ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
প্রহরীগণ যেরূপ ভাবে সেই সরাইতে বিশ্রাম করিতে লাগিল, তাহাতে তাহারা যে শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, এরূপ অনুমান হইল না। এক্কা-চালকগণ তাহাদিগের এক্কার ঘোড়া এক্কা হইতে খুলিয়া দিয়া ঘাস-দানার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া হোসেন সেই সর্দ্দার-প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কি আপনারা এই স্থানে অবস্থান করিবেন?”
প্রহরী। রাত্রিযাপন আমরা এই স্থানে করিব না। এই স্থান হইতে দুই ক্রোশ ব্যবধানে একটা খানা আছে, রাত্রিকালে সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে হইবে।
হোসেন। এক্কা-চালকগণ যেরূপ ভাবে একা চালাইয়া আসিতেছে, তাহাতে দুই ক্রোশ পথ গমন করিতে অতি অল্প সময়েরই প্রয়োজন হইবে।
প্রহরী। এই স্থান হইতে বাহির হইলে, একঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেই থানায় গিয়া অনায়াসেই উপস্থিত হইতে পারিব।
হোসেন। আপনারা এই স্থান হইতে কখন রওনা হইতে চাহেন?
প্রহরী। একটু বিশ্রাম করিবার পরই, আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
হোসেন। আপনাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত কোথায় হইবে? প্রহরী। থানায় গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই স্থানেই আহারাদি করিব, এরূপ বিবেচনা করিতেছি।
হোসেন। এই স্থানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। এই স্থান হইতে আহারাদি করিয়া, থানায় গমন করিলে হইত না কি?
প্রহরী। তাহা হইলে আমরা কখন থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিব?
হোসেন। আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া যদি আমরা এই স্থান হইতে রওনা হই, তাহা হইলে সন্ধ্যার পূর্ব্বেই দুই ক্রোশ পথ অনায়াসেই অতিক্রম করিতে পারিব। সন্ধ্যার পূর্ব্বেই যদি আপনারা আসামীর সহিত থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
প্রহরী। ক্ষতি কিছুই নাই; কিন্তু এখানে থাকিয়া আমাদিগের লাভ কি?
হোসেন। লাভ আর কিছুই নহে, কেবল সময় মত আহার করিয়া লইতে পারিবেন।
প্রহরী। এখানে আহারাদি করিবার কি সুবিধা হইবে?
হোসেন। না হইবে কেন? এখানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়।
প্রহরী। এখানে আহারাদি প্রস্তুত করার পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা হইবে।
হোসেন। কিসে?
প্রহরী। মোটে আমরা পাঁচজন বই প্রহরী নই। আমরা সকলেই এখন পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। ইহার মধ্যে আসামীদ্বয়কে পাহারাই বা কে দিবে, আহারাদির আয়োজনই বা কে করিবে?
হোসেন। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরাই সমস্ত আয়োজন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।
প্রহরী। কে রন্ধন করিবে?
হোসেন। আমি আছি, আমার দুইজন পরিচারকও রহিমাছে। অনুমতি পাইলে আহারীয় প্রস্তুত করিতে আর কত বিলম্ব হইবে?
প্রহরী। তোমাদিগের প্রস্তুত করা আহারীয় দ্রব্য আমরা কিরূপে আহার করিতে পারি?
হোসেন। কেন?
প্রহরী। আমি শুনিয়াছি, বহুদিবস হইল, এইরূপ একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল। একজন কয়েদী-আসামীকে লইয়া দুইজন প্রহরী গমন করিতেছিল। যাইতে যাইতে পথে অপর আর একজন লোক আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হয়। সেই ব্যক্তি সেই আসামীর দলস্থিত একজন; কিন্তু এ পরিচয় সে পূর্ব্বে সেই প্রহরীদ্বয়ের নিকট প্রদান করে নাই। ক্রমে তাহারা এইরূপ একটী সরাইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই ব্যক্তিই সকলের আহারীয় প্রস্তুত করে। প্রথমে আসামীকে আহার করান হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার কোনরূপ অসুখ হয় না। পরিশেষে প্রহরীদ্বয় আহার করিতে বসে, কিন্তু আহার করা শেষ হইতে না হইতেই উভয়েই হতজ্ঞান হইয়া পড়ে। পরে সরাইয়ের লোকজন যখন জানিতে পারে যে, দুইজন প্রহরী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তখন তাহারা সেই স্থানে গমন করে; কিন্তু সেই কয়েদী-আসামী এবং আহার-প্রস্তুতকারীকে আর তাহারা দেখিতে পায় না। এই সংবাদ ক্রমে থানায় গিয়া উপস্থিত হয়। প্রহরীদ্বয়কে হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। থানাদার নিজে আসিয়া এই ঘটনার সবিশেষ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই পাওয়া যায় না। উভয় ব্যক্তির মধ্যে কেহই ধৃত হয় না। অধিকন্তু প্রহরীগণ চৈতন্য লাভ করিলে জানিতে পারা যায় যে, তাহাদিগের নিকট যে সকল টাকা-পয়সা ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। ইহা যখন প্রকৃত ঘটনা বলিয়া সকলেই অবগত আছেন, তখন বলুন দেখি, আমরা কিরূপে আপনাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে বন্ধন করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারি?
হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আপনারা আমাকে পূর্ব্ব হইতে জানেন কি না, বলিতে পারি না। যদি আমাকে পূর্ব্ব হইতে জানিতেন, তাহা হইলে আপনার আমাকে বোধ হয়, এতদূর অবিশ্বাস করিতে পারিতেন, না। সে যাহা হউক, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করিতেই না পারেন, তাহা হইলে অপর আর কোনরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে না কি? অপর যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে বলেন, আমরা সেইরূপ করিতেই প্রস্তুত আছি। প্রহরী। আর কি বন্দোবস্ত হইতে পারে?
হোসেন। আমরা আর সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি, আপনাদিগের এক ব্যক্তি অনায়াসেই পাক করিয়া লইতে পারেন।
প্রহরী। আমরা সকলেই অতিশয় ক্লান্ত। সুতরাং আমাদিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সেই কার্য্য যে সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহা আমি বোধ করি না।
হোসেন। যদি এ কার্য্য আপনাদিগের দ্বারা না হয়, তাহা হইলে আপনাদিগের মধ্যে একজন যদি রন্ধনশালার নিকট উপস্থিত থাকিতে পারেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী একজন লোকের দ্বারা আমি কার্য্য করাইয়া লইতে পারি। আপনাদিগের সম্মুখে যদি আহারীয় প্রস্তুত হয়, তাহা হইলে আমরা উহাতে কিরূপে বিষ মিশ্রিত করিতে পারিব?
প্রহরী। অত গোলযোগে কায নাই। আমরা একরূপ জলযোগ করিয়াছি, এখন আর আহার করিবার ইচ্ছা নাই। সুতরাং আহারীয় প্রস্তুত করিবার আর প্রয়োজন কি? আপনারা ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আহারাদি প্রস্তুত করিয়া অনায়াসেই আহার করিতে পারেন।
হোসেন। আমি আমাদিগের আহারের নিমিত্ত বলিতেছি না। আপনারা যে আসামীদ্বয়ের সহিত আসিয়াছেন, তাহাদিগের আজ কয়েকদিবস হইতে আহার হয় নাই; কোন দিন অনাহারে, কোন দিন জলাহারে, দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন। ইহাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা পরে হইবে; কিন্তু এখন আমাদিগের ইচ্ছা, উঁহাদিগকে কিছু আহার করাই। এই নিমিত্ত আপনাদিগকে এত অনুরোধ করিতেছি। প্রহরী। উহারা ত এখনই আহার করিলেন?
হোসেন। বাজারের মিষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন করিয়া কোন্ ব্যক্তি কয় দিবস জীবনধারণ করিতে পারে?
প্রহরী। যখন আপনারা আহারাদি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত এতই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন আমার সম্মুখে আপনারা আমাদিগের সকলের আহারীয় প্রস্তুত করুন। আহারীয় প্রস্তুত করিবার সময় আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, ইহাতে আপনাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি আছে কি না।
হোসেন। এ উত্তম কথা। উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্ত্তা হইবার পর, হোসেন নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া সকলের আহারাদির উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।