১০

 উভয় পক্ষের যুদ্ধসজ্জা সম্পূর্ণ হইয়া যখন সেনাপতিগণ সৈন্যদিগকে যুদ্ধারম্ভের আদেশ প্রদানে উদ্যত হইয়াছেন, তখন সহসা ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অস্ত্র-শস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক রিপুসৈন্যাভিমুখে পদব্রজে গমন করিতে লাগিলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এই অদ্ভুত আচরণে উদ্বিগ্ন হইয়া পাণ্ডবগণ স্বস্ব রথ হইতে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইলেন। কৃষ্ণও অর্জ্জুনের সঙ্গে চলিলেন এবং অন্যান্য অনেক রাজগণ কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া তাঁহাদের অনুগমন করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন—

 হে ধর্ম্মরাজ! তুমি কি নিমিত্ত পাদচারে শত্রুদলমধ্যে গমন করিতেছ?

 ভীমসেন কহিলেন—সৈন্যগণ সকলেই সুসজ্জিত হইয়া প্রস্তুত রহিয়াছে এ সময়ে তুমি অস্ত্র নিক্ষেপপূর্ব্বক কোথায় প্রস্থান করিতেছ?

 নকুল-সহদেব কহিলেন―মহারাজ। তুমি জ্যেষ্ঠ হইয়া আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতেছ ইহাতে আমরা একান্ত ব্যথিত হইতেছি; অতএব ইহার অর্থ কি আমাদের নিকট প্রকাশ কর।

 কিন্তু যুধিষ্ঠির কাহাকেও কোন উত্তর প্রদান না করিয়া একমনে ভীষ্মের রথাভিমুখে চলিলেন। তখন কৃষ্ণ ঈষৎ হাস্যসহকারে বলিয়া উঠিলেন―

 হে পাণ্ডবগণ! তোমরা চিন্তিত হইও না, আমি যুধিষ্ঠিরের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছি, গুরুজনদের অনুমতি না লইয়া তাঁহার যুদ্ধারম্ভের প্রবৃত্তি হইতেছে না।

 এই অদ্ভুত দৃশ্য অবলোকনে কৌরবদলের মধ্যে নানারূপ কথােপকথন হইতে লাগিল। কেহ কেহ বলিল—

 এই ক্ষত্রিয়-কুল-কলঙ্ক যুধিষ্ঠির নিশ্চয়ই ভীত হইয়া শরণ গ্রহণার্থে ভীষ্মের সমীপে আগমন করিতেছে। আহা! মহাবীর ভ্রাতৃগণকে লজ্জা দিয়া কাপুরুষ যুধিষ্ঠির কি প্রকারে এরূপ দুষ্কার্য্য করিতেছে।

 এই ভাবের কথা কুরুসেনামধ্যে চতুর্দ্দিকে রাষ্ট্র হওয়ায় সৈন্যগণ পাণ্ডবদিগকে ধিক্কার প্রদান ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে প্রশংসা করিয়া মহাহর্ষে পতাকা বিকশিত করিতে লাগিল।

 অনন্তর যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকটবর্ত্তী হইলে তিনি কি বলেন, ভীষ্মই বা কি উত্তর করেন, শুনিবার জন্য সকলে তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিল। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির সেই আয়ুধসঙ্কুল শত্রুদলমধ্যে ভ্রাতৃগণসহ প্রবেশপূর্ব্বক সংগ্রামার্থ প্রস্তুত কুরুপিতামহের সমীপে উপনীত হইয়া তাঁহার চরণদ্বয় গ্রহণ করিয়া কহিলেন―

 হে দুর্দ্ধর্ষ! আমি আপনাকে আমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছি, এক্ষণ যুদ্ধার্থে অনুমতি প্রদান ও আশীর্ব্বাদ করুন।

 ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের এই শিষ্টতায় পরম প্রীত হইয়া কহিলেন—

 হে রাজন্! তুমি আমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে আমি দুঃখিত হইতাম, কিন্তু এক্ষণে সম্পূর্ণ প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করিতেছি—যুদ্ধে জয়লাভ কর।

 তখন যুধিষ্ঠির পিতামতকে অভিবাদনপূর্ব্বক আচার্য্য দ্রোণের নিকট উপস্থিত হইয়া যুদ্ধার্থে তাঁহার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন।

 দ্রোণাচার্য্য কহিলেন―হে সৌম্য! তুমি গুরুর অনুমতি ব্যতীত যুদ্ধারম্ভ করিলে আমি নিশ্চয়ই রুষ্ট হইয়া তােমার পরাজয় কামনা করিতাম, কিন্তু তুমি যখন আমার নিকট আগমন করিয়াছ, তখন আমি প্রীতমনে আশীর্ব্বাদ করিতেছি―তোমার জয় হৌক। আমি অর্থদ্বারা তােমার বিপক্ষে আবদ্ধ আছি; অতএব অতি দীনের ন্যায় তােমাকে কহিতেছি, তােমার পক্ষাবলম্বন ব্যতীত আমার নিকট যাহা ইচ্ছা প্রার্থনা কর।

 তখন যুধিষ্ঠির যাচ্ঞা করিলেন―

 হে গুরো! আপনি কৌরবপক্ষে সংগ্রাম করুন, কিন্তু আমার হিতার্থে মন্ত্রণা-দান করুন।

 তদুত্তরে দ্রোণ কহিলেন—

 হে রাজন্! মহাত্মা বাসুদেব তোমার মন্ত্রী থাকিতে আমি আর কি উপদেশ প্রদান করিব? হে ধর্ম্মরাজ! তোমার পক্ষে যখন ধর্ম্ম আছে, তখন অবশ্যই তোমার জয় হইবে, সে বিষয়ে শঙ্কা করিও না? তবে আমি যতক্ষণ রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিব, ততক্ষণ তোমার জয়লাভের সম্ভাবনা নাই, অতএব ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে শীঘ্র আমাকে সংহার করিতে যত্নবান্ হইও।

 অনন্তর যুধিষ্ঠির কৃপাচার্য্যের অনুমতি গ্রহণার্থে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন―

 হে আর্য্য! আজ্ঞা করুন—আমি শত্রুগণকে পরাজয় করি।

 কৃপ আশীর্ব্বাদ-সহকারে কহিলেন—

 মহারাজ! আমি তোমাদের অবধ্য, কিন্তু তজ্জন্য কোন চিন্তা নাই, আমাকে বধ না করিলেও তোমাদের জয়লাভের কোন ব্যাঘাত হইবে না।

 অনন্তর কৌরবসৈন্য হইতে বহির্গত হইবার সময়ে যুধিষ্ঠির উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন—

 যদি এই পক্ষের মধ্যে কেহ আমার হিতাকাঙ্ক্ষী থাকেন, তবে তিনি আমার নিকট আগমন করুন, আমি তাঁহাকে বরণ করিব।

 তখন ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যা-গর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু সকলের প্রতি দৃষ্টি করিয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন―

 হে ধর্ম্মরাজ! আমি তােমার পক্ষ অবলম্বনপূর্ব্বক কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিব।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—ভ্রাতঃ! আইস, সকলে একত্র হইয়া তোমার মূঢ় ভ্রাতৃগণের সহিত সংগ্রাম করি। আমি প্রীতি সহকারে তােমাকে স্বপক্ষে বরণ করিলাম। স্পষ্টই বােধ হইতেছে―তুমি একাকী ধৃতরাষ্ট্রের অবলম্বনস্বরূপ থাকিয়া তাঁহার বংশরক্ষা করিবে।

 যুধিষ্ঠির মান্যব্যক্তিগণের সম্মান রক্ষা করিলেন দেখিয়া চতুর্দ্দিকস্থিত ভূপতিগণ পাণ্ডবদিগকে সাধুবাদ প্রদান করিলেন এবং শত শত দুন্দুভি ও ভেরী নিনাদিত হইতে লাগিল। পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ মহা আনন্দে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

 যুধিষ্ঠির পুনরায় রথারােহণ ও অস্ত্র ধারণ করিলে পাণ্ডু পুত্রগণ ও অন্যান্য রাজগণ স্ব স্ব স্থান অধিকারপূর্ব্বক ব্যূহ পূর্ণ করলেন।

 অনন্তর দুর্য্যোধনের আদেশানুসারে দুঃশাসন ভীষ্মকে পুরস্কৃত করিয়া সেনাগণ-সমভিব্যাহারে সংগ্রামার্থে অগ্রসর হইতে আরম্ভ করিলেন; তদ্দৃষ্টে পাণ্ডব-ব্যূহমুখ-রক্ষক ভীমসেন উন্মুক্ত বলদের ন্যায় প্রচণ্ডরবে গর্জ্জন করিতে করিতে স্বীয় বিভাগ লইয়া শত্রুগণের উপর নিপতিত হইলেন। তখন সেই সাগরোপম বাহিনীদ্বয় পরস্পরের সহিত মিলিত হইলে তুমুল নিনাদে আকাশমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইল।

 মহারথীসকল ক্রুদ্ধ হইয়া স্পর্ধাপূর্ব্বক পরস্পরের সম্মুখবর্ত্তী হইলে ক্ষণকাল উভয়পক্ষীয় সৈন্যদল যেন চিত্রপটস্থ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। ক্রমে সমুত্থিত ধূলিপটলে ভাস্করের প্রভা বিলুপ্তপ্রায় হইলে আর কিছুই স্পষ্টরূপে দৃষ্টিগোচর রহিল না। অর্জ্জুনের ভীষ্মের সহিত, ভীমসেনের দুর্য্যোধনের সহিত, যুধিষ্ঠিরের মদ্ররাজের সহিত, বিরাটের ভগদত্তের সহিত, সাত্যকির কৃতবর্ম্মার সহিত এবং এইরূপে একপক্ষের প্রত্যেক বীরগণের অপরপক্ষের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সহিত কিয়ৎকাল সমভাবে ঘোর ঘুদ্ধ চলিতে লাগিল। কিন্তু কেহ কাহাকেও পরাজয় করিতে সক্ষম না হওয়ায় উভয়পক্ষেরই ব্যূহরচনা অক্ষুণ্ণ রহিল। সৈন্যগণের কিলকিলা শব্দ, তল ও শঙ্খের গভীর নিস্বন, বীরগণের সিংহনাদ শরাসন-জ্যার ভীষণ ধ্বনি, আয়ুধসমুদায়ের ঝঞ্চনা, ধাবমান গজের ঘণ্টানিনাদ ও বজ্রতুল্য রথনির্ঘোষে চতুর্দ্দিক্ পরিপূরিত রহিল।

 পূর্ব্বাহ্ণ এইভাবেই কাটিয়া গেল। উভয়পক্ষের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হইলেও কোন পক্ষই কিছুমাত্র অগ্রসর হইতে পারিল না। এরূপ তুল্য-যোদ্ধৃ-সমাগমকে অনর্থক বলক্ষয়কর বিবেচনা করিয়া অপরাহ্ণের পূর্ব্বভাগে কৌররসেনাপতি ভীষ্ম অন্য কৌশল অবলম্বন করিলেন। কৃপ, শল্য, কৃতবর্ম্মাপ্রভৃতি বীরগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া তিনি পাণ্ডবব্যূহের এক রক্ষিত স্থান লক্ষ্য করিয়া সহসা সেই দিকে প্রধাবিত অসংখ্য সৈন্য বিনষ্ট করিয়া ব্যূহ ভেদ করিতে উদ্যত হইলেন।

 একাকী বালক অভিমন্যু ব্যতীত নিকটে সৈন্যরক্ষক আর কেহ ছিল না। অর্জ্জুনের তুল্যতেজা পুত্র সৈন্যগণের সমূহ বিপদ এবং ব্যূহ বিনষ্টপ্রায় দেখিয়া অকুতোভয়ে ভীষ্মপ্রভৃতি মহারথীগণকে নিবারণ করিবার উদ্দেশ্যে তথায় উপস্থিত হইলেন। তিনি প্রথমত কৃতবর্ম্মা ও শল্যকে বিদ্ধ করিয়া ভীষ্মের প্রতি বাণ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং তৎক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদায় মধ্যপথেই নিবারণপূর্ব্বক নিশিত ভল্লের দ্বারা কৃপের সুবর্ণমণ্ডিত শরাসন ছেদন করিলেন।

 তখন ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হইয়া অভিমন্যুর রথধ্বজ ছেদন, তাঁহার সারথিকে আহত ও তাঁহাকে তিন বাণে বিদ্ধ করিলেন, কিন্তু মহাবীর অর্জ্জুনতনয় কিছুতেই কম্পিত হইলেন না। তিনি দুর্য্যোধনপক্ষীয় বীরগণে পরিবৃত হইয়াও সকলকে একাকী নিবারণ করিতে লাগিলেন এবং শরবৃষ্টিদ্বারা প্রতিপক্ষকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ভীষ্মকে শরনিকরে নিপীড়িত করায় দ্বিতীয় গাণ্ডীবধন্বার ন্যায় প্রতীয়মান হইলেন।

 অনন্তর সুযোগ বুঝিয়া লঘুহস্ত অভিমন্যু ভীষ্মের রথধ্বজ ছেদন করিলেন। কৌরব-সেনাপতির সেই মহোচ্চ রজতময় মণিভূষিত তালধ্বজ ছিন্ন হইয়া ভূতল-পাতিত হইলে কৌরবগণের মধ্য হইতে হাহাকার ও পাণ্ডবসৈন্য় হইতে সাধুধ্বনি উত্থিত হইল। ইত্যবসরে ভীমসেনাদি পাণ্ডবপক্ষীয় দশজন মহাবথ তথায় সমাগত হইয়া ভীষ্মের আক্রমণ বিফল করিলেন।

 ইঁহাদের মধ্য হইতে গজারূঢ় বিরাটতনয় উত্তর মদ্রাধিপতি শল্যের প্রতি ধাবিত হইলেন। উত্তরের মহাগজ শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া শলের রথের যূগকাষ্ঠ আক্রমণপূর্ব্বক তাঁহার অশ্বগণকে পদাঘাতে বিনষ্ট করিল। তখন ভীষণযোদ্ধা শল্য সেই বাহনবিহীন রথেই অবস্থান করিয়া এক লৌহময় শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক উত্তরের গাত্রে তাহা নিক্ষেপ করিলেন। সেই শক্তি উত্তরের বর্ম্ম ভেদ করিয়া তাঁহার মর্ম্মস্থলে প্রবিষ্ট হইলে বিরাটতনয় চতুর্দ্দিক্ অন্ধকারময় দেখিয়া গজস্কন্ধ হইতে নিপতিত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তখন মদ্ররাজ খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক সেই হস্তীকে বিনষ্ট করিয়া কৃতবর্ম্মার রথে আরোহণ করিলেন।

 প্রিয়সম্বন্ধযুক্ত বিরাটতনয়ের এই শোচনীয় মৃত্যুতে পাণ্ডবগণ নিতান্ত ভগ্নোৎসাহ ও বিষণ্ণ হইলেন। সেই সুযোগে কৌরবগণ বহুসংখ্য পাণ্ডবযোদ্ধা বিনষ্ট করিতে লাগিলে তাহাতে পাণ্ডবসেনামধ্য হইতে মহান্ হাহাকার সমুত্থিত হইল।

 এই অবস্থায় মরীচিমালী অস্তগমনোন্মুখ হইল। পাণ্ডবসেনাপতি অর্জ্জুন কৌরবগণকে নিতান্ত পরাক্রান্ত দেথিয় সৈন্যগণকে অবহারার্থে আদেশ করিলেন। এইরূপে ভীষণ যুদ্ধের প্রথম দিবস অবসান হইল।

 অনন্তর প্রভাত হইলে দৃঢ়ব্যূহিত পাণ্ডবসৈন্যের অগ্রভাগে সেনাপতি অর্জ্জুনের ভীষণ কপিধ্বজ লক্ষিত হইল। সেনাধ্যক্ষগণ ব্যূহের দুই পক্ষে অবস্থান করিলেন এবং মধ্যে ও পশ্চাতে অগণ্য মহারথসকল সজ্জিত হইলেন। চতুর্দ্দিকে পর্ব্বতশ্রেণীর ন্যায় বীরণগণ ব্যূহদ্বার রক্ষা করিতে লাগিল। মধ্যস্থলে ধর্ম্মরাজের শ্বেতচ্ছত্র সর্ব্বোপরি শোভা পাইল, ভথায় তিনি যুদ্ধারম্ভের আদেশ দিবার জন্য স্থিরচিত্তে সূর্য্যোদয় প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 এদিকে দুর্য্যোধন সেই অভেদ্য কৌঞ্চাবরণ নামক পাণ্ডবব্যুহ অবলােকন করিয়া দ্রোণাচার্য্যপ্রমুখ সেনানায়কগণকে কহিতে লাগিলেন―

 হে বীরগণ! তােমরা সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ ও নানাশাস্ত্রবেত্তা। তােমরা একত্র হইয়া দূরে থাক—তােমরা প্রত্যেকে পাণ্ডব— পরাজয়ে সমর্থ। আমাদের সৈন্যদলও অপর্য্যাপ্ত; অতএব বহুসংখ্যক মহারথ ও সেনা কেবলমাত্র ভীষ্মের রক্ষা কার্য্যে নিযুক্ত করা বিধেয়।

 এইরূপ যুক্তি স্থির হইলে ভীষ্ম তদনুসারে ব্যূহ রচনা করিলেন।

 অনন্তর মহাশঙ্খধ্বনিদ্বারা উভয়পক্ষীয় সেনাধ্যক্ষগণ স্ব স্ব বিভাগকে উত্তেজিত করিলে পুনরায় বীরসমুদায় তুমুল নিনাদে পরস্পরের সহিত অতি ঘাের যুদ্ধে সঙ্ঘটিত হইলেন।

 ক্রমে ভীষ্ম পূর্ব্ববৎ পাণ্ডবসেনা বিদ্রাবিত করিতে আরম্ভ করিলে অর্জ্জুন কৃষ্ণকে কহিলেন—

 হে বাসুদেব! সত্বর পিতামহের সমক্ষে গমন কর। মহাবীর ভীষ্ম দুর্য্যোধনের হিতসাধনে একান্ত তৎপর, উহাকে নিবারণ না করিলে আমাদের সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হইবে, অতএব অদ্য উঁহার সহিত প্রাণপণ যুদ্ধ করিব।

 কৃষ্ণ সেই বাক্য অনুসারে রথ চালনা করতে আরম্ভ করিলে, অর্জ্জুন কৌরব-সৈন্যদিগকে সংহার করিতে করিতে ভীষ্মের রথাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। অনন্তর দুই তেজের সংস্পর্শনবৎ এই দুই মহাবীরের সংঘটনে অতি অদ্ভুত ব্যাপার হইল। চতুর্দ্দিকে সৈন্যমধ্যে এরূপ স্তুতিবাক্য শ্রুত হইতে লাগিল―

 অহো! কি আশ্চর্য যুদ্ধ হইতেছে। এরূপ সমর আর কখনও হয় নাই। মহাবীর পার্থ ভীষ্মকে পরাজয় করিতে পারিতেছেন না এবং দুর্দ্ধর্ষ ধনঞ্জয়ের ভীষ্মকর্ত্তৃক পরাস্ত হইবারও কোন সম্ভাবনা নাই। এরূপ সংগ্রাম আর কখনও হইবে না!

 শ্রেষ্ঠ ধনুর্দ্ধরগণ এই তুমুল যুদ্ধ উপলক্ষে এক স্থানে আবদ্ধ থাকায় মহাবল ভীমসেন সেই অবসর অবলম্বন করিয়া কৌবর-সেনামধ্যে মহা হুলস্থুল বাধাইয়া দিলেন। করীগণ তাঁহার ভীষণ খড়্গাঘাতে ঘােরতর চীৎকার করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল, এবং অশ্ব ও অশ্বারােহিগণ তাঁহার শরে মর্ম্মবিদ্ধ হইয়া দলে দলে ধরাতলে শয়ন করিতে লাগিল। বৃকোদর বিচিত্রগতি প্রদর্শন করিয়া লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক রথিগণকে পাতিত, এবং কাহাকে পদাঘাতে নিহত, কাহাকে বা আকর্ষণপূর্ব্বক প্রােথিত করিতে লাগিলেন। সেই ভীম মুর্ত্তি দর্শনে সকলে পলায়নপূর্ব্বক ভীষ্মের নিকট আশ্রয় লাভার্থে ধাবমান হইল।

 তখন কলিঙ্গদেশীয় ক্ষত্রিয়গণ ভীমসেনকে নিবারণ করতে আসিলে তিনি ধনুর্ব্বাণ গ্রহণপূর্ব্বক প্রথমত কলিঙ্গদেশাধিপতি ও তাঁহার রক্ষকগণকে এবং তৎপরে বহুসংখ্যক কলিঙ্গসেনাকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। ফলত তথায় রুধিরময়ী নদী প্রবাহিত হইল এবং সৈন্যগণ সাক্ষাৎ কালস্বরূপ ভীমসেনের অদ্ভুত যুদ্ধ অবলোকন করিয়া মহা হাহাকারধ্বনি করিতে লাগিল।

 সেই নিনাদ শ্রবণ করিয়া ভীষ্ম নিকটবর্ত্তী সৈন্যগণকে ব্যূহিত করিয়া স্বয়ং ভীমসেনকে নিবারণ করিবার জন্য ধাবমান হইলেন এবং ভীম-রক্ষক পাণ্ডবগণকে শরাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার অশ্ব বিনষ্ট করলেন।

 তখন মহাবীর সাত্যকি সহসা অগ্রসর হইয়া ভীষ্মের সারথিকে সংস্থার করিলে ভীমসেন সেই অবসরে শক্তি গদা ও বহুবিধ অস্ত্র প্রক্ষেপ করিতে করিতে সাত্যকির রথারোহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। ভীষ্মের অশ্বগণ সারথি অভাবে তাঁহাকে লইয়া মহাবেগে বণক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিল।

 ভীষ্মের অনুপস্থিতির সুযোগ অবলম্বন করিয়া মহাবীর অর্জ্জুন ও তাঁহার সমতেজা পুত্র অভিমন্যু পূর্ণ বিক্রম বিকাশপূর্ব্বক শত্রুগণের উপর নিপতিত হইলেন। দুর্য্যোধনের পুত্র লক্ষণকে একান্ত নিপীড়িত করায় স্বয়ং দুর্য্যোধন শ্রেষ্ঠ কৌরব-বীর-সমভিব্যাহারে তথায় উপস্থিত হইলেন। তখন অর্জ্জুনশরে শত শত নরপতি প্রাণত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল, এবং সৈন্যগণ একান্ত ত্রস্ত হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিলে কৌরব-ব্যূহ একেবারে শিথিল হইয়া পড়িল।

 ইতিমধ্যে মহামতি ভীষ্ম রণক্ষেত্রে প্রত্যাবর্ত্তনপূর্ব্বক এই দৃশ্য অবলোকন করিয়া দ্রোণাচার্য্যকে কহিলেন—

 হে দ্বিজোত্তম! এই দেখ ধনঞ্জয় কৌরব-সৈন্যমধ্যে অতি ভীষণ কার্য্য করিতেছেন, অদ্য আর সৈন্যগণকে পুনর্ব্যূহিত করিবার উপায় দেখিতেছি না; সূর্য্যও অস্তাচল-চূড়াবলম্বী হইয়াছেন; অতএব এক্ষণে অবহারের আদেশ প্রদানই কর্ত্তব্য।

 অনন্তর কৌরবসেনা যুদ্ধপরাঙ্মুখ হইলে কৃষ্ণার্জ্জুন মহা আনন্দে শঙ্খধ্বনি করিয়া সে দিবসের যুদ্ধকার্য্য শেষ করিলেন।

 পরদিনের যুদ্ধে অর্জ্জুনের ভীষণ প্রতাপ অসহ্য় হইয়া উঠিল। নীরদের বারিবর্ষণের ন্যায় কৌরবগণের উপর তিনি বাণ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহারাও ব্যথিত হইয়া পুনরায় পলায়নের উপক্রম করিল। তখন দুর্য্যোধন ক্ষুণ্ণমনে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন—

 হে পিতামহ! আপনি ও মহাস্ত্রবিৎ আচার্য্য থাকিতে কৌরবসেনা পলায়ন করিতেছে, ইহা নিতান্ত বিসদৃশ বোধ হইতেছে। আমাদের সমূহ বিপদ দেখিয়াও যখন উপেক্ষা করিতেছেন, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, পাণ্ডবগণকে অনুগ্রহপ্রদর্শন করাই আপনার উদ্দেশ্য। আপনার এই অভিপ্রায় পূর্ব্বে জানিতে পারিলে আমি কদাপি এ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতাম না।

 দুর্য্যোধনের এই বাক্য শ্রবণে ভীষ্ম ক্রোধভরে নয়নদ্বয় বিঘূর্ণনপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে রাজন! পাণ্ডবগণ যে দুর্জ্জয়-পরাক্রমশালী এ কথা তোমাকে আমি পূর্ব্ব হইতেই বার বার বলিয়াছি। যাহা হোক, আমি যে স্বীয় কর্ত্তব্য অবহেলা করিতেছি না, তাহা তুমি স্বচক্ষে অবলােকন কর।

 এই বলিয়া ভীষ্ম পুনরায় তরঙ্গায়িত মহাসমর-সাগরে অবগাহনপুর্ব্বক অতি আশ্চর্য্য কর্ম্মসকল সম্পাদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার মণ্ডলীকৃত শরাসন হইতে আশীবিষসদৃশ দীপ্তাগ্র শরনিকর মহাবেগে চতুর্দ্দিকে পতিত হইয়া পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণকে নিপাতিত করিতে লাগিল। সমরাঙ্গণস্থ বীরগণ ভীষ্মকে এই পূর্ব্বদিকে, এই পশ্চিমে, পরে উত্তরে এবং মুহুর্ত্তমধ্যে দক্ষিণে সন্দর্শন করিয়া বিস্মায়াপন্ন ও ভয়বিহ্বল হইলেন। এইরূপে পাণ্ডবসৈন্য নিহত হইতে থাকিলে ক্রমে সকলে অর্জ্জুনের সমক্ষেই পলায়নে প্রবৃত্ত হইল।

 মহাতেজা কৃষ্ণ তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া অর্জ্জুনকে ধিক্কার প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে ধনঞ্জয়! যদি মুগ্ধ না হইয়া থাক, তবে অবিলম্বে ভীষ্মকে প্রহার কর। ঐ দেখ, সিংহের ভয়ে ক্ষুদ্র মৃগের ন্যায় ভূপতিগণ ভীষ্মের প্রতাপে ইতস্তত পলায়ন করিতেছেন। তুমি সমরক্ষেে থাকিতে ইহা শোভন হইতেছে না।

 এই বলিয়া বাসুদেব অর্জ্জুনের রথ ভীষ্মের সম্মুখীন করিলে আবার সেনাপতিদ্বয়ের ঘাের যুদ্ধ উপস্থিত হইল। অর্জ্জুন হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক পিতামহকে নিবারণ করিয়া বারম্বার তাঁহার শরাসন ছেদন করায় ভীষ্ম অতিশয় প্রীতমনে ধনঞ্জয়কে ভূরি ভূরি সাধুবাদ প্রদান করিলেন। বৃদ্ধ পিতামহের আশ্চর্য্য যুদ্ধকৌশল ও উৎসাহ দর্শনে চমৎকৃত হলেন এবং তাঁহাকে অধিক পীড়ন করিতে ইচ্ছা করিলেন না। কিন্তু ভীষ্ম অর্জ্জুন কর্ত্তৃক নিবারিত হইলে পাণ্ডবপক্ষীয় সেনাধ্যক্ষগণ অবসর পাইয়া শত্রুগণকে অতিশয় ব্যথিত করিলেন। অবশেষে কৌরবগণের অযুত রথ ও সপ্তশত গজ এবং প্রাচাসৌবীর ও ক্ষুদ্রক-দেশীয় যােদ্ধৃগণ সমূলে বিনষ্ট হইলে দুর্য্যোধনের সৈন্যগণ একান্ত হতাশ্বাস হইয়া পড়িল এবং সেনানায়কগণ দুর্য্যোধনের অনুমতিক্রমে অবহারের আদেশ প্রদান করিলেন।

 এইরূপে প্রতিদিন ভীষ্ম পাণ্ডবসৈন্য বিনষ্ট করিতে আরম্ভ করিলেই তিনি অর্জ্জুনকর্ত্তৃক নিবারিত হইতেন অবহারের সময় পাণ্ডববিজয়বার্ত্তায় কৌরবগণ একান্ত হতাশ্বাস হইতেন। দুর্য্যোধন ক্রোধপরিপূর্ণ হৃদয়ে পিমহের প্রতি পক্ষপাতিতার দোষারোপ করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। কিন্তু মহাত্মা গাঙ্গেয় সে সকল অভিযোগ তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া সুগভীর বৈরাগ্যভরে স্বীয় কর্ত্তব্য পালন করিয়া চলিতেন।

 অনন্তর অষ্টম দিবসের যুদ্ধ চলিতেছে―এমন সময়ে অর্জ্জুনের অপরা-স্ত্রী নাগকন্যা উলুপীর গর্ভজাত পুত্র ইরাবান্ সহসা উপস্থিত হইল। এই প্রিয়দর্শন বালক মাতৃগৃহে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হইয়াছিল, এক্ষণে যুদ্ধসংবাদ প্রাপ্ত হইয়া বহুসংখ্যক নাগসৈন্য পরিবৃত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইল এবং কৌরবসেনা বিনষ্ট করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া শকুনি অধিকৃত সৌবল-সৈন্যদলের উপর নিপতিত হইল। গান্ধারগণ ইরাবানকে চতুর্দ্দিক্ হইতে পরিবৃত করিয়া নানা স্থানে সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রে বিদ্ধ করিয়া তাহার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করিল, কিন্তু ইরাবান্ তাহাতে ব্যথিত না হইয়া বরং অধিক ক্রোধাবিষ্টচিত্তে দুর্য্যোধন-প্রেরিত শকুনির রক্ষকগণের আগমন সত্বেও গান্ধারবীরগণকে ক্রমাগত বিনাশ করিতে লাগিল। একমাত্র শকুনি বারম্বার পরিরক্ষিত হইয়া পরিত্রাণ লাভ করিলেন।

 তখন দুর্য্যোধন অতিশয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভীমকর্ত্তৃক নিহত বক-নামক রাক্ষসের অনুচর আর্য্যশৃঙ্গকে ইরাবানের সংহারার্থে প্রেরণ করিলেন। সেই নিশাচর তথায় উপস্থিত হইলে, ইরাবান্ খড়্গদ্বারা তাহার কার্ম্মুক বিনষ্ট করিয়া তাহাকে বিশেষরূপে আহত করিল। রাক্ষস তখন মায়াযুদ্ধ অবলম্বন করিয়া আকাশমার্গে উত্থিত হইল কিন্তু তথায়ও ইরাবান্ তাহাকে শরনিকরে একান্ত ব্যথিত করিলে আর্য্যশৃঙ্গ অতি ঘোররূপ পরিগ্রহ করিয়া বালক ইরাবানকে বিমোহিত করিল এবং সেই অবসর প্রাপ্ত হইয়া সুতীক্ষ্ণ অসিদ্বারা তাহার কিরীট-শোভিত সুন্দর বদনমণ্ডল ভূতলে নিপাতিত করিল।

 তখন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ অতিশয় হৃষ্ট হইলেন। কিন্তু অর্জ্জুন স্থানান্তরে শত্রু-নিপাতনে ব্যাপৃত ছিলেন বলিয়া তিনি এ ঘটনার কিছুই জানিতে পারেন নাই। ভীমসেনের পুত্র ঘটোৎকচ ভ্রাতা ইরাবানের মৃত্যু সন্দর্শনে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া রাক্ষসবৃন্দ লইয়া একেবারে দুর্য্যোধনকে আক্রমণ করিল। তাহার হস্ত হইতে দুর্য্যোধনকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত মহাবীর বঙ্গাধিপতি বহুসংখ্যক গজসৈন্য লইয়া তাঁহাকে বেষ্টন করিলে, অতি ঘােরতর যুদ্ধ চলিতে লাগিল। রাজা দুর্য্যোধন জীবিতাশা পরিত্যাগ করিয়া সেই রাক্ষসবৃন্দের প্রতি নিশিত শরসমূহ নিক্ষেপপূর্ব্বক তাহাদের প্রধান প্রধান অনেককে বিনষ্ট করিলেন। তখন ঘটোৎকচ একান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া দুর্য্যোধনের প্রতি এক অনিবার্য্য মহাশক্তি নিক্ষেপ করিলে বঙ্গরাজ দুর্য্যোধনের সমূহ বিপদ দেখিয়া সহসা স্বীয় রথদ্বারা তাঁহাকে আচ্ছাদনপূর্ব্বক নিজগাত্রে সেই শক্তি গ্রহণ করিয়া অকাতরে প্রাণত্যাগ করিলেন।

 সেই সময়ে ভীষ্ম দুর্য্যোধনকে রাক্ষসপরিবৃত দেখিয়া দ্রোণ-সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে আচার্য্য! ঐ দেখ দুর্য্যোধনের বিভাগে অতি ঘাের রাক্ষসধ্বনি শ্রুত হইতেছে; অতএব এই নিশাচরের হস্ত হইতে উহাকে রক্ষা না করিলে নিস্তার নাই।

 এই বলিয়া বহুসংখ্যক মহারথ-সমভিব্যাহারে ভীষ্ম ও দ্রোণ দুর্য্যোধনের সাহায্যার্থে গমন করিলেন। তথায় দেখিলেন রাক্ষসগণের মায়াযুদ্ধপ্রভাবে শােণিতাক্ত কৌরবগণ অতিশয় ভীত ও বিবর্ণ হইয়া পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিতেছেন এবং প্রধানগণের এই দুরবস্থা দর্শনে অনেকে পলায়ন করিতেছে। ভীষ্ম বারম্বার আক্ষেপ প্রকাশপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে যোদ্ধৃগণ! তােমরা রাজা দুর্য্যোধনকে রাক্ষসহস্তে ফেলিয়া পলায়ন করিও না।

 কিন্তু তাহারা নিতান্ত বিমোহিত হওয়ায় কেহ তাঁহার কথা রক্ষা করিল না। তখন ভীষ্ম বিষণ্ণবদন দুর্য্যোধনকে কহিলেন―

 হে রাজন্! তােমার নিজেকে এরূপ বিপদ্‌মুখে পতিত করা উচিত নহে। রাজার সর্ব্বদাই যত্নপূর্ব্বক আত্মরক্ষা করিয়া যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য। আমরা সকলেই তোমার কার্য্য সাধনোদ্দেশে এখানে উপস্থিত আছি। যদি কাহারও প্রতি বিশেষ ক্রোধের সঞ্চার হয়, তবে উপযুক্ত কোন বীরপুরুষকে তাহার বিরুদ্ধে নিয়ােগ করা বিধেয়।

 এই বলিয়া ভীষ্ম মহাবীর ভগদত্তকে কহিলেন—

 হে মহারাজ! তুমি পূর্ব্বে অতি অদ্ভুত পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছ; অতএব তুমিই ঘটোৎকচের উপযুক্ত প্রতিযােদ্ধা হইবে। এক্ষণে তুমি অবিলম্বে সেই বলদৃপ্ত নিশাচরকে নিবারণ কর।

 ভগদত্তকে এইরূপে নিয়ােগ করিয়া ভীষ্ম দুর্য্যোধনকে নিরাপদ স্থানে স্থাপনপূর্ব্বক পুনরায় যুদ্ধকার্য্যে ব্যাপৃত হইলেন।

 ইতিমধ্যে অর্জ্জুন ভীমসেনের নিকট স্বীয় তনয় ইরাবানের যুদ্ধে আগমন, বিক্রমপ্রদর্শন ও শােচনীয়, মৃত্যুর সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া একান্ত শোকাবিষ্ট হইয়া কৃষ্ণকে কহিলেন—

 হে মধুসূদন! এই সমাগত জ্ঞাতি ও বন্ধুবিনাশে আমাদের কি লাভ হইবে? এক্ষণে বিলক্ষণ উপলব্ধি করিতেছি, ধর্ম্মরাজ কি নিমিত্ত পঞ্চগ্রাম মাত্র রাখিয়া বিবাদ ভঞ্জনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। ক্ষিত্রিয়বৃত্তিতে ধিক্! যে হেতু অর্থলাভার্ধে দয়িত ব্যক্তির মৃত্যু সম্পাদন করিতে হয়। যাই হোক, এতদূর অগ্রসর হইয়া আর প্রত্যাবর্ত্তনের উপায় নাই, অএব আর বৃথা কালবিলম্বে প্রয়োজন নাই। আমাকে শীঘ্র ভীষণতম যুদ্ধস্থলে লইয়া চল।

 অর্জ্জুনের বাক্যানুসারে দ্রোণাদি-মহারথ-রক্ষিত ভীষ্ম যেখানে নির্দ্দয়রূপে পাণ্ডবসেনা সংহার করিতেছিলেন, বাসুদেব তথায় রথ উপনীত করিলেন। তখন ক্ষুব্ধ ধনঞ্জয়ের সাতিশয় উত্তেজিত যুদ্ধ-প্রকোপে শ্রেষ্ঠ কৌরবগণ নিবারিত ও আত্মরক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত হইলে, পাণ্ডব-সেনাধ্যক্ষগণ অবসর প্রাপ্ত হইয়া যুদ্ধের গতি বিবর্ত্তনপূর্ব্বক কৌরবগণকে অত্যন্ত পীড়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।

 ভীমসেন এই সুযোগে ব্যূহ-ভেদ করিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে প্রাপ্ত হইয়া তাহাদিগকে নির্ম্মমভাবে একে একে যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিলেন, সে সময়ে কেহই তাহাদিগকে রক্ষা করিতে সমর্থ হয় নাই।

 ক্রমে ভীমার্জ্জুনের ভীষণ যুদ্ধপ্রভাবে শােণিত-লিপ্ত কাঞ্চনময় কবচ, সুবর্ণপুঙ্খ শর, কিঙ্কিণী-জাল-জড়িত ভগ্ন রথ, পাণ্ডুবর্ণ ধ্বজ এবং ছিন্নবিচ্ছিন্ন হস্তী-অশ্ব-নর-কলেবরে আচ্ছাদিত হইয়া রণস্থল অতিশয় অদ্ভুত রূপ ধারণ করিল।

 অনন্তর সূর্য্যাস্তের পর ঘোর অন্ধকার সমুপস্থিত হইলে, হতাবশিষ্ট কৌরবসৈন্য শ্রান্তদেহে ও ভগ্নোৎসাহে শিবিরাভিমুখে প্রস্থান করিল। পাণ্ডবগণও বিজয়ােৎফুল্ল-চিত্তে সৈন্য অবহার করিলেন।

 অনন্তর প্রভাত হইলে মহাবীর শান্তনু-নন্দন সমভিব্যাহারে যুদ্ধার্থে বহির্গত হইয়া ব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়া তাহার মুখে স্বয়ং অবস্থান করিলেন এবং যুধিষ্ঠিরের বল প্রতিব্যূহিত হইলে তিনি জীবিতাশা পরিহারপূর্ব্বক প্রজ্জ্বলিত দাবানলের ন্যায় শত্রুবলকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে সুতীক্ষ্ণ শস্ত্রসমূহে পাণ্ডবসেনা সমাচ্ছন্ন হইল এবং পাণ্ডবপক্ষের রথ গজ ও অশ্বসকল আরোহিবিহীন হইতে লাগিল।

 ক্রমে বজ্র-নির্ঘোষ তুল্য তাঁহার জ্যা-তল-ধ্বনি পাণ্ডবযোদ্ধৃগণের নিতান্ত ভীতিজনক হইয়া উঠিল এবং যখন সােমক সৈন্যদল নিঃশেষে নিহতপ্রায় হইল, তখন মহারথগণ ভীষ্মবাণে গাঢ় বিদ্ধ হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলে, কেহই তাহাদিগকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইল না।

 তাঁহারা এইরূপ ভয়বিহ্বল হইয়াছিলেন যে কোন দুইজনকে আর একত্র দেখা যাইতেছিল না এবং চতুর্দ্দিক হইতে কেবল আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইতে লাগিল। তখন বাসুদেব সৈন্যগণের তদবস্থা দেখিয়া এবং অর্জ্জুনকে পিতামহের দেহে আঘাত করিতে উদাসীন দেখিয়া নিতান্ত উদ্বিগ্নচিত্তে রথ স্থগিত করিয়া কহিলেন—

 হে পার্থ! তুমি সভাস্থলে ভীষ্ম-বধের প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে, এক্ষণে ক্ষত্রিয় হইয়া কিরূপে নিজবাক্য মিথ্যা করিতেছ? তুমি ক্ষত্রধর্ম্ম স্মরণপূর্বক সন্তাপ পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর।

 অর্জ্জুন বন্ধুর প্রতি তির্য্যক্‌ দৃষ্টিপাতমাত্র করিয়া অধোমুখে কহিলেন—

 হে কৃষ্ণ! যদি অবধ্য দিগকে বধ করিয়া নরক-যন্ত্রণাই ভোগ করিতে হইল, তবে সামান্য অরণ্য-বাস-ক্লেশে আমরা কাতর হইলাম কেন? যাহা হউক, তোমার উপদেশানুসারে যুদ্ধারম্ভ করিয়াছি, তোমার কথা অনুসারেই যুদ্ধ চালাইব, অতএব যথায় অভিলাষ অশ্বচালনা কর।

 তখন বাসুদেব ভীষ্ম-সমীপে অর্জ্জুনকে উপনীত করিলে ধনঞ্জয় অতিশয় অপ্রবৃত্তি-সহকারে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন, সুতরাং তাঁহার মৃদুযুদ্ধহেতু ভীষ্ম প্রভূত অবসর প্রাপ্ত হইয়া পাণ্ডব-বলক্ষয়-কার্য্য অবাধে চালাইতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যসংখ্যা ক্রমাগতই হ্রাস হইতেছে, তথাপি অর্জ্জুনের অনিচ্ছাপ্রেরিত লঘুবাণে তাহার কিছুমাত্র প্রতিকার হইতেছে না দেখিয়া কৃষ্ণ ক্রোধান্ধ ও স্বীয় প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হইয়া রথ হইতে লম্ফ প্রদান ও স্বীয় সুদর্শনচক্র বিঘূর্ণনপূর্ব্বক ভীষ্মকে আক্রমণার্থ পদব্রজেই ধাবিত হইলেন।

 তদ্দর্শনে অর্জ্জুন অত্যন্ত লজ্জিত ও প্রিয়বন্ধুর নিরাশ্রয়ভাবে শত্রুমধ্যে গমনে শঙ্কিত হইয়া সত্বর রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক তৎপশ্চাতে ধাবিত হইলেন এবং কৃষ্ণ শতপদ অগ্রসর না হইতেই তাঁহার বাহুযুগল ধারণ করিলেন, কিন্তু ক্রোধ-প্রজ্বলিত বাসুদেব ধৃত হইলেও অর্জ্জুনকে আকর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে লইয়াই বেগে গমন করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন নিরুপায় হইয়া তাঁহার পদদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক অতি বিনীতচনে সেই আরক্তনয়ন বীরকে কহিলেন—

 হে মহাবাহো! নিবৃত্ত হও, তুমি যুদ্ধে যােগদান করিয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিলে তোমার চিরস্থায়ী অকীর্ত্তি এবং তন্নিমিত্ত আমার লজ্জার সীমা থাকিবে না। আমার প্রতি যখন সমস্ত ভার অর্পিত আছে, তখন আমিই পিতামহকে সংহার করিব।

 কৃষ্ণ অর্জ্জুনের বাক্যে কোন প্রত্যুত্তর না করিয়া আশীবিষের ন্যায় শ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে পুনরায় রথারােহণ করিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে ভীষ্ম সৈন্যদলকে এতই উৎপীড়ন করিয়াছিলেন যে, তাহারা কেহই সে স্থানে আর অবস্থান করিতে সক্ষম হয় নাই। যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনের ঔদাসীন্যহেতু একান্ত বিষণ্ণচিত্ত হইয়া এবং সূর্য্যাস্তকাল আগতপ্রায় দেখিয়া আর বিলম্ব না করিয়াই অবহারের আদেশ করিলেন।

 সেই রাত্রে যুধিষ্ঠির সকলকে মন্ত্রণার্থে আহ্বান করিয়া কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন―

 হে বাসুদেব! দেখ উগ্রপরাক্রম পিতামহ মাতঙ্গের নলবনদলনের ন্যায় আমার সেন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিতেছেন; আমাদের এমন সামর্থ্য নাই যে তাঁহাকে নিবারণ করি। এক্ষণে আমি বুদ্ধির দুর্ব্বলতা বশত ভীষ্মের প্রতাপে শােকসাগরে নিমগ্ন হইতেছি, উদ্ধারের কোন উপায় দেখিতেছি না। অতএব যুদ্ধে আমার আর স্পৃহা নাই। আমি যদি তোমাদের অনুগ্রহের যােগ্য হই, তবে এ সম্বন্ধে হিতকর উপদেশ প্রদান কর।

 কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাতরতা দেখিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়ায় কহিলেন―

 হে ধর্ম্মরাজ! তােমার ভ্রাতা দুর্জ্জয় ভীমার্জ্জুন এবং তেজস্বী নকুল সহদেব থাকিতে বিষাদ করিও না। অথবা যদি অর্জ্জুন নিতান্ত যুদ্ধ ইচ্ছা না করেন, তবে আমাকে আদেশ কর, আমি অস্ত্রধারণপূর্ব্বক কুরুপ্রবীর ভীষ্মের সহিত যুদ্ধ করি। তোমাদের শত্রুই আমার শত্রু, তোমাদের বিপদই আমার বিপদ। অর্জ্জুন আমার প্রিয়তম সখা, তাঁহার কার্য্যে আমি অনায়াসে প্রাণদান করিতে পারি। অর্জ্জুন সকলের সমক্ষে ভীষ্ম বধের প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন; এক্ষণে যদি তাহা রক্ষা করিবার প্রবৃত্তি না হয়, তবে আমি তাঁহার সে প্রতিজ্ঞা ভার বহন করিব।

 যুধিষ্ঠির এই বাক্যে প্রীত হইয়া কহিলেন―

 হে মহাবাহো! তুমি যখন আমার পক্ষে অবস্থান করিতেছ, তখন আমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ হইবে সন্দেহ কি? কিন্তু তোমাকে যুদ্ধকার্য্যে নিয়ােগ করিয়া আত্মগৌরবের নিমিত্ত তােমাকে মিথ্যাবাদী করিতে আমার ইচ্ছা হয় না। মহামতি ভীষ্ম দুর্য্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করিতেছেন, কিন্তু যুদ্ধারম্ভের পূর্ব্বে তিনি বলিয়াছিলেন, যে, আমার হিতার্থে মন্ত্রণাদান করিবেন; অতএব আইস, সকলে মিলিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হই।

 বাসুদেব কহিলেন—মহারাজ! আপনার বাক্য আমার মনোমত হইতেছে। ভীষ্মকে স্বীয় বধোপায় জিজ্ঞাসা করিলে আমাদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই সিদ্ধ হইবে।

 এরূপ স্থির হইলে কৃষ্ণসহ পাণ্ডবগণ অস্ত্র ও কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীষ্ম-শিবিরে গমন করিলেন এবং তথায় প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে অর্চ্চনাপূর্ব্বক শরণাপন্ন হইলেন। ভীষ্ম তাঁহাদের দর্শনলাভে অতিশয় প্রীত হইয়া স্নেহবচনে কহিলেন―

 ইে ধর্ম্মরাজ! ভীমসেন! কেশব! ধনঞ্জয়! নকুল! সহদেব! তোমাদের প্রীতিবর্দ্ধন কোন্ কার্য্য করিতে হইবে?

 তখন দীনাত্মা রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন―

 হে পিতামহ! আপনি নিয়তই শরজাল বর্ষণ করিয়া আমার বিপুল সৈন্য ক্ষীণ করিতেছেন, অথচ আমরা আপনার অনিষ্টাচরণে সক্ষম নহি; অতএব আমাদের পক্ষে কি রূপে কল্যাণ লাভ হইতে পারে, তাহা উপদেশ করুন।

 স্নেহভাজন ও ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবগণের প্রতিনিয়ত অনিষ্টাচরণ করিয়া এবং তদুপরি অশিষ্ট দুর্য্যোধনেৱ মর্ম্মভেদী সন্দেহব্যঞ্জক বাক্যযন্ত্রণা সহ্য করিয়া করিয়া ভীষ্মের সুগভীর বৈরাগ্য-প্রভাবে জীবন ধারণের ইচ্ছা সম্পূর্ণ তিরােহিত হইয়াছিল, সুতরাং তিনি প্রসন্নমনে কহিলেন―

 হে পাণ্ডবগণ! আমি জীবিত থাকিতে তােমাদের জয়লাভের সম্ভাবনা নাই; অতএব আমি অনুমতি করিতেছি তােমরা স্বচ্ছন্দে আমাকে প্রহার করিও। তোমরা যে আমার সম্মান রক্ষা করিয়াছ ইহাতেই আমি পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে আমাকে সংহার না করিলে এ যুদ্ধের আর শেষ হবে না। হে যুধিষ্ঠির! তােমার সৈন্য মধ্যে শিখণ্ডিনামক যে দ্রুপদতনয় আছে, সে প্রকৃতপক্ষে পুরুষত্বপ্রাপ্ত নারী; অতএব তাহার প্রতি আমি অস্ত্রপ্রয়ােগ করিতে পারি না। এই বৃত্তান্তু অবগত হইয়া তোমরা আমার বধের নিমিত্ত উপযুক্ত উপায় বিধান করিও। ইহাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ।

 পিতামহকে পরাজয় করিবার উপায় অবগত হইয়া যুধিষ্ঠির মহাত্মা ভীষ্মকে অভিবাদনপূর্ব্বক কৃষ্ণ ও ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে স্বশিবিরে প্রত্যাগমন করিলেন। কিন্তু অর্জ্জুন প্রাণ-পরিত্যাগ-সমুদ্যত পিতামহের বাক্য শ্রবণে দুঃখ-সন্তপ্ত ও লজ্জিত হইয়া কৃষ্ণকে কহিলেন—

 সখে! বাল্যকালে ক্রীড়া করিতে করিতে ধূলিঅনুলিপ্ত-কলেবরে যাঁহাকে পিতা সম্বোধন করিলে যিনি বলিতেন― আমি তোমার পিতা নহি, তোমার পিতার পিতা—সেই বৃদ্ধ পিতামহকে কি প্রকারে কঠিন আঘাত করিব, কি প্রকারেই বা সংহার করিব? তিনি আমার সৈন্যসমুদায় বিনাশই করুন, আমার পরাজয় বা মৃত্যুই হউক, আমি তাহা কিছুতেই করিতে পারিব না।

 কৃষ্ণ বলিলেন―হে ধনঞ্জয়! তুমি ভীষ্মকে বধ করিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, ক্ষত্রিয় হইয়া তাহা তোমার লঙঘন করিবার উপায় নাই। তাহা ছাড়া তুমি বিবেচনা করিয়া দেখ, ভীষ্মের এ সময়ে নিশ্চয়ই মৃত্যুকাল উপস্থিত হইয়াছে, নহিলে তিনি তোমাদিগকে এরূপ উপদেশ প্রদান করিতেন না। তােমা-ব্যতীত কেহই তাঁহাকে সংহার করিতে সক্ষম হইবে না; অতএব তুমি সমরস্থলে আপনাকে কালের নিমিত্তস্বরূপ-মাত্র জ্ঞান করিয়া গুরুজন বা দয়িত ব্যক্তি নির্ব্বিচারে সম্মুখীন আততায়ীকে বধ করিবে।

 অর্জ্জুন কহিলেন—হে কৃষ্ণ! যদি নিতান্তই কর্ত্তব্য হয়, তবে শিখণ্ডিই পিতামহের বধসাধন করুন। তাঁহাকে সমক্ষে দেখিলে মহামতি ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করিবেন, ভীষ্মের মহারথ রক্ষকগণ হইতে আমি স্বয়ং শিখণ্ডিকে রক্ষা করিব, অতএব এ কার্য্য তাঁহার অনায়াসসাধ্য হইবে।

 বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ অর্জ্জুনের এই বাক্যে হৃষ্টচিত্তে সম্মত হইয়া স্ব স্ব বিশ্রাম-গৃহে প্রবেশ করিলেন।

 অনন্তর যুদ্ধের দশম দিবস উপস্থিত হইলে পাণ্ডবগণ ভীষ্মবধে কৃতসংকল্প হইয়া দুর্ভেদ্য ব্যূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক শিখণ্ডিকে তাহার অগ্রে স্থাপন করিলেন। ভীমসেন ও অর্জ্জুন তাঁহার দুই পার্শ্ব এবং অভিমন্যু পৃষ্ঠদেশ রক্ষা করিতে লাগিলেন। সেনানায়কসকলে স্ব-স্ব সৈন্যবিভাগ লইয়া ইঁহাদিগকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিলেন এবং এইরূপে ব্যূহিত হইয়া ভীষ্মকে আক্রমণার্থে শত্রুসৈন্যাভিমুখে অল্পে অল্পে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

 অর্জ্জুন মুহুর্মুহু জ্যাবিক্ষেপ ও শরপরম্পরা বর্ষণ করিতে করিতে পথরোধক যােদ্ধাদিগকে ত্রাসিত করিলে তাঁহাদের গতির কোন বিঘ্ন রহিল না। তখন দুর্য্যোধন ভীষ্মকে কহিলেন―

 হে পিতামহ! সৈন্যগণ শত্রুশরে অতিশয় উৎপীড়িত হইতেছে; অতএব আপনি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া উহাদিগকে রক্ষা করুন।

 ভীষ্ম পাণ্ডবব্যূহের অগ্রভাগে শিখণ্ডিকে দেখিয়া দুর্যোধনকে কহিলেন—

 হে রাজন! আমি সাধ্যমত পাণ্ডবসেনা বিনাশ করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, সে প্রতিজ্ঞা আমি অদ্যাবধি পালন করিয়া আসিয়াছি, আজি আমি মহৎকর্ম্ম সম্পাদনান্তে সেনামুখে প্রাণত্যাগ করিয়া স্বামিপ্রদত্ত অন্নের ঋণ হইতে বিমুক্ত হইব।

 এই কথা বলিয়া ভীষ্ম পাণ্ডব-সৈন্য-মধ্যে অবগাহনপূর্ব্বক আত্মশক্তি পূর্ণমাত্রায় বিকাশ করিয়া শত শত বীরকে ধরাশায়ী করলেন। দুর্য্যোধনও মহতীসেনা-সমভিব্যাহারে ভীষ্মের নিকট অবস্থান পূর্ব্বক তাঁহাকে পদে পদে রক্ষা করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডব-বল-রক্ষিত শিখণ্ডি অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিলে অশ্বত্থামা সাত্যকির প্রতি, দ্রোণাচার্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি, জয়দ্রথ বিরাটের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং ক্রমে উভয়দলের রক্ষকগণ পরস্পরের গতিরােধ করিয়া ঘাের যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।

 সমগ্র ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী সঞ্জয় সেই দিন সন্ধ্যার পর রণক্ষেত্র হইতে প্রত্যাগমনপুর্ব্বক ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিলেন—

 মহারাজ! আমি সঞ্জয়! আপনাকে অভিবাদন করি। কুরুপিতামহ ভীষ্ম অদ্য নিপতিত হইয়াছেন! যিনি যোদ্ধৃগণের অগ্রগণ্য ও কুরুবীরগণের আশ্রয়স্থল, সেই ভীষ্ম আজি শিখণ্ডির সহিত যুদ্ধে শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন।

 ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন―হে সঞ্জয়! ভীষ্ম নিহত বলিয়া কি প্রকারে তুমি আমার নিকট ব্যক্ত করিতেছ? দেবগণের ও দুরাসদ সেই অতিরথ ভীষ্মকে পাঞ্চাল্য শিখণ্ডি কি প্রকারে যুদ্ধে নিহত করিল?

 সঞ্জয় পূর্ব্বরাত্রে ভীষ্মের নিকট পাণ্ডবগণের আগমন ও তাঁহার উপদেশানুযায়ী ব্যূহ রচনা ও যুদ্ধাস্তু যথাযথরূপে বর্ণনা করিয়া কহিতে লাগিলেন―

 যখন শিখণ্ডিপুরস্কৃত পাণ্ডববলের সহিত কৌরববেষ্টিত ভীষ্মের সংঘটন হইল, তখন অতি ঘাের যুদ্ধ হইতে আরম্ভ হইল।

 ―ক্রমে ভীমার্জ্জুন আমাদের সৈন্য বিনষ্ট করিতে করিতে ব্যূহমুখের নিকটবর্ত্তী হইলে তাঁহাদের রক্ষিত শিখণ্ডির রথ ভীষ্মের রথসমীপে অগ্রসর হইবার পথ প্রাপ্ত হইল। তখন অর্জ্জুন কহিলেন—

 —হে শিখণ্ডি। এই সুযোগে ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হও, অন্য কোন চিন্তায় এক্ষণে প্রয়োজন নাই।

 —এই বাক্যানুসারে শিখণ্ডি ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে নিশিত বাণসকল বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আপনার পিতা তাঁহার প্রতি অবজ্ঞাদৃষ্টি করিলেন মাত্র। সকলেই দেখিতে পাইলেন যে, ভীষ্ম শিখণ্ডিকে কোনরূপ প্রত্যাখাত না করিয়া পূর্ব্ববৎ অন্যান্য যোদ্ধৃগণের উপর বাণ বর্ষণ করিতে থাকিলেন।

 —কিন্তু শিখণ্ডি এ বৃত্তান্ত বুঝিতে পারেন নাই। যাহাতে বুঝিবার অবসর না প্রাপ্ত হন, এই নিমিত্ত অর্জ্জুন ক্রমাগত উৎসাহবাক্যে তাঁহাকে উত্তেজিত করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 ―হে শিখণ্ডি! এক্ষণে ভীষ্মকে বিনাশ করিতে যত্নবান্ হও। তোমা ব্যতীত এ বৃহৎ সৈন্যমধ্যে আর এমন যোদ্ধা দেখি না, যে এই মহৎকার্য্য সাধনের উপযুক্ত। অদ্য তুমি নিষ্ফল হইলে আমরা উভয়েই হাস্যাস্পদ হইব।

 ―তখন শিখণ্ডি বলমদোন্মত্ত চিত্তে ভীষ্মকে শরজালে আবৃত করিলেন, কিন্তু এই লঘুবাণে আপনার পিতা কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া হাস্যসহকারে তাহা শরীরে ধারণ ও অবিচলিত উৎসাহে পাণ্ডবসৈন্য বিনাশ করিতে লাগিলেন। শিখণ্ডিকে অর্জ্জুনবাণে সুরক্ষিত দেখিয়া দুর্য্যোধন কহিলেন―

 ―হে যোদ্ধৃগণ। তোমরা অবিলম্বে ধনঞ্জয়কে আক্রমণ কর, ভীষ্ম তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন।

 এই আদেশানুসারে ভূপতিগণ হুতাশনের প্রতি পতঙ্গবৎ অর্জ্জুনের প্রতি ধাবিত হইলেন। কিন্তু তাঁহার মহাবেগশালী অস্ত্রসমূহের প্রতাপে একান্ত দগ্ধ হইয়া কেহ বা প্রাণত্যাগ কেহ বা পলায়ন করিলেন। অর্জ্জুন পূর্ব্ববৎ শরাকর্ষণদ্বারা ভীষ্মের রক্ষকগণের অস্ত্রাঘাত হইতে শিখণ্ডিকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখলেন।

 ―অনন্তর আপনার পিতা শিখণ্ডির এবং অন্যান্য যোদ্ধার বাণে চতুর্দ্দিক্ হইতে আহত ও অতিশয় তাপিত হইয়া মৃত্যুকাল আগত প্রায় জানিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা একেবারে বিসর্জ্জন দিয়া ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ ও অসিগ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতরণ করিলেন। তখন করুণার্দ্রহৃদয় অর্জ্জুন শিখণ্ডির ব্যর্থ লঘুবাণে পিতামহকে অনর্থক অধিকক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে একে একে পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকদ্বারা অতিগাঢ় বিদ্ধ করিলেন, তখন কুরুপিতামহ ভীষ্ম স্খলিত অঙ্গ ও বিকলৈন্দ্রিয় হইয়া পার্শ্বস্থিত দুঃশাসনকে কহিলেন—

 —হে দুঃশাসন! এই যে বাণসকল দৃঢ় বর্ম্ম ভেদ করিয়া আমার মর্ম্মস্থল বিদ্ধ করিতেছে, ইহা কখনই শিখণ্ডিপ্রক্ষিপ্ত নহে। এই যে ব্রহ্মদণ্ডসমস্পর্শ বজ্রবেগের ন্যায় দুর্বিষহ শরনিকর আমার শরীর ভগ্ন করিতেছে, ইহা শিখণ্ডি-হস্তমুক্ত হইতেই পারে না। এই যে জাতক্রোধ লেলিহান আশীবিষের ন্যায় বিশিখজাল আমার মর্ম্মস্থানসমুদায়ে প্রবেশপূর্ব্বক প্রাণবিনাশ করিতেছে, ইহা অর্জ্জুনেরই গাণ্ডীব-নিঃসৃত তাহাতে সন্দেহ নাই। গাণ্ডীবধন্বা ব্যতীত কেহই আমাকে ধরাশায়ী করিতে সক্ষম নহে।

 ―এই কথা বলিতে বলিতে মহাত্মা কুরুবৃদ্ধ ধীরে ধীরে ভূপতিত হইলেন। কিন্তু তাঁহার শরীর শরসমূহে এরূপ ঘনবিদ্ধ হইয়াছিল, যে তাহা ধরাস্পর্শ করে নাই। আপনার পিতা পতিত হইয়াও বীরোচিত শরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন।

 হে মহারাজ! সেই মহাবীরের দেহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও চিত্ত পতিত হইল, সেই সূর্য্যপ্রভ মহাত্মার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সকল আশা ভরসা অস্তমিত হইল।

 ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন―আমারই দুর্ব্বুদ্ধিপ্রযুক্ত অদ্য আমি পিতাকে নিহত শুনিয়া যে দুঃখ লাভ করিলাম, ইহা অপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে? আমার হৃদয় নিশচয়ই পাষাণে নির্ম্মিত, নচেৎ এই শোচনীয় সংবাদে তাহা শতধা বিদীর্ণ হইল না কেন? ঋষিগণ ক্ষত্রধর্ম্মকে কি নিদারুণ করিয়া প্রদর্শন করিয়াছেন, যাহা অবলম্বন করিয়া আমরা সেই মহাত্মাকে নিহত করাইয়া রাজ্য অভিলাষ করিতেছি এবং পাণ্ডবগণও তাঁহাকে নিহত করিয়া রাজ্য প্রার্থী হইয়াছেন। পারগামীর নৌকা অগাধ সলিলে নিমগ্ন হইলে যেরূপ হয়, ভীষ্মের মৃত্যুতে আমার পুত্রগণের নিশ্চয় তদ্রূপই বোধ হইতেছে। হায়! ভীষ্মের অভাবে এক্ষণে দুর্য্যোধন কাহাকে অবলম্বন করিবেন? হে সঞ্জয়! পুত্রের বিনাশজন্য মহাশােকানল আমার অন্তঃকরণে আরূঢ় হইয়াছিল, তুমি যেন ঘৃতদ্বারা সেই অগ্নি উদ্দীপিত করিয়া দিলে। এক্ষণে সেই যুদ্ধেরভূষণ ভীম কর্ম্মা পিতার নিধনবার্ত্তা শুনিয়া আমার আর বাঙ্‌নিষ্পত্তির শক্তি নাই।

 এদিকে কুরুসেনাপতি ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান হইলে, কৌরবগণ ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া কিয়ৎক্ষণ পরস্পরের মুখাবলােকন করিতে লাগিলেন। অনন্তর দুঃশাসন জ্যেষ্ঠের নিয়োগানুসারে ত্বরিত্রগমনে দ্রোণাচার্য্যের বিভাগ অভিমুখে গমন করিলেন। তিনি কি অভিপ্রায়ে ধাবমান হইতেছেন জানিবার জন্য বহুসংখ্যক যোদ্ধা তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া চলিলেন।

 অনন্তর দ্রোণ-সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া দুঃশাসন তাঁহাকে ভীষ্মের পতনবার্ত্তা কহিবামাত্র সেই অপ্রিয় সংবাদ শ্রবণে আচার্য্য সহসা মূর্চ্ছিত হইয়া রথােপরি পতিত হইলেন। পরে সংজ্ঞা লাভ করিয়া তৎক্ষণাৎ দূতদ্বারা স্বীয় সৈন্যবিভাগ নিবারিত করিলেন। পাণ্ডবগণও শঙ্খধ্বনি-দ্বারা যুদ্ধকার্য্য স্থগিত করলেন।

 সৈন্যগণ নিবৃত্ত হইলে উভয়পক্ষীয় বীরগণ কবচ ও অস্ত্র পরিত্যাগ-পুর্ব্বক ভীষ্মের নিকট সমাগত হইয়া অভিবাদন পূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন কুরুপিতামহ সকলকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে মহাভাগগণ! তোমাদের স্বাগত? আমি তােমাদের দর্শনে অতিশয় পরিতুষ্ট হইলাম।

 ক্ষণকাল পরে ভীষ্ম পুনরায় কহিলেন―

 হে ভূপতিগণ! আমার মস্তক লম্বমান হইতেছে; অতএব আমাকে উপাধান প্রদান কর।

 রাজগণ তৎক্ষণাৎ দ্রুতগতিতে বহুবিধ মহামূল্য সুকোমল উপাধান সকল আনয়ন করিলেন, কিন্তু ভীষ্ম তাহা গ্রহণ না করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন—

 হে মহাবাহো! হে বৎস! তুমি আমাকে উপযুক্ত উপাধান প্রদান কর।

 তখন সাশ্রুলোচন ধনঞ্জয় পিতামহের অভিপ্রায় অনুমান করিয়া গাণ্ডীব আনয়নপূর্ব্বক ভীষ্মের মস্তকের নিম্নদেশে তিনটি শর নিক্ষেপ করিলে ভীষ্ম শরশয্যার উপযোগী উপাধান প্রাপ্ত হইয়া পরিতুষ্টচিত্তে অর্জ্জুনকে আশীর্ব্বাদ করিলেন।

 পরে শস্ত্রসন্তাপিত ভীষ্ম ধৈর্য্যগুণে বেদনা সম্বরণপূর্ব্বক পানীয় প্রার্থনা করিলেন। তখন সকলে চতুর্দ্দিক হইতে নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী ও সুশীতল জলপূর্ণ কুম্ভ আনয়ন করিলেন, কিন্তু পিতামহকে ইহাতে অসন্তুষ্ট দেখিয়া অর্জ্জুন পুনরায় তাঁহার প্রকৃত অভিপ্রায় বুঝিয়া বারুণাস্ত্রদ্বারা তাঁহার দক্ষিণপার্শ্বস্থ ভূমি বিদ্ধ করিলে তাহা হইতে অতি শীতল বিমল দিব্যস্বাদু জলের উৎস উত্থিত হইল, তদ্দ্বারা ভীষ্ম অতিশয় পরিতৃপ্ত হইয়া অর্জ্জুনকে ভূরিভূরি প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর শল্যোদ্ধারকুশল সুশিক্ষিত বৈদ্যগণ সর্ব্বপ্রকার উপকরণ লইয়া তথায় উপস্থিত হইলে ভীষ্ম তাহা দেখিয়া কহিলেন—

 হে দুর্য্যোধন! তুমি ইহাদিগকে উপযুক্ত সৎকার করিয়া বিদায় কর। আমি ক্ষত্রিয়বাঞ্ছিত পরমগতি প্রাপ্ত হইয়াছি, চিকিৎসার আর প্রয়ােজন নাই। আমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে এই শরশয্যার সহিত আমার শরীর দগ্ধ করিও।

 অনন্তর বৈদ্যগণ প্রস্থিত হইলে ভীষ্ম দুর্য্যোধনকে কহিলেন—

 বৎস। এক্ষণে ক্রোধ পরিত্যাগ কর। আমার একান্ত ইচ্ছা যে, আমার মৃত্যুতেই যুদ্ধের অবসান হৌক। আমার মৃত্যুর পর প্রজাগণের শান্তিলাভ হৌক, পার্থিবগণ প্রীতিমান্ হইয়া পরস্পরের সহিত মিলিত হৌন, পিতা পুত্রকে ভ্রাতা ভ্রাতাকে ও আত্মীয়সকল পরস্পরকে প্রাপ্ত হৌন। হে রাজন! তুমি প্রসন্ন হও। পাণ্ডবগণকে রাজ্যার্দ্ধ প্রদানপূর্ব্বক উহাদের সহিত সন্ধিস্থাপন কর।

 এইমাত্র বলিয়া শল্য-সন্তপ্ত-মর্ম্মা ভীষ্ম বেদনাভরে চক্ষুনিমীলনপূর্ব্বক আত্মাকে যােগস্থ করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। পাণ্ডব, কৌরব ও সমবেত ভূপালগণ তাঁহাকে তিন বার প্রদক্ষিণ করিয়া অভিবাদন করিলেন এবং তাঁহার চতুর্দ্দিকে পরিখাখনন ও রক্ষক নিয়ােগপূর্ব্বক সঙ্গে বিষণ্ণ মনে স্ব-স্ব-শিবিরে প্রস্থান করিলেন।

 কিন্তু মুমূর্ষু ব্যক্তির ঔষধে অনভিরুচির ন্যায় পিতামহের বাক্যে দুর্য্যোধনের আস্থা হইল না।

 এদিকে মহাবীর কর্ণ ভীষ্মের পতন-সংবাদে পূর্ব্ববৈর বিস্মৃত হইয়া সত্বরগমনে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। নিমীলিত-নয়ন কুরুপিতামহকে রুধিরাক্ত কলেবরে অন্তিমশয্যায় শয়ান দেখিয়া সহৃদয় কর্ণ তাঁহার পদতলে নিপতিত হইয়া বাষ্পাকুলকণ্ঠে কহিলেন—

 হে মহাত্মন্। যে সর্ব্বদা আপনার নয়নপথের অতিথি হইয়া আপনার অপ্রীতিভাজন হইত― সেই রাধেয় আপনাকে অভিবাদন করিতেছে।

 ভীষ্ম এই বাক্য শ্রবণে বলপূর্ব্বক নেত্রদ্বয় উন্মীলন করিয়া যখন দেখিলেন, যে তথায় আর কেহ উপস্থিত নাই, তখন রক্ষকগণকে অপসারিত করিয়া পিতার ন্যায় তিনি কর্ণকে দক্ষিণ হস্তদ্বারা আলিঙ্গনপূর্ব্বক সস্নেহবচন, কহিলেন—

 হে কর্ণ! তুমি সর্ব্বদা আমার সহিত স্পর্ধা করিতে, কিন্তু এ সময়ে আমার নিকট আগমন না করিলে আমি দুঃখিত হইতাম। আমি বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত আছি, যে তুমি রাধেয় নহ, তুমি কুন্তী-নন্দন। সত্য কহিতেছি, আমি কদাপি তোমার প্রতি দ্বেষ করি নাই। তুমি পাণ্ডবগণের বিরুদ্ধাচরণ করিতে বলিয়া আমি তোমার তেজোবোধের নিমিত্ত পরূষবাক্য কহিতাম। তোমার দুর্ব্বিষহ বীরত্ব ও ধর্ম্মনিষ্ঠা আমি বিলক্ষণ অবগত আছি। তোমার প্রতি পূর্ব্বে যে ক্রোধ সঞ্চার হইয়াছিল, তাহা অদ্য অপনীত হইল। হে পুরুষপ্রবীর! আর এ বৃথা যুদ্ধে প্রয়োজন কি? তুমি স্বীয় সহােদর পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইলেই এই বৈরভাব পর্য্যবসিত হয়, অতএব আমার প্রাণদানেই এ যুদ্ধের অবসান হোক।

 কর্ণ কহিলেন —হে পিতামহ! আপনি যাহা কহিলেন, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি যথার্থ ই কুন্তী-পুত্র। কিন্তু কুন্তী সে সময়ে আমাকে পরিত্যাগ করিলেন, সূত অধিরথ তখন আমাকে স্নেহভরে প্রতিপালন করিলেন, পরে দুর্য্যোধনের কৃপায় আমি পরিবর্দ্ধিত হইয়াছি। আমাকে আশ্রয় করিয়াই এই দুর্নিবার বৈরভাব উৎপন্ন হইয়াছে; অতএব আপনি অনুমতি করুন, আমি ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করি। ক্ষত্রিয়ের ব্যাধিদ্বারা মরণ কখনই বিধেয় নহে; অতএব দুর্জ্জয় পাণ্ডবদের সহিত যুদ্ধ করিতে আমি কৃতনিশ্চয় হইয়াছি।

 তখন ভীষ্ম কহিলেন—

 হে কর্ণ! যদি নিতান্তই এ সুদারুণ বৈর পরিহার করিতে না পার, তবে আমি অনুজ্ঞা করিতেছি তুমি স্বর্গকাম হইয়া ও অহঙ্কার পরিত্যাগপূর্ব্বক যুদ্ধ কর। আমি প্রথমাবধি এ যুদ্ধ নিবারণের বহুবিধ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না।

 ভীষ্ম এইরূপ কহিলে কর্ণ তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া দুর্য্যোধনের নিকট গমন করিলেন।