চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/গুপী-সায়েব

গুপী সায়েব

ই লোকটির নয় আপনাদের হয়তো জানা নেই। আমিও তাকে ভুলে গিয়েছিলুম, কিন্তু সেদিন হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তার যে ইতিহাস নয়নচাঁদ পাইন আর দাশু মল্লিককে বলেছিলুম তাই আজ আপনাদের বলছি। নয়নচাঁদ আর দাশু তা মন দিয়ে শোনেন নি, কারণ তাঁদের তখন অন্য ভাবনা ছিল। আমার বিশ্বাস, গুপী সায়েব অখ্যাত হলেও একজন অসাধারণ গুণী লোক। আশা করি আপনারা যথোচিত শ্রদ্ধাসহকারে তার এই ইতিহাস শুনবেন।

 নয়নচাঁদ পাইনের ঘড়ির ব্যবসা আছে। দাশু মল্লিক তাঁর দূর সম্পর্কের শালা, নেশাখোর, কিন্তু খুব সরল লোক। নয়নচাঁদের ছেলের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কনের ঠাকুরদা হৃদয় দাসের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, সেজন্যে নয়নচাঁদ আমাকে অনুরোধ করেছেন তাঁর দাবি সম্বন্ধে আমিই যেন হৃদয় দাসের সঙ্গে কথা বলি। দাবির দুটি আইটেমর ওপর আমাকে বেশী জোর দিতে হবে। এক নম্বর— পাত্রের পিতার জন্যে একটি মোটর গাড়ি অগ্রিম চাই, উত্তম সেকেণ্ড হ্যাণ্ড হলেও চলবে। দু নম্বর—যেহেতু এদেশে পাত্রের তেমন লেখাপড়া হল না, সেকারণে দাদা শ্বশুরের খরচে তাকে জেনিভা পাঠাতে হবে, ঘড়ি তৈরি শেখবার জন্যে।

 আমার দৌত্যের ফল কি হল তা জানবার জন্য দাশু মল্লিক আমার কাছে এসেছেন, নয়নচাঁদও একটু পরে আসবেন। আমি বললুম, দাশুবাবু, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, পাইন মশাই এলেই সব খবর বলব। ততক্ষণ একটা বর্মা চুরটে টনন।

 দাশু মল্লিক ধূমপান করতে করতে চুপিচুপি বললেন, দেখ হে, তুমি এই দেনাপাওনার ব্যাপারে বেশী জড়িয়ে প’ড়ো না, পরে হয়তো লজ্জায় পড়বে। আমার ভাগনে, মানে নয়নচাঁদের ছেলে একটি পাঁঠা।

 এমন সময় নয়নচাঁদ এলেন, এসেই একটা তাকিয়া টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লেন।

 আমি প্রশ্ন করলুম, কি হল পাইন মশাই, শরীরটা খারাপ নাকি?

 নয়নচাঁদ আঙুল নেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাদের এই বলে রাখলুম, দেশ উচ্ছন্নে যেতে বসেছে, সর্বনাশের আর দেরি নেই।

 দাশু মল্লিক আর আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলুম। নয়নচাঁদ বলতে লাগলেন, গেল হপ্তায় মানিকতলা বাজারে পকেট থেকে সাড়ে চোদ্দ টাকা উধাও হল। আবার আজ সকালে কলেজস্ট্রীট মার্কেটে ঊনিশ টাকা তেত্রিশ নয়াপয়সা মেরে নিয়েছে। তোমাদের মিনমিনে গণতন্ত্রী সরকারকে দিয়ে কিছুই হবে না, জবরদস্ত আয়ুবশাহী গভরমেণ্ট দরকার, পকেটমার চোর আর ভেজালওয়ালাদের সরাসরি ফাঁসিতে লটকাতে হবে।

 দাশু মল্লিক বললেন, যা বলেছ দাদা। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, তেরো-চোদ্দ বছর আগে লীগ মন্ত্রীদের আমলে পুরো একটি বছর পিকপকেটিং একবারে বন্ধ ছিল, নট এ সিংগল কেস। তার পর যেমন স্বাধীনতা এল, আবার যে কে সেই।

 আমি বললুম, আপনারা প্রকৃত খবর জানেন না। লীগ মন্ত্রীদের বা পুলিসের কিছুমাত্র কেরামতি ছিল না, পকেটমারদের ঠাণ্ডা করেছিল আমাদের গুপী সায়েব।

 নয়নচাঁদ বললেন, তিনি আবার কে?

 —আমার এখানে দেখে থাকবেন, এখন ভুলে গেছেন। তেরো-চোদ্দ বছর আগে প্রায়ই এখানে আসত, অতি অদ্ভুত লোক।

 —ফিরিঙ্গী নাকি?

 —না, খাঁটী বাঙালী। গুপী সায়েবের আসল নাম বোধ হয় গোপীবল্লভ ঘোষ, গোপীনাথ গোপেশ্বর কিংবা গোপেন্দ্রও হতে পারে, ঠিক জানি না। একটা বিস্কুটের কারখানায় কাজ করত। এখনকার ছোকরারা যেমন প্যাণ্ট-শার্ট প’রে গলায় লম্বা টাই উড়িয়ে খালি মাথায় রোদে ঘুরে বেড়ায়, স্বাধীনতার আগের যুগে তেমন ফ্যাশন ছিল না। রামানন্দ চাটুজ্যে মশাই একবার লিখেছিলেন, রোদে বেরুতে হলে মাথায় হ্যাট দেওয়া ভাল, দেশী সাজের সঙ্গেও তা চলতে পারে। গুপী এই উপদেশটি শিরোধার্য করেছিল, ধুতি পঞ্জাবি প’রে মাথায় শোলা হ্যাট দিয়ে বাইসিকল চড়ে ঘুরে বেড়াত। একবার অর্ধোদয় যোগের সময় তাকে দেখেছিলুম, একটা গামছা প’রে আর একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে মাথায় হ্যাট দিয়ে হাতে কমণ্ডলু ঝুলিয়ে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে। এই হ্যাটের জন্যেই সবাই তাকে গুপী সায়েব বলত।

 নয়নচাঁদ বললেন, তোমার ভণিতা রেখে দাও, পকেট-মারা কিসে বন্ধ হল তাই চটপট বলে ফেল। আমাদের এখন অনেক কাজ আছে। একটা বিয়ের যোগাড় কি সোজা কথা!

 একটু চটে গিয়ে আমি বললুম, গুপী সায়েব হেঁজিপেঁজি লোক নয়, তার ইতিহাস বলতে সময় লাগে, আর ধীরে-সুস্থে তা শুনতে হয়। আপনাদের যখন ফুরসত নেই তখন থাক।

 নয়নচাঁদ বললেন, আরে না না, রাগ কর কেন। কি জান, মনটা একটু খিঁচড়ে আছে, তাই ব্যস্ত হয়েছিলাম। হাঁ ভাল কথা, শুনলুম হৃদয় দাস নাকি একটা ভাল রোভার গাড়ির জন্যে বায়না করেছে। তা হলে কঞ্জুস বুড়োর সুব্বুদ্ধি হয়েছে?

 —তা হয়েছে।

 —বেশ বেশ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। যাক, এখন তুমি গুপী সায়েবের ইতিহাস বল।

 আমি বলতে লাগলুম।—

গুপী সায়েব লেখাপড়া বেশী শেখে নি, কিন্তু ছোকরা খুব পরোপকারী ছিল আর হরেক রকম জানোয়ার সম্বন্ধে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। তার মক্কেলও ছিল বিস্তর। পয়সার জন্যে নয়, শখের জন্যেই সে ফরমাশ খাটত, তবে কেউ কিছু দিলে খুশী হয়ে নিত। মনে করুন আপনি একটা ভাল কাবুলী বেরাল চান। গুপী সায়েব ঠিক যোগাড় করে দেবে, এমন বেরাল যার ন্যাজ খ্যাঁকশেয়ালকে হারিয়ে দেয়। আমাদের পাড়ার রাধাশ্যাম গোসাঁইএর নাতির শখ হল একটা বুলডগ পুষবে। কিন্তু বাড়িতে মাংস আনা বারণ। গ্রুপী সায়েব এমন একটা কুত্তা এনে দিল যে ভাত ডাল ডাঁটা-চচ্চড়িতেই তুষ্ট, আর হাড়ের বদলে এক টুকরো কঞ্চি বা একটি পুরনো টুথব্রশ পেলেও তার চলে। কালীচরণ তন্ত্রবাগীশকে মনে আছে? লোকটা গোঁড়া শাক্ত, রাধাকৃষ্ণ কি সীতারাম শুনলে কানে আঙুল দিতেন। তাঁর শখ হল একটি ময়না পুষবেন, কিন্তু বৈষ্ণবী বুলি কপচালে চলবে না। গুপী সায়েব তারাপীঠ না চন্দ্রনাথ কোথা থেকে একটা পাখি নিয়ে এল, সে গাঁজাখোরের মতন হেঁড়ে গলায় শুধু বলত, তারা তারা বল্ শালারা।

 সেই সময় হ্যারিসন রোডে বিখ্যাত সিনেমা হাউস ছিল ঝমক মহল। করুগেট লোহার ছাত, তার নীচে কাঠের সীলিং। বহুকালের পুরনো বাড়ি, সীলিংএ অনেক ফাঁক ছিল, তাই দিয়ে বিস্তর পায়রা ঢুকে ভেতরের কার্নিসে রাত্রিযাপন করত। অডিটোরিয়ম এত নোংরা হত যে দর্শকরা হল্লা করতে শুরু করল। ম্যানেজার হরমুসজী ছিপিওয়ালা পায়রা তাড়াবার অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুই হল না। মেরে ফেলবার উপায় নেই, কারণ হিন্দুর চোখে গরু যেমন ভগবতী, তেমনি হিন্দু, মুসলমান আর পারসীর চোখে পায়রা লক্ষ্মীর প্রজা। ছিপিওয়ালা সায়েব লোকপরম্পরায় শুনলেন, পায়রা তাড়াতে পারে একমাত্র গুপী সায়েব। তাকে কল দেওয়া হল। সে বলল, খুব সোজা কাজ। রাত বরোটার পর যখন শো বন্ধ হবে আর পায়রার দল বেহুঁশ হয়ে ঘুমুবে তখন দু-তিন জন লোক লাগিয়ে দেবেন। তারা মই দিয়ে উঠবে আর প্রত্যেকটি পায়রার পেট টিপে ছেড়ে দেবে। পায়রার স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ নয়, সেজন্যে দিন কতক নিয়মিত ভাবে পেট টেপা দরকার। ক্রমশ তাদের হৃদয়ংগম হবে যে এই ঝনক মহল সিনেমা ভবন পায়রার পক্ষে মোটেই নিরাপদ আশ্রয় নয়। গুপী সায়েবের ব্যবস্থা অনুসারে হরমুসজী ছিপিওয়ালা প্রাত্যহিক পেট টেপার অর্ডার দিলেন, দিন কতক পরেই পায়রার দল বিদায় হল। গুপী পঁচিশ ঢাকা দক্ষিণা পেল। তার কয়েক মাস পরে সিনেমা হাউসের ভাড়া নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় ছিপিওয়ালা সায়েব নাগপুরে চলে গেলেন, ঝনক মহলের মালিক পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন হাউস বানালেন।

 একদিন গুপী সায়েব আমার এখানে এসেছে, তার ডান হাতে রবারের দস্তানা, বাঁ হাতে একটা দেশলাই-এর বাক্স। আমরা প্রশ্ন করলুম, ব্যাপার কি? গুপী সায়েব জবাব দিল না, ফরাসের ওপর দুখানা খবরের কাগজ বিছিয়ে দেশলাইএর বাক্স খুলে তার ওপর ঢালল। ছোট ছোট জুঁই ফলের কুঁড়ির মতন সাদা পদার্থ। গুপী বলল, ডেয়ো পিঁপড়ের ডিম, বারো টাকা ভরি, দু আনা দিয়ে এক রতি কিনেছি, খুব পোষ্টাই। তার পর দস্তানা পরা ডান হাত পকেটে পুরে আবার বের করল, কাঁকড়াবিছেতে হাত ছেয়ে গেছে। আমরা ত্রস্ত হয়ে তক্তপোশ থেকে নেমে গেলুম। কাঁকড়াবিছের দল গুপীর হাত থেকে কাগজের ওপর পড়ল আর টপ টপ করে সমস্ত পিঁপড়ের ডিম খেয়ে ফেলল। তার পর গুপী সায়েব তার পোষা জানোয়ারদের আবার পকেটে পুরল।

 আমরা সবাই বললুম, তোমার এ কিরকম ভয়ংকর শখ? কোন্ দিন বিছের কামড়ে মারা যাবে দেখছি।

 গুপী সায়েব বলল, আপনারা জানেন না, কাঁকড়াবিছে অতি উপকারী প্রাণী। বিছানায় ছারপোকা হয়েছে? কীটিংস পাউডারে কিছু হচ্ছে না? (তখন ডিডিটি ইত্যাদি বেরোয় নি)। গুটিকতক কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দিন, তিন-চার দিন অন্য ঘরে রাত্রিযাপন করুন, তার পর দেখবেন ছারপোকা নির্বংশ, আণ্ডা বাচ্চা ধাড়ী সমস্ত সাবাড়। আলমারি কি দরজা-জানালায় উই লেগেছে? ভাঁড়ার ঘরে পিঁপড়ে? তারও দাবাই কাঁকড়াবিছে।

 জিতেন বোসের নাম শুনে থাকবেন। ভদ্রলোকের পুরনো বই সংগ্রহের বাতিক আছে। একদিন এখানে আড্ডা দিতে এসেছেন। কথায় কথায় বললেন, আর তো পারা যায় না, কলকাতার যত রিসার্চ স্কলার আর পি-এচ. ডি. আছেন সবাই আমার ওপর হামলা করছেন। কেবলই বলেন, এই বইটা দু দিনের জন্যে দাও, ওইখানা সাত দিনের জন্যে দাও। বই দিলে কিন্তু ফেরত আসে না। ওমর খাইয়ামের স্বহস্তে লেখা একটি মহামূল্য পুঁথি আমার আছে। ডকটর সীতারাম নশকর সেই পুঁথিটি বাগাতে চান, একজন জর্মন প্রোফেসরকে দেখাবেন। নশকর মশাইকে হাঁকিয়ে দিতে পারি না, এককালে তাঁর কাছে পড়েছিলুম। তানানানা করে এতদিন কাটিয়েছি, কিন্তু আসছে রবিবারে তিনি আবার আসবেন, কি ছুতো করব তাই ভাবছি।

 দৈবক্রমে গ্রুপী সায়েব উপস্থিত ছিল। সে বলল, আপনি ভাববেন না জিতেনবাবু। আপনার প্রত্যেক আলমারিতে আমি পাঁচটি করে কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেব আর গুটিদশেক ডিম। কেউ বই চাইলে বলবেন, আলমারি বিছেয় ভরতি, বই নিতে পারেন অ্যাট ইওর রিস্ক।

 জিতেনবাবু রাজী হলেন, গুপী সায়েব যথোচিত ব্যবস্থা করল। তার পর ডকটর নশকর এসে ওমর খাইয়াম চাইলেন। জিতেনবাবু বললেন, মহা মুশকিল সার, সব আলমারি বিছেয় ভরে গেছে। এই সেদিন আমার ভাগনেকে কামড়েছে, বেচারা হাসপাতালে আছে। আমার তো হাত দেবার সাহস নেই। আপনি যদি নিরাপদ মনে করেন তবে বইটা খুঁজে বের করে নিতে পারেন। ডকটর নশকর সন্দিগ্ধ মনে আলমারিতে উঁকি মেরে দেখলেন, কাঁকড়াবিছে সঙিন খাড়া করে পাহারা দিচ্ছে। তিনি তখনই ওবাবা বলে প্রস্থান করলেন।

 এইবার গুপী সায়েবের মহত্তম অবদানের কথা শুনুন। কিছুকাল তার দেখা পাই নি, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা টেলিফোন বেজে উঠল। কে আপনি? উত্তর এল, আমি গুপী, আপনাদের গুপী সায়েব, মুচীপাড়া থানা থেকে বলছি। আমাকে গ্রেপতার করেছে, শিগগির আসুন, বেল দিতে হবে।

 থানায় গিয়ে দেখলুম, একটা সরু কঠের বেঞ্চে বসে গুপী সায়ের পা দোলাচ্ছে, দারোগা গুলজার হোসেন তাঁর চেয়ারে বসে কটমট করে তার দিকে চেয়ে আছেন। গুপীর পশেই বেঞ্চে আর একটি লোক বসে আছে, রোগা, বেঁটে, অল্প দাড়ি আছে, পরনে ময়লা ইজার ফরসা জামা, মাথায় টুপি। লোকটি কাতর স্বরে মাঝে মাঝে ‘বাপ রে বাপ' বলছে আর একটা গামলায় বরফ দেওয়া জলে হাত ডোবাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ব্যাপার কি ইনস্পেকটার সাহেব?

 গুলজার হোসেন বললেন, এই গোপী ঘোষ আপনার ফ্রেণ্ড? অতি ভয়ানক লোক, এই বেচারা চোট্টু মিঞার জান লিয়েছেন।

 ব্যাপার যা শুনলুম তা এই।—গুপী সায়ের বউবাজারে কি কিনতে গিয়েছিল। চোট্টু মিঞা পকেট মারবার জন্যে গুপীর পকেটে হাত পোরে, সঙ্গে সঙ্গে দুটো কাঁকড়াবিছে তাকে কামড়ে দেয়। যন্ত্রণায় চোট্টু অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখন দুজন পাহারাওয়ালা তাকে আর গুপী সায়েবকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে।

 আমি নিবেদন করলাম, চোট্টু মিঞা পকেট মারার চেষ্টা করেছিল, তাকে আপনারা অবশ্যই প্রসিকিউট করবেন। কিন্তু গুপী সায়েবের কসুর কি? ওঁকে তো আটকাতে পারেন না।

 দারোগা সায়েব গর্জন করে বললেন, আমাকে আইন শিখলাবেন না মশয়। এই গোপী একজন খুনী, ডেঞ্জার টু দি পবলিক। গরিব বেচারা চোট্টু মিঞা একটু আধটু পাকিট মারে, কিন্তু তার জন্যে আমরা আছি, সোরাবর্দি সাহেব আছেন, লাট সাহেব ভি আছেন। চোট্টুর জান নেবার কোনও ইখতিয়ার আপনার এই ফ্রেণ্ডের নেই।

 আমার কথায় কোনও ফল হল না। এক শ টাকার বেল দিয়ে গুপীকে খালাস করে নিয়ে এলুম; পাঁচ দিন পরে ব্যাংকশল স্ট্রীটের কোর্টে মকদ্দমা উঠল, শুধু গুপীর কেস। পকেটমার চোট্টুর বিচার পরে হবে, সে তখনও হাসপাতালে।

 সরকারী উকিল বললেন, ইওর অনার, এই আসামী গোপী ঘোষকে কড়া সাজা দেওয়া দরকার। পিকপকেটকে বাধা দেবার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু তাকে খুন বা নিমখুন করা মারাত্মক অপরাধ। হুজুর সেই বহুকালের পুরনো কেস ক্লাউন ভার্সস ভিখন পাসীর নজিরটি দেখুন। ভিখন পাসী তাড়ি তৈরি করত, তালগাছে ঝোলানো তার ভাঁড় থেকে রোজই তাড়ি চুরি যেত। চোরকে জব্দ করার মতলবে ভিখন ধুতরো ফলের রস ভাঁড়ের মধ্যে রাখল। পরদিন একটা তাড়িচোর মারা পড়ল, আর একটা কোনও গতিকে বেঁচে গেল। হাকিম রায় দিলেন, চোরের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক উপায় অবলম্বন করা গুরুতর অপরাধ। ভিখন পাসার এক বছর জেল আর পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হয়েছিল।

 গুপী সায়েবের উকিল বললেন, ইওর অনার, অমার মক্কেলের কেস একবারে আলাদা। কোনও লোককে জব্দ করবার মতলব বা ম্যালিস প্রিপেন্স এঁর ছিল না, পিকপকেটদের প্রতিও ইনি শত্রুভাবাপন্ন নন। ইনি শখ করে কাঁকড়াবিছে পোষেন, তাদের ট্রেনিং দেন, আদর করেন, ভালবাসেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে রাখেন। কি করে ইনি জানবেন যে পুওর ফেলো চোট্টুর মতিচ্ছন্ন হবে? ইনি তার অনিষ্টচেষ্টা করেন নি, এঁর পালিত অবোধ প্রাণীরাই আত্মরক্ষার জন্যে চোট্টুকে কামড়ে দিয়েছিল। চোট্টু মিঞার প্রতি আমার ক্লায়েণ্টের খুব সিমপাথি আছে, কিন্তু এঁর দায়িত্ব কিছুই নেই।

 হাকিম ব্রজবিহারী অধিকারী ভুক্তভোগী লোক, বার দুই তাঁরও পকেট মারা গিয়েছিল। হাসি চেপে বললেন, পকেটে কাঁকড়াবিছে নিয়ে বাজারে যাওয়া অন্যায় কাজ। আসামী অপরাধী। ওঁকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আর যেন এমন না করেন। আচ্ছা গোপীবাবু আপনি যেতে পারেন।

 গুপী সায়েব নমস্কার করে করজোড়ে বলল, হুজুর, একটা কোশ্চেন করতে পারি কি?

 হাকিম বললেন, কি কোশ্চেন?

 —আজ্ঞে, পঞ্জাবির পকেটে কাঁকড়াবিছে রাখা আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু যদি কোট পরি, তার পকেটের ওপর যদি বোতাম দেওয়া ফ্ল্যাপ থাকে, আর তার গায়ে যদি একটি নোটিস সেঁটে দিই— পাকিট মে বিচ্ছু হৈ, হাথ ঘুসানা খতরনাক হৈ—তা হলে কি বেআইনী হবে?

 হাকিম ব্রজবিহারী অধিকারী একটু চিন্তা করে বললেন, না, তা হলে বেআইনী হবে না। কিন্তু মাইণ্ড ইউ, আমি হাকিম হিসেবে মত প্রকাশ করছি না, একজন সাধারণ লোক হিসেবেই বলছি।

 গুপী সায়েব খালাস হল, তার কিছু আক্কেলও হল। কিন্তু ব্যবসাবুদ্ধি তার কিছু মাত্র ছিল না। আমি বললুম, তোমার শ্বশুরবাড়ি কেষ্টনগরে না? কালই সেখানে যাও, হাজার খানিক মাটির কাঁকড়াবিছে অর্ডার দিয়ে এস, দাঁড়ার নীচে যেন ফাউণ্টেন পেনের মতন ক্লিপ থাকে। বিজ্ঞাপন দেওয়া চলবে না, আমরা পাঁচজন মুখে মুখেই জিনিসটি চালু করে দেব। গুপী সায়েব হাজারটা নকল বিছে আনাল, বিশ দিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেল। খুব ডিমাণ্ড, আরও আনাতে হল। চোট্টু মিঞার দুর্ভোগের খবর পিকপকেট সমাজে রটে গিয়েছিল, পথচারী ভদ্রলোকদের পকেট থেকে দুটি দাঁড়া উঁকি মারছে দেখে তারা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল, তাদের পেশা একদম বন্ধ হয়ে গেল। তার পর ক্রমশ জানাজানি হল যে আসল বিচ্ছু নয়, মাটির তৈরী। পকেটমারদের ভয় ভেঙে গেল, তারা আবার ব্যবসা শুরু করল।

 ইতিহাস শুনে নয়নচাঁদ বললেন, হাঁ, দিব্যি আষাঢ়ে গল্প বানিয়েছ। এখন কাজের কথা বল। হৃদয় দাস মোটর কিনছে ভাল কথা। আমার ছেলেকে বিলেত পাঠাতে রাজী আছে তো?

 বিষণ্ণ মখে আমি বললুম, আজ্ঞে না। মোটর কিনছেন নিজের জন্যে। নাতজামাইকে বিলেত পাঠাতে পারবেন না।

 —বটে! আমার ছেলেকে জলের দরে পেতে চান?

 —আজ্ঞে না, অন্য জায়গায় নাতনীর সম্বন্ধ স্থির করেছেন। কি জানেন পাইন মশাই, আপনি ধনী মানী লোক, কাজেই অনেকের চোখ টাটায়। হিংসুটে লোকে ছেলের নামে ভাংচি দিয়েছে।

 —কি বলেছে?

 —বলেছে, ষাঁড়ের গোবর।

১৮৮১