গ্রহ-নক্ষত্র/নক্ষত্রদের জন্ম

নক্ষত্রদের জন্ম

মরার কথাই বলিলাম, নক্ষত্রদের জন্মের কথা এখনো বলা হয় নাই। জন্ম ও মৃত্যু বড় মজার ব্যাপার; ইহারা ঠিক্ তালে তালে পা ফেলিয়া পাশাপাশি না চলিলে সংসার টিকিয়া থাকে না।

 বোধ হয় আমার কথাটি বুঝিলে না। এই বাংলা দেশে যে দশ কোটি আন্দাজ লোক আছে, মনে কর আজ হইতে তাহাদের মৃত্যু রহিত হইয়া গেল, কিন্তু জন্ম যেমন চলিতেছে ঠিক্ সেই রকমেই চলিতে লাগিল। বেশি দিন নয়, পঞ্চাশ বৎসর পরে দেশের অবস্থাটা কি হইবে ভাবিয়া দেখ দেখি। তখন নিশ্চয়ই বাংলার মাটিতে পা রাখিবার জায়গাটুও থাকিবে না,—মানুষে মানুষে সমস্ত দেশটা ভরিয়া যাইবে। আবার মনে কর, যেন ভগবানের আজ্ঞায় বাংলাদেশের লোকেরা ম্যালেরিয়া, কলেরা, হাম, বসন্তে যেমন মরিতেছে ঠিক্ সেই রকমই মরিতে লাগিল, কিন্তু কেহ জন্মিল না। তাহা হইলে দেশের অবস্থা কি দাঁড়াইবে ভাবিয়া দেখ। পঞ্চাশ ষাট্ বা সত্তর বৎসর পরে নিশ্চয়ই দেখিবে, বাংলা দেশ শ্মশান হইয়া গিয়াছে,—মানুষের নাম-গন্ধও নাই!

 তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, জন্মমৃত্যু তালে তালে পা ফেলিয়া না চলিলে সংসার থাকে না। আমাদের বাংলার মানুষ লইয়া যে কথা বলিলাম, আকাশের নক্ষত্রদের লইয়া ঠিক্ সেই কথাই বলা চলে। নক্ষত্রদের মধ্যে জন্ম লোপ পাইয়া যদি কেবল মৃত্যুই থাকিত, তাহা হইলে এত দিনে একএকটি করিয়া সব তারা নিভিয়া গিয়া আকাশটাকে অন্ধকার করিয়া ফেলিত। কিন্তু তাহা যখন হয় নাই, তখন মানিয়া লইতে হয়, মানুষের জন্মমৃত্যুর মত নক্ষত্রদেরও জন্ম-মৃত্যু তালে তালে এক সঙ্গে চলে।

 তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, দূরবীণ খাটাইয়া বুঝি এখনি তোমাদিগকে নক্ষত্রদের জন্মমৃত্যু দেখাইব। কিন্তু তাহা পারিব না। মানুষ বাঁচে কত বৎসর জান ত,—সত্তর আশী নব্বুই না হয় একশত বৎসর পর্য্যন্ত। কিন্তু এমন কতকগুলি পোকা আছে, যাহারা দু’ ঘণ্টা তিন ঘণ্টা মাত্র বাঁচে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাহারা জন্মিয়া বড় হয়, বুড়ো হয় এবং মরিয়া যায়। এখন যদি এই রকম একটি পোকার দল একটা পাড়া গাঁয়ে গিয়া কোমর বাঁধিয়া বলে, মানুষ কি রকমে জন্মে ও কি রকমে মরে দেখিতে হইবে, তাহা হইলে তাহারা কি সতাই মানুষের জন্মমৃত্যু দেখিতে পায়। পাড়া গাঁয়ে রোজ মানুষের জন্মমৃত্যু হয় না। কাজেই আস্ফালন করিয়া বসিতে বসিতেই এক ঘণ্টার মধ্যে পোকার দলের ভবলীলা সংবরণ করিতে হয়;—জন্মমৃত্যু দেখিবে কে? নক্ষত্রদের তুলনায় মানুষের পরমায়ু ঠিক পোকার দলের পরমায়ুরই সমান। নক্ষত্রেরা বাঁচে লক্ষ লক্ষ বৎসর, মানুষ বাঁচে এক শত বৎসর। কাজেই আমরা যদি এই একশো বৎসরের পরমায়ু হাতে করিয়া এখনি দূরবীণ খাটাইয়া নক্ষত্রদের জন্মমৃত্যু দেখিতে যাই, তাহা হইলে একটা হাসির ব্যাপার হয় না কি?

 অল্পায়ু পোকাদের সঙ্গে মানুষের তুলনা করিলাম, কিন্তু তাহাদের বুদ্ধি-বিবেচনা যে সত্যই পোকার মত নয়, একথা বোধ হয় তোমাদিগকে বুঝাইয়া দিতে হইবে না। মানুষের খুব উচ্চ বুদ্ধি ও জ্ঞান আছে। তা ছাড়া বর্ত্তমানকে দেখিয়া অতীত কালের কথা বেশ আন্দাজ করিতে পারে এবং ভবিষ্যতে কি হইবে তাহাও সব দিক্ দেখিয়া শুনিয়া ঠিক্ জানিতে পারে। জ্যোতিষীরা বর্ত্তমানের নানা ঘটনা দেখিয়া এই রকমেই নক্ষত্রদের জন্মবৃত্তান্ত লিখিয়াছেন।

 আকাশের কোনো এক জায়গায় হঠাৎ একটা নূতন নক্ষত্র দেখা দিল এবং তাহা শুক্র বা বৃহস্পতির মত উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিয়া দু’মাস চারমাস পরে নিভিয়া গেল, এরকম ঘটনার কথা বোধ হয় তোমরা শুন নাই। আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু দেখি নাই। জ্যোতিষীরা কিন্তু গত এক শত বৎসরে এই রকম সাত আটটি নক্ষত্র জ্বলিতে দেখিয়াছেন।

 এই নক্ষত্রদের জন্মমৃত্যু বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার। ডাক্তার এন্‌ডারসন্ ইংলণ্ডের একজন বড় জ্যোতিষী। ইংরাজি ১৯০১ সালে তিনি এই রকম একটি নূতন নক্ষত্রকে বাহির করিয়াছিলেন। কোথায় কিছু নাই, রাত্রি আড়াইটার সময়ে উত্তর আকাশের এক জায়গায় ইহা জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। প্রথমে তাহার বিশেষ আলো ছিল না, কিন্তু চতুর্থ দিনে সেটি প্রথম দিনের চেয়ে দশহাজার গুণ উজ্জ্বল হইয়াছিল। ভাবিয়া দেখ, আকাশের ঐ জায়গায় কি ভয়ানক আগুন জ্বলিয়াছিল! কিন্তু আগুন বেশি দিন থাকে নাই। জন্মের ঠিক্ পাঁচ ছয় দিন পরে নক্ষত্রটির আলো কমিতে আরম্ভ করিয়াছিল এবং আট দিনে সেটি একেবারে নিভিয়া গিয়াছিল। ১৯০১ সালের পরে আরো গোটা দুই নক্ষত্রের এই রকম জ্বলা ও নিভা দেখা গিয়াছে।

 ইংরাজি ১৮৭৬ এবং ১৮৮৫ সালে যে দুটি নূতন নক্ষত্রকে দেখা গিয়াছিল, সেগুলির কথা আরো আশ্চর্য্য। এই নক্ষত্রগুলি হঠাৎ নিভিয়া যায় নাই, প্রায় একমাস ধরিয়া তাহাদিগকে আকাশে দেখা গিয়াছিল। আজও তাহারা আকাশে জ্বলিতেছে। কিন্তু সাধারণ নক্ষত্রদের মত ইহাদিগকে খালি চোখে দেখা যায় না। দূরবীণ দিয়া দেখিলে বোধ হয়া যেন, এক-একটা প্রকাণ্ড বাষ্পরাশি আকাশে জ্বলিতেছে।

 তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, সকল নূতন নক্ষত্র জন্মিয়াই মরে না; কেহ কেহ বাঁচিয়াও থাকে।

 তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, আকাশের এক কোণে একটি আলোর বিন্দু দেখা গেল, এবং হয় ত মাস-খানেক থাকিয়া নিভিয়া গেল। তাহা লইয়া এত হাঙ্গামা কেন। কিন্তু চোখে একটুখানি দেখাইলেও ইহা কখনই সামান্য আগুন নয়। এই সকল অগ্নিকাণ্ড আকাশের কোটি কোটি মাইল জুড়িয়া চলে। কাজেই জ্যোতিষীরা ঘটনাগুলিকে উড়াইয়া দিতে পারেন নাই। কেন আকাশের খালি জায়গায় হঠাৎ এই রকম আলো জ্বলে, তাঁহারা বৎসরের পর বৎসর আলোচনা করিয়া তবে জানিতে পারিয়াছেন।

 যাহা হউক, এসম্বন্ধে জ্যোতিষীরা যাহা বলেন, তাহা বড়ই আশ্চর্য্যজনক। উল্কাপিণ্ডেরা বাতাসের ভিতর দিয়া জোরে নামিবার সময়ে বাতাসের ঘসা পাইয়া জ্বলিয়া উঠে, একথা তোমরা আগেই শুনিয়াছ; পাথরে পাথরে ঠোকালুকি লাগিলে আগুনের ফুল্‌কি বাহির হয়, তাহা হয় ত স্বচক্ষেই দেখিয়াছ। জ্যোতিষীরা বলেন, নূতন নক্ষত্রের তাপ ও আলো সকলি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জিনিসের ঠোকাঠুকি হইতে উৎপন্ন হয়।

 তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, মহাকাশে আবার এরকম ঠোকাঠুকি হইবে কি রকমে! কিন্তু আকাশে বড় জিনিসের অভাব নাই। যে সব আলোহীন লক্ষ লক্ষ ঠাণ্ডা নক্ষত্র মরিয়া গিয়া ভূতের মত আকাশের অন্ধকারে বেড়াইতেছে, তাহাদের কথা মনে কর। তাহাদের সব গিয়াছে, কেবল গতিটুকুই আছে। কাজেই ভয়ানক বেগে ইহারা যখন পরস্পরকে ধাক্কা দেয়, তখন কি কাণ্ড হয় ভাবিয়া দেখ দেখি। দু’খানা রেলের গাড়ীতে ঠোকাঠুকি হইলে কি হয়, তোমরা শুন নাই কি? তখন একখানা গাড়ীও আস্ত থাকে না। যখন দু’টা বড় বড় মরা নক্ষত্র দু’দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়া পরস্পরকে ধাক্কা দেয়, তখন তাহাদেরও ঐ রকম দশা হয়। দু’টাই চুরমার হইয়া ভাঙিয়া যায়। কেবল ইহাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক আগুন জ্বলে এবং আগুনে তাহাদের দেহের মাটি-পাথর ধাতু সকলি জ্বলিয়া পুড়িয়া বাষ্প হইয়া

ধাক্কার পূর্ব্বে

পড়ে! এই জ্বলন্ত বাষ্পরাশিকেই আমরা দূর হইতে নূতন নক্ষত্রের আকারে দেখি।


ধাক্কার সময়ে

 মরা নক্ষত্রেরা কি রকমে ধাক্কা পাইয়া জ্বলিয়া উঠে এখানে তাহার দুইখানি ছবি দিলাম। ছবি দেখিলেই বুঝিবে মরা নক্ষত্রেরা যখন

ধাক্কার পরে

পরস্পরকে একটুখানি ছুঁইয়া ধাক্কা দেয়, তখন তাহাদের সমস্ত দেহ ভাঙিয়া যায় না। কেবল যেটুকুতে ধাক্কা লাগে তাহাই জ্বলে ও পোড়ে। কাজেই এ রকম ঠোকাঠুকির আগুন বেশি দিন থাকে না, অল্প দিনের মধ্যে ঠাণ্ডা হইয়া নিভিয়া যায়। কিন্তু যখন একটা নক্ষত্র একবারে আর একটার গায়ে পড়িয়া ধাক্কা দেয়, তখন কাহারো রক্ষা থাকে না। নিমেষের মধ্যে দু’টাই সম্পূর্ণ ভাঙিয়া-চুরিয়া জ্বলিয়া উঠে। এই আগুন কয়েক দিনের মধ্যে কমিয়া যায় বটে, কিন্তু একবারে নিভে না। রাবণের চিতার মত তাহা দাউ দাউ করিয়া লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া জ্বলিতে থাকে।

 জ্যোতিষীরা স্বচক্ষে এপর্য্যন্ত যে-সকল নূতন নক্ষত্রের জন্ম দেখিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে কেবল দুইটারই দেহ জ্বলিতে দেখা যাইতেছে। এ কথা তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি। কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, এই মহাকাশে নক্ষত্রদের কেবল দু’টা চিতাই আছে। এই রকম আগুন আকাশের যেখানে-সেখানে দেখা যায়। যখন পৃথিবী ও চন্দ্রসূর্য্যের জন্ম হয় নাই, এরকম প্রাচীন কালেও নক্ষত্রদের ঠোকাঠুকি হইয়াছে এবং তখন যে-সব আগুন জ্বলিয়াছে তাহা নিভিয়া যায় নাই। আকাশের প্রায় পাঁচ হাজার জায়গায় এই রকম আগুনের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। জ্যোতিষীরা এগুলিকে নীহারিকা (Nebula) বলেন। নামটি যতই মিষ্টি হউক না কেন, এগুলি যে সত্যই বড় বড় মরা নক্ষত্রদের চিতার আগুন, তাহা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন।