গ্রহ-নক্ষত্র/সূর্য্যের কলঙ্ক

সূর্য্যের কলঙ্ক

চাঁদের কলঙ্ক আছে, ইহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। চাঁদের উপরে ঐ কলঙ্কের দাগগুলিকে লইয়া যে-সব গল্পের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাও তোমরা হয় ত শুনিয়াছ। কেহ বলে, চাঁদে এক বুড়ী আছে, সে সেখানে এক কদম-তলায় বসিয়া চরকায় সূতা কাটিতেছে। কেহ বলে, চাঁদ এক সময়ে নাকি একটা শশক অর্থাৎ খরগোস চুরি করিয়াছিল এবং এই পাপের জন্য তার গায়ে সেই খরগোসটার চেহারা চিরদিনের জন্য আঁকা আছে। এ সব গল্প কখনই সত্য নয়। চাঁদের গায়ের দাগগুলি

সূর্য্যের কলঙ্ক

যে কি, তাহা তোমাদের পরে বলিব। কিন্তু তোমাদের বোধ হয় জানা নাই যে, চাঁদের কলঙ্কের ন্যায় সূর্য্যেরও কলঙ্ক আছে। চাঁদের কলঙ্ক যেমন চিরদিনের মত তাহার গায়ে লাগানো থাকে, সূর্য্যের কলঙ্ক অবশ্য সে-রকম থাকে না। দু’দিন দশদিন বা মাসখানেক ধরিয়া সূর্য্যের গায়ে এগুলি কালো কালো দাগের মত দেখা দেয় এবং তার পরে আবার ধীরে ধীরে মিলাইয়া যায়। এগুলি বড় মজার জিনিস। যদি ছোটখাটো দূরবীণ দিয়া সূর্য্যকে দেখার সুবিধা পাও, তবে একবার সূর্য্যের কলঙ্ক দেখিয়া লইও। সূর্য্যের কোনো-না-কোনো অংশে এই কলঙ্ক প্রায় সকল সময়েই দেখা যায়।

 কি রকমে এই সকল কলঙ্কের সৃষ্টি হয়, এখন দেখা যাউক।

 আমাদের আকাশ এক এক সময়ে মেঘে কি-রকম ঢাকা থাকে, তাহা তোমরা দেখিয়াছ। সে সময়ে যদি একটা প্রকাণ্ড ঝড় উঠে, তবে মেঘের অবস্থা কি-রকম হয়, তাহা লক্ষ্য করিয়াছ কি?—ঝড়ে মেঘ উড়াইয়া লইয়া যায়, তখন হয় ত মেঘের ফাঁক দিয়া নীল আকাশ দেখা যায় এবং মেঘেরা এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করিতে থাকে।

 মেঘ হইয়াছে এবং ঝড় উঠিয়াছে; মনে কর, এমন সময়ে তুমি একটা ব্যোমযান বা এরোপ্লেনে চড়িয়া মেঘ ও ঝড় ছাড়িয়া আকাশের খুব উপরে ভাসিয়া বেড়াইতেছ। তখন তুমি নীচের দিকে তাকাইলে কি দেখিবে?—তোমার এরোপ্লেনের নীচে যে ঘর-বাড়ী, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্ব্বত আছে, তাহা তোমার নজরেই পড়িবে না; কারণ, এরোপ্লেনের নীচে যে মেঘ আছে, তাহা তোমার দৃষ্টি আট্‌কাইয়া দিবে। মনে কর, একটা দম্‌কা হাওয়া আসিয়া যেন নীচেকার মেঘের কতক অংশ উড়াইয়া দিল। এখন তুমি মেঘের এই ফাঁক দিয়া নিশ্চয় নীচের ঘর-বাড়ী বন-জঙ্গল সব দেখিতে পাইবে। এরোপ্লেনে চড়িয়া সমস্ত পৃথিবীটাকে যে সাদা মেঘের আবরণে ঢাকা দেখিয়াছিলে, কতক কতক মেঘ ঝড়ে উড়িয়া যাওয়ায়, তাহার স্থানে স্থানে যেন এক-একটা গর্ত্ত হইয়া পড়িবে এবং এই গর্ত্তের ভিতর দিয়া পৃথিবীর উপরকার গাছ-পালাকে কালো কালো দেখাইবে। সূর্য্যের দেহে যে কলঙ্ক দেখা যায়, তাহা সম্ভবত এই-রকম ঝড়েই জন্মে বলিয়া পণ্ডিতেরা ঠিক করিয়াছেন।

 সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলটা বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। লক্ষ লক্ষ মাইল জুড়িয়া নানা-রকম বাষ্প ইহাতে জ্বলে এবং পোড়ে। কাজেই জ্বলন্ত বাষ্প ভয়ানক বেগে ছুটাছুটি করিয়া এবং ধাক্কাধাক্কি দিয়া সূর্য্যে প্রায়ই ঝড় উঠায়। ঝড় ছোটখাটো হইলে আমরা এতদূরে থাকিয়া তাহার সন্ধানই করিতে পারি না; কিন্তু যখন বড় ঝড় উঠে, তখন আমরা তাহার পরিচয় পৃথিবীতে বসিয়া-বসিয়াই পাইতে থাকি। তখন ঝড়ের জোরে সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলের জ্বলন্ত বাষ্প স্থানে স্থানে ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যায়; কাজেই সেই সকল জায়গার ফাঁকে উহার আসল দেহটা আমাদের নজরে পড়িতে থাকে। তোমাদের পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আলোক-মণ্ডলের তাপ ও আলোই সূর্য্যকে এত উজ্জ্বল ও গরম করিয়াছে। যে ঘন বাষ্প দিয়া সূর্য্যের আসল দেহটা নির্ম্মিত, তাহা খুব উজ্জ্বল নয় এবং গরমও নয়। এইজন্যই অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলের ফাঁক দিয়া সূর্য্যের দেহটা কালো দেখায়।

 ঝড়ের সময়ে আলোক-মণ্ডলের উজ্জ্বল বাষ্প সরিয়া গিয়া এই রকমে যে কালো কালো গর্ত্ত উৎপন্ন করে, সেই-গুলিকেই আমরা দূর হইতে সূর্য্যের কলঙ্কের আকারে দেখি। আমাদের বায়ুমণ্ডলে ঝড় উঠিলে, তাহা হয় ত দু’ঘণ্টা চার ঘণ্টা, না হয় একদিন দুইদিন থাকে। কিন্তু সূর্য্য যেমন প্রকাণ্ড জিনিস, তাহার ঝড়ও তেমনি প্রকাণ্ড। একবার ঝড় উঠিলে তাহা পনেরে কুড়ি দিনের কমে থামে না। কখনো কখনো থামিতে এক মাসের উপরেও সময় লয়। কাজেই ঝড়ে সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলে যে গর্ত্ত উৎপন্ন হয়, তাহাও ঐ-রকম একমাস-পর্য্যন্ত থাকে। একবার একটা ঝড় উঠিয়াছিল, তাহা ছয় মাস পর্য্যন্ত ছিল। এই কারণে সূর্য্যের উপরে একবার কলঙ্ক দেখা দিলে, তাহা খুব শীঘ্র মুছিয়া যায় না। এগুলির আকারও বড় কম নয়; কখনো কখনো ইহা এত বড় হয় যে, খালি চোখেও দেখা যায়। আমরা প্রায় দশ বৎসর পূর্ব্বে এই-রকম একটা বড় কলঙ্ককে দূরবীণ না দিয়া কেবল কালী-মাখানো কাচের ভিতর দিয়া দেখিয়াছিলাম। সেই গর্ত্তটা এত বড় ছিল যে, হাজারটা পৃথিবী তাহার ভিতরে অনায়াসে লুকাইয়া থাকিতে পারিত!


সূর্য্যের একটা খুব বড় কলঙ্ক

 ঝড়ের জোরে আলোক-মণ্ডল ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেই যে, কলঙ্ক জন্মে, কলঙ্কের ছবিটা ভাল করিয়া দেখিলেই তাহা তোমরা আন্দাজ করিয়া লইতে পারিবে।

 সূর্য্যের কলঙ্ক কি রকমে জন্মে তাহা ঠিক করিয়া উহার আলোক-মণ্ডল সম্বন্ধে অনেক কথা পণ্ডিতের আবিষ্কার করিয়াছেন। কিন্তু এখনো জানিতে অনেক বাকি আছে।

 সূর্য্যের কলঙ্ক পরীক্ষা করিয়া জ্যোতিষীরা যে রকমে সূর্য্যের গতি আবিষ্কার করিয়াছেন, এখন সেই কথাটা তোমাদিগকে বলিব।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, পৃখিবী লাট্টুর মত নিজে নিজে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক খায় এবং ইহাতেই দিন রাত্রি হয়। সূর্য্য এ-রকমে লাট্টুর মত ঘুরে কি না, তাহা আমাদের জানা ছিল না। এখন সূর্য্যের কলঙ্ক পরীক্ষা করিয়াই ইহারও ঘুরপাক খাওয়ার কথা জানা গিয়াছে।

 এক-রঙা গোল জিনিসের গায়ে যদি কোনো দাগ না থাকে, তবে খুব জোরে ঘুরিতে থাকিলেও, তাহা ঘুরিতেছে কি না দূর হইতে বুঝা যায় না। মনে কর, কুড়ি হাত দূরে একটা সাদারঙ-করা ফুট্‌বলের মত বড় লাট্টু ঘুরিতেছে; ইহা ঘুরিতেছে কি না, তুমি দূর হইতে বুঝিতে পারিবে কি? মনে হইবে, যেন সাদা ফুট্‌বল্‌টি স্থির হইয়া দাঁড়াইয়াই আছে। কিন্তু ঐ সাদা ফুট্‌বলে যদি একটা বড় রকমের কালো দাগ থাকে এবং বল্ যদি ধীরে ধীরে ঘুরে, তাহা হইলে সেই কালো দাগ একবার তোমার সম্মুখে আসিয়া আবার পিছনে পড়িতে থাকিবে। ইহা দেখিয়াই তুমি বুঝিতে পারিবে যে, ফুট্‌বল্ ঘুরিতেছে। সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলে যে কলঙ্ক প্রকাশ পায়, তাহা ঐ ফুট্‌বলের কালো দাগের মত একবার সম্মুখে আসিয়া কয়েক দিনের মধ্যে সূর্য্যের পিছনে চলিয়া যায় এবং আবার সম্মুখে আসিয়া দেখা দেয়।

 ইহা দেখিয়াই পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, পৃথিবী যেমন তাহার অক্ষরেখার উপরে দাঁড়াইয়া লাট্টুর মত ঘুরপাক খায়, সূর্য্যও ঠিক সেই রকমে ঘুরপাক খায়। তাহা না হইলে উহার কলঙ্কগুলি কখনই সম্মুখ হইতে ধীরে ধীরে পিছনে লুকাইত না। কেবল ইহাই নয়, এক একটা কলঙ্ক সূর্য্যের সম্মুখ হইতে পিছনে গিয়া আবার ঘুরিয়া সম্মুখে আসিতে যে সাতাইশ দিন সময় লয়, ইহাও ঠিক করা হইয়াছে। কাজেই বলিতে হইতেছে, পৃথিবী যেমন চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক থায়, সূর্য্য তেমনি সাতাইশ দিনে একটা ঘুরপাক দেয়। এখানে কিন্তু পৃথিবীরই জিত, কারণ পৃথিবী সূর্য্যের চেয়ে খুব জোরে জোরে পাক খায়।