চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/প্রাচীন কথা

প্রাচীন কথা

 [এই সব ঘটনার ৭০-৮০% সত্য, ২০-৩০% মিথ্যা, অর্থাৎ স্মৃতিকথায় যতটা ভেজাল দেওয়া দস্তুর তার চাইতে বেশী নেই। নাম সবই কাল্পনিক]

১। বনোয়ারী বাবু

স্থান—উত্তর বিহারের একটি ছোট শহর। কাল—প্রায় সত্তর বৎসর আগে। বেলা তিনটে, আমাদের মিড ল ইংলিশ অর্থাৎ মাইনর স্কুলের থার্ড ক্লাসে পাটীগণিত পড়ানো হচ্ছে। ক্লাসের ছেলেরা উসখুস ফিসফিস করছে দেখে বিধু মাষ্টার বললেন, কি হয়েছে রে?

 তখন শিক্ষককে সার বলা রীতি ছিল না, মাষ্টার মশাই বলা হত। আমাদের মুখপাত্র কেষ্ট বলল, এইবার ছুটি দিন মাষ্টার মশাই, সবাই চাদরাবাগ যাব।

 —সেখানে কিজন্যে যাবি?

 —কলকাতা থেকে একজন বাবু এসেছেন, তাঁর দাড়ি গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা। তাই আমরা দেখতে যাব। হেঁই মাষ্টার মশাই ছুটি দিন।

 —চারটের সময় ছুটি হলে তার পরে তো যেতে পারিস।

 —অনেক দূর যেতে হবে, বেলা হয়ে যাবে। শুনেছি রোজ বিকেলে তিনি রায়সাহেবদের বাড়ি দাবা খেলতে যান। দেরি করে গেলে দেখা হবে না।

 বিধু মাস্টার বললেন, বেশ, সাড়ে তিনটেয় ছুটি দেব। আমিও তোদের সঙ্গে যাব। দাড়িবাবুর কথা শুনেছি বটে।

 চাদরাবাগ অনেক দূর, আমরা প্রায় সাড়ে চরটের সময় বিভূতিবাবর বাড়ি পৌঁছলুম, দাড়িবাবু সেখানেই উঠেছেন। বারান্দায় একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে তিনি হুঁকো টানছিলেন। আমাদের দলটিকে দেখে তাঁর বোধ হয় একটু আমোদ হল, নিবিড় কালো দাড়িগোঁফের তিমির ভেদ করে সাদা দাঁতে একটা হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। সেকালে ব্রাহ্মরা প্রায় সকলেই দাড়ি রাখতেন, অব্রাহ্মদেরও অনেকের বড় বড় দাড়ি ছিল। কিন্তু সেসব দাড়ি এই নবাগত ভদ্রলোকের দাড়ির কাছে দাঁড়াতেই পারে না।

 বিধু মাষ্টার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, এই ছেলেরা আপনাকে দেখতে এসেছে মশাই, কিছুতেই ছাড়বে না, তাই আধ ঘণ্টা আগেই ক্লাস বন্ধ করতে হল।

 দাড়িধারী ভদ্রলোকের নাম বনোয়ারী বাবু। তিনি প্রসন্ন বদনে বললেন, বেশ বেশ, দেখবে বইকি, দেখাবার জন্যেই তো রেখেছি। যত ইচ্ছে হয় দেখ বাবারা, পয়সা দিতে হবে না।

 দাড়িটি বনোয়ারী বাবুর গলায় কম্ফর্টরের মতন জড়ানো ছিল, এখন তিনি দাঁড়িয়ে উঠে আলুলায়িত করলেন। হাঁটুর নীচে পর্যন্ত ঝুলে পড়ল।

 সবিস্ময় আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে আমরা একযোগে বলে উঠলাম, উ রে বাবা!

 বনোয়ারী বাবু বললেন, কিছু জিজ্ঞাস্য আছে কি? টেনে দেখতে পার, আমার দাড়ি যাত্রার দলের মুনি-ঋষিদের মতন টেরিটিবাজারের নকল দাড়ি নয়। এই বলে তিনি দাড়ি ধরে বারকতক হেঁচকা টান দিলেন।

 বিধু মাষ্টার বললেন, আচ্ছা বনোয়ারী বাবু, আপনার দাড়ির বর্তমান ঝুল কত? সাড়ে তিন ফুট হবে কি?

 —থুতনি থেকে পাক্কা বিশ গিরে, মানে পৌনে চার ফুট। পরশু আবদুল দরজী ফিতে দিয়ে মেপেছিল, তার ইচ্ছে একটা মলমলের খোল করে দেয়, যাতে দাড়িতে গরদা না লাগে। আমি তাতে রাজী হই নি।

 —এতখানি গজাতে ক বছর লেগেছে?

 —তা প্রায় দশ বছর। চব্বিশ বছর বয়সে কামানো বন্ধ করেছিলাম, এখন বয়স হল চৌত্রিশ।

 বিধু মাষ্টার তাঁর ক্লাসের উপযুক্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, এই ছেলেরা, চব্বিশ থেকে চৌত্রিশ বছর বয়সে দাড়ি যদি পৌনে চার ফুট হয় তবে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে কত হবে?

 ছেলেদের ঠোঁট নড়তে লাগল, বিড়বিড় শব্দ করে তারা মানসাঙ্ক কষছে। অঙ্কে আমার খুব মাথা ছিল, সকলের আগেই বললাম, সাড়ে সাত ফুট মাষ্টার মশাই।

 বিধু মাষ্টার বললেন, করেক্ট। আচ্ছা বনোয়ারী বাবু, দশ বছর পরে সাড়ে সাত ফুট দাড়ি হলে আপনি সামলাবেন কি করে?

 বনোয়ারী বাবু সহাস্যে বললেন, তা তো ভাবি নি, তখন যা হয় করা যাবে, না হয় কিছু ছেঁটে ফেলব।

 আমাদের দলের মধ্যে সব চেয়ে সপ্রতিভ ছেলে কেষ্ট। সে বলল, না না ছাঁটবেন না, কানের পাশ দিয়ে তুলে মাথায় পাগড়ির মতন জড়ালে বেশ হবে।

 বনোয়ারী বাবু বললেন, ঠিক বলেছ হে ছোকরা, পাগড়িই বাঁধব, পশমী শালের চাইতে গরম হবে।

 একটু আমতা আমতা করে বিধু মাষ্টার বললেন, কিছু মনে করবেন না বনোয়ারী বাবু ইয়ে, একটা প্রশ্ন করছি। আপনি কি বিবাহিত?

 —অভ কোর্স। হোআই নট?

 —তা হলে, তা হলে—

 —আমার স্ত্রী এই দাড়ি বরদাস্ত করেন কি করে— এই তো আপনার প্রবলেম? চিন্তার কারণ নেই মাষ্টার মশাই। তিনি প্রসন্ন মনেই মেনে নিয়েছেন, মিউচুয়াল টলারেশন, বুঝলেন কিনা। তাঁরও তো ফুট তিনেক আছে।

 বিধু মাষ্টার আঁতকে উঠে বললেন, কি সর্বনাশ!

 —তাঁরটা দাড়ি নয় মশাই, মাথার চুল, যাকে বলে কেশপাশ, কুন্তলভার, চিকুরদাম।

 আমরা নিশ্চিন্ত হলুম। তার পর বনোয়ারী বাব, বাঙালী ময়রার দোকান থেকে জিলিপি আনিয়ে আমাদের সবাইকে খাওয়ালেন। আমরা খুশী হয়ে বিদায় নিলাম।

২। সত্যবতী ভৈরবী

খন হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের যুগে, পলিটিক্স নিয়ে বেশী লোক মাথা ঘামাত না। সুরেন বাঁড়ুজ্যের চাইতে মাদাম ব্লাভাৎস্কি শশধর তর্কচূড়ামণি আর পরিব্রাজক শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন বেশী জনপ্রিয় ছিলেন।

 আমাদের বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে হরনাথ মুখুজ্যের আশ্রম। বিস্তর জমি, অনেক আম কাঁঠাল লিচুর গাছ, একতলা পাকা বাড়ি, তা থেকে কিছু দূরে একটি কালীমন্দির। হরনাথ বাবু কলকাতা থেকে কালীমাতার একটি প্রকাণ্ড অয়েল পেণ্টিং আনিয়ে খুব ঘটা করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভেটকু তেওয়ারী নামক এক ভোজপুরী ব্রাহ্মণ সেই চিত্রমূর্তির নিত্য সেবা করত। বিশেষ বিশেষ পর্ব দিনে হরনাথ বাবু নিজেই পূজা করতেন।

 শাস্ত্রে পটপূজার বিধান থাকলেও সাধারণ লোকে মাটি-পাথরের বিগ্রহেই অভ্যস্ত। হরনাথ বাবুর এই টু-ডাইমেনশন-ধারিণী পটরূপা দেবীর উপর প্রথম প্রথম লোকের তেমন শ্রদ্ধা হয় নি। একদিন শোনা গেল, তেওয়ারীর হাত থেকে মা-কালী খাঁড়া কেড়ে নিয়েছেন, হরনাথ বাবু স্বচক্ষে তা দেখেছেন। এর পরে আর কোনও সন্দেহ রইল না যে দেবী পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত এবং সক্রিয়।

 হরনাথ বাবুর আশ্রমে সদাব্রত লেগেই আছে, সব রকম সাধুবাবাই এখানে দিন কতক বাস করতে পারেন। মন্দিরের গায়ে দুটি ছোট ছোট কুঠুরি আছে, সেখানে শুধু গৈরিকধারী কানঢাকা-টুপি-পরা এক নম্বর সন্ন্যাসী মহারাজদের থাকবার অধিকার আছে। মন্দিরের পিছনে কিছু দূরে একটা চালা ঘর আছে, সেখানে জটা-কৌপীন-লোটা-চিমটা-ধারী দু নম্বর সাধুবাবারা আশ্রয় পান। দুই শ্রেণীর সাধুদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। জটাধারীরা সন্ন্যাসী মহারাজদের বলেন, বিলকুল ভ্রষ্ট্ ভণ্ড্। অপর পক্ষ বলেন, গঁড়েজী ভাংখোর মূর্খ্।

 আশ্রমে কোনও নামজাদা বা নতুন ধরনের সং এলে অনেকে দেখতে যেত। আমি, কেষ্ট, আর তার ভাগনে জিতুও মাঝে মাঝে যেতুম, অনেক রকম মজাও দেখতুম। একবার তর্ক করতে করতে এক বাঙালী তান্ত্রিক একজন হিন্দুস্থানী বেদান্তীর কাঁধে চড়ে বসলেন, কিছুতেই নামবেন না। দাঙ্গা বাধবার উপক্রম হল। অবশেষে হরনাথ বাবু অতি কষ্টে সবাইকে শান্ত করলেন। আর একবার কামরূপ থেকে এক সিদ্ধপুরুষ এসেছিলেন, সন্ধ্যার পর তিনি এক আশ্চর্য ইন্দ্রজাল দেখালেন। সামনে একটা আঙটি রেখে তার কিছু দূরে একটা টাকা রাখলেন, তার পর মন্ত্রপাঠ করে মাথা নাড়তে লাগলেন। আঙটিটা লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল এবং টাকাকে গ্রেপতার করে নিয়ে ফিরে এল। ওভারসিয়র নীরদবাবু উপস্থিত ছিলেন। তিনি ম্যাজিক জানতেন, তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। খপ করে সিদ্ধবাবার কান ধরে তিনি একটা সূক্ষ্ম কালো সুতো টেনে বার করলেন। সুতোটা কানে আটকানো ছিল, আঙটি আর টাকার সঙ্গেও তার যোগ ছিল।

 একদিন খবর এল, কাশী থেকে এক বাঙালিনী ভৈরবী এসেছেন, বয়স হলেও তাঁর রূপ নাকি ফেটে পড়ছে। হিন্দুস্থানীরা তাঁকে বলে মাতাজী সত্যবতী, বাঙালীরা বলে তপস্বিনী ভৈরবী। কেষ্ট জিতু আর আমি দেখতে গেলাম। মন্দিরের সামনের বারান্দায় একটা বাঘছালের উপর ভৈরবী বসে আছেন আর দু হাতের মুঠোয় একটা কলকে ধরে হুশ হুশ করে তামাক টানছেন। রঙ ফরসা, মাথায় এক রাশ কালো রুক্ষ ফাঁপানো চুল, অল্প পাক ধরেছে, কপালে ভস্মের তিলক। সামনে একটা চকচকে ত্রিশূল পড়ে আছে।

 ক্রমে ক্রমে অনেক দর্শক এল, কেউ ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল, কেউ খাড়া হয়েই নমস্কার করল। নানা লোক ভৈরবীকে প্রার্থনা জানাল, তিনিও সকলকে আশ্বাস দিলেন। এমন সময় মুনশী রামভকত এসে করজোড়ে বললেন, মাতাজী, আজ মেরা কোঠিমে জানে কি বাত থি, এক্কা লায়া।

 ভৈরবী বললেন, হাঁ বাবা, আমার ইয়াদ আছে, একটু পরেই উঠছি। মুনশীজী, এই দেখ তোমার জন্যে আমি জয়রাম ধূপ বানিয়েছি, হপ্তা খানিক এর ধোঁয়া দিলে তোমার বাড়ির সব আলাই বালাই ভূত প্রেত দূর হবে, তোমার জরুর উপর যে চুড়ৈল (পেতনী) ভর করেছে সেও ভেগে যাবে।

 রামভকত কৃতার্থ হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন।

 এমন সময় ভিড় ঠেলে প্রাণকান্ত বাবু এলেন। ইনি একজন সম্ভ্রান্ত বড় অফিসার, শহরের সকলেই এঁকে খাতির করে। প্রাণকান্ত বাব, এগিয়ে এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে মৃদুস্বরে বললেন, ভৈরবী মাতাজী, আমার প্রতি একটু কৃপাদৃষ্টিতে তাকান, বড়ই সংকটে পড়েছি, আপনি ছাড়া কে উদ্ধার করবে?

 ভৈরবী কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ একটু কুঁচকে গেল, মুখে সকৌতুক হাসির রেখা ফাটে উঠল। বললেন, আরে প্রাণকান্ত যে! হরে রাম হরে রাম! চিনতে পেরেছ তো? ওকি, অমন হতভম্ব হয়ে গেলে কেন, ভূত দেখলে নাকি?

 প্রাণকান্ত বাবু, নির্বাক বিমূঢ় হয়ে মিটমিট করে চাইতে লাগলেন। ভৈরবী বললেন, সেকি প্রাণকান্ত, এর মধ্যেই ভুলে গেলে? লজ্জা কেন, এখন তুমিও সাধু আমিও সাধ্বী, দুজনেই পোড়খাওয়া খাঁটী সোনা। ওকি, পালোচ্ছ কেন, দাঁড়াও দাঁড়াও।

 প্রাণকান্ত বাবু দাঁড়ালেন না, ভিড় ঠেলে সবেগে প্রস্থান করলেন! ভৈরবী স্মিতমুখে বললেন, একটা পুরনো ভূত ভেগে গেল। চল মুনশী রামভকত, এইবার তোমার কুঠিতে যাব। ভৈরবী চলে গেলে দর্শকদের মধ্যে কলরব উঠল। এক দল বলল, ভৈরবী না আরও কিছু। ছিছি, এত লোকের সামনে কেলেঙ্কারি ফাঁস করতে মাগীর লজ্জাও হল না। সেই যে বলে, অঙ্গারঃ শতধৌতেন। আর এক দল বলল, অমন কথা মুখে আনতে নেই, উনি এখন পূর্ণমাত্রায় তপঃসিদ্ধা, গৌতমপত্নী অহল্যার মতন পাপশূন্যা, লজ্জা ভয় নিন্দা প্রশংসার বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন, আগের কথাও লুকুতে চান না। সেই জন্যেই তো সত্যবতী নাম।

 ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমি কেষ্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে ভাই, প্রাণকান্ত বাবু পালিয়ে গেল কেন?

 কেষ্ট বলল, বুঝতে পারলি না বোকা, এই ভৈরবীর সঙ্গে প্রাণকন্ত বাবুর লভ হয়েছিল।


৩। মধু-কুঞ্জ সংবাদ

সেকালেও বদমাশ ছেলে ছিল, কিন্তু এখনকার মতন তারা কলেকটিভ অ্যাকশন নিতে জানত না। মাষ্টাররা তখন বেপরোয়া ভাবে বেত লাগাতেন, ছেলেরা তা শিক্ষারই অঙ্গ মনে করত, মা-বাপরাও আপত্তি করতেন না।

 বেত মারায় আমাদের মধুসূদন মাষ্টারের জুড়ি ছিল না। দোষ করলে তো মারতেনই, বিনা দোষেও শুধু হাতের সুখের জন্যে মারতেন। তিনি একটি নতুন শাস্তি আবিষ্কার করেছিলেন— রসমোড়া, অর্থাৎ পেটের চামড়া খামচে ধরে মোচড় দেওয়া।

 মধু মাষ্টার বাঙলা পড়াতেন। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ, কালো রঙ, একমুখ দাড়িগোঁফ, তাতে চেহারাটি বেশ ভীষণ দেখাত। তখনও তাঁর বিবাহ হয় নি, বাড়িতে শুধু বিধবা বিমাতা আর দশ-এগারো বছরের একটি আইবুড়ো বৈমাত্র ভগ্নী। শুনতুম দেশে তাঁর যথেষ্ট বিষয়সম্পত্তি আছে, শুধু ছেলে ঠেঙাবার লোভেই নানা জায়গায় মাষ্টারি করেছেন।

 আমাদের ক্লাসের একটি ছেলের নাম কুঞ্জ। বয়স চোদ্দ-পনরো, আমাদের চাইতে ঢের বড়। একটু পাগলাটে, লেখাপড়ায় অত্যন্ত কাঁচা, তিন বৎসর প্রমোশন পায় নি।

 মধু মাষ্টার চারুপাঠ পড়াচ্ছেন। হঠাৎ কুঞ্জ বলল, মাষ্টার মশাই, একবার বাইরে যাব, পেচ্ছাব পেয়েছে।

 ধমক দিয়ে মধু মাষ্টার বললেন, মিথ্যে কথা। রোজ এই সময় তোর বাইরে যাবার দরকার হয়। নিশ্চয় তামাক কি বাডসাই খাস।

 একটু পরে কুঞ্জ আবার বলল, উঃ, আর থাকতে পারছি না, ছুটি দিন মাষ্টার মশাই। ফিরে এলে বরং আমার মুখে শুঁখে দেখবেন তামাক খেয়েছি কিনা।

 —খবরদার, চুপ করে বসে থাক। ছুটি পাবি না।

 মুখ কাঁচুমাচু করে কাতর কণ্ঠে কুঞ্জ বলল, উহুহুহু। তার পর উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মধু মাষ্টার তাকে ধরে ফেলে একটা রসমোড়া দিলেন তার পর সপাসপ বেত মারতে লাগলেন। কুঞ্জ চিৎকার করে বলল, আমার দোষ দিতে পারবেন না কিন্তু। বেত এড়াবার জন্যে সে চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল, মধু মাষ্টারও সঙ্গে সঙ্গে ধাওয়া করে বেত চালাতে লাগলেন।

 আমরা তারস্বরে বললুম, মাষ্টার মশাই, সমস্ত ঘর ভিজে নোংরা হয়ে গেল, আপনার কাপড়েও ছিটে লেগেছে। মেথর ডাকতে হবে।

 মধু মাষ্টার তখনও উন্মত্ত হয়ে বেত চালাচ্ছেন। হঠাৎ কুঞ্জ মাটিতে শুয়ে পড়ে গোঁগোঁ করতে লাগল। আমরা বললুম, কুঞ্জ মরে গেছে, নিশ্চয় মরে গেছে।

 কেষ্ট তাড়াতাড়ি এক ফালি কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে কুঞ্জর নাকের কাছে ধরে বলল, এখনও মরে নি, দেখন না কাগজটা ফরফর করছে। মারের চোটে কুঞ্জ অজ্ঞান হয়ে গেছে, আর একটু পরেই মরে যাবে। ছুটি দিন মাষ্টার মশাই আমরা চ্যাংদোলা করে কুঞ্জকে তার বাড়ি নিয়ে যাব, সেখানে মরাই তো ভাল। আপনি মেথর ডাকান আর চান করে কাপড়টা ছেড়ে ফেলুন।

 অগত্যা মধু মাষ্টার ক্লাস বন্ধ করলেন।

 পরদিন কুঞ্জ স্কুলে এল না। মধু মাষ্টার বললেন, আজ বিকেলে ওর বাড়িতে খোঁজ নিস তো, কেমন আছে ছোঁড়া।

 ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমরা একসঙ্গে আবৃত্তি করছি—সকলের পিতা তুমি, তুমি সর্বময়। হঠাৎ কুঞ্জ তার মাকে নিয়ে উপস্থিত হল। মা খুব লম্বা চওড়া মহিলা, নাকে নথ, কানে মাকড়ির ঝালর, চওড়া লালপেড়ে শাড়ি কোমরে জড়িয়ে পরেছেন, মাথায় কাপড় না থাকারই মধ্যে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নাক সিটকে একবার চারদিকে উঁকি মারলেন, যেন অরসোলা কি নেংটি ইদুর খুঁজছেন। তার পর আমাদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, মোধো মাষ্টার কোন্‌টে রে?

 একালের চাইতে তখন ছেলেদের মধ্যে শিভালরি ঢের বেশী ছিল। আমরা সকলেই সসম্ভ্রমে আঙুল বাড়িয়ে মধু মাষ্টারকে শনাক্ত করলাম।

 কুঞ্জর মা সোজা তাঁর কাছে গিয়ে কান ধরে বললেন, ইষ্টুপিট মুখপোড়া বাঁদর! তোর বেতগাছটা কোথা ৱে?

 আমরা বললাম, ওই যে, চেয়ারে ওঁর পাশেই রয়েছে। কুঞ্জর মা কিন্তু আমাদের নিরাশ করলেন। বেতটা বাঁ হাতে নিলেন বটে, কিন্তু লাগালেন না, শুধু ডান হাত দিয়ে মধু মাষ্টারের দাড়ি-ভরা গালে গোটা চারেক থাবড়া লাগালেন। তার পর বেতটা নিয়ে কুঞ্জর হাত ধরে গটগট করে চলে গেলেন।

 গোলমাল শুনে মাষ্টাররা সবাই আমাদের ক্লাসে এলেন। হেডমাষ্টার মশাই বললেন, বাড়ি যা তোরা।

 পরদিন থেকে মধু মাষ্টার গোবেচারার মতন বিনা বেতেই পড়াতে লাগলেন।

 ছ মাস পরেই কুঞ্জর সঙ্গে মধু মাষ্টারের একটা পাকা রকম মিটমাট হয়ে গেল। রেল স্টেশনের মালবাবু যামিনী ঘোষাল ছিলেন কুঞ্জর দূর সম্পর্কের ভাই, তাঁর সঙ্গে মধু মাষ্টারের বৈমাত্র বোন ভুতির বিয়ে স্থির হল। মধু মাষ্টার যথাসাধ্য আয়োজন করলেন, অনেক লোককে নিমন্ত্রণ করলেন, কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে গেল। বিবাহসভায় সবাই বরের জন্যে অপেক্ষা করছে, এমন সময় বরপক্ষের একজন খবর আনল— যামিনী বলেছে, মধু চামারের বোনকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কেষ্ট আমাদের চুপিচুপি বলল, কুঞ্জই ভাঙচি দিয়েছে।

 বিয়েবাড়িতে প্রচণ্ড হইচই উঠল। মধু মাষ্টারের বিমাতা কুঞ্জর মায়ের পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, রক্ষা কর দিদি এখন বর কোথায় পাব, তোমার ছেলে কুঞ্জকে আদেশ কর।

 কুঞ্জর মা বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, বামনের জাতধর্ম বাঁচাতে হবে বইকি। এই কুঞ্জ, তোর ময়লা কাপড়টা ছেড়ে এই চেলিটা পর।

 কুঞ্জ বলল, ভুতি যে বিচ্ছিরি!

 তার মা বললেন, আহা, কি আমার কাত্তিক ছেলে রে! ওঠ বলছি, নয়তো মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব।

 কুঞ্জর বাবা বললেন, ছেলেটার যখন আপত্তি তখন জোর করে বিয়ে দেবার দরকার কি?

 কুঞ্জর মা বললেন, যাও যাও, তুমি আবার এর মধ্যে নাক গলাতে এলে কেন?

 কুঞ্জ তবু ইতস্তত করছে দেখে কেউ তাকে চুপিচুপি বলল, বিয়েটা করে ফেল কুঞ্জ, অনেক সুবিধে। সোনার আঙটি পাবি, রূপোর ঘড়ি আর ঘড়ির চেন পাবি, ক্লাসে প্রমোশনও পেয়ে যাবি। আর, মধু মাষ্টার মশাই তোর কে হবেন জানিস তো? শালা।

 কুঞ্জ আর আপত্তি করে নি।

১৮৮০