ষষ্ঠ সর্গ।


 তখন পার্ব্বতী বিশ্বস্ত সখী দ্বারা শিবকে এই কথা বলিয়া পাঠাইলেন, পর্ব্বতরাজ আমাকে সম্প্রদান করিবার অধিকারী; অতএব তাঁহার মত করুন॥ ১॥

 যেমন সহকারলতা কোকিলের আলাপদ্বারা বসন্তের সহিত সম্ভাষণ করে, তদ্রূপ পার্ব্বতী শিবের নিকটে অবস্থিত হইয়াও সখীদ্বারা তাঁহার নিকট পূর্ব্বোক্ত কথাটী বলিয়া পাঠাইলেন॥ ২॥

 ‘তাহাই করিতেছি’ শিব এই প্রকার প্রতিশ্রুত হইয়া অতি কষ্টে পার্ব্বতীর নিকট বিদায় লইয়া আকাশে তার রূপে বিরাজমান সপ্ত ঋষিকে স্মরণ করিলেন॥ ৩॥

 তৎক্ষণাৎ সেই সপ্ত ঋষি অরুন্ধতীকে সঙ্গে লইয়া এবং পুঞ্জ পুঞ্জ আলোক দ্বারা আকাশমণ্ডলকে উজ্জ্বলীকৃত করিতে করিতে প্রভুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন॥ ৪॥

 তখন তাঁহাদিগের সেই স্বর্গগঙ্গার স্রোতে অবগাহন করা হইয়াছে, যে স্রোতের তরঙ্গ তীরস্থিত মন্দার বৃক্ষের শুষ্ক পুষ্পগুলিকে ইতস্তত ভাসাইয় লয় এবং যাহার জল দিগ্‌গজদিগের মদ বারির গন্ধে সুরভীকৃত হইয়া থাকে॥ ৫॥

 তাঁহাদিগের যজ্ঞোপবীত মুক্তাময়, বল্কল সুবর্ণময়, এবং জপমালা রত্নময়, সুতরাং দেখিলে জ্ঞান হয় যেন কল্পতরুরা সংন্যাসী হইয়াছেন॥৬॥

 ইঁহারা এত ঊর্দ্ধে থাকেন, যে সূর্য্যের রথের ঘোটকেরা ইঁহাদিগের নিম্ন দিয়া প্রস্থান করে, তখন রথের ধ্বজা সূর্য্যকে অবতারণ করিতে হয়, পাছে সপ্তর্ষিমণ্ডলে স্পর্শ হয়, আর স্বয়ং সূর্য্যদেব ঊর্দ্ধে নিরীক্ষণ পূর্ব্বক প্রণাম করেন॥ ৭॥

 যখন প্রলয়কালে ভূতধাত্রী পৃথিবীকে বরাহ অবতার দন্তে ধারণ করেন, তখন ইঁহারাও সেই সংকটের সময় বরাহের দন্তে আপনাদিগের ক্ষীণ বাহু সংলগ্ন করিয়া বিশ্রাম করিয়াছিলেন॥ ৮॥

 ব্রহ্মার পর অবশিষ্ট সৃষ্টি ইঁহারাই রচনা করেন, একারণ পৌরাণিকেরা ইঁহাদিগকে প্রাচীন সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া উল্লেখ করিয়া থাকেন॥ ৯॥

 পূর্ব্বে যে তপস্যা করা হইয়াছিল, তাহা ফলপ্রদ হইয়াছে, এবং সেই ফল ইঁহারা ভোগ করিতেছেন, অথচ তপস্যা পরিত্যাগ করেন নাই॥ ১০॥

 পতিব্রতা অরুন্ধতী তাঁহাদিগের মধ্য স্থলে অবস্থিত থাকিয়া স্বামীর চরণ নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিলে জ্ঞান হইত যেন ইনিই তাঁহাদিগের তপস্যার সিদ্ধি মূর্ত্তিমতী হইয়াছেন, তাঁহাকে এমনি সুন্দর দেখাইতেছিল॥ ১১॥

 যেমন সপ্ত ঋষিকে, তদ্রূপ অরুন্ধতীকেও, শিব সকলকেই সমান সমাদর করিলেন। কারণ স্ত্রী কি পুরুষ ইহা কথার মধ্যেই নয়; সাধু লোকের চরিত্রই আদরণীয়॥ ১২॥

 অরুন্ধতীকে দেখিয়া শিবের বিবাহার্থ আরো যত্ন-মনোমধ্যে উদিত হইল; কারণ পতিব্রতা পত্নীর সহকারিতা দ্বারাই অশেষ প্রকার ধর্ম্মানুষ্ঠান হইয়া থাকে॥ ১৩॥

 পার্ব্বতীকে বিবাহ করিবার জন্য শিবের যে চেষ্টা, যদিও তাহা তাঁহার ধর্ম্মবাসনাতেই ঘটিয়াছিল; তথাপি কামদেব তাঁহার নিকট অপরাধ করিয়া ভীত ছিলেন, তাঁহার মনে এখন কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হইল॥১৪॥

 পরে বেদবেদাঙ্গ-পারদর্শী সেই সপ্তঋষি জগদ্‌গুরু মহাদেবকে প্রণাম পূর্ব্বক আহ্লাদে, পুলকিতশরীর হইয়া এই রূপ কহিলেন॥ ১৫॥

 আমরা যে রীতিমত বেদাধ্যয়ন করিয়াছি, অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান যথা নিয়মে করিয়াছি, আর তপস্যা যে করিয়াছি, সে সমস্ত বিষয় আজি আমাদিগের সফল হইল॥ ১৬॥

 কারণ আপনি যে ত্রিভুবনের প্রভু, আপনি আমাদিগকে স্মরণ করিয়া নিজ মনোভূমিতে আরোহণ করাইয়াছেন, এরূপ উচ্চ স্থান আমাদিগের আশা-পথের অতীত॥ ১৭॥

 আপনি যাহার অন্তঃকরণে স্থান লন, তাহার তুল্য সৌভাগ্যশালী কেহ নাই। কিন্তু ব্রহ্মার উৎপত্তিদাতা যে আপনি, আপনার চিত্তে যে স্থান পায়, তাহার সৌভাগ্যের কথা কি বলিব॥ ১৮॥

 সত্য বটে, সূর্য্য-মণ্ডল, এবং চন্দ্র-মণ্ডল অপেক্ষাও উচ্চতর স্থান আমরা অধিকার করিয়া থাকি। অদ্য কিন্তু আপনি স্মরণ করিয়াছেন এ অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইয়া ততোধিক উচ্চস্থান অধিকার করিলাম॥ ১৯॥

 আপনি সমাদর করিয়াছেন বলিয়া আমাদিগের নিজের প্রতি গৌরববুদ্ধি উপস্থিত হইতেছে। কারণ মহতের আদর পাইলে আপনাকে গুণবান্‌ বলিয়া বিশ্বাস সহজেই হইয়া থাকে। ২০॥

 হে ত্রিলোচন আপনি স্মরণ করাতে আমাদিগের যে আনন্দ উদয় হইয়াছে, তাহার কথা বলিয়া জানাইবার প্রয়োজন নাই, কারণ আপনি প্রাণীগণের অন্তর্যামী॥ ২১॥

 আপনাকে প্রত্যক্ষ দেখিতেছি অথচ আপনার স্বরূপ আমরা অবগত নহি। অনুগ্রহ পূর্ব্বক আপনার স্বরূপ আমাদিগকে বুঝাইয়া দিন, যেহেতু আপনি বুদ্ধিপথের অতীত॥ ২২॥

 এ আপনার কোন্‌ মূর্ত্তি? যে মূর্ত্তিতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন অথবা যাহা দ্বারা উহার পালন করেন অথবা যে মূর্ত্তি ব্রহ্মাণ্ড সংহার করে?॥ ২৩॥

 অথবা এই গুরুতর বাসন সম্প্রতি স্থগিত থাকুক। হে দেব! চিন্তা মাত্রে আমরা যে উপস্থিত হইয়াছি, আমাদিগকে কি করিতে হইবেক, আজ্ঞা করুন॥ ২৪॥

 তখন ভগবান্‌ সপ্তঋষিদিগের কথার উত্তর দানে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে তাঁহার শিরোভূষণ-ভূত চন্দ্র-কলার যৎসামান্য প্রভা সুনির্ম্মল দন্ত-কান্তি দ্বারা পরিপুষ্ট হইতে লাগিল॥ ২৫॥

 আপনারা ত অবগতই আছেন যে আমার নিজের জন্য কোন কার্য্য করা হয় না—দেখুন না কেন, আমার অষ্ট মূর্ত্তির বিষয় পর্য্যালোচনা করিলেই আপনারা বুঝিতে পারিবেন যে তাবৎ কার্য্যই আমার পরার্থে॥ ২৬॥

 আমার এই রীতি জানিয়া, যেমন চাতকেরা পিপাসায় কাতর হইয়া মেঘের নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তদ্রূপ দেবতারা বিপক্ষের নিকট পরাভব প্রাপ্ত হইয়া আমার নিকট, সন্তান কামনা করিয়াছেন॥ ২৭॥

 অতএব যেরূপ যজ্ঞ-করণোদ্যত ব্যক্তি অগ্নি নিষ্কাশিত করিবার নিমিত্ত অরণি নামক অগ্নিমন্থন-কাষ্ঠ আহরণ করেন, তদ্রূপ পুত্র উৎপাদন করিবার জন্য আমার ইচ্ছা হইয়াছে যে পার্ব্বতীকে সংগ্রহ করি॥ ২৮॥

 আপনাদিগকে হিমালয়ের নিকট আমার জন্য পার্ব্বতী প্রার্থনা করিতে হইবেক। এ বিষয়ে আপনাদিগকে অনুরোধ করিবার তাৎপর্য্য এই যে, সাধু লোকে থাকিয়া বিবাহের সম্বন্ধ ঘটনা করিয়া দিলে তাহা পরিণামে ক্লেশদায়ক হয় না॥ ২৯॥

 দেখুন হিমালয় লোকটী উন্নত, সদাচারী, এবং পৃথিবীর ভার ধারণ করিতেছেন। অতএব তাঁহার গৃহে এ সম্বন্ধ ঘটনা হইলে আমারো মানের লাঘব নাই॥ ৩০॥

 কন্যার জন্য এই কথা বলিরেন ইহা আর আমি আপনাদিগকে উপদেশ দিতে চাহি না। কারণ আপনারা যে আচারের উপদেশ দেন, তাহাই সাধুলোকের নিকট প্রমাণস্বরূপ পরিগৃহীত হয়॥ ৩১॥

 আর পরমমাননীয়া অরুন্ধতীও যেন এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ মনোযোগ করেন। কেন না এ প্রকার কার্য্যের সম্পাদন বিষয়ে স্ত্রীলোকেরই বিশেষ পটুতা দৃষ্ট হইয়া থাকে॥ ৩২॥

 অতএব আপনার হিমালয়ের রাজধানী ওষধিপ্রস্থ নগরীতে শুভযাত্রা করুন। আর ঐ যে স্থান, যথায় মহাকোশী নদী উচ্চ হইতে নিম্নে পতিত হইতেছে, ঐ স্থানে পুনর্ব্বার আমার সাক্ষাৎ পাইবেন॥ ৩৩॥

 যখন তাপসকুল-চূড়ামণি শিব বিবাহার্থ উদ্যত হইলেন, তখন ব্রহ্মার সন্তান সেই সপ্তঋষি দার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে যে লজ্জা ছিল, তাহা ত্যাগ করিলেন॥ ৩৪॥

 পরে তথাস্তু বলিয়া সেই কয়েক জন মুনি যাত্রা করিলেন, আর প্রভুও পূর্ব্বোল্লিখিত স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন॥ ৩৫॥

 মানসের ন্যায় বেগশালী সেই ঋষিরা তরবারির ন্যায় নীল নভোমণ্ডলে আরোহণ পূর্ব্বক ওষধিপ্রস্থ নগরে উপস্থিত হইলেন॥ ৩৬॥

 নগরটী দেখিলে জ্ঞান হইবে যে ধন সম্পত্তি সমূহের অদ্বিতীয় আবাস স্বরূপ যে কুবেরপুরী, যেন তথা হইতে লোক উঠাইয়া আনিয়া এই নগর বসতি করান হইয়াছে, অথবা স্বর্গে অনেক লোক অতিরিক্ত হইয়াছিল, তাহারা আসিয়া এই পুরী সংস্থাপন করিয়াছে॥ ৩৭॥

 গঙ্গার প্রবাহ ইহার পরিখা স্বরূপ হইয়া চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া আছে, ইহার রক্ষা-বিধায়ক প্রাচীরের উপর ওষধিলতা আলোক দিতেছে, ইহার প্রাচীর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মাণিক্য দ্বারা গঠন করা হইয়াছে; অতএব এই নগরীর রক্ষার উপায় স্বরূপ নির্ম্মাণ গুলিও দেখিতে অতি সুন্দর॥ ৩৮॥

 এই স্থানের হস্তীরা সিংহকে ভয় করে না; এখানকার অশ্বগণ ভূ-গর্ভ হইতে উৎপন্ন হয়, যক্ষ ও কিন্নর লোক এখানকার পুরবাসী এবং বন-দেবতারা এখানকার পুরনারী॥ ৩৯॥

 এই পুরের অট্টালিকা এত উচ্চ যে অগ্রভাগে মেঘ সংলগ্ন থাকে, সুতরাং গৃহমধ্যে মৃদঙ্গ ধ্বনি হইলে মেঘ কি মৃদঙ্গ আর কিছুতেই জানা যায় না, কেবল মৃদঙ্গ হইতে যে সকল করণ (ভাষায় কহে, বাজানার বোল্‌) বাদিত হয়, তদ্দ্বারাই মৃদঙ্গ বলিয়া জ্ঞান হয়॥ ৪০॥

 এইপুরে কল্পতরুর শাখায় চঞ্চল বস্ত্র লম্বমান থাকে, সুতরাং পুরবাসীদিগকে যত্ন পাইতে হয় না, অথচ প্রত্যেক গৃহ ধ্বজদণ্ড সমন্বিত পতাকা দ্বারা সুশোভিত হইয়া থাকে॥ ৪১॥

 এই পুরে স্ফটিক নির্ম্মিত অট্টালিকার উপরিভাগে সুরাপান করিবার স্থান রচনা করা হয় এবং গ্রহনক্ষত্রাদির প্রতিবিম্ব পতিত হইয়া শোভার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে পুষ্প বিকীর্ণ রহিয়াছে এরূপ জ্ঞান হইতে থাকে॥ ৪২॥

 এখানে অভিসারিকারা মেঘাচ্ছন্ন রজনীতেও অন্ধকার কাহাকে বলে তাহা জানেনা যেহেতু ওষধিলতার আলোকে রাজ পথ আলোকময় হইয়া থাকে॥ ৪৩॥

 এস্থানে যৌবনের অতিরিক্ত বয়ঃক্রম কাহারো হয় না, কামদেবই এস্থানে যম আর স্ত্রীসম্ভোগ জন্য নিদ্রা যাওয়া ব্যতীত অন্য কোন রূপে লোকে অচৈতন্য হয় না॥ ৪৪॥

 এই পুরে যখন রমণী ভ্রূকুটী রচনাপূর্ব্বক অধরোষ্ঠ কম্পমান করিতে করিতে রমণীয় অঙ্গুলি দ্বারা প্রিয়জনকে তর্জন করিতে থাকে, তখনই তাঁহারা সেই রমণীগণের যতক্ষণ না ক্রোধ শান্তি হয় ততক্ষণ তাঁহাদিগের নিকট যাচ্‌ঞা করিতে থাকেন। অন্য কোন প্রকার যাচ্‌ঞা এ স্থানে বিদিত নাই॥ ৪৫॥

 গন্ধমাদন গিরি এই পুরের বহির্ভাগস্থ উপবন স্বরূপ হইয়া আছে, তথায় সন্তানক তরুতলে বিদ্যাধর জাতীয় পথিকগণ নিদ্রা যাইতেছেন এবং স্থান সৌরভে পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে॥ ৪৬॥

 দেবর্ষিগণ হিমালয়ের রাজধানী নিরীক্ষণ করিয়া মনে করিলেন, যে, লোকে স্বর্গের উদ্দেশে যাগ যজ্ঞ যে করিয়া থাকে, তাহা তাহাদিগের ভ্রান্তি, এই স্থানের উদ্দেশে করা উচিত॥৪৭।

 তাঁহারা সবেগে গিরিভবনে অবতীর্ণ হইলেন, তৎকালে তাঁহাদিগের মস্তকের জটা চিত্রিত বহ্নির ন্যায় নিশ্চল ভাবে প্রভা প্রকাশ করিতে লাগিল এবং দ্বারবানেরা মুখ ঊর্দ্ধ করিয়া তাঁহাদিগকে দেখিতে লাগিল॥ ৪৮॥

 মুনিগণ যখন আকাশ হইতে অবতীর্ণ হইলেন, তখন যাঁহার যত অধিক বয়স, তিনি তত অগ্রে রছিলেন, এই ভাবে শ্রেণী-রচনা পূর্ব্বক তাঁহারা দণ্ডায়মান হওয়াতে জ্ঞান হইল যেন জলের মধ্যে সূর্য্যের প্রতিবিম্ব-শ্রেণী বিরাজ করিতেছে॥ ৪৯॥

 হিমালয় অর্ঘ হস্তে পরমমাননীয় সেই ঋষিগণের সম্মানার্থ দূর হইতে অগ্রসর হইয়া গেলেন। তখন তাঁহার অন্তঃসার ভরে গুরুতর চরণ বিন্যাস দ্বারা পৃথিবী অবনত হইয়া যাইতে লাগিল॥ ৫০॥

 তাঁহাকে দেখিলেই সুস্পষ্ট হিমালয় বলিয়া জ্ঞান হয়, যেহেতু তাঁহার অধর গিরিমৃত্তিকার ন্যায় রক্তবর্ণ, কলেবর সুদীর্ঘ, দুই বাহু দেবদারুর ন্যায় প্রকাণ্ড আর বক্ষঃস্থল স্বভাবত প্রস্তরের ন্যায় কঠিন॥ ৫১॥

 পবিত্র-চরিত্রশালী ঋষিগণকে যথবিধানে পূজা পূর্ব্বক গিরিরাজ স্বয়ং পথ দেখাইতে দেখাইতে অগ্রসর হইয়া তাঁহাদিগকে অন্তঃপুরে আনয়ন করিলেন॥ ৫২॥

 তথায় পর্ব্বতরাজ সেই মহাপুরুষদিগকে বেত্রাসনে উপবেশন করাইয়া আপনি উপবেশন পূর্ব্বক কৃতাঞ্জলি পুটে এই সকল কথা বলিতে লাগিলেন॥ ৫৩॥

 আপনারা যে, আমি মনেও করি নাই এ প্রকার এই দর্শন দান করিয়াছেন, তাহা আমার জ্ঞান হইতেছে যেন, বিনা মেঘে বৃষ্টি হইল, বিনা পুষ্পে ফল হইল॥ ৫৪॥

 আপনাদিগের এই অনুগ্রহ প্রযুক্ত জ্ঞান হইতেছে যেন আমি অজ্ঞানাচ্ছন্ন ছিলাম, এখন জ্ঞান লাভ করিলাম; পূর্ব্বে লৌহময় ছিলাম, সংপ্রতি স্বর্ণময় হইয়াছি; পূর্ব্বে পৃথিবীতে ছিলাম, এখন স্বর্গে আরোহণ করিয়াছি॥ ৫৫॥

 আজি অবধি প্রাণিগণ পবিত্রতালাভের নিমিত্ত আমার এ স্থানে আগমন করিবে। কারণ পূজ্য ব্যক্তিরা যথায় অধিষ্ঠান হন, সেই স্থানই তীর্থস্থান বলিয়া প্রসিদ্ধ হয়॥ ৫৬॥

 হে ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠগণ। গঙ্গা যে আমার মস্তকে পতিত হইতেছেন, তদ্দ্বারা আপনাকে যেরূপ পবিত্র জ্ঞান করি, আপনাদিগের চরণ প্রক্ষালনের বারি-সংস্পর্শেও সেই প্রকার পবিত্র আপনাকে বোধ হইতেছে॥ ৫৭॥

 আমার যে দুই প্রকার শরীর, এক স্থাবর শিলাময়; দ্বিতীয় গতিশক্তিসম্পন্ন এই শরীর, ইছাদের উভয়ের প্রতি আপনারা পৃথক্‌ পৃথক্ অনুগ্রহ বিভাগ করিয়া দিয়াছেন, যে হেতু জঙ্গম শরীর আপনাদিগের পরিচারক হইয়া আছে, আর স্থাবর শরীর আপনাদিগের চরণ চিহ্নে চিহ্নিত হইয়াছে॥ ৫৮॥

 আপনাদিগের অনুগ্রহ জন্য যে আনন্দ আমার অন্তঃকরণে বিস্তারিত হইতেছে; আমি বোধ করি যে আমার দিগ্‌দিগন্তব্যাপী পর্ব্বতদেহও সে আনন্দ ধারণ করিতে অক্ষম॥ ৫৯॥

 আপনাদিগের মূর্ত্তি তেজঃপুঞ্জ, সুতরাং আপনাদিগের আবির্ভাবে আমার গুহামধ্যস্থিত অন্ধকার ত নষ্ট হইয়াছে, পরন্তু আমার অন্তঃকরণে রজোগুণের পরবর্ত্তী যে তম ছিল, তাহাও নষ্ট হইল॥ ৬০॥

 আপনাদিগের প্রয়োজন ত কিছু দেখি না, যদিই থাকে, ত সম্পন্ন না হইবেক কেন? তবে বোধ করি কেবল আমাকে পবিত্র করিবার জন্যই আপনারা এস্থলে উপস্থিত হইয়াছেন॥ ৬১॥

 তথাপি আমার বাসনা যে আপনারা আমাকে কোন কার্য্যে নিযুক্ত করেন; কারণ প্রভু কোন আজ্ঞা প্রদান করিলেই ভৃত্যেরা কৃতার্থ বোধ করে॥ ৬২॥

 এই আমি স্বয়ং উপস্থিত, এই আমার গৃহিণী, আমার সমস্ত পরিবারের প্রাণত্যুল্য এই কন্যা; ইহার মধ্যে কাহাকে আবশ্যক, বলুন | আর এসকল অপেক্ষা বহিরঙ্গভূত অন্যান্য বস্তুর কথা ত বলিবারই প্রয়োজন নাই॥ ৬৩॥

 হিমালয়ের এই কথা বলা শেষ হইলে গুহার মুখ হইতে অবিকল তদাকার এক প্রতিধ্বনি উদয় হইল, তাহাতে জ্ঞান হইল যে হিমালয় সেই কথা এক বার বলিয়া সন্তুষ্ট হয়েন নাই, পুনর্ব্বার কহিতেছেন॥ ৬৪॥

 তখন ঋষিরা অঙ্গিরা মুনিকে বক্তা নিযুক্ত করিলেন, কারণ ইনি কোন প্রস্তাবের বক্তৃতা করিতে অদ্বিতীয় ছিলেন। অঙ্গিরাও তদনুসারে হিমালয়ের কথায় উত্তর দিলেন॥ ৬৫॥

 তুমি যাহা কহিলে কিছুই অলীক নহে, ইহা অপেক্ষা আরো অধিক ঔদার্য্যও তোমাতে থাকা অসম্ভব নহে, কারণ যেমন তোমার শিখর গুলি উচ্চ, তদ্রূপ তোমার মনও উন্নত॥ ৬৬॥

 তোমার পর্ব্বত-দেহকে যে বিষ্ণু বলিয়া থাকে, তাহা যথার্থ; তাহার সাক্ষী দেখ তোমার অভ্যন্তর সংসারের সর্ব্ব প্রকার শরীরী বস্তুর আশ্রয়স্থান স্বরূপ হইয়া আছে॥ ৬৭॥

 যদি তুমি পাতালের নিম্ন ভাগ পর্য্যন্ত পৃথিবীকে ধারণ করিয়া না থাকিতে, তাহা হইলে সর্পরাজের সাধ্য কি যে তিনি মৃণালের ন্যায় সুকোমল ফণাদ্বারা পৃথিবীকে ধরিয়া রাখেন॥ ৬৮॥

 এক দিকে তোমা হইতে নদী সকল উৎপন্ন হইয়া আপনাদিগের অবিচ্ছিন্ন নির্ম্মল প্রবাহকে সমুদ্রের তরঙ্গের বেগ পরাজয় পূর্ব্বক তন্মধ্যে প্রবিষ্ট করাইতেছে এবং স্বয়ং পবিত্র বলিয়া তাবৎ লোককে পবিত্র করিতেছে; অন্যদিকে তোমার কীর্ত্তিমণ্ডল সমুদ্রের তরঙ্গ উত্তীর্ণ হইয়া পর পারে প্রচারিত হইতেছে, তাহাদিগের বিচ্ছেদ কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না এবং লোকে উহা কীর্ত্তন করিয়া পবিত্র হইয়া থাকে॥ ৬৯॥

 নারায়ণের চরণ গঙ্গার উৎপত্তি স্থান, এ কারণ গঙ্গার যে প্রকার মাহাত্ম্য, গঙ্গার দ্বিতীয় উৎপত্তিস্থান তুমি বলিয়াও তাঁহার মাহাত্ম্য তদ্রূপই বৃদ্ধি হইয়াছে॥ ৭০॥

 হরি যখন বলিকে ছলনা করিবার সময় তিন বার পাদক্ষেপ করেন, কেবল সেই সময়েই ঊর্দ্ধে, ও নিম্নে ও চতুঃপার্শ্বে বিস্তারিত ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী মূর্ত্তি তিনি ধারণ করিয়াছিলেন; তুমি কিন্তু স্বভাবত এবং চিরকালই দিগ্‌দিগন্তব্যাপী হইয়া আছ॥ ৭১॥

 সুমেরুর উচ্চ শিখর সুবর্ণময় হইলে কি হয়? তুমি যখন যজ্ঞভাগ ভোক্তা দেবতাদিগের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছ, তখন তোমার পদ সুমেরু অপেক্ষা উন্নত॥ ৭২॥

 তোমার যাহা কিছু কঠিনতা, সমস্তই তোমার পর্ব্বত, দেহে সমর্পণ করিয়া রাখিয়াছ; কিন্তু এই যে তোমার শরীর, ইহা ভক্তিভাবে নম্র এবং সাধুদিগের আরাধনা কার্য্যে নিযুক্ত আছে॥ ৭৩॥

 অতএব আমরা যে কার্য্য উপলক্ষে আসিয়াছি, শ্রবণ কর; তাহা তোমার কার্য্য। তবে আমরা সৎপরামর্শ দান করিয়া ইহার অংশী হইতেছি॥ ৭৪॥

 ঈশ্বর এই যে নাম, যাহা অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি প্রয়োগ হয় না, যিনি সেই নাম ও অণিমা আদি অষ্ট সিদ্ধি এবং মস্তকে চন্দ্রকলা এই তিন ধারণ করিয়া থাকেন॥ ৭৫॥

 যেমন পথে গমন কালে রথবাহী ঘোটকেরা পরস্পর সাহায্য করত রথকে অবলম্বন করিয়া থাকে, তদ্রূপ যাঁহার পৃথিবী আদি অষ্টমূর্ত্তি পরস্পরের সহকারিতা করিতে করিতে এই ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে॥ ৭৬॥

 যিনি শরীরের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন, অথচ যোগীর যাঁহার সাক্ষাৎকার লাভের নিমিত্ত যত্ন করিয়া থাকেন, আর পণ্ডিতেরা বলিয়া থাকেন যে যাঁহার ধামে উপনীত হইলে আর সংসারে প্রত্যাগমন করিতে হয় না॥ ৭৭॥

 সেই অভীষ্ট-সিদ্ধি-দাতা ব্রহ্মাণ্ডের কর্ম্ম-সাক্ষী মহাদেব আমাদিগকে প্রেরণ পূর্ব্বক তোমার কন্যা বিবাহ করিবার প্রার্থনা করিতেছেন॥৭৮॥

 যেমন বাক্য আর অর্থের সমাগম, তদ্রূপ তাঁহার সহিত তোমার কন্যার সমাগম সংঘটন কর। কারণ সৎপাত্রে কন্যা দান করিলে তাহার নিমিত্ত পিতাকে দুঃখ করিতে হয় না।॥৭৯॥

 তাহা হইলে স্থাবর জঙ্গম যাবতীয় প্রাণী তোমার কন্যাকে জননী বলিয়া জ্ঞান করিবেক, যেহেতু শিব জগতের পিতা॥ ৮০॥

 তাহা হইলে দেবগণ অগ্রে মহাদেবকে প্রণাম করিবার পর মস্তকস্থিত মণির আলোকদ্বারা ইঁহার দুই চরণ রঞ্জিত করিবেন॥ ৮১॥

 এই সম্বন্ধ স্থির হইলে তোমার বংশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে কিছুই অবশিষ্ট থাকিবেক না, দেখ উমা কন্যা, সম্প্রদান করিবে তুমি, ঘটক আসিয়াছি আমরা, আর বর স্বয়ং মহাদেব॥ ৮২॥

 কাহাকেও স্তব করেন না, সকলের স্তব গ্রহণ করেন, কাহাকেও প্রণাম করেন না, সকলের প্রণাম প্রাপ্ত হয়েন, এমন যে ব্রহ্মাণ্ডের গুরু মহাদেব, তাঁহার সহিত সম্বন্ধ সংঘটন পূর্ব্বক তুমি তাঁহার গুরু হও॥ ৮৩॥

 দেবর্ষি অঙ্গিরা যৎকালে এই সকল কথা বলিতেছিলেন, তখন পার্ব্বতী পিতার পার্শ্বে অবস্থিত ছিলেন, তিনি মনের ভাব গোপন করিবার জন্য হস্তস্থিত পদ্ম দল গুলি গণিতে লাগিলেন॥ ৮৪॥

 হিমালয়ের মনের বাসনাই সিদ্ধ হইল, তথাপি তিনি মেনকার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, যে তাঁহার মত কি; কারণ কন্যা-সংক্রান্ত সকল কর্ম্মেই গৃহস্থ লোকে গৃহিণীর কথা অনুসারেই চলিয়া থাকেন॥ ৮৫॥

 স্বামীর তাহাই অভিপ্রায় ইহা মেনকা জানিতেন, সুতরাং সে সমস্ত বিষয়ে সম্মতি প্রদান করিলেন; কারণ পতিব্রতা দিগের স্বভাবই এই যে স্বামীর অভিলাষের অনুবর্ত্তিনী হয়॥ ৮৬॥

 এ বিষয়ে এই প্রকার উত্তর প্রদানই উচিত, মনে মনে ইহা বিবেচনা পূর্ব্বক হিমালয় সকলের কথা শেষ হইলে বিবাহ যোগ্য শুভ অলঙ্কারে অলঙ্কত আপন কন্যাকে ধারণ করিলেন॥ ৮৭॥

 বৎসে, এস, তোমাকে শিবের নিমিত্ত ভিক্ষা দিলাম, মুনিগণ ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছেন; গৃহস্থ লোকের যে চরিতার্থতা, আজি আমার তাহা লাভ হইল॥ ৮৮॥

 কন্যাকে এই কথা বলিয়া হিমালয় ঋষিগণকে কহিলেন, এই দেখুন, শিবের পত্নী আপনাদিগকে প্রণাম করিতেছেন॥ ৮৯॥

 তাঁহাদিগের অভিলষিত সিদ্ধ হওয়াতে হিমালয়ের ঐ কথা অতি উদার বোধ হইল, অতএব ঋষিরা উহাতে সবিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়া, শীঘ্রই সফল হইবেক, এ প্রকার নানা আশীর্ব্বাদ পর্ব্বতীকে করিলেন॥ ৯০॥

 অরুন্ধতীকে সমাদর পূর্ব্বক প্রণাম করিবার সময় পার্ব্বতীর সুবর্ণময় কর্ণ-ভূষণ বিগলিত হইল; তিনি লজ্জা করিতেছিলেন, অরুন্ধতী তাঁহাকে ক্রোড়ে করিলেন॥ ৯১॥

 কন্যার প্রতি স্নেহ প্রযুক্ত কাতর হইয়া মেনকার মুখ অশ্রুজলে অভিষিক্ত হইল, অরুন্ধতী বরের বিবাহান্তর নাই এই কথা বলিয়া এবং অন্য নানা গুণ বর্ণনা করিয়া মাতার শোক শান্তি করিয়া দিলেন॥ ৯২॥

 শিবের শ্বশুর মুনিগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বিবাহ কোন দিবস হইতে পারিবেক, তাহাতে তিন দিবসের পর এই কথা বলিয়া বল্কলধারী ঋষিরা গাত্রোত্থান করিলেন॥ ৯৩॥

 তাঁহার হিমালয়ের নিকট বিদায় লইয়া শিবের সহিত পুনর্ব্বার দেখা করিলেন। তাঁহাকে কার্য্য সিদ্ধির বিষয় বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক বিদায় লইয়া আকাশে উঠিয়া গেলেন॥ ৯৪॥

 শিবও পার্ব্বতীর সহিত মিলনের জন্য এত অস্থির হইয়া ছিলেন যে তাঁহার সেই তিন দিন অতিকষ্টে অতিবাহিত হইল। যখন সেই প্রভুকে পর্য্যন্ত ঐ প্রকার মনোবৃত্তি সকল আসিয়া স্পর্শ করে, তখন অন্য কোন সামান্য ব্যক্তি যে অধীর হয়, ইহাতে আর বিচিত্র কি?॥ ৯৫॥