ত
একটি প্রভাতে ফুটে অনন্ত জীবন,
হে সুন্দরি!
মদন
সঙ্গীতে যেমন, ক্ষণিকের
তানে, গুঞ্জরি কাঁদিয়া উঠে অন্তহীন
কথা। তা'র পরে বল।
চিত্রাঙ্গদা
ভাবিতে ভাবিতে
সর্ব্বাঙ্গে হানিতেছিল ঘুমের হিল্লোল
দক্ষিণের বায়ু। সপ্তপর্ণশাখা হ'তে
ফুল্ল মালতীর লতা টুপটাপ করি’
মাের গৌরতনুপরে পাঠাইতেছিল
শত নিঃশব্দ চুম্বন; ফুলগুলি কেহ
চুলে, কেহ পদমূলে, কেহ স্তনতটে
বিছাইল আপনার মরণশয়ন।
অচেতনে গেল কতক্ষণ। হেনকালে
জানি না কখন্ ঘুমঘােরে, অনুভব
হ’ল, যেন কার মুগ্ধ নয়নের দৃষ্টি
দশ অঙ্গুলির মত পরশ করিছে
রভস-লালসে মাের নিদ্রালস তনু।
চমকি’ উঠিমু জাগি'।
দেখিনু, সন্ন্যাসী
পদপ্রান্তে নির্ণিমেষ দাঁড়ায়ে রয়েছে
স্থির প্রতিমূর্ত্তি সম। পূর্ব্বাচল হ'তে
ধীরে ধীরে সরে' এসে পশ্চিমে হেলিয়ে
দ্বাদশীর শশী সমস্ত হিমাংশুরাশি
দিয়াছে ঢালিয়া, ঙ্খলিতবসন মাের
অম্লাননূতন শুভ্র সৌন্দর্য্যের পরে।
পুষ্পগন্ধে পূর্ণ তরুতল; ঝিল্লিরবে
তন্দ্রামগ্ন-নিশীথিনী; স্বচ্ছ সরােবরে
অকম্পিত চন্দ্রকরচ্ছায়া; সুপ্ত বায়ু;
শিরে ল’য়ে জ্যোৎস্নলােকে মসৃণ চিক্কণ
রাশি রাশি অন্ধকার পল্লবের ভার
স্তম্ভিত অটবী। সেই মত চিত্রার্পিত
দাঁড়াইয়া দীর্ঘকায় বনস্পতিসম,
দণ্ডধারী ব্রহ্মচারী ছায়াসহচর।
প্রথম সে নিদ্রাভঙ্গে চারিদিক চেয়ে
মনে হ’ল, কবে কোন্ বিস্মৃত প্রদোষে
জীবন ত্যজিয়া, স্বপ্নজন্ম করিয়াছি
লাভ, কোন্ এক অপরূপ নিদ্রালােকে,
জনশূন্য ম্লানজ্যোৎস্না বৈতরণীতীরে।
দাঁড়ানু উঠিয়া। মিথ্যা সরম সঙ্কোচ
খসিয়া পড়িল শ্লথ বসনের মত
পদতলে। শুনিলাম, “প্রিয়ে, প্রিয়তমে!”
গম্ভীর আহ্বানে, জন্ম জন্ম শত জন্ম
মোর, উঠিল জাগিয়া এক দেহ মাঝে।
কহিলাম, “লহ, লহ, যাহা আছে, সব
লহ জীবনবল্লভ।” দিলাম বাড়ায়ে,
দুই বাহু।—চন্দ্র অস্ত গেল বনান্তরে,
অন্ধকারে ঝাঁপিল মেদিনী। স্বর্গ মর্ত্ত্য
দেশকাল দুঃখসুখ জীবন মরণ
অচেতন হ'য়ে গেল অসহ্য পুলকে।
প্রভাতের প্রথম কিরণে, বিহঙ্গের
প্রথম সঙ্গীতে, বাম করে দিয়া ভর
ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিনু শয্যাতলে।
দেখিনু চাহিয়া, সুখসুপ্ত বীরবর।
শ্রান্ত হাস্য লেগে আছে ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর
প্রভাতের চন্দ্রকলাসম, রজনীর
আনন্দের শীর্ণ অবশেষ। নিপতিত
উন্নত ললাট-পটে অরুণের আভা;
মর্ত্ত্যলােকে যেন নব উদয়পর্ব্বতে
নবকীর্ত্তি-সূর্যোদয় পাইবে প্রকাশ।
নিশ্বাস ফেলিয়া, উঠিনু শয়ন ছাড়ি';
মালতীর লতাজাল দিলাম নামায়ে
সাবধানে, রবিকর করি' অন্তরাল
সুপ্তমুখ হ’তে। দেখিলাম চতুর্দ্দিকে
সেই পূর্ব্বপরিচিত প্রাচীন পৃথিবী।
আপনারে আরবার মনে পড়ে' গেল,
ছুটিয়া পলায়ে এনু, নব প্রভাতের
শেফালি-বিকীর্ণ-তৃণ বনস্থলী দিয়ে,
আপনার ছায়াত্রস্তা হরিণীর মত।
বিজন বিতানতলে বসি’, করপুটে
মুখ আবরিয়া, কাঁদিবারে চাহিলাম,
এল না ক্রন্দন।
মদন
হায়, মানবনন্দিনি,
স্বর্গের সুখের দিন স্বহস্তে ভাঙিয়া
ধরণীর একরাত্রি পূর্ণ করি’ তাহে
যত্নে ধরিলাম তব অধরসম্মুখে;
শচীর প্রসাদসুধা, রতির চুম্বিত,
নন্দনবনের গন্ধে মােদিত-মধুর,
তােমারে করানু পান, তবু এ ক্রন্দন!
চিত্রাঙ্গদা
কারে, দেব, করাইলে পান? কার তৃষা
মিটাইলে? সে চুম্বন, সে প্রেমসঙ্গম
এখনাে উঠিছে কাঁপি যে অঙ্গ ব্যাপিয়া
বীণার ঝঙ্কার সম, সে ত মাের নহে!
বহুকাল সাধনায় এক দণ্ড শুধু
পাওয়া যায় প্রথম মিলন, সে মিলন
কে লইল লুটি’, আমারে বঞ্চিত করি।
সে চিরদুর্লভ মিলনের সুখস্মৃতি
সঙ্গে করে’ ঝরে' পড়ে যাবে, অতিস্ফুট
পুস্পদলসম, এ মায়া-লাবণ্য মাের;
অন্তরের দরিদ্র রমণী, রিক্তদেহে
বসে' র'বে চিরদিনরাত। মীনকেতু,
কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া
অঙ্গসহচরী করি’ ছায়ার মতন-
কি অভিসম্পাত? চিরন্তন তৃষ্ণাতুর
লােলুপ ওষ্ঠের কাছে আসিল চুম্বন,
সে করিল পান। সেই প্রেমদৃষ্টিপাত
এমনি আগ্রহপূর্ণ, যে অঙ্গেতে পড়ে
সেথা যেন অঙ্কিত করিয়া রেখে যায়
বাসনার রাঙা চিহ্নরেখা, সেই দৃষ্টি
রবিরশ্মিসম, চিররাত্রিতাপসিনী
কুমারীহৃদয়পদ্মপানে ছুটে এল,
সে তাহারে লইল ভুলায়ে।
মদন
কল্য নিশি
ব্যর্থ গেছে তবে! শুধু, কূলের সম্মুখে
এসে আশার তরণী গেছে ফিরে' ফিরে'
তরঙ্গ-আঘাতে?
চিত্রাঙ্গদা
কাল রাত্রে কিছু নাহি
মনে ছিল দেব! সুখস্বর্গ এত কাছে
দিয়েছিল ধরা, পেয়েছি কি না পেয়েছি
করিনি গণনা আত্মবিস্মরণসুখে।
আজ প্রাতে উঠে,' নৈরাশ্যধিক্কারবেগে
অন্তরে অন্তরে টুটিছে হৃদয়। মনে
পড়িতেছে একে একে রজনীর কথা,
বিদ্যুৎবেদনাসহ হতেছে চেতনা
অন্তরে বাহিরে মাের হয়েছে সতীন,
আর তাহা নারিব ভুলিতে। সপত্নীরে
স্বহস্তে সাজায়ে সযতনে প্রতিদিন
পাঠাইতে হবে, আমার আকাঙ্ক্ষা-তীর্থ
বাসরশয্যায়; অবিশ্রাম সঙ্গে রহি’
প্রতিক্ষণ দেখিতে হইবে চক্ষু মেলি’
তাহার আদর। ওগো, দেহের সােহগে
অন্তর জ্বলিবে হিংসানলে, হেন শাপ
নরলােকে কে পেয়েছে আর? হে অতনু
বর তব ফিরে’ লও।
মদন
যদি ফিরে’ লই,—
ছলনার আবরণ খুলে' ফেলে' দিয়ে
কাল প্রাতে কোন্ লাজে দাঁড়াইবে আসি’
পার্থের সম্মুখে, কুসুমপল্লবহীন
হেমন্তের হিমশীর্ণ লতা? প্রমােদের
প্রথম আস্বাদটুকু দিয়ে, মুখ হ'তে
সুধাপাত্র কেড়ে নিয়ে চূর্ণ করে' ফেল
যদি ভূমিতলে, কি আঘাতে উঠিবে সে
চমকিয়া, কি আক্রোশে হেরিবে তােমায়!
চিত্রাঙ্গদা
সেও ভালো দেব! এই ছদ্মরূপিণীর
চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে। আপনারে
করিব প্রকাশ; ভালো যদি নাই লাগে,
ঘৃণাভরে চলে' যান যদি, বুক ফেটে
মরি যদি আমি, তবু আমি, আমি র'ব
সেও ভালো ইন্দ্রসখা!
বসন্ত
শােন মাের কথা।
ফুলের ফুরায় যবে ফুটিবার কাজ
তখন প্রকাশ পায় ফল। যথাকালে
আপনি ঝরিয়া পড়ে' যাবে, তাপক্লিষ্ট
লঘু লাবণ্যের দল; আপন গৌরবে
তখন বাহির হবে; হেরিয়া তােমারে
নূতন সৌভাগ্য বলি’ মানিবে ফাল্গুনী।
যাও, ফিরে' যাও, বৎসে, যৌবন-উৎসবে!
অৰ্জ্জুন ও চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
কি দেখিছ বীর!
অৰ্জ্জুন
দেখিতেছি পুষ্পবৃন্ত
ধরি’, কোমল অঙ্গুলিগুলি রচিতেছে
মালা; নিপুণতা চারুতায় দুই বােনে
মিলি, খেলা করিতেছে যেন, সারাবেলা
চঞ্চল উল্লাসে, অঙ্গুলির আগে আগে।
দেখিতেছি, আর ভাবিতেছি।
চিত্রাঙ্গদা
কি ভাবিছ?
অৰ্জ্জুন
ভাবিতেছি অমনি সুন্দর করে' ধরে'
সরসিয়া ওই রাঙা পরশের রসে
প্রবাস-দিবসগুলি গেঁথে গেঁথে প্রিয়ে
অমনি রচিবে মালা; মাথায় পরিয়া
অক্ষয় আনন্দহার গৃহে ফিরে' যাব।
চিত্রাঙ্গদা
এ প্রেমের গৃহ আছে?
অর্জ্জুন
গৃহ নাই?
চিত্রাঙ্গদা
নাই
গৃহে নিয়ে যাবে? বােলাে না গৃহের কথা।
গৃহ চির বরষের; নিত্য যাহা থাকে তাই
গৃহ নিয়ে যেয়াে। অরণ্যের ফুল যবে
শুকাইবে, গৃহে কোথা ফেলে' দিবে তা'রে,
অনাদরে পাষাণের মাঝে? তা'র চেয়ে
অরণ্যের অন্তঃপুরে, নিত্য নিত্য যেথা
মরিছে অঙ্কুর, পড়িছে পল্লবরাশি,
ঝরিছে কেশর, খসিছে কুসুমদল,
ক্ষণিক জীবনগুলি ফুটিছে টুটিছে
প্রতি পলে পলে,—দিনান্তে আমার খেলা
সাঙ্গ হ'লে ঝরিব সেথায়, কাননের
শত শত সমাপ্ত সুখের সাথে। কোনাে
খেদ রহিবে না কারাে মনে।
অর্জ্জুন
এই শুধু?
চিত্রাঙ্গদা
শুধু এই। আর কিছু নয়। বীরবর
তাহে দুঃখ কেন! আলস্যের দিনে যাহা
ভালাে লাগে, আলস্যের দিনে তাহা শেষ
করে' ফেল। সুখেরে রাখিলে ধরে’-বেঁধে'
তা’র বেশি একদণ্ড কাল, দুঃখ হ'য়ে
ওঠে। যাহা আছে তাই লও, যতক্ষণ
আছে ততক্ষণ রাখ। কামনার কালে
যতটুকু চেয়েছিলে, তৃপ্তির সন্ধ্যায়
তা’র বেশি আশা করিয়াে না।
দিন গেল।
এই মালা পর গলে। শ্রান্ত মাের তনু
ওই তব বাহুপরে টেনে লও বীর।
সন্ধি হােক অধরের সুখ-সম্মিলনে
ক্ষান্ত করি’ মিথ্যা অসন্তোষ। বাহুবন্ধে
এস বন্দী করি দোঁহে দোঁহা, প্রণয়ের
সুধাময় চির-পরাজয়ে।
অর্জ্জুন
ওই শােন
প্রিয়তমে, বনান্তের দূর লােকালয়ে
আরতির শান্তিশঙ্খ উঠিল বাজিয়া।
মদন ও বসন্ত
মদন
আমি পঞ্চশর, সখা; এক শরে হাসি,
অশ্রু এক শরে; এক শরে আশা, অন্য
শরে ভয়; এক শরে বিরহ-মিলন-
আশা-ভয়-দুঃখ-সুখ এক নিমিষেই।
বসন্ত
শ্রান্ত আমি, ক্ষান্ত দাও সখা! হে অনঙ্গ,
সাঙ্গ কর রণরঙ্গ তব। রাত্রিদিন
সচেতন থেকে, তব হুতাশনে আর
কতকাল করিব ব্যজন। মাঝে মাঝে
নিদ্রা আসে চোখে, নত হয়ে পড়ে পাখা,
ভস্মে ম্লান হ'য়ে আসে তপ্তদীপ্তিরাশি।
চমকিয়া জেগে, আবার নূতনশ্বাসে
জাগাইয়া তুলি তা’র নব-উজ্জ্বলতা।
এবার বিদায় দাও সখা!
মদন
জানি তুমি
অনন্ত অস্থির, চিরশিশু। নিত্য তুমি
বন্ধনবিহীন হ'য়ে দ্যুলােকে ভূলােকে
করিতেছ খেলা। একান্ত যতনে যারে
তুলিছ সুন্দর করি’ বহুকাল ধরে'
নিমেষে যেতেছ তা'রে ফেলি’ ধূলিতলে
পিছে না ফিরিয়া। আর বেশি দিন নাই;
আনন্দচঞ্চল দিনগুলি, লঘুবেগে,
তব পক্ষ-সমীরণে, হুহু করি’ কোথা
যেতেছে উড়িয়া, চ্যুত পল্লবের মত।
হর্ষঅচেতন বর্ষ শেষ হ'য়ে এল।
অরণ্যে অৰ্জ্জুন
অৰ্জ্জুন
আমি যেন পাইয়াছি, প্রভাতে জাগিয়া
ঘুম হ’তে, স্বপ্নলব্ধ অমূল্য রতন।
রাখিবার স্থান তা'র নাহি এ ধরার
মৃত্তিকায়; ধরে' রাখে এমন কিরীট
নাই, গেঁথে' রাখে হেন সূত্র নাই, ফেলে'
যাই হেন নরাধম নহি; তা'রে ল'য়ে
চিররাত্রি চিরদিন ক্ষত্রিয়ের বাহু
বন্ধ হ'য়ে পড়ে' আছে কর্ত্তব্যবিহীন।
( চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ)
চিত্রাঙ্গদা
কি ভাবিছ?
অৰ্জ্জুন
ভাবিতেছি মৃগয়ার কথা।
ওই দেখ বৃষ্টিধারা আসিয়াছে নেমে
পর্ব্বতের পরে; অরণ্যেতে ঘনঘাের
ছায়া; নির্ঝরিণী উঠেছে দুরন্ত হ'য়ে,
কলগর্ব্ব-উপহাসে তটের তর্জ্জন
করিতেছে অবহেলা; মনে পড়িতেছে
এমনি বর্ষার দিনে, পঞ্চভ্রাতা মিলে
চিত্রক অরণ্যতলে যেতেম শিকারে।
সারাদিন রৌদ্রহীন স্নিগ্ধ অন্ধকারে
কাটিত উৎসাহে; গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে
নৃত্য করি’ উঠিত হৃদয়; ঝরঝর
বৃষ্টিজলে, মুখর নির্ঝরকলোল্লাসে
সাবধান পদশব্দ শুনিতে পেত না
মৃগ; চিত্রব্যাঘ্র পঞ্চনখচিহ্নরেখা
রেখে যেত পথপঙ্কপরে, দিয়ে যেত
আপনার গৃহের সন্ধান। কেকারবে
ধ্বনিত’ অরণ্যভূমি। শিকার সমাধা
হ'লে পঞ্চসঙ্গী পণ করি’ সন্তরণে
হইতাম পার, বর্ষার সৌভাগ্যগর্ব্বে
স্ফীত তরঙ্গিণী। সেই মত বাহিরিব
মৃগয়ায়, করিয়াছি মনে।
চিত্রাঙ্গদা
হে শিকারি,
যে মৃগয়া আরম্ভ করেছ, আগে তাই
হােক্ শেষ। তবে কি জেনেছ স্থির
এই স্বর্ণ মায়ামৃগ তােমারে দিয়েছে
ধরা? নহে, তাহা নহে। এ বন্য-হরিণী
আপনি রাখিতে নারে আপনারে ধরি’!
চকিতে ছুটিয়া যায় কে জানে কখন
স্বপনের মত। ক্ষণিকের খেলা সহে,
চিরদিবসের পাশ বহিতে পারে না।
ওই চেয়ে দেখ, যেমন করিছে খেলা
বায়ুতে বৃষ্টিতে,—শ্যাম বর্ষা হানিতেছে
নিমেষে সহস্র শর বায়ুপৃষ্ঠপরে,
তবু সে দুরন্ত মৃগ মাতিয়া বেড়ায়
অক্ষত অজেয়;—তােমাতে আমাতে, নাথ,
সেই মত খেলা, আজি বরষার দিনে;—
চঞ্চলারে করিবে শিকার প্রাণপণ
করি’; যত শর, যত অস্ত্র আছে তূণে
একাগ্র আগ্রহভরে করিবে বর্ষণ।
কভু অন্ধকার, কভু বা চকিত আলো
চমকিয়া হাসিয়া মিলায়, কভু স্নিগ্ধ
বৃষ্টিবরিষণ, কভু দীপ্ত বজ্রজ্বালা।
মায়ামৃগী ছুটিয়া বেড়ায়, মেঘাচ্ছন্ন
জগতের মাঝে, বাধাহীন চিরদিন।
মদন ও চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
হে মন্মথ, কি জানি কি দিয়েছ মাখায়ে
সর্ব্বদেহে মাের। তীব্র মদিরার মত
রক্তসাথে মিশে’ উন্মাদ করেছে মােরে।
আপনার গতিগর্ব্বে মত্ত মৃগী আমি,
ধাইতেছি মুক্তকেশে, উচ্ছ্বসিত বেশে
পৃথিবী লঙ্ঘিয়া। ধনুর্দ্ধর ঘনশ্যাম
ব্যাধেরে আমার, করিয়াছি পরিশ্রান্ত
আশাহতপ্রায়, ফিরাতেছি পথে পথে
বনে বনে তা’রে। নির্দয় বিজয়সুখে
হাসিতেছি কৌতুকের হাসি। এ খেলায়
ভঙ্গ দিতে হইতেছে ভয়, একদণ্ড
স্থির হলে পাছে, ক্রন্দনে হৃদয় ভরে
ফেটে পড়ে যায়।
মদন
থাক! ভাঙিয়াে না খেলা।
এ খেলা আমার। ছুটুক ফুটুক বাণ,
টুটুক্ হৃদয়। আমার মৃগয়া আজি
অরণ্যের মাঝখানে নবীন বর্ষায়।
দাও দাও শ্রান্ত করে' দাও; কর তা'রে
পদানত; বাঁধ তারে দৃঢ়পাশে; দয়া
করিয়াে না, হাসিতে জর্জ্জর করে' দাও,
অমৃতে-বিষেতে-মাখা খর বাক্যবাণ
হান বুকে। শিকারে দয়ার বিধি নাই।
অৰ্জ্জুন ও চিত্রাঙ্গদা
অৰ্জ্জুন
কোনাে গৃহ নাই তব প্রিয়ে, যে ভবনে
কাঁদিছে বিরহে তব প্রিয় পরিজন?
নিত্য স্নেহ-সেবা দিয়ে যে আনন্দপুরী
রেখেছিলে সুধাময় করে’, যেথাকার
প্রদীপ নিয়ে দিয়ে এসেছ চলিয়া
অরণ্যের মাঝে? আপন শৈশবস্মৃতি
যেথায় কাঁদিতে যায় হেন স্থান নাই?
চিত্রাঙ্গদা
প্রশ্ন কেন? তবে কি আনন্দ মিটে গেছে?
যা’ দেখিছ তাই আমি, আর কিছু নাই
পরিচয়। প্রভাতে এই যে দুলিতেছে
কিংশুকের একটি পল্লব প্রান্তভাগে
একটি শিশির, এর কোনাে নাম ধাম
আছে? এর কি শুধায় কেহ পরিচয়?
তুমি যারে ভালবাসিয়াছ, সে এমনি
শিশিরের কণা, নামধামহীন।
অর্জ্জুন
কিছু
তা’র নাই কি বন্ধন পৃথিবীতে? এক
বিন্দু স্বর্গ শুধু ভূমিতলে ভুলে’ পড়ে'
গেছে?
চিত্রাঙ্গদা
তাই বটে। শুধু নিমেষের তরে
দিয়েছে আপন উজ্জ্বলতা অরণ্যের
কুসুমেরে।
অর্জ্জুন
তাই সদা হারাই হারাই
করে প্রাণ, তৃপ্তি নাহি পাই, শান্তি নাহি
মানি। সুদুর্লভ, আরো কাছাকাছি এস।
মানুষের মত, নামধামগােত্রগৃহ-
দেহমনবাক্যে, সহস্র বন্ধনে দাও
ধরা। চারিপার্শ্ব হ’তে পরশি তােমারে,
নির্ভয়নির্ভরে করি বাস! নাম নাই?
তবে কোন্ প্রেমমন্ত্রে জপিব তােমারে
হৃদয়মন্দিরমাঝে? গােত্র নাই? তবে
কি মৃণালে এ কমল ধরিয়া রাখিব?
চিত্রাঙ্গদা
নাই, নাই, নাই।—যারে বাঁধিবারে চাও
কখনাে সে বন্ধন জানেনি। সে কেবল
মেঘের সুবর্ণছটা, গন্ধ কুসুমের,
তরঙ্গের গতি।
অর্জ্জুন
তাহারে যে ভালবাসে
অভাগা সে। প্রিয়ে, দিয়াে না প্রেমের হাতে
আকাশকুসুম। বুকে রাখিবার ধন
দাও তা'রে সুখে দুঃখে সুদিনে দুর্দ্দিনে।
চিত্রাঙ্গদা
এখনাে যে বর্ষ যায় নাই, শ্রান্তি এরি
মাঝে? হায় হায় এখন বুঝিনু, পুষ্প
স্বল্প-পরমায়ু দেবতার আশীর্ব্বাদে।
গতবসন্তের যত মৃতপুষ্পসাথে
ঝরিয়া পড়িত যদি এ মােহন তনু
আদরে মরিত হবে। বেশি দিন নহে
পার্থ! যে ক’দিন আছে, আশা মিটাইয়া
কুতুহলে, আনন্দের মধুটুকু তা'র
নিঃশেষ করিয়া কর পান। এর পরে
বারবার আসিয়াে না স্মৃতির কুহকে
ফিরে' ফিরে’, গত সায়াহ্নের চ্যুতবৃন্ত
মাধবীর আশে, তৃষিত ভূঙ্গের মত।
বনচরগণ ও অর্জ্জুন
বনচর
হায় হায় কে রক্ষা করিবে?
অর্জ্জুন
কি হয়েছে
বনচর
উত্তর পর্ব্বত হ'তে আসিছে ছুটিয়া
দস্যুদল, বরষার পার্ব্বত্য বন্যার
মত বেগে, বিনাশ করিতে লােকালয়।
অর্জ্জুন
এ রাজ্যে রক্ষক কেহ নাই?
বনচর
রাজকন্যা
চিত্রাঙ্গদা আছিলেন দুষ্টের দমন;
তাঁর ভয়ে রাজ্যে নাহি ছিল কোনাে ভয়,
যমভয় ছাড়া। শুনেছি গেছেন তিনি
তীর্থপর্যটনে, অজ্ঞাত ভ্রমণব্রত।
অর্জ্জুন
এ রাজ্যের রক্ষক রমণী?
বনচর
এক দেহে
তিনি পিতামাতা অনুরক্ত প্রজাদের।
স্নেহে তিনি রাজমাতা, বীর্য্যে যুবরাজ।
( চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ)
চিত্রাঙ্গদা
কি ভাবিছ নাথ?
অর্জ্জুন
রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
কেমন না জানি তাই ভাবিতেছি মনে।
প্রতিদিন শুনিতেছি শতমুখ হ'তে
তারি কথা, নব নব অপূর্ব্ব কাহিনী।
চিত্রাঙ্গদা
কুৎসিত, কুরূপ! এমন বঙ্কিম ভুরু
নাই তা'র, এমন নিবিড় কৃষ্ণতারা।
কঠিন সবল বাহু বিঁধিতে শিখেছে
লক্ষ্য, বাঁধিতে পারে না বীরতনু, হেন
সুকোমল নাগপাশে।
অর্জ্জুন
কিন্তু শুনিয়াছি,
স্নেহে নারী বীর্য্যে সে পুরুষ।
চিত্রাঙ্গদা
ছি ছি, সেই
তা’র মন্দভাগ্য। নারী যদি নারী হয়
শুধু, শুধু ধরণীর শােভা, শুধু আলাে,
শুধু ভালবাসা, শুধু সুমধুর ছলে,
শতরূপ ভঙ্গিমায় পলকে পলকে
লুটায়ে জড়ায়ে বেঁকে বেঁধে হেসে কেঁদে
সেবায় সােহাগে ছেয়ে চেয়ে থাকে সদা
তবে তা'র সার্থক জনম। কি হইবে
কর্ম্মকীর্ত্তি বীর্য্যবল শিক্ষা দীক্ষা তা'র।
হে পৌরব, কাল যদি দেখিতে তাহারে
এই বনপথপার্শ্বে, এই পূর্ণাতীরে,
ওই দেবালয় মাঝে-হেসে চলে' যেতে।
হায় হায়, আজ এত হয়েছে অরুচি
নারীর সৌন্দর্য্যে, নারীতে খুঁজিতে চাও
পৌরুষের স্বাদ।
এস নাথ, ওই দেখ
গাঢ়চ্ছায়া শৈলগুহামুখে, বিছাইয়া
রাখিয়াছি আমাদের মধ্যাহ্ন-শয়ন,
কচি কচি পীতশ্যাম কিশলয় তুলি’
আর্দ্র করি’ ঝরণার শীকরনিকরে।
গভীর পল্লবছায়ে বসি’, ক্লান্তকণ্ঠে
কঁদিছে কপােত, “বেলা যায়” “বেলা যায়”
বলি'। কুলুকুলু বহিয়া চলেছে নদী
ছায়াতল দিয়া। শিলাখণ্ডে স্তরে স্তরে
সরস সুস্নিগ্ধ সিক্ত শ্যামল শৈবাল
নয়ন চুম্বন করে কোমল অধরে।
এস নাথ বিরল বিরামে।
অৰ্জ্জুন
আজ নহে
প্রিয়ে!
চিত্রাঙ্গদা
কেন নাথ?
অর্জ্জুন
শুনিয়াছি দস্যুদল
আসিছে নাশিতে জনপদ। ভীতজনে
করিব রক্ষণ।
চিত্রাঙ্গদা
কোনাে ভয় নাই প্রভু!
তীর্থযাত্রাকালে, রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
স্থাপন করিয়া গেছে সতর্ক প্রহরী
দিকে দিকে; বিপদের যত পথ ছিল
বন্ধ করে' দিয়ে গেছে বহু তর্ক করি'।
অর্জ্জুন
তবু আজ্ঞা কর, প্রিয়ে স্বল্পকালতরে
করে' আসি কর্ত্তব্যসন্ধান। বহুদিন
রয়েছে অলস হ'য়ে ক্ষত্রিয়ের বাহু।
সুমধ্যমে, ক্ষীণকীর্ত্তি এই ভুজদ্বয়
পুনর্ব্বার নবীন গৌরবে ভরি’ আনি’
তােমার মস্তকতলে যতনে রাখিয়া
দিব, হবে তব যােগ্য উপধান।
চিত্রাঙ্গদা
যদি
নাই যেতে দিই? যদি বেঁধে রাখি? ছিন্ন
করে’ যাবে? তাই যাও। কিন্তু মনে রেখাে
ছিন্ন লতা জোড়া নাহি লাগে। যদি তৃপ্তি
হ'য়ে থাকে, তবে যাও, করিব না মানা;
যদি তৃপ্তি নাহি হ'য়ে থাকে, তবে মনে
রেখাে, চঞ্চলা সুখের লক্ষী কারাে তরে
বসে’ নাহি থাকে; সে কাহারাে সেবাদাসী
নহে; তা'র সেবা করে নরনারী, অতি
ভয়ে ভয়ে নিশিদিন রাখে চোখে চোখে
যতদিন প্রসন্ন সে থাকে। রেখে যাবে।
যারে সুখের কলিকা, কর্মক্ষেত্র হ'তে
ফিরে এসে সন্ধ্যাকালে দেখিবে তাহার
দলগুলি ফুটে' ঝরে' পড়ে' গেছে ভূমে;
সব কর্ম্ম ব্যর্থ মনে হবে। চিরদিন
রহিবে জীবনমাঝে জীবন্ত অতৃপ্তি
ক্ষুধাতুরা। এস, নাথ, বস'। কেন আজি
এত অন্যমন? কার কথা ভাবিতেছ?
চিত্রাঙ্গদা? আজ তা'র এত ভাগ্য কেন?
অর্জ্জুন
ভাবিতেছি বীরাঙ্গনা কিসের লাগিয়া
ধরেছে দুষ্কর ব্রত? কি অভাব তা'র?
চিত্রাঙ্গদা
কি অভাব তা’র? কি ছিল সে অভাগীর?
বীর্য্য তা’র অভ্রভেদী দুর্গ সুদুর্গম
রেখেছিল চতুর্দ্দিকে অবরুদ্ধ করি’
রুদ্যমান রমণীহৃদয়। রমণী ত
সহজেই অন্তরবাসিনী; সঙ্গোপনে
থাকে আপনাতে; কে তা'রে দেখিতে পায়,
হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেহের শােভায়
প্রকাশ না পায় যদি। কি অভাব তা’র?
অরুণ-লাবণ্য-লেখা-চিরনির্ব্বাপিত
ঊষার মতন, যে রমণী আপনার
শতস্তর তিমিরের তলে বসে' থাকে
বীর্য্যশৈলশৃঙ্গপরে নিত্য-একাকিনী
কি অভাব তা’র? থাক থাক, তা'র কথা।
পুরুষের শ্রুতি-সুমধুর নহে, তা'র
ইতিহাস!
অর্জ্জুন
বল বল। শ্রবণলালসা
ক্রমশঃ বাড়িছে মাের। হৃদয় তাহার
করিতেছি অনুভব হৃদয়ের মাঝে।
যেন পান্থ আমি, প্রবেশ করেছি গিয়া
কোন্ অপরূপ দেশে অর্দ্ধ রজনীতে।
নদীগিরিবনভূমি সুপ্তিনিমগন,
শুভ্রসৌধকিরীটিনী উদার নগরী
ছায়াসম অর্দ্ধস্ফুট দেখা যায়, শুনা
যায় সাগরগর্জ্জন; প্রভাতআকাশে
বিচিত্র বিস্ময়ে যেন ফুটিবে চৌদিক;
প্রতীক্ষা করিয়া আছি উৎসুক হৃদয়ে
তারি তরে। বল বল শুনি তা'র কথা।
চিত্রাঙ্গদা
কি আর শুনিবে?
অর্জ্জুন
দেখিতে পেতেছি তা'রে
অশ্বারােহী, অবহেলে বাম করে বল্লা
ধরি’, দক্ষিণেতে শরাসন, নগরের
বিজয়লক্ষনীর মত, আর্ত্ত প্রজাগণে
করিছেন বরাভয়দান। দরিদ্রের
সঙ্কীর্ণ দুয়ারে, রাজার মহিমা যেথা
নত হয় প্রবেশ করিতে, মাতৃরূপ
ধরি’ সেথা, করিছেন দয়াবিতরণ।
সিংহিনীর মত, চারিদিকে আপনার
বৎসগণে রয়েছেন আগলিয়া, শত্রু
কেহ কাছে নাহি আসে ডরে। ফিরিছেন
মুক্তলজ্জা, ভয়হীনা, প্রসন্নহাসিনী,
বীর্য্যসিংহ পরে চড়ি’ জগদ্ধাত্রী দয়া।
রমণীর কমনীয় দুই বাহু পরে
স্বাধীন সে অসঙ্কোচ বল, ধিক্ থাক
তা'র কাছে রুনুঝুনু কঙ্কণ কিঙ্কিণী।
অয়ি বরারোহে, বহুদিন কর্ম্মহীন
এ পরাণ মাের, উঠিছে অশান্ত হ'য়ে
দীর্ঘ শীত-সুপ্তোথিত ভুজঙ্গের মত।
এস এস দোঁহে দুই মত্ত অশ্ব ল'য়ে
পাশাপাশি ছুটে চলে' যাই, মহাবেগে
দুই দীপ্ত জ্যোতিষ্কের মত। বাহিরিয়া
যাই, এই রুদ্ধ সমীরণ, এই তিক্ত
পুষ্পগন্ধমদিরায় নিদ্রাঘনঘাের
অরণ্যের অন্ধগর্ভ হ'তে।
চিত্রাঙ্গদা
হে কৌন্তেয়,
যদি এ লালিত্য, এই কোমল ভীরুতা,
স্পর্শক্লেশসকাতর শিরীষপেলব
এই রূপ, ছিন্ন করে' ঘৃণাভরে ফেলি'
পদতলে, পরের বসনখণ্ড সম,—
সে ক্ষতি কি সহিতে পারিবে? কামিনীর
ছলাকলা মায়ামন্ত্র দূর করে' দিয়ে
উঠিয়া দাঁড়াই যদি সরল উন্নত
বীর্য্যমন্ত অন্তরের বলে, পর্ব্বতের
তেজস্বী তরুণ তরুসম, বায়ুভরে
আনম্রসুন্দর, কিন্তু লতিকার মত
নহে নিত্য কুণ্ঠিত লুণ্ঠিত,—সেকি ভালাে
লাগিবে পুরুষচোখে?—থাক থাক, তা'র
চেয়ে এই ভালো। আপন যৌবনখানি,
দুদিনের বহুমূল্য ধন, সাজাইয়া
সযতনে, পথচেয়ে বসিয়া রহিব;
অবসরে আসিবে যখন, আপনার
সুধাটুকু দেহপাত্রে আকর্ণ পূরিয়া
করাইব পান; সুখস্বাদে শ্রান্তি হ'লে
চলে' যাবে কর্ম্মের সন্ধানে; পুরাতন
হ'লে, যেথা স্থান দিবে, সেথায় রহিব
পার্শ্বে পড়ি। যামিনীর নর্ম্মসহচরী
যদি হয় দিবসের কর্ম্মসহচরী,
সতত প্রস্তুত থাকে বামহস্তসম
দক্ষিণ হস্তের অনুচর, সে কি ভালাে
লাগিবে বীরের প্রাণে?
অৰ্জ্জুন
বুঝিতে পারিনে
আমি রহস্য তােমার। এতদিন আছি,
তবু যেন পাইনি সন্ধান। তুমি যেন
বঞ্চিত করিছ মােরে গুপ্ত থেকে সদা;
তুমি যেন দেবীর মতন, প্রতিমার
অন্তরালে থেকে, আমারে করিছ দান
অমূল্য চুম্বন রত্ন, আলিঙ্গন সুধা;
নিজে কিছু চাই না, লহ না। অঙ্গহীন
ছন্দোহীন প্রেম প্রতিক্ষণে পরিতাপ
জাগায় অন্তরে। তেজস্বিনী, পরিচয়
পাই তব মাঝে মাঝে কথায় কথায়।
তা'র কাছে এ সৌন্দর্যরাশি, মনে হয়
মৃত্তিকার মূর্ত্তি শুধু, নিপুণ চিত্রিত
শিল্প যবনিকা। মাঝে মাঝে মনে হয়
তােমারে তােমার রূপ ধরিতে পারে না
আর, তাই সদা কাঁপিতেছে টলমল
করি'। নিত্যদীপ্ত হাসিটির মাঝে
ভরা অশ্রু করিতেছে বাস, মাঝে মাঝে
ছলছল করে' ওঠে, মুহূর্ত্তের মাঝে
ফাটিয়া পড়িবে যেন আবরণ টুটি'।
সাধকের কাছে, প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে
মনােহর মায়াকায়া ধরি’; তা'র পরে
সত্য দেখা দেয়, ভূষণ-বিহীনরূপে
আলাে করি’ অন্তর বাহির। সেই সত্য
কোথা আছে তােমার মাঝারে, দাও তা'রে।
আমার যে সত্য তাই লও। শ্রান্তিহীন
সে মিলন চিরদিবসের। অশ্রু কেন
প্রিয়ে? বাহুতে লুকায়ে মুখ কেন এই
ব্যাকুলতা? বেদনা দিয়েছি প্রিয়তমে?
তবে থাক, তবে থাক্। ওই মনােহর
রূপ পুণ্যফল মাের। এই যে সঙ্গীত
শােনা যায় মাঝে মাঝে বসন্তসমীরে
এ যৌবন যমুনার পরপার হ'তে,
এই মাের বহুভাগ্য। এ বেদনা মাের
সুখের অধিক সুখ, আশার অধিক
আশা, হৃদয়ের চেয়ে বড়, তাই তা'রে
হৃদয়ের ব্যথা বলে' মনে হয় প্রিয়ে।
মদন, বসন্ত ও চিত্রাঙ্গদা
মদন
শেষ রাত্রি আজি।
বসন্ত
আজ রাত্রিঅবসানে
তব অঙ্গ-শােভা, ফিরে' যাবে বসন্তের
অক্ষয়ভাণ্ডারে। পার্থের চুম্বনস্মৃতি
ভুলে' গিয়ে, তব ওষ্ঠ-রাগ, দুটি নব
কিশলয়ে মঞ্জরি’ উঠিবে লতিকায়।
অঙ্গের বরণ তব, শত শ্বেত ফুলে
ধরিয়া নূতন তনু, গতজন্মকথা
ত্যজিবে স্বপ্নের মত নব জাগরণে।
চিত্রাঙ্গদা
হে অনঙ্গ, হে বসন্ত, আজ রাত্রে তবে
এ মুমূর্ষুরূপ মাের, শেষ রজনীতে
শ্রান্ত প্রদীপের অন্তিম শিখার মত-
আচম্বিতে উঠুক উজ্জ্বলতম হ'য়ে।
মদন
তবে তাই হােক। সখা, দক্ষিণ পবন
দাও তবে নিশ্বাসিয়া প্রাণপূর্ণ বেগে।
অঙ্গে অঙ্গে উচুক উচ্ছ্বসি পুনর্ব্বার
নবােল্লাসে যৌবনের ক্লান্ত মন্দ স্রোত
আজি মাের পঞ্চ পুষ্পশরে, নিশীথের
নিদ্রাভেদ করি’, ভােগবতী তটিনীর
তরঙ্গউচ্ছ্বাসে, প্লাবিত করিয়া দিব
বাহুপাশে বদ্ধ দুটি প্রেমিকের তনু।
শেষ রাত্রি
অর্জ্জুন ও চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
প্রভু, মিটিয়াছে সাধ? এই সুললিত
সুগঠিত নবনী-কোমল সৌন্দর্য্যের
যত গন্ধ যত মধু ছিল, সকলি কি
করিয়াছ পান! আর কিছু বাকি আছে?
আর কিছু চাও? আমার যা কিছু ছিল
সব হয়ে গেছে শেষ?—হয় নাই প্রভু!
ভালাে হােক, মন্দ হােক, আরাে কিছু বাকি
আছে, সে আজিকে দিব।
প্রিয়তম, ভালাে
লেগেছিল বলে’ করেছিনু নিবেদন
এ সৌন্দর্য-পুষ্পরাশি চরণকমলে—
নন্দনকানন হ’তে তুলে' নিয়ে এসে
বহু সাধনায়। যদি সাঙ্গ হ’ল পূজা
তবে আজ্ঞা কর প্রভু, নির্ম্মাল্যের ডালি
ফেলে দিই মন্দির বাহিরে। এইবার
প্রসন্ন নয়নে চাও সেবিকার পানে।
যে ফুলে করেছি পূজা, নহি আমি কভু
সে ফুলের মত প্রভু এত সুমধুর,
এত সুকোমল, এত সম্পূর্ণ সুন্দর।
দোষ আছে, গুণ আছে, পাপ আছে, পুণ্য
আছে; কত দৈন্য আছে; আছে আজন্মের
কত অতৃপ্ত তিয়াষা। সংসার-পথের
পান্থ, ধূলিলিপ্ত বাস, বিক্ষত চরণ;
কোথা পাব কুসুম-লাবণ্য, দুদণ্ডের
জীবনের অকলঙ্ক শােভা! কিন্তু আছে
অক্ষয় অমর এক রমণী-হৃদয়?
দুঃখ সুখ আশা ভয় লজ্জা দুর্ব্বলতা
ধূলিময়ী ধরণীর কোলের সন্তান,
তা’র কত ভ্রান্তি, তা'র কত ব্যথা,
কত ভালবাসা, মিশ্রিত জড়িত হ'য়ে
আছে এক সাথে।—আছে এক সীমাহীন
অপূর্ণতা, অনন্ত মহৎ। কুসুমের
সৌরভ মিলায়ে থাকে যদি, এইবার
সেই জন্ম-জন্মান্তের সেবিকার পানে
চাও।
সূর্য্যোদয়
( অবগুণ্ঠন খুলিয়া)
আমি চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্রনন্দিনী:
হয় ত পড়িবে মনে, সেই একদিন
সেই সরােবরতীরে, শিবালয়ে, দেখা
দিয়েছিল এক নারী, বহু আবরণে
ভারাক্রান্ত করি’ তা'র রূপহীন তনু।
কি জানি কি বলেছিল নির্লজ্জ মুখরা,
পুরুষেরে করেছিল পুরুষ-প্রথায়
আরাধনা; প্রত্যাখ্যান করেছিলে তা'রে।
ভালোই করেছ। সামান্য সে নারীরূপে
গ্রহণ করিতে যদি তা'রে, অনুতাপ
বিঁধিত তাহার বুকে আমরণ কাল।
প্রভু, আমি সেই নারী। তবু আমি সেই
নারী নহি; সে আমার হীন ছদ্মবেশ।
তার পরে পেয়েছিনু বসন্তের বরে
বর্ষকাল অপরূপ রূপ। দিয়েছিনু
শ্রান্ত করি’ বীরের হৃদয়, ছলনার
ভারে। সেও আমি নহি।
আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি’ রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই, অবহেলা করি’ পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মােরে সঙ্কটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর’
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুখে মােরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়। গর্ভে
আমি ধরেছি যে সন্তান তােমার, যদি
পুত্র হয়, আশৈশব বীরশিক্ষা দিয়ে
দ্বিতীয় অর্জ্জুন করি’ তা’রে একদিন
পাঠাইয়া দিব যবে পিতার চরণে,
তখন জানিবে মােরে প্রিয়তম!
আজ
শুধু নিবেদি চরণে, আমি চিত্রাঙ্গদা,
রাজেন্দ্রনন্দিনী।
প্রিয়ে, আজ ধন্য আমি