কমলা।

 এক চাষা আর তার চাষানী ছিল। তারা যার পর নাই গরীব ছিল; আর তাদের ভারী দুঃখ ছিল যে তাদের একটিও ছেলে মেয়ে নাই।

 চাষার বাড়ীর পাশে একটা মস্ত বাগান, আর তাতে ফল ফুলের গাছ কতই ছিল। কিন্তু সেটা যে বুড়ীর বাগান, সে ছিল ডাইনী। তার ভয়ে কেউ সে বাগানে ঢুক্‌তে সাহস করত না।

 একবার চাষানীর খুব অসুখ করেছে, অরুচি হয়েছে। কিছু খেতে পারে না, কেবল ফল খেতে চায়। কিন্তু তারা গরীব মানুষ, ভাল ফল কিনে খাবার পয়সা কোথায় পাবে? এমন সময় একদিন জানালা দিয়ে চাষানী দেখ্‌তে পেল বুড়ীর বাগানে একটা কমলা লেবুর গাছ ভরে কমলা হয়ে রয়েছে। কমলা দেখে তার এতই লোভ হল যে সে কিছুতেই চুপ করে থাক্‌তে পারল না। চাষা বাড়ী আস্‌তেই যে তাকে বলল, “আমাকে ঐ কমলা লেবু এনে দিতে হবে।” চাষা যত বলে “ও যে ডাইনী বুড়ীর বাগান। কি করে যাব। বুড়ী দেখ্‌তে পেলে আমাদের মেরে ফেল্‌বে।” ততই চাষানী আরও বেশী করে বলে “না এনে দিতেই হবে। আমার বড্ড‌ খেতে ইচ্ছা কর্‌ছে।” শেষে চাষা আর কি করে, সে লেবু আন্‌তে বুড়ীর বাগানে গেল। আস্তে আস্তে বাগানের দরজা খুলে, চারিদিকে চেয়ে যখন দেখ্‌ল কেউ কোথাও নেই, তখন সে তাড়াতাড়ি গিয়ে কয়েকটা লেবু ছিঁড়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ী চলে এলো।

 সেই লেবু খেতে এমন মিষ্টি ছিল যে চাষানী একবার খেয়ে রোজই চাষাকে বলে, “লেবু এনে দাও।” চাষাও রোজ বুড়ীর বাগান থেকে লেবু নিয়ে আসে, কেউ জানতে পারে না।

 একদিন হয়েছে কি চাষা যেই গাছ থেকে লেবু পেড়ে নিয়ে বাড়ী চলে আস্‌বে, অমনি দেখে সামনে ডাইনী বুড়ী! দেখেই ত ভয়ে তার প্রাণ শুকিয়ে গেছে! বুড়ী তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বল্‌ল, “বটে! আমার বাগান থেকে লেবু চুরি!” চাষা কাঁপ্‌তে কাঁপ্‌তে হাত যোড় করে বল্‌ল, “মাপ করুন, এমন কাজ আর কখনও কর্‌ব না। চাষানীর বড্ড অসুখ করেছে, সে লেবু খেতে চায়। আমরা গরীব মানুষ, কমল লেবু কোথায় পাব, তাই এই বাগান থেকে দুটো লেবু নিতে এসেছিলাম।” বুড়ী তখন অনেকটা নরম হয়ে বল্‌ল “আচ্ছা এবার ছেড়ে দিলাম। কিন্তু একটা কথা মনে থাকে যেন। তোমাদের যে প্রথম ছেলে কি মেয়ে হবে তাকে আমাকে দিতে হবে।” চাষা প্রাণের ভয়ে তাতে রাজি হ’ল।

 কিছুদিন পরে তাদের একটি সুন্দর ফুট্‌ফুটে মেয়ে হ’ল। মেয়ে হয়েছে খবর পেয়ে বুড়ী এসে বল্‌ল “কি বলেছিলে মনে আছে ত? এইবার তোমার মেয়েকে দাও। তোমাদের কিছু ভয় নেই, আমি তাকে মায়ের মত যত্ন কর্‌ব।” এই বলে বুড়ি মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল।

 মেয়েটিকে এনে বুড়ী তার নাম রাখ্‌ল ‘কমলা’। কমলা যখন বার বছরের হ’ল তখন বুড়ী এক বনের ভিতরে একটা খুব উঁচু বাড়ী ত’য়ের করাল। সে বাড়ীতে ঢুকবার দরজা জানালা কিছু নেই, উপরে উঠবার সিঁড়ি নেই। কেবল সব চেয়ে উপরের তলার ঘরে, বাইরের দিক দিয়ে একটি মাত্র জানালা।

 সেই ঘরে বুড়ী কমলাকে বন্ধ করে রেখে দিল। রোজ দুবেলা সে নিজে গিয়ে খাবার দিয়ে আস্‌ত, আর কাউকে সেখানে যেতে দিত না। কমলার খুব লম্বা লম্বা চুল ছিল। বুড়ী এসে জানালার নীচে দাঁড়িয়ে ডাক্‌ত, “কমলা, কমলা, চুল খুলে দাও।”

 কমলা জানালা দিয়ে তার চুল খুলে দিত। লম্বা লম্বা চুল একেবারে মাটি অবধি এসে পড়্‌ত; বুড়ী সেই চুল বেয়ে উপরে উঠ্‌ত।

 একদিন সে দেশের রাজার ছেলে ঘোড়ায় চড়ে সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে দেখ্‌তে পেলেন একটা উঁচু বাড়ী, তার দরজা জানালা কিছু নেই, কেবল সব চেয়ে উপরের ঘরে একটা জানালা। একটা কুঁদো, কালো, ডাইনীর মতন বুড়ী সেই জানালার নীচে দাড়িয়ে ডাক্‌ল, “কমলা, কমলা, চুল খুলে দাও।”

 অমনি জানালা থেকে কালাে কালাে লম্বা লম্বা রেশমের মত চুল একেবারে মাটি পর্য্যন্ত এসে পড়্‌ল, আর বুড়ী সেই চুল বেয়ে উপরে উঠে গেল। খানিক পরে আবার সেই চুল জানালা থেকে
চুল ধ’রে রাজার ছেলে উপরে উঠ্‌লেন।
মাটি পর্য্যন্ত এসে নাম্‌ল, আর বুড়ী তাই ধরে ধরে নেমে এল।

 রাজার ছেলে অবাক্ হয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলেন। তার পর বুড়ী চলে গেলে তিনি জানালার নীচে এসে ডাক্‌লেন, “কমলা, কমলা, চুল খুলে দাও।”

 অমনি কমলা তার চুল খুলে দিল, আর তাই ধরে রাজার ছেলে উপরে উঠ্‌লেন। উপরে উঠে দেখেন, কি সুন্দর মেয়ে!

 কমলা মনে করেছিল বুড়ীই বুঝি আবার এসেছে। সে রাজার ছেলেকে দেখে আগে খুব ভয় পেল। কিন্তু তাঁর মিষ্টি কথা শুনে, আর সুন্দর চেহারা দেখে, শেষে তার ভয় চলে গেল। সেত বুড়ী ছাড়া আর কাউকে কখনও দেখেনি, সে মনে করত সব মানুষই বুঝি বুড়ীর মত বিশ্রী দেখতে। রাজার ছেলে দেখে তার খুব ভাল লাগ ল, আর তাদের দুজনে খুব ভাব হয়ে গেল।

 এমনি করে রাজার ছেলে রোজ কমলার সঙ্গে দেখা কর্‌তে যান, বুড়ী কিছু জান্‌তে পারে না। একদিন তিনি কমলাকে বল্‌লেন “কমলা, তুমি আমাদের দেশে যাবে? আমাকে বিয়ে কর্‌বে?” কমলা বল্‌ল, “হাঁ। কিন্তু কি ক’রে যাব? এখান থেকে নামব কি ক’রে?” রাজার ছেলে বল্‌লেন, “এক কাজ করা যাবে। এর পর থেকে আমি খানিকটা ক’রে সুতাে নিয়ে আস্‌ব! তুমি সেই দিয়ে দড়ি বানাবে। যখন দড়ি খুব লম্বা হবে তখন সেই দড়ি বেয়ে আমরা নীচে নাম্‌ব।

 তার পর রাজার ছেলে রােজ সুতো নিয়ে আসেন, আর কমলা দড়ি বােনে। দড়ি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় একদিন বুড়ী এলে পর কমলা তাকে বল্‌ছে, “বুড়ী মা, তুমি যখন আমার চুল বেয়ে ওঠ তখন এত ভারি লাগে কেন? রাজার ছেলে যখন ওঠেন তখন ত এত ভারি লাগে না?” একথা শুনেই বুড়ী ভয়ানক চটে গেল, “কি! কি বলছিস? রাজার ছেলে? বটে! দাঁড়া তােকে দেখাচ্ছি।”

 এই ব’লে সে কাঁচি দিয়ে কচ্ কচ্ করে কমলার সব চুল কেটে দিল। তার পর তাকে নিয়ে আর একটা ভয়ানক বনে ছেড়ে দিল। তার পর ফিরে এসে কমলা যে ঘরে ছিল সেই ঘরে চুপ্ করে বসে রইল।

 সেদিন সন্ধ্যার সময় রাজার ছেলে এসে ডাক্‌লেন, “কমলা, কমলা, চুল খুলে দাও।”

 বুড়ী অমনি কমলার সেই কাটা চুল গুলাে জানালা দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। রাজার ছেলেত কিছু জানেন না, তিনি চুল বেয়ে উপরে উঠ্‌লেন; উঠেই দেখেন কমলা ত নাই বুড়ী বসে আছে। তাকে দেখে বুড়ী খিল খিল করে হেসে বল্ল, “কেমন জব্দ, কেমন জব্দ! কমলাকে আর পাচ্ছ না। তাকে ডাইনীতে ধরে নিয়ে গিয়েছে, আর সেই ডাইনী তােমারও চোখ খাব্‌লে নেবে।”

 রাজার ছেলে তাড়াতাড়ি জানালা থেকে লাফিয়ে পড়লেন। নীচে কাঁটার গাছ ছিল, সেই কাঁটার খোঁচা লেগে তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে গেল।

 তারপর, তিনি অন্ধ হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ান, গাছের ফল ঝরণার জল খান, আর কমলার জন্য কাঁদেন। এমনি করে এক বছর কেটে গেল। একবছরের পর, ঘুরতে ঘুরতে তিনি, কমলা যে বনে ছিল সেই বনে এসে পড়লেন। কমলা তাঁকে দেখেই ছুটে এলো, আর তাঁকে অন্ধ দেখে ভয়ানক কাঁদতে লাগ্‌ল। কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে হটাৎ কমলার চোখের জল রাজার চোখে পড়ল। আর কি আশ্চর্য্য! অমনি তাঁর চোখ ভাল হয়ে গেল। তখন তিনি কমলাকে নিয়ে মনের সুখে দেশে ফিরে গেলেন। তখন কি আনন্দই হল!