গ্রহ-নক্ষত্র/ধূমকেতুর আকৃতি-প্রকৃতি

ধূমকেতুর আকৃতি-প্রকৃতি

হ্যালির ধূমকেতুর গল্প বলিতে অনেক সময় কাটিয়া গেল। এখন ধূমকেতুদের আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা তোমাদিগকে বলিব।

 আকৃতির কথা জিজ্ঞাসা করিলে জ্যোতিষীরা বলেন, ধূমকেতুদের নির্দ্দিষ্ট আকৃতি নাই। খুব ছোট ছোট জড়কণা দিয়া তাহাদের দেহ প্রস্তুত, সুতরাং তাহাদের স্থায়ী আকার কেমন করিয়া থাকিবে? এক গাদা বালির আকৃতি কি রকম তোমরা বলিতে পার কি? কখনই পার না। বালিগুলিকে যখন ঝুড়িতে বোঝাই দেওয়া যায়, তখন আকৃতি ঝুড়ির মত হয়; বাল্‌তিতে বোঝাই দিলে বাল্‌তির মত হয়। ধূমকেতুদের অবস্থা ঠিক্ সেই প্রকার। অবস্থাবিশেষে একই ধূমকেতুর নানা আকৃতি হয়। সূর্য্য হইতে যখন দূরে থাকে তখন তাহাদের লেজ থাকে না; সূর্য্যের কাছে আসিতে আরম্ভ করিলে এক একটু করিয়া লেজ বাহির হইতে থাকে। তার পরে সূর্য্যের খুব কাছে আাসিলে, লেজ খুব লম্বা হয়। শেষে তাহারা যখন সূর্য্য হইতে দূরে যাইতে আরম্ভ করে, তখন লেজগুলিও আপনা হইতে গুটাইয়া আসে; খুব দূরে গেলে লেজের চিহ্নমাত্র খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। একই ধূমকেতুর ক্ষণে ক্ষণে এই রকম পরিবর্ত্তন দেখিয়াই জ্যোতিষীরা বলেন, পৃথিবী বৃহস্পতি শনি প্রভৃতি গ্রহদের যেমন এক-একটি নির্দ্দিষ্ট আকৃতি আছে, ধূমকেতুদের তাহা নাই। সকলেরই এক একটা মুণ্ড থাকে এবং সময়ে সময়ে ঐ মুণ্ড হইতে লেজ গজাইয়া উঠে,—ইহাই তাহাদের আকৃতি।

 ধূমকেতুদের লেজ বড় মজার জিনিস। এগুলি কখনই সূর্য্যের দিকে বিস্তৃত থাকে না; সূর্য্য যেদিকে থাকে, ধূমকেতুদের লেজগুলিকে সকল সময়ে তাহারি উল্‌টা দিকে দেখা যায়। বিড়াল কুকুর ভালুক বা সিংহ প্রভৃতি প্রাণীর একটার বেশি লেজ থাকে না, কিন্তু এক একটা ধূমকেতুর লেজ প্রায়ই দুইটা তিনটা দেখা যায়। লেজগুলি লম্বাও মন্দ নয়। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া একটা ধূমকেতুর লেজকে প্রায় দশ কোটি মাইল লম্বা হইতে দেখিয়াছিলেন। কিন্তু লম্বা হইলে কি হয়,—উহাতে পদার্থ কিছুই থাকে না। আমরা আগেই বলিয়াছি, গোটা লেজকে গুটাইয়া দাঁড়িপাল্লায় ওজন করিলে, তাহা আধ্ সের তিন পোয়ার বেশি ভারি হয় না।

 ধূমকেতুদের লেজ যে কত অসার জিনিস, তাহার একটি গল্প বলি, শুন।

 ইংরাজি ১৭৭০ সালে একটি বড় ধূমকেতু দেখা গিয়াছিল। লেক্‌সেল্ নামে একজন জ্যোতিষী ইহার আবিষ্কার করেন, এজন্য লোকে ইহাকে লেক্‌সেলের ধূমকেতু বলিত। ঘুরিতে ঘুরিতে সে যখন সূর্য্য ও পৃথিবীর মাঝে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন তাহার প্রকাণ্ড লেজ দেখিয়া জ্যোতিষীরা ভয় পাইয়া গেলেন। তাঁহারা ভাবিতে লাগিলেন, যদি ধূমকেতুর লেজটা একবার পৃথিবীর গায়ে আসিয়া লাগে বা তাহার মুণ্ডটা ধাক্কা দেয় তাহা হইলে বুঝি পৃথিবী চুরমার হইয়া যাইবে। লেক্‌সেল্ চেষ্টার ত্রুটি করিল না, একদিন সত্যই তাহার লম্বা লেজ পৃথিবীর গায়ে ঠেকিল। জ্যোতিষীরা ভাবিলেন, এবার বুঝি সর্ব্বনাশ হইল! কিন্তু পৃথিবীর তাহাতে কিছুই হইল না। এই লেক্‌সেলের ধূমকেতুকে পরে বৃহস্পতির কাছে বিলক্ষণ অপমানিত হইতে হইয়াছিল। বৃহস্পতির চারিটি বড় চাঁদ উহার লম্বা লেজটিকে ধরিয়া এমন টানাটানি আরম্ভ করিয়াছিল যে, তাহার লেজ ছিঁড়িয়া টুক্‌রা-টুক্‌রা হইয়া গিয়াছিল। এই রকমে পৃথিবী ও বৃহস্পতির কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার পরে, লেকসেল্ আর সূর্য্য-জগতে পা দেয় নাই।

 তাহা হইলে দেখ, যতই লম্বা হউক না কেন, ধূমকেতুর লেজ বাতাসের চেয়েও হাল্‌কা। গায়ে ঠেকিলে গ্রহ-উপগ্রহদের একটুও ক্ষতি হয় না,—বরং ক্ষতি হয় লেজেরই। জ্যোতিষীরা বলেন, সে বার যখন হ্যালির ধূমকেতুর উদয় হইয়াছিল, সে পৃথিবীর উপরে তাহার লেজ বুলাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু পৃথিবীর তাহাতে একটুও লোকসান হয় নাই। ধূমকেতুর লেজের মধ্যে যে আমরা একদিন বাস করিয়াছিলাম, একথাটি পর্য্যন্ত আমরা তখন জানিতে পারি নাই।

 ধূমকেতুর মুণ্ড লেজের চেয়ে ভারি বটে, কিন্তু তাহাতেও সার বা জমাট জিনিস নাই। ধূমকেতুর আর একটা গল্প বলিলে, ইহা তোমরা বুঝিতে পারিবে।

 অনেক দিনের কথা নয়, ইংরাজি ১৮২৬ সালের অর্থাৎ প্রায় একশত বৎসর পূর্ব্বে আমাদের আকাশে একটি বেশ বড় ধূমকেতুর উদয় হইয়াছিল। বায়েলা নামে একজন জ্যোতিষী ইহাকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন, এজন্য লোকে ইহাকে বায়েলার ধূমকেতু বলিত। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া দেখিলেন, এটি ছয় বৎসর নয় মাসে এক একবার সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া আনাগোনা করে। কাজেই জানা গেল, উহা ১৮৩২ সালে আমাদিগকে আবার একবার দেখা দিবে।

 ফুট্‌বল্ ক্রিকেটের ম্যাচ্ দেখা তোমাদের যেমন একটা বাতিক, আকাশের কোথায় কি হইতেছে খোঁজ করা জ্যোতিষীদের সেই রকম বাতিক। রাত্রিতে আকাশখানিকে পরিষ্কার পাইলে, তাঁহাদের আহার নিদ্রা বন্ধ হইয়া যায়; তথন দূরবীণে চোখ লাগাইয়া কোথায় কি আছে, দেখিতেই তাঁহাদের রাত্রি ভোর হইয়া যায়। ১৮৩২ সালে যে দিন বায়েলার ধূমকেতুর আসার কথা ছিল, তাহার দশ দিন আগে হইতে জ্যোতিষীরা উহার খোঁজ আরম্ভ করিয়াছিলেন। ঠিক্ সময়ে ধূমকেতু দেখা দিল; কিন্তু ১৮২৬ সালে তাহাকে যে রকমটি দেখা গিয়াছিল, এবারে সে রকম দেখা গেল না। বুঝা গেল, ধূমকেতুটি যেন এক গোলাকার পিণ্ডের মত হইয়া আসিয়াছে। জ্যোতিষীরা ভাবিলেন, বৃহস্পতি বুঝি তাহার লেজটি ছিঁড়িয়া দিয়াছে।

 ইহার পর ১৮৩৯ সালে বায়েলার আসিবার কথা ছিল। সে ঠিক সময়েই আসিয়াছিল, কিন্তু সে বার জ্যোতিষীরা তাহাকে ভাল করিয়া দেখিবার সুবিধা পান নাই। কাজেই ১৮৪৬ সালে সে যখন আবার ফিরিয়া আসিবে, তখন তাহার আকৃতি কি রকম হয় দেখিবার জন্য জ্যোতিষীরা প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 সময় আসিল, জ্যোতিষীরা দূরবীণ দিয়া বায়েলাকে দেখিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু এবারে তাহার যে মূর্ত্তি দেখা গেল, তাহাতে সকলেই অবাক্ হইয়া গেলেন। বায়েলার সেই লম্বা লেজ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না এবং তাহার সেই সুগোল মূর্ত্তি মিলিল না,—সে একটা মুগুরের মত একটা অদ্ভুত আকৃতি লইয়া আকাশে দেখা দিল। তার পরে সে যতই সূর্য্যের কাছাকাছি হইতে লাগিল, তাহার মাঝখানটা সরু হইয়া ঠিক ডম্‌বেলের মত হইয়া পড়িল এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটা ধূমকেতু সুস্পষ্ট দু’টা ধুমকেতু হইয়া দাঁড়াইল।

 এই ঘটনায় জ্যোতিষীরা যে কত বিস্মিত হইয়াছিলেন, তাহা বোধ হয় তোমরা বুঝিতে পারিতেছ। কিন্তু সেই যমজ ধূমকেতুকে সে বৎসর আর ভাল করিয়া দেখিবার সুবিধা হইল না। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া দেখিলেন, ১৮৫২ সালে তাহারা আবার দেখা দিবে। কাজেই এই ছয়টা বৎসর তাঁহারা ধৈর্য্য ধরিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 ১৮৫২ সালে তাহারা ঠিক সময়েই উদিত হইল, কিন্তু এবারে তাহাদের যমজ মূর্ত্তি দেখা গেল না। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া দেখিলেন,—বায়েলার দুই খণ্ডের মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ মাইল তফাৎ হইয়াছে। ইহার পরে ১৮৫৭ সালে তাহাদের ফিরিবার কথা ছিল। বায়েলার আরো কি দুর্গতি হয় দেখিবার জন্য জ্যোতিষীরা উদ্বিগ্ন হইয়া বসিয়া ছিলেন; কিন্তু তাহার দেহের একটুক্‌রাকেও সে বৎসরে দেখা যায় নাই। সেই সময় হইতে বায়েলা একেবারে নিরুদ্দেশ।

 বায়েলার ধূমকেতুর এই রকম দুর্গতি জ্যোতিষের একটা মজার গল্প। ধূমকেতুদের লেজে বা মুণ্ডতে যে কোনো সার বস্তু নাই, এই ঘটনা হইতে বুঝা যায় না কি? বায়েলার মুণ্ডতে যদি একটুও জমাট বা ভারি জিনিস থাকিত তাহা হইলে সেটা কখনই সূর্য্য বা গ্রহদের টানে ঐ রকমে ভাঙিয়া-চুরিয়া ধূলা হইয়া যাইত না।

 ধূমকেতুদের অনেক কথাই তোমাদিগকে বলিলাম। কেন সূর্য্যের কাছে আসিলে তাহাদের লেজ বাহির হয় এবং দূরে গেলে লেজ ছোট হইয়া আসে, কেবল এই কথাটাই তোমাদিগকে বলা হয় নাই।

 এখানে ধূমকেতুর একটা ছবি দিলাম। ছবি দেখিলেই বুঝিবে ধূমকেতুর লেজটি সর্ব্বদাই সূর্য্যের উল্‌টা দিকে রহিয়াছে এবং সে যেমন সূর্য্যের কাছে আসিতেছে, অমনি লেজটা এক-একটু করিয়া বাড়িয়া চলিতেছে।

 লেজের এই রকম বাড়া-কমার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে জ্যোতিষীরা বলেন, ধূমকেতুরা যখন সূর্য্য হইতে দূরে থাকে তখন তাহাদের দেহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জড়পিণ্ডগুলির মধ্যে কোনো রকম চঞ্চলতা থাকে না। কিন্তু সূর্য্যের কাছে আসিলেই তাহার টানে সেগুলির মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দেয়। তাহারা তখন দেহের ভিতরে থাকিয়া ছুটাছুটি করে এবং পরস্পরকে ধাক্কাধুক্কি মারিতে থাকে। কতকগুলি পরস্পরকে ঠোকাঠুকি দিতে থাকিলে কি হয়, তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। একখানা পাথরকে


ধূমকেতুর লেজ বড় হওয়া

আর একখানা পাথরে ঠুকিতে থাক, দেখিবে দু’খানাই গরম হইয়া পড়িয়াছে এবং মাঝে মাঝে তাহাদের গা হইতে আগুনের ফুল্‌কি বাহির হইতেছে। সূর্য্যের আকর্ষণে ধূমকেতুর দেহের পিণ্ডগুলি পরস্পরকে ঠোকাঠকি করিয়া ঠিক্ ঐ দশাই পায়—খুব গরম হইয়া উঠে এবং শেষে দেহের কতক অংশ বাষ্প হইয়া পড়ে। জ্যোতিষীরা বলেন, এই বাষ্পই সম্ভবতঃ লেজের সৃষ্টি করে। তার পরে ধূমকেতুরা যখন সূর্য্যের কাছ হইতে দূরে যাইতে আরম্ভ করে, তখন ঠোকাঠুকির পরিমাণ কমিয়া আসে, কাজেই আর নূতন বাষ্প জন্মিতে পারে না বলিয়া লেজটাও ছোট হইয়া পড়ে।

 ধূমকেতুর হাল্‌কা লেজগুলি কেন সকল সময়ে সূর্য্যের উল্‌টা দিকে থাকে, তোমরা বোধ হয় এখন সেই কথাটি জানিতে চাহিতেছ। কিন্তু এ সম্বন্ধে জ্যোতিষীরা যাহা বলেন, তোমরা বোধ হয় তাহা ভাল বুঝিবে না। এখন কেবল এইটুকু জানিয়া রাখিয়া দাও যে, ধূমকেতুর দেহ হইতে যে বাষ্প বাহির হয় তাহা যখনি সূর্য্যের দিকে যাইতে চায়, সূর্য্য জোর করিয়া তাহাকে দূরে তাড়াইয়া দেয়। কাজেই অন্য কোনো পথ না পাইয়া বাষ্পরাশি সূর্য্যের উল্‌টা দিকেই ছড়াইয়া পড়ে। এই একপাশে-ছড়ানো বাষ্পকেই আমরা দূর হইতে ধূমকেতুর লেজের আকারে দেখিতে থাকি।