কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/অনন্ত জীবন
অনন্ত জীবন
অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,
জনমেছি দুদিনের তরে,
যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে
গান গাই আনন্দের ভরে।
এ আমার গানগুলি দুদণ্ডের গান,
রবে না রবে না চিরদিন,
পূরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস
পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।
তা বলে নয়নে কেন ওঠে অশ্রুজল—
কেন তোর দুখের নিশ্বাস,
গীত গান বন্ধ করে রয়েছিস্ বসে
কেন ওরে হৃদয় হতাশ?
আনন্দের প্রাণ তোর, আনন্দের গান,
সাঙ্গ তাহা করিসনে আজ—
যখন যা মনে হবে উঠিবি গাহিয়া
এই শুধু——এই তোর কাজ।
একবার ভেবে দেখু——ভেবে দে মন
পৃথিবীতে পাখী কেন গায়;
জাগিয়া দেখে সে চেয়ে প্রভাত-কিরণ
আকাশেতে উথলিয়া যায়;
অমনি নয়নে ফোটে আনন্দের আলো,
কণ্ঠ তুলি মনের উচ্ছ্বাসে
সঙ্গীতনির্ঝরস্রোতে ঢেলে দেয় প্রাণ—
ঢেলে দেয় অনন্ত আকাশে।
কনক মেঘেতে যেন খেলবার তরে
গানগুলি ছুটে বাহু তুলি;
প্রিয়তমা পাশে বসি——বুকের কাছেতে
ঘেঁসে আসে ছোট ছানাগুলি।
কাল গান ফুরাইবে, তা বলে গাবে না কেন,
আজ যবে হয়েছে প্রভাত;
আজ যবে জ্বলিছে শিশির,
আজ যবে কুসুম-কাননে
বহিয়াছে বিমল সমীর
আজ যবে ফুটেছে কুসুম,
নলিনীর ভাঙিয়াছে ঘুম,
পল্লবের শ্যামল-হিল্লোল,
তটিনীতে উঠেছে কল্লোল,
নয়নেতে মোহ লাগিয়াছে,
পরাণেতে প্রেম জাগিয়াছে।
তোরা ফুল, তোরা পাখী, তোরা খোলা প্রাণ,
জগতের আনন্দ যে তোরা,
জগতের বিষাদ-পাসরা।
পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দ-লহরী
তোরা তার একেকটি ঢেউ,
কখন্ উঠিলি আর কখন্ মিলালি
জানিতেও পারিল না কেউ।
কত শত উঠিতেছে, যেতেছে টুটিয়া,
কে বল রাখিবে তাহা মনে;
তা বলে কি সাধ যায় লুকাইতে প্রাণ
সূর্য্যহীন আঁধার মরণে?
যা হবে তা হবে মোর, কিসের ভাবনা,
রাখি শুধু মুহূর্ত্তের আশ,
আনন্দ-সাগর মাঝে উঠিব একটি ঢেউ
মুহূর্ত্তেই পাইব বিনাশ।
প্রতিদিন কত শত ফুটে ওঠে ফুল,
প্রতিদিন ঝরে পড়ে যায়,
ফুল-বাস মুহূর্তে ফুরায়।
প্রতিদিন কত শত পাখী গান গায়,
গান তার শূন্যেতে মিশায়।
ভেসে যায় শত ফুল, ভেসে যায় বাস,
ভেসে যায় শত শত গান—
তারি সাথে, তারি মাঝে দেহ এলাইয়া
ভেসে যাবি তুই মোর প্রাণ।
তুই ফুরাইয়া গেলে গান ফুরাইবে,
কত সহে সঙ্গীতের প্রাণে।
আবার নূতন কবি এই উপবনে,
আসিয়া বসিবে এইখানে।
তোরি মত রহিবে সে পূরবে চাহিয়া,
দেখিবে সে ঊষার বিকাশ,
অমনি আপনা হতে হৃদয় উথলি
উঠিবেক গানের উচ্ছ্বাস।
তুই যাবি, সেও যাবে, একেকটি পাখী,
একেকটি সঙ্গীতের কণা,
তা বলিয়া—যত দিন রবি শশী আছে
জগতের গান ফুরাবে না;
তবে আর কিসের ভাবনা,
গারে গান প্রভাত-কিরণে।
যারা তোর প্রাণসখা, যারা তোর প্রিয়তম
ওই তারা কাছে বসে শোনে।
নাই তোর নাইরে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা
ভেসে আসে, সাগরে মিশায়,
জান না কোথায় তারা যায়?
একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর
রচিছে বিশাল মহাদেশ,
না জানি কবে তা হবে শেষ!
মুহূর্ত্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,
জান না ত কোথায় তা যায়?
আকাশের সাগর-সীমায়।
আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে
গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,
যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে
সেইখানে করিছে গমন।
আকাশ পূরিয়া যাবে শেষ,
উঠিবে গানের মহাদেশ।
করিব গানের মাঝে বাস,
লইবরে গানের নিশ্বাস,
ঘুমাইব গানের মাঝারে,
বহে যাবে গানের বাতাস।
নাই তোর নাইরে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
প্রাণপণে ভালবাসা করে’ সমর্পণ
ফিরে তাহা পেলিনে না হয়—
বৃথা নহে নিরাশ-প্রণয়।
নিমেষের মোহে জন্মে যে প্রেম-উচ্ছ্বাস
নিমেষেই করে পলায়ন,
সেও কভু জানে না মরণ।
জগতের তলে তলে তিলে তিলে পলে পলে
প্রেমরাজ্য হতেছে সৃজন,
সেথায় সে করিছে গমন।
কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল
দুটি ভাই গলাগলি করি;
দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল
দুটি সখা হাতে হাতে ধরি;
দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে
ঘুমায়ে করিছে স্তনপান,
ঘুমন্ত মুখের 'পরে বরষিছে স্নেহ-ধারা
স্নেহমাখা নত দুনয়ান;
দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক
বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি—
কত কি যে দেখেছিনু হয়ত সে সব ছবি
আজ আমি গিয়েছি পাসরি।
তা বলে নাহি কি তাহা মনে?
ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?
স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি
রচিতেছে জীবন আমার
কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে
চিনিতে পারিনে তাহা আর।
হয়ত অনেক দিন দেখেছিনু ছবি এক
দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে—
তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি
সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।
হয়ত অনেক দিন শুনেছিনু পাখী এক
আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,
সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি
প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।
সকলি মিশিছে আসি হেথা,
জীবনে কিছু না যায় ফেলা,
এই যে যা কিছু চেয়ে দেখি
এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।
এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,
চারিদিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি, যত গান, যত প্রাণ
ভেসে আসে সেই স্রোতভরে,
মেশে আসি সেই সিন্ধুপরে।
পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম
সেই মহাসাগর উদ্দেশে;
আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি
অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে
সাগরে পড়িব অবশেষে।
জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে
রচিত হতেছে পলে পলে,
অনন্ত-জীবন মহাদেশ;
কে জানে হবে কি তাহা শেষ?
তাই বলি প্রাণ ওরে—মরণের ভয় করে
কেনরে আছিস্ ম্রিয়মাণ
সমাপ্ত করিয়া গীত গান!
গান গা পাখীর মত, ফোটরে ফুলের প্রায়,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি-
তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে
তুই আর তোর গানগুলি।
মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্ত সাগরতলে,
একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,
তুই আর তোর এই গান।