চাঁদের কলা

অমাবস্যার পরে দ্বিতীয়ার চাঁদ সরু কাস্তের মত পশ্চিম আকাশের নীচে দেখা দেয়,—তার পরে সে দিনে দিনে বাড়িয়া পূর্ণিমার দিন ঠিক্ গোল হইয়া দাঁড়ায়। ইহার পরেই কৃষ্ণপক্ষ আরম্ভ হয়। কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ হইতে চাঁদ একএকটু করিয়া দিনে দিনে ক্ষয় পাইতে সুরু করে। প্রায় পনেরো দিন পরে অর্থাৎ অমাবস্যায়, চাঁদকে আর খুঁজিয়াই পাওয়া যায় না।

 চাঁদের এই রকম ক্ষয় ও বুদ্ধি তোমরা হয় ত দেখিয়াছ। যদি ভাল করিয়া না দেখিয়া থাক, কিছুদিন ধরিয়া চাঁদকে পরীক্ষা করিও, তাহা হইলে বুঝিবে আমি যে-সকল কথা বলিলাম তাহা ঠিক্। যদি আমার কথাটাই ঠিক্ হয়, তাহা হইলে কি রকমে চাঁদের ক্ষয়বৃদ্ধি হয়, তোমরা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিতে পার কি?

 পর পৃষ্ঠায় একটা ছবি দিলাম। এই ছবিটা দেখিলে, বোধ হয় তোমরা চাঁদের ক্ষয়বৃদ্ধির কথাটা বুঝিবে। চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে প্রায় গোলাকার পথে ঘুরিয়া বেড়ায়। তাই ছবির মাঝখানে আমরা পৃথিবীকে রাখিয়াছি, এবং তাহার চারিদিকে চাঁদের বিভিন্ন সময়ের ছবি দিয়াছি। সূর্য্য চাঁদের ভ্রমণ-পথের ভিতরে নাই,—বাহিরে আছে। সূর্য্যের আলো চাঁদের গায়ে লাগিয়া কি রকমে তাহার কলার হ্রাসবৃদ্ধি করায় এথন তোমরা বুঝিতে পারিবে।

 চাঁদ যখন ছবির এক নম্বর জায়গায় থাকে তখন কি হয় ভাবিয়া দেখ। এই অবস্থায় চাঁদ প্রায় পৃথিবী ও সূর্য্যের মাঝে পড়িয়াছে। কাজেই চাঁদের যে পিঠে সূর্য্যের আলো পড়ে তাহাকে পৃথিবী হইত দেখা যায় না। পৃথিবী হইতে উহার অন্ধকার দিক্‌টাই দেখা যায়।

চন্দ্রকলার ক্ষয়বৃদ্ধি

সুতরাং এ অবস্থায় আমরা চাঁদকে একেবারে দেখিতে পাই না। ইহাই অমাবস্যা। অমাবস্যায় চাঁদ দেখা যায় না।

 তার পরে চাঁদ যখন অগ্রসর হইয়া দুই নম্বর জায়গায় আসিয়া দাঁড়ায় তখন তাহার যে আধ্‌খানায় সূর্য্যের আলো পড়ে, তাহার অতি সামান্য অংশ পৃথিবী হইতে দেখা যায়। ইহাই দ্বিতীয়া তৃতীয়ার চাঁদ। ইহার আকৃতি তথন সরু কাস্তের মত হইয়া দাঁড়ায়।

 ইহার পরে চাঁদ যখন পৃথিবীকে ঘুরিতে গিয়া ছবির তিন নম্বর জায়গায় আসিয়া দাঁড়ায়, তখন চাঁদের আলোকিত অংশের আধ্‌খানা মাত্র আমরা পৃথিবী হইতে দেখিতে পাই। তার পরে চারি নম্বর জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইলে চাঁদের আলোকিত অংশের প্রায় বারো আনা আমাদের নজরে পড়ে এবং শেষে পাঁচ নম্বর জায়গায় চাঁদকে আমরা সম্পূর্ণ গোল দেখিতে আরম্ভ করি। এই অবস্থায় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য্যের মাঝে থাকে; কাজেই চাদের যে আধ্‌খানা সূর্য্যের আলো পায়, তাহার সবটাই আমরা দেখিতে পাই। ইহাই পূর্ণিমার চাঁদ।

 পূর্ণিমার পরে চাঁদ যতই ছয়, সাত ও আট নম্বর জায়গায় যাইতে আরম্ভ করে, তাহার আলোকিত অংশ ততই আমাদের আড়ালে পড়িতে আরম্ভ করে। এই সময়টাতেই চাঁদের ক্ষয় হয়। ইহাই কৃষ্ণপক্ষ। তার পর আট নম্বর জায়গা ছাড়িয়া আবার এক নম্বর জায়গায় আসিলে চাঁদ একেবারে অদৃশ্য হইয়া যায় অর্থাৎ আবার অমাবস্যা হয়।

 তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, চাঁদ যে সময়ে পৃথিবীকে একবার ঘুরিয়া আসে সেই সময়ে অমাবস্যা হইতে পূর্ণিমা এবং পূর্ণিমা হইতে আবার অমাবস্যা হয়।

 এই সময়টা যে কত দিন তাহা তোমরা জান। যদি না মনে থাকে তাহা হইলে একটা পাঁজি দেখিলেই জানিতে পারিবে। এক অমাবস্যার পর আর এক অমাবস্যা হইতে প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ দিন সময় লাগে। তাহা হইলে তোমরা বলিতে পার, পৃথিবী সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে যেমন তিন শত পঁইষট্টি দিন সময় লয়, চাঁদও সেই রকমে পৃথিবীকে ঘুরিতে সাড়ে ঊনত্রিশ দিন সময় লয়। কিন্তু পণ্ডিতেরা খুব ভাল হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন, অমাবস্যা সাড়ে ঊনত্রিশ দিন অন্তর হইলেও, চাঁদ পৃথিবীকে ঘুরিয়া আসে সাতাইশ দিন আট ঘণ্টায়।

 পাঁজির কথার সহিত পণ্ডিতদের কথার কেন এরকম অমিল হইল, তাহা তোমরা এখন বুঝিবে না; কেবল এইটুকু মনে করিয়া রাখ যে, যখন চাঁদ পৃথিবীকে ঘুরিতে থাকে তখন পৃথিবী স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে না। সে সূর্য্যকে ঘুরিবার জন্য নির্দ্দিষ্ট পথে চলিতে থাকে। চাঁদের গতি এবং পৃথিবীর এই গতি মিলিয়া পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়গুলাকে একএকটু লম্বা করিয়া দেয়। যদি পৃথিবী সূর্য্যের মত নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিত, তাহা লইলে চাঁদের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা ঠিক্ সাতাইশ দিন আট ঘণ্টা অন্তরে হইত।

 অমাবস্যার দুই দিন পরে যখন কাস্তের মত সরু চাঁদখানি পশ্চিম আকাশের গায়ে দেখা দেয়, তখন তোমরা যদি ভাল করিয়া চাঁদটিকে দেখ, তবে স্পষ্ট সমস্ত চাঁদকেই দেখিতে পাইবে। ইহা একটা মজার ব্যাপার নয় কি? সেই সময়ে কাস্তের মত অংশটা খুব উজ্জ্বল থাকে, অবশিষ্ট অংশে আব্‌ছায়া রকমের এক রকম আলো দেখা যায়। কিন্তু এই আলোতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, আমাদের চাঁদ কাস্তের মত নয়,—তাহা গোলাকার।

 কাস্তের মত অংশটা কেন এত উজ্জ্বল তাহা তোমরা জান। কিন্তু বাকি অংশে এই আব্‌ছায়া আলো কোথা হইতে আসে, বলিতে পার কি? পঞ্চমী ষষ্ঠী তিথিতে চাঁদ যখন বেশ বড় হইয়া পড়ে, তখন ঐ আব্‌ছায়া আলো দেখা যায় না। দ্বিতীয়া, তৃতীয়া এবং চতুর্থী পর্য্যন্ত উহা সুস্পষ্ট দেখা যায়।

 চাঁদের নিজের আলো নাই। ধার-করা আলোতেই তাহার আলো, একথা তোমরা অনেকবার শুনিয়াছ। কাজেই বলিতে হয়, দ্বিতীয়া তৃতীয়ার যে আব্‌ছায়া আলোতে চাঁদের অন্ধকার অংশের যে একএকটু নজরে পড়ে, তাহাও চাঁদের নিজের আলো নয়। তবে কাহার আলো? জ্যোতিষীরা ইহার মজার উত্তর দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, ইহা চাঁদের উপরকার জ্যোৎস্নার আলো। চাঁদ যেমন আামাদের পৃথিবীতে জ্যোৎস্না দেয়, পৃথিবী তেমনি চাঁদের উপরে ঐরূপ জ্যোৎস্না দেয়।

 বোধ হয় আমার কথা বুঝিলে না। আচ্ছা, মনে কর, তুমি যেন চাঁদের উপরে গিয়া দাঁড়াইয়াছ এবং সেখান হইতে পৃথিবীকে দেখিতেছ। পৃথিবীকে তুমি একটা খুব বড় চাঁদের মতই দেখিবে। যদি অমাবস্যার দিন বা তাহার দু-তিন দিন পরে তুমি চাঁদের অন্ধকার দিকটায় থাক, তাহা হইলে তুমি পৃথিবীকে পূর্ণিমার চাঁদের মত প্রায় সম্পূর্ণ গোলাকার দেখিতে পাইবে। তথন পৃথিবীর আলো—ঠিক্‌রাইয়া গিয়া চাঁদের যে অন্ধকার অংশে তুমি দাঁড়াইয়া আছ, তাহাতে জ্যোৎস্না দেখাইতে থাকিবে। ষষ্ঠী সপ্তমীর চাঁদের অন্ধকার অংশেও পৃথিবীর জ্যোৎস্না পড়ে, কিন্তু তখন চাঁদের উজ্জ্বল অংশের আলোটা এত বেশি হয় যে, তাহার অন্ধকার অংশে পৃথিবীর জ্যোৎস্না পড়িলেও তাহা নজরে পড়ে না। অন্ধকার ঘরে একটা মাটির প্রদীপ জ্বালাইলেও তাহাকে খুব উজ্জ্বল দেখায়, কিন্তু যে ঘরে ইলেক্‌ট্রিক আলো জ্বলিতেছে, সেইখানে ঐ প্রদীপ জ্বালাইলে তাহার আলো চোখেই পড়ে না। ইহাও যেন সেই রকম। পৃথিবীতে চাঁদ যে জ্যোৎস্না দেয় তাহার আলো কত তোমরা দেখিয়াছ। কিন্তু চাঁদে পৃথিবী যে জ্যোৎস্না দেয় তাহার আলো পৃথিবীর জ্যোৎস্নার প্রায় তেরো গুণ। তাহা হইলে দেখ, চাঁদে জ্যোৎস্না উঠিলে বেশি অন্ধকার থাকে না।