কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প/বালখিল্যগণের উৎপত্তি

বালখিল্যগণের উৎপত্তি

পুরাণে আছে, বালখিল্য মুনিরা বড়ো আঙুলের মতন লম্বা এবং সংখ্যায় ষাট হাজার। তাঁদের পিতার নাম ক্রতু, মাতার নাম ক্রিয়া। এই বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ, এতে কিছ, ভুলও আছে। বালখিল্যগণের প্রকৃত ইতিহাস নিম্নে বিবৃত করছি।

 পুরাকালে নৈমিষারণ্যে বহ‍ু ঋষির আশ্রম ছিল। ব্রহ‍্মার অন্যতম মানসপুত্র মহর্ষি ক্রতু তাঁর ভার্যা ক্রিয়ার সঙ্গে সেখানেই বাস করতেন। ক্রতু হলেন সপ্তর্ষিগণের ষষ্ঠ ঋষি। একদিন বিকাল বেলা কুটীরের দাওয়ায় বসে তিনি তাঁর পত্নীকে ব্যাকরণ শেখাচ্ছিলেন। ক্রতু বলছিলেন, প্রিয়ে, এই স্ত্রীপ্রত্যয়প্রকরণ বড়ই কঠিন, তুমি উত্তমরূপে কণ্ঠস্থ কর। মৎস্য শব্দে য-ফলা আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে মৎসী, য-ফলা হয় না। অনুরূপ মনুষ্য মনুষী। ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী, কিন্তু চন্দ্রের স্ত্রী চন্দ্রা। অশ্বের স্ত্রী অশ্বা, অথচ গর্দভের স্ত্রী গর্দভী।

 সহসা একটা গম্ভীর চাপা আওয়াজ শোনা গেল। মহর্ষি ক্রতু সবিস্ময়ে কান পেতে শুনলেন যেন কেউ কলসীর ভিতর থেকে কথা বলছে—আপনি সব ভুল শেখাচ্ছেন।

 ক্রুদ্ধ হয়ে ক্রতু বললেন, কে রে তুই, এতদূর আম্পর্ধা যে আমার ভুল ধরিস!

 আবার আওয়াজ হল—ওসব সেকেলে ব্যাকরণ চলবে না। স্ত্রীলিঙ্গ একই পদ্ধতিতে করতে হবে—মৎস্যী মনুষ্যী ইন্দ্রী চন্দ্রী অশ্বী গর্দভী, কিংবা মংস্যিনী মনষ্যিণী ইন্দ্রিণী চন্দ্রিণী অশ্বিনী গর্দভিনী।  ক্রতু বললেন, কোথায় আছিস তুই, সম্মুখে আয়, লগ‍ুড়াঘাতে তোকে ব্যাকরণ শিক্ষা দেব।

 ঋষিপত্নী ক্রিয়া বললেন, স্বামী, অদৃশ্য মূর্খের বাক্যে কর্ণপাত ক’রো না। ব্যাকরণের পাঠ আজ স্থগিত থাকুক, সেদিন তুমি যে প্রত্যক্ষ দেবতাদের কথা বলছিলে তাই পুনর্বার শ‍ুনতে ইচ্ছা করি।

 ক্রতু বললেন, প্রিয়ে, প্রণিধান কর। আকাশে তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন। —সূর্য চন্দ্র ও মেঘর‍ূপ পর্জন্য। ভূতলেও তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন—গর্ভধারিণী মাতা, জন্মদাতা পিতা, এবং বিদ্যাদাতা গ‍ুর‍ু। এঁরাই সর্বাগ্রে উপাস্য। অগ্নি বায়ু বর‍ুণ প্রভৃতির স্থান এঁদের নিম্নে।

 পুনর্বার আওয়াজ হল—সব ভুল। আকাশে বা ভূতলে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা নেই, চন্দ্র সূর্য পর্জন্য পিতা মাতা গ‍ুর‍ু কেউ উপাস্য নয়।

 অত্যন্ত র‍ুষ্ট হয়ে ক্রতু বললেন, ওরে পাষণ্ড পিশাচ, সাহস থাকে তো দৃষ্টিগোচর হয়ে তর্ক কর্, নতুবা ব্রহ্মশাপে তোকে ধ্বংস করব।

 ঋষিপত্নী ক্রিয়া কাতর হয়ে করজোড়ে বললেন, স্বামী, ও পিশাচ নয়, আমার গর্ভস্থ পুত্রই কথা বলছে। অবোধ শিশ‍ুকে তুমি ক্ষমা কর।

 — গর্ভস্থ পুত্র না জ্যেষ্ঠতাত! বেরিয়ে আয় হতভাগ্য অকালকুষ্মাণ্ড!

 ক্রিয়া তাঁর পুত্রের উদ্দেশে বললেন, বৎস, ক্ষান্ত হও, পূজ্যপাদ পিতার বাক্যের প্রতিবাদ ক’রো না। আগে ভূমিষ্ট হও, তোমার দন্তোদ‍্গম হক, অন্নপ্রাশন চূড়াকরণ উপনয়ন প্রভৃতি সংস্কার চুকে যাক, তার পর যদি কিছু, জ্ঞাতব্য থাকে তবে পিতাকে সবিনয়ে শ্রদ্ধাসহকারে জিজ্ঞাসা ক’রো। এখন মৌনাবলম্বন কর, গর্ভস্থ অপোগণ্ডের পক্ষে বাচালতা অত্যন্ত অনিষ্টকর।

 মহর্ষি ক্রতুর অজাত অপত্য নীরব হল। অধ্যাপনার ব্যাঘাত হওয়ায় ক্রতু উঠে পড়ে সন্ধ্যাবন্দনা করতে গেলেন।


নৈমিষারণ্যের একদিকে গোমতী নদী। জ্যৈষ্ঠ মাসের শ‍ুক্ল পক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে সেখানে দেশ বিদেশ থেকে গর্ভিণী নারীরা সমাগত হন এবং সুপুত্রকামনায় পুণ্যতোয়া গোমতীতে স্নান করে ষণ‍্মাতৃকা অর্থাৎ ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা করেন। এবারে এই শ‍ুভতিথিতে পুষ্য নক্ষত্র ও বৃদ্ধিযোগ পড়েছে, সেজন্য অসংখ্য নারী গোমতীতীরে সমবেত হয়েছেন। ক্রতুর পত্নী ক্রিয়া তাঁদের নেত্রীস্থানীয়া, তিনি সকলকে ব্রতপালনের পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

 সহসা তাঁর গর্ভস্থ পুত্রের গ‍ুর‍ুগম্ভীর স্বর শোনা গেল—ভো অজাত অপোগণ্ডগণ, শ্রুয়তাম্।

 তণ্ডুলভাণ্ডবাসী মূষিকশাবকের ন্যায় কিচকিচকণ্ঠে সহস্র সহস্র ভ্রূণ উত্তর দিলে—হাঁ হাঁ আমরা শ‍ুনছি।

 —বিশ্বের অপোগণ্ড এক হও।

 —এক হব।

 — সকলে আরাব উত্তোলন কর—প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা মানব না।

 —মানব না।

 — পিতা মাতা গ‍ুর‍ু কারও শাসন মানব না।

 —মানব না।

 —গ‍ুর‍ুকে আর ডরাব না, গ‍ুর‍ুর গর‍ু চরাব না। গ‍ুর‍ুকুলে নাহি রব, না পড়ে পণ্ডিত হব।

 —না পড়ে পণ্ডিত হব।

 —তবে কাকে মানবে, কার আজ্ঞায় চলবে?

 — তাই তো, কাকে মানব?

 —আদিবিদ্রোহী মহান্ ত্রিশঙ্কুকে, যিনি ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে রাশিচক্রের বহির্দেশে বিদ্যমান রয়েছেন।

 — মহান, ত্রিশঙ্কু বিদ্যতাম্ অন্য গুরু, ম্রিয়তাম্!

 — ত্রিশঙ্কুর জন্য যিনি আকাশে নূতন স্বর্গলোক সৃষ্টি করেছেন সেই বশিষ্ঠশত্রু বিশ্বামিত্রকেও ধন্যবাদ দাও।

 বিশ্বামিত্র ধন্যবাদ, বশিষ্ঠাদি নিন্দাবাদ!

 — ভ্রাতৃগণ, এই বারে গর্ভকারা থেকে বেরিয়ে এস, স্বাধীন হও, বসুন্ধরা ভোগ কর।

 — কিন্তু এখন যে পাঁচ মাসও পূর্ণ হয় নি!

 —তর্ক ক’রো না, ত্রিশঙ্কুর আজ্ঞা, ভূমিষ্ঠ হও।

 — আমাদের পালন করবে কে, খেতে দেবে কে?

 — তর্ক— ক’রো না, তোমাদের স্নেহান্ধ মূর্খ পিতামাতাই পালন করবে। নিষ্ক্রান্ত হও।

 ষাট হাজার গভির্ণী আর্তনাদ করে উঠলেন, ষাট হাজার ভ্রূণ গর্ভচ্যুত হল। বহ‍ু প্রসূতি প্রাণত্যাগ করলেন।

 আর্তনাদ শ‍ুনে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণ সত্বর গোমতীতীরে উপস্থিত হলেন। তাঁরা দেখলেন, সদ্যোজাত মুনিসন্তানগণ গর্ভনাড়ী ছিন্ন করে ক্লেদাক্ত নগ্ন দেহে চিৎকার ও আস্ফালন করছে। সেই অকালপ্রসূত অকালপক্ক দন্তহীন জটাশ্মশ্রুধারী বালখিল্যগণের নেতা ক্রতুপুত্র ক্রাতব। সে দুই হাত নেড়ে বলছে, ভাই সব, এগিয়ে চল, আমরা এখানকার সমস্ত আশ্রম পড়িয়ে ফেলব, তার পর বশিষ্ঠের আশ্রমে গিয়ে তার কামধেনু হরণ করে দুধ খাব। বিশ্বামিত্র যা পারেন নি আমরা তা পারব।

 — দুধ খাব, দুধ খাব! মহান্ ত্রিশঙ্কু বিদ্যতাম্ বশিষ্ঠ ঋষি ম্রিয়তাম্! বালখিল্যা বর্ধন্তাম্, আর সবাই ক্ষীয়ন্তাম্!

বালখিল্যগণ উপদ্রব করতে উদ্যত হয়েছে দেখে ঋষিরা ভীত হয়ে বললেন, মহর্ষি ক্রতু, তোমার ওই অকালজাত পুত্র ক্রাতবই এই সর্বনাশের মূল, তুমিই এর প্রতিকার কর।

 ক্রতু একটু চিন্তা করে বললেন, এরা ব্রাহ্মণসন্তান, অপজাত হলেও অধৃষ্য ও অবধ্য, নতুবা মুখে লবণ দিয়ে এদের ব্যাপাদিত করা যেত। এরা দেখছি ত্রিশঙ্কুর ভক্ত, সুতরাং ত্রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র হয়তো এদের বশে আনতে পারবেন। চল, বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হওয়া যাক।

 নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণের প্রার্থনা শ‍ুনে বিশ্বামিত্র বললেন, এই বালখিল্যগণের উপর অপদেবতার ভর হয়েছে, এরা সদুপদেশ শুনবে না, কৌশলে এদের বশে আনতে হবে। চল, চেষ্টা করে দেখা যাক।

 বিশ্বামিত্রকে পুরোবর্তী করে ঋষিগণ নৈমিষারণ্যে ফিরে এলেন। বালখিল্যচমূ তখন ব্যূহবদ্ধ হয়ে আক্রমণের উপক্রম করছে।

 বিশ্বামিত্র বললেন, ভো বালখিল্যগণ, আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি হচ্ছি আদিবিদ্রোহী ত্রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র।

 বালখিল্যগণ চিৎকার করে বললে, মহামহিম বিশ্বামিত্রের জয়োঽস্তু, অন্য ঋষিদের ক্ষয়োঽস্তু!

 বিশ্বামিত্র বললেন, কল্যাণমস্তু। বৎসগণ, তোমরা আমার অতি স্নেহের পাত্র। তোমাদের ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে, কিছু, খাবে?

 — খাব, খাব।

 — মৃগমাংস? পুরোডাশ? পিষ্টক? সুপক্ব হরীতকী? ইক্ষুদণ্ড?

 —ওসব চিবুতে পারব না, দাঁত নেই যে। আপনার সন্ধানে দুধ আছে?

 —আছে। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ বা গবাদির দুগ্ধ তো তোমরা জীর্ণ করতে পারবে না। এস আমার সঙ্গে, আমি লঘু পথ্যের ব্যবস্থা করব।

 বালখিল্যদের নিয়ে বিশ্বামিত্র অলম্ব তীর্থে উপস্থিত হলেন। সেখানে একটি বিশাল বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় লক্ষ লক্ষ বাদুড় ত্রিশঙ্কুর মতন ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে ঝুলছে। স্ত্রী-বাদুড়দেব সম্বোধন করে বিশ্বামিত্র বললেন, অয়ি চর্মপর্ণা দন্তবতী পয়স্বিনী বিহঙ্গীর দল, এই সদ্যঃপ্রসূত বভুক্ষ মুনিশাবকগণকে তোমরা স্তন্যদান কর।

 বাদুড়-বনিতারা করণাবিষ্ট হয়ে বললে, আহা, এস এস বাছারা।

 বিশ্বামিত্র বালখিল্যদের একে একে তুলে বটবৃক্ষের শাখায় লম্বিত করে দিলেন। তারা বাদুড়ীদের বক্ষোলগ্ন হয়ে পরমানন্দে স্তন্যপানে রত হল।


 ক্রতু প্রশ্ন করলেন, এরা কত কাল এইপ্রকার শান্ত হয়ে থাকবে?

 বিশ্বামিত্র বললেন, এখন তো থাকুক, এর পর আবার যদি উপদ্রব করে তখন দেখা যাবে।

১৩৬০