গ্রহ-নক্ষত্র/নক্ষত্রদের আলো বাড়ে কমে কেন?

নক্ষত্রদের আলো বাড়ে কমে কেন?

পাৎলা মেঘে ঢাকা পড়িলে চন্দ্র-সূর্য্য ও নক্ষত্রদের আলো কমিয়া যায়। ইহার কারণ বেশ বুঝা যায়,—মেঘগুলাই উহাদের আলো আট্‌কাইয়া দেয়। কিন্তু আকাশে মেঘ নাই, অথচ নক্ষত্রদের আলো হঠাৎ কমিয়া গেল, এই রকমটি তোমরা দেখিয়াছ কি? বোধ হয় দেখ নাই, কিন্তু অতি প্রাচীন কালের জ্যোতিষীরাও ইহা দেখিয়াছিলেন এবং আজকালকার জ্যোতিষীরা শত শত নক্ষত্রের আলো এই রকমে বাড়িতে কমিতে দেখিয়াছেন।

 তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, যখন-তখন ঐ রকমে নক্ষত্রদের আলো কমে। কিন্তু তাহা নয়, এক-একটা নির্দ্দিষ্ট সময় অন্তর আলোর বাড়া-কমা হয়। কোনো নক্ষত্রে এই পরিবর্ত্তন দেখিবার জন্য সত্তর বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতে হয়, আবার কোনো কোনোটির পরিবর্ত্তন আড়াই দিনে, আট দশ দিনে বা এক বৎসরেই দেখা যায়।

 পারসুস্ রাশিতে “আলগল্” নামে একটি মাঝারি রকমের উজ্জ্বল তারা আছে; সেটির আলো প্রায় তিন দিন অন্তর ভয়ানক কমিয়া আসে। তখন তাহাকে একবারে মিট্‌মিট্ করিতে দেখা যায়। অদ্ভুত নয় কি? আরব দেশের প্রাচীন জ্যোতিষীরা এই পরিবর্ত্তন দেখিয়া নক্ষত্রটিকে “দৈত্য তারা” বলিতেন। অবশ্য তাঁরা আলো পরিবর্ত্তনের কারণ জানিতেন না, দেখিয়া শুনিয়া অবাক্ হইয়া থাকিতেন। সিটস্ (Cetus) নক্ষত্রমণ্ডলের একটা নক্ষত্রের নাম “মাইরা”। তোমরা নক্ষত্রদের ম্যাপ দেখিয়া দক্ষিণ আকাশে এই নক্ষত্রকে অনায়াসে বাহির করিতে পারিবে। এটি আরো মজার নক্ষত্র। সাধারণতঃ ইহাকে খুব উজ্জ্বল দেখা যায়, কিন্তু দশ মাস অন্তর ইহার আলো এমন কমিয়া যায় যে, তখন তাহাকে খালি চোখে দেখাই যায় না,—দেখিতে গেলে চোখে দূরবীণ লাগাইতে হয়! মজার ব্যাপার নয় কি?

 আজকালকার জ্যোতিষীরা নক্ষত্রদের এই রকম আলো কমা-বাড়া দেখিয়াই ক্ষান্ত হন নাই,—ইহার কারণও আবিষ্কার করিয়াছেন। তাহার কথা শুনিলে তোমরা অবাক্ হইয়া যাইবে।

 আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, আকাশে যতগুলি উজ্জ্বল জীবন্ত নক্ষত্র দেখা যায়, তার চেয়ে অনুজ্জ্বল মরা নক্ষত্রই আকাশে বেশি আছে। জন্ম-মৃত্যুকে কেহই এড়াইতে পারে না। আজ যে সূর্য্য এত তাপ-আলো দিতেছে, লক্ষ লক্ষ বৎসর পরে সে তাহা দিতে পারিবে না, কারণ তখন তাহার তাপ ও আলোর ভাণ্ডার একেবারে খালি হইয়া পড়িবে,—সূর্য্য নিভিয়া যাইবে। আমাদের চাঁদ ও বুধগ্রহ এই রকমেই নিভিয়া মরিয়া গিয়াছে। তাহাদের গায়ে একটুও তাপ নাই এবং নিজেদের আলো দিবার ক্ষমতাও নাই। পৃথিবী, মঙ্গল ও শুক্রেরও সেই দশা উপস্থিত হইতেছে।

 তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, এই মহাকাশটা যেন গ্রহ-নক্ষত্রদের শ্মশান-ক্ষেত্র। জীব-জন্তু গাছ-পালা মরিলে পচিয়া নষ্ট হয়, লোকে পুড়াইয়া ফেলে বা মাটিতে পুঁতিয়া রাখে। কাজেই তাহাদের মৃতদেহের একটু চিহ্নও পৃথিবীর উপরে থাকে না। কিন্তু অনাদি কাল হইতে যে হাজার হাজার নক্ষত্র নিভিয়া ঠাণ্ডা হইয়া মরিতেছে, তাহারা ত এরকমে নষ্ট হইতেছে না; মরিয়া গেলেও তাহাদের শুক্‌নো হাড়গোড়-সার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দেহগুলা আকাশের অন্ধকারের মধ্যে যেখানে সেখানে ছড়াইয়া থাকিতেছে। জীবন্ত নক্ষত্রদের সংখ্যা করা যায়, না হয় সংখ্যার একটা আন্দাজ করা চলে। কিন্তু মরা নক্ষত্রদের আর সংখ্যাই হয় না, অনন্তকাল ধরিয়া তাহারা কেবল বাড়িয়াই চলিয়াছে।

 যাহা হউক আমরা নক্ষত্রদের যে আলোর বাড়া-কমার কথা বলিলাম, তাহা এই মরা নক্ষত্রদেরই কাজ। জোতিষীরা বলেন, যে-সব নক্ষত্রদের আলো বাড়ে কমে তাহাদের সকলেই যমক-তারা; কিন্তু ইহাদের দুটাই জীবন্ত নক্ষত্র নয়,—একটা মরা এবং আর একটা জীবন্ত। মরা নক্ষত্রদের আলো থাকে না, থাকে কেবল জীবন্ত নক্ষত্রদেরই। কাজেই যথন কালো মরা নক্ষত্রটি ঘুরিতে ঘুরিতে উজ্জ্বল জীবন্ত নক্ষত্রটিকে ঢাকিয়া ফেলে, তখন সূর্য্য-গ্রহণের মত নক্ষত্রেও একটা ছোট-খাটো গ্রহণ হইয়া পড়ে। কালো নক্ষত্র যদি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সবটাই ঢাকিয়া ফেলে, তাহা হইলে সর্ব্বগ্রাস গ্রহণ হয়; তথন আলো একেবারেই দেখা যায় না। যদি অর্দ্ধেক বা সিকি পরিমাণে ঢাকিয়া ফেলে, তাহা হইলে আলোও অর্দ্ধেক বা সিকি কমিয়া আসে। জ্যোতিষীরা বলেন, জীবন্ত ও মরা নক্ষত্রদের এই রকম ঢাকাঢাকি ও লুকোচুরি খেলাতেই তাহাদের আলোর বাড়া-কমা দেখা যায়।