চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/সাড়ে সাত লাখ

সাড়ে সাত লাখ

হেমন্ত পাল চৌধুরীর বয়স ত্রিশের বেশী নয়, কিন্তু সে একজন পাকা ব্যবসাদার, পৈতৃক কাঠের কারবার ভাল করেই চালাচ্ছে। রাত প্রায় নটা, বাড়ির একতলার অফিস ঘরে বসে হেমন্ত হিসাবের খাতাপত্র দেখছে। তার জ্ঞাতি-ভাই নীতীশ হঠৎ ঘরে এসে বলল, তোমার সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী কথা আছে। বড় ব্যস্ত নাকি?

 হেমন্ত বলল, না, আমার কাজ কাল সকালে করলেও চলবে। ব্যাপার কি, এমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছ কেন? তোমাদের তো এই সময় জোর তাসের আড্ডা বসে। কোনও মন্দ খবর নাকি?

 নীতীশ বলল, ভাল কি মন্দ জানি না, আমার মাথা গুলিয়ে গেছে। যা বলছি স্থির হয়ে শোন।

 নীতীশের কথার আগে তার সঙ্গে হেমন্তর সম্পর্কটা জানা দরকার। এদের দুজনেরই প্রপিতামহ ছিলেন মদনমোহন পাল চৌধুরী, প্রবলপ্রতাপ জমিদার। তাঁর দুই পত্র অনঙ্গ আর কন্দর্প বৈমাত্র ভাই, বাপের মৃত্যুর পর বিষয় ভাগ করে পৃথক হন। অনঙ্গ অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন, অনেক সম্পত্তি বন্ধক রেখে কন্দর্পের কাছ থেকে বিস্তর টাকা ধার নিয়েছিলেন। অল্পবয়স্ক পুত্র বসন্তকে রেখে অনঙ্গ অকালে মারা যান। কন্দর্প তাঁর ভাইপোর সঙ্গে আজীবন মকদ্দমা চালান। অবশেষে তিনি জয়ী হন এবং বসন্ত প্রায় সর্বস্বান্ত হন। পরে বসন্ত কাঠের কারবার আরম্ভ করেন। তিনি গত হলে তাঁর পুত্র হেমন্ত সেই কারবারের খুব উন্নতি করেছে।

 কন্দর্প আর তাঁর পুত্র যতীশও গত হয়েছেন। যতীশের পুত্র নীতীশ এখন পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী। জমিদারি আর নেই, আগেকর ঐশ্বর্যও কমে গেছে, কিন্তু পৈতৃক সঞ্চয় যা আছে তা থেকে নীতীশের আয় ভালই হয়। রোজগারের জন্যে তাকে খাটতে হয় না, বদখেয়ালও তার নেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আর সাহিত্য সিনেমা ফুটবল ক্রিকেট রাজনীতি চর্চা করে সময় কাটায়। হেমন্ত তার সমবয়স্ক, দুজনে একসঙ্গে কলেজে পড়েছিল। এদের বাপদের মধ্যে বাক্যালাপ ছিল না, কিন্তু হেমন্ত আর নীতীশের মধ্যে পৈতৃক মনোমালিন্য মোটেই নেই, অন্তরঙ্গতাও বেশী নেই।

 মাথায় দু হাত দিয়ে নীতীশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার পর বলল, ভাই হেমন্ত, মহাপাপ থেকে আমাকে উদ্ধার কর।

 হেমন্ত বলল, পাপটা কি শুনি। খুন না ডাকাতি না নারীহরণ? কি করেছ তুমি?

 —আমি কিছুই করি নি, করেছেন আমার ঠাকুরদা।

 —কন্দর্পমোহন পাল চৌধুরী? তিনি তো বহুকোল গত হয়েছেন, তাঁর পাপের জন্যে তোমার মাথাব্যথা কেন? উত্তরাধিকারসূত্রে কোনও বেয়াড়া ব্যাধি পেয়েছ নাকি?

 —না, আমার শরীরে কোনও রোগ নেই। আজ সকালে পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটছিলুম। জমিদারি তো গেছে, বাজে দলিল আর কাগজপত্র রেখে লাভ নেই, তাই জঞ্জাল সাফ করছিলুম। ঠাকুরদার আমলের একটা কাঠের বাক্সে হঠাৎ কতকগুলো পুরনো চিঠিপত্র আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে গেছি, আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়েছে। ওঃ, মহাপাপ মহাপাপ!

 —ব্যাপারটা কি?

 —আমার ঠাকুরদা কন্দর্প তোমার ঠাকুরদা অনঙ্গের নায়েবগোমস্তাদের ঘুষ দিয়ে কতকগুলো দলিল জাল করেছিলেন আর মিথ্যে সাক্ষী খাড়া করেছিলেন। তারই ফলে তোমার বাবা মকদ্দমায় হেরে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।

 —বল কি! না না, তা হতে পারে না, নিশ্চয় তোমার ভুল হয়েছে।

 —ভুল মোটেই হয় নি। আমার ভগিনীপতি ফণীবাবুকে জান তো? মত উকিল। তাঁকে সব কাগজপত্র দেখিয়েছি। তিনিও বলেছেন, আমার ঠাকুরদার জাল-জোচ্চুরির ফলেই তোমার বাবা বসন্ত পাল চৌধুরী সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।

 —তা এখন করতে চাও কি? ফণীবাবু কি বলেন?

 —বললেন, চুপ মেরে যাও। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে মন খারাপ ক’রো না, পুরনো কাগজপত্র সব পুড়িয়ে ফেল, ঘুণাক্ষরে কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।

 —তাই বুঝি তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে জানাতে এসেছ? ফণীবাবু বিচক্ষণ ঝানু লোক, পাকা কথা বলেছেন, গতস্য অনুশোচনা নাস্তি। পুরনো কাসন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। আর, ও তো তামাদি হয়ে গেছে।

 উত্তেজিত হয়ে নীতীশ বলল, কি যা তা বলছ, পাপ কখনও তামাদি হয় না। আমার ঠাকুরদা জোচ্চুরি করে যা আদায় করেছেন তা আমি ভোগ করতে চাই না। খতিয়ে দেখেছি, সুদে আসলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা তোমার পাওনা। সে টাকা তোমাকে না দিলে আমার স্বস্তি নেই।

 —ওই টাকা দিলে তোমার অবস্থা কি রকম দাঁড়াবে?

 —খুব মন্দ হবে। কষ্টে সংসার চলবে, রোজগারের চেষ্টা দেখতে হবে। কিন্তু তার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি।

 —আচ্ছা, তোমার বাবা এসব জানতেন?

 —বোধ হয় না। তিনি নিজে জমিদারি দেখতেন না, নায়েবের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। নায়েব নতুন লোক, তারও কিছু জানবার কথা নয়।

 —তোমার বউকে জানিয়েছ?

 —না। জানলে কান্নাকাটি করবে, শ্বশুর মশাইকে বলে মহা হাঙ্গামা বাধাবে। আগে তোমার পাওনা শোধ করব তার পর জানবে।

 —বাহবা! দেখ নীতীশ, ভাগ্যক্রমে আমি নিঃস্ব নই, রোজগার ভালই করি, বেশী বড়লোক হবার লোভও নেই। ফাঁকতালে তুমি যা পেয়ে গেছ তা তোমারই থাকুক, নিশ্চিন্ত হয়ে ভোগ কর। আমি খোশ মেজাজে বহাল তবিয়তে বলছি, ওই টাকার ওপর আমার কিছু মাত্র দাবি নেই। চাও তো একটা না-দাবি পত্র লিখে দিতে পারি। আরও শোন—সাড়ে সাত লাখ টাকা না পেলেও আমার পরিবারবর্গের স্বচ্ছন্দে চলবে, কিন্তু ওই টাকার অভাবে তোমার স্ত্রী ছেলে মেয়ের অবস্থা কি রকম হবে তা ভেবেছ? তুমি না হয় একজন প্রচণ্ড সাধুপুরুষ, সাক্ষাৎ রাজা হরিশ্চন্দ্র, কিছুই গ্রাহ্য কর না, কিন্তু তোমার স্ত্রী আর সন্তানরা যে রকম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে কষ্ট দেবে কেন? তোমার ঠাকুরদার কুকর্ম আমাকে জানিয়েছ তাতেই আমি সন্তুষ্ট, তোমারও দায়িত্ব খণ্ডে গেছে। আর কিছু করবার দরকার নেই।

 সজোরে মাথা নেড়ে নীতীশ বলল, ওই পাপের টাকা ভোগ করলে আমি মরে যাব। যা তোমার হক পাওনা তা নেবে না কেন?

 একটু ভেবে হেমন্ত বলল, শোন নীতীশ, আজ তুমি বড়ই অস্থির হয়ে আছে, তোমার মাথার ঠিক নেই। কাল সন্ধ্যের সময় এখানে এসো, দুজনে পরামর্শ করে একটা মীমাংসা করা যাবে, যাতে তোমার মনে শান্তি আসে। তোমার ভগিনীপতি ফণীবাবুর সঙ্গেও আর একবার পরামর্শ করো।


রদিন সন্ধ্যায় নীতীশ আবার এল। হেমন্ত প্রশ্ন করল, ফণীবাবুকে তোমার মতলব জানিয়েছ?

 —হুঁ। তিনি রফা করতে বললেন।

 —রফা কি রকম?

 —বিবেকের সঙ্গে রফা। বললেন, ওহে নীতীশ, তুমি আর হেমন্ত দুজনেই সমান বোকা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। টাকাটা আধাআধি ভাগ করে নাও, তা হলে দুজনেরই কনশেন্স ঠাণ্ডা হবে।

 ——হেমন্ত হেসে বলল, চমৎকার। তুমি কি বল নীতীশ?

 —ড্যাম ননসেন্স। চুরির টাকা চোররা ভাগ করে নেয়, কিন্তু তুমি আর আমি চোর নই। পরের ধনের এক কড়াও আমি নিতে পারি না। ভেমার যা হক পাওন, তা পুরোপুরি তোমাকে নিতে হবে।

 —আমার হক পাওনা কি করে হল? জমিদারি পত্তন করেন তোমার-আমার প্রপিতামহ মহামহিম দোর্দণ্ডপ্রতাপ ৺মদনমোহন পাল চৌধুরী। তিনি রামচন্দ্র বা বুদ্ধদেব ছিলেন না। সেকালে অনেক দুর্দান্ত লোক যেমন করে জমিদারি পত্তন করত তিনিও তেমনি করেছিলেন। ডাকাতি লাঠিবাজি জালিয়াতি জোচ্চুরি ঘুষ—এই ছিল তাঁর অস্ত্র। তুমি নিশ্চয় শুনে থাকবে?

 —ওই রকম শুনেছি বটে।

 — তা হলে বুঝতে পারছ, ওই জমিদারিতে কারও ধর্ম সংগত অধিকার থাকতে পারে না। পূর্বপুরুষের সম্পত্তি আমার হাতছাড়া হয়েছে তা ভালই হয়েছে।

 —কিন্তু আমার তো হাতছাড়া হয় নি, প্রপিতামহ আর পিতামহ দুজনেরই পাপের ধন সবটা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। তুমি যদি নিতান্তই না নিতে চাও তবে মদনমোহন যাদের বঞ্চিত করেছিলেন তাদের উত্তরাধিকারীদের দিতে হবে।

 —তাদের খুঁজে পাবে কোথায়, সে তো এক-শ সওয়া-শ বছর আগেকার ব্যাপার। তুমি সম্পত্তি দান করবে এই কথা রটে গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে জোচ্চোর এসে তোমাকে ছেঁকে ধরবে।

 —তবে জনহিতার্থে টাকাটা দান করা যাক। কি বল?

 —সে তো খুব ভাল কথা।

 —দেখ হেমন্ত, ওই টাকাটা সদুদ্দেশ্যে খরচ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে, আমি এ কাজে পটু নই।

 —রক্ষে কর। আমি নিজের ব্যবসা নিয়েই অস্থির, তোমার দনেসত্রের বোঝা নেবার সময় নেই। আর একটা কথা। সদুদ্দেশ্যে দান, শুনতে বেশ, কিন্তু উদ্দেশ্যটা কি? মন্দির মঠ সেবাশ্রম হাসপাতাল আতুরাশ্রম ইস্কুল-কলেজ, না আর কিছু?

 —তা জানি না। তুমিই বল।

 —আমিও জানি না। আমাদের সঙ্গে ফেলু মহান্তি পড়ত মনে আছে? তার শালা ডক্টর প্রেমসিন্ধু খাণ্ডারী সম্প্রতি ইওরোপ আমেরিকা ফার-ঈস্ট টূর করে এসেছেন। শুনেছি তিনি মহাপণ্ডিত লোক, প্লেটো কৌটিল্য থেকে শুরু করে বেন্থাম মিল মার্ক্‌স লেনিন সবাইকে গুলে খেয়েছেন। চীন সরকার নাকি কনসল্টেশনের জন্যে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তুমি যদি রাজী হও তবে ডক্টর প্রেমসিন্ধুর মত নেওয়া যাবে, তোমার টাকার সার্থক খরচ কিসে হবে তা তিনিই বাতলে দেবেন।

 —বেশ তো। তাঁর সঙ্গে চটপট এনগেজমেণ্ট করে ফেল।

রদিন বিকালবেলা হেমন্ত আর নীতীশ প্রেমসিন্ধু খাণ্ডারীর বাড়ি উপস্থিত হল। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে প্রেমসিন্ধু বললেন, নীতীশবাবুর সংকল্প খুবই ভাল, কিন্তু সাড়ে সাত লাখ টাকা কিছুই নয়, তাতে বিশেষ কিছু করা যাবে না।

 হেমন্ত বলল, যতটুকু হতে পারে তারই ব্যবস্থা দিন।

 একটু চিন্তা করে ডক্টর খাণ্ডারী বললেন, সর্বাধিক লোকের যাতে সর্বাধিক মঙ্গল হয় তাই দেখতে হবে, কিন্তু অযোগ্য লোকের জন্যে এক পয়সা খরচ করা চলবে না। সমাজের ক্ষণস্থায়ী উপকার করাও বৃথা, এমন কাজে টাকাটা লাগাতে হবে যাতে চিরস্থায়ী মঙ্গল হয়। আচ্ছা নীতীশবাবু, আপনার ইচ্ছেটা আগে শুনি, কি রকম সৎকার্য আপনার পছন্দ?

 একটু ইতস্তত করে নীতীশ বলল, আমার মা খুব ভক্তিমতী ছিলেন। তাঁর নামে টাকাটা কোনও সাধু-সন্ন্যাসীর মঠে দিলে কেমন হয়? ধর্মের প্রচার হলে লোকচরিত্রের উন্নতি হবে, তাতে সমাজেরও মঙ্গল হবে।

 প্রেমসিন্ধু হেসে বললেন, অত্যন্ত সেকেলে আইডিয়া। টাকাটা পেলে সাধু মহারাজদের নিশ্চয়ই মঙ্গল হবে, তাঁরা লুচি মণ্ডা দই ক্ষীর খেয়ে পুষ্টিলাভ করবেন, কিন্তু সমাজের মঙ্গল কিছুই হবে না। তা ছাড়া আপনার মায়ের নামে টাকা দিলে তো নিঃস্বার্থ দান হবে না, টাকার বদলে আপনি চাচ্ছেন মায়ের স্মৃতিপ্রতিষ্ঠা।

 লজ্জিত হয়ে নীতীশ বলল, আচ্ছা মায়ের নামে না-ই দিলাম। যদি কোনও ভাল সেবাশ্রমে—

 —সব ভাল সেবাশ্রমেরই প্রচুর অর্থবল আছে। তেলা মাথায় তেল দিয়ে কি হবে? আর, আপনার সাড়ে সাত লাখ তো ছিটেফোঁটা মাত্র।

 —যদি উদ্বাস্তুদের সাহায্যের জন্যে দেওয়া যায়?

 —খেপেছেন! উদ্বাস্তুদের হাতে পৌঁছবার অগেই বাস্তুঘুঘুরা টাকাটা খেয়ে ফেলবে। কাগজে যে সব কেলেঙ্কারি ছাপা হয় তা পড়েন না?

 —একটা কলেজ বা গোটাকতক স্কুল প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়?

 —ভস্মে ঘি ঢাললে যা হয়। স্কুল কলেজে কি রকম শিক্ষা হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছেন। আপনার টাকায় তার চাইতে ভাল কিছু হবে না, শুধু নতুন একদল হল্লাবাজ ধর্মঘটী ছোকরার সৃষ্টি হবে।

 —তবে না হয় সরকারের হাতেই টাকাটা দেওয়া যাক। তাঁরাই কোনও লোকহিতকর কাজে খরচ করবেন।

 অট্টহাস্য করে প্রেমসিন্ধু বললেন, নীতীশবাবু, আপনি এখনও বালক। হয়তো মনে করেন সরকার হচ্ছেন একজন অগাধবুদ্ধি সর্বশক্তিমান পরমকারুণিক পুরুষোত্তম। তা নয়! মশাই, সরকার মানে পাঁচ ভূতের ব্যাপর। কোটি কোটি টাকা যেখানে খরচ হয় সেখানে আপনার সাড়ে সাত লাখ তো সমূদ্রে জলবিন্দুর মতন ভ্যানিশ করবে।

 হেমন্ত বলল, আচ্ছা আমি একটা নিবেদন করি। শুনতে পাই ভগবান এখন মন্দির ত্যাগ করে ল্যাবরেটরিতে অধিষ্ঠান করছেন, সেখানেই তিনি বাঞ্ছাকল্পতরু হয়েছেন। কৃষি আর খাদ্যের রিসার্চের জন্যে কোনও ইন্‌স্টিটিউটে টাকাটা দিলে কেমন হয়?

 —হেমন্তবাবু সে রকম ইন্‌স্টিটিউট দেশে অনেক আছে। বলতে পারেন, ঢাক পেটানো ছাড়া কোথাও কিছুমাত্র কাজ হয়েছে?

 হতাশ হয়ে নীতীশ বলল, আচ্ছা, টাকাটা যদি কোনও আতুরাশ্রমে দেওয়া যায়? অন্ধ বোবা-কালা পঙ্গু, উন্মাদ অসাধ্য-রোগগ্রস্ত— এদের সেবার জন্যে?

 ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে ডক্টর প্রেমসিন্ধু খাণ্ডারী কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়লেন। তার পর বললেন, শুনুন নীতীশবাবু, আপনার মতন নরম মন অনেকেরই আছে, কিন্তু তা একটা মহা ভ্রাম্ভির ফল। যদি শক্‌ড না হন তবে খোলসা করে বলি।

 নীতীশ আর হেমন্ত একসঙ্গে বলল, না না, শক্‌ড হব না, খোলসা করেই বলুন।

 —নীতীশবাবু যে সব আতুরজনের কথা বললেন, তাদের বাঁচিয়ে রাখলে সমাজের কি লাভ? ধরুন আপনি বেগুন কি ঢ্যাঁড়িসের খেত করেছেন। পোকাধরা অপুষ্ট গাছগুলোকেও কি বাঁচিয়ে রাখবেন? নিশ্চয়ই নয়, তাদের উপড়ে ফেলে দেবেন, নয়তো ভাল গছগুলোর ক্ষতি হবে। পঙ্গু আতুর জনও সেই রকম, তারা সমাজের কোনও কাজে আসে না, শুধু গলগ্রহ। যদি স্বহস্তে উৎপাটন করতে না চান তবে অন্তত তাদের বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করবেন না, চটপট মরতে দিন। দেখুন, আমাদের দেশে নানা রকম অভাব আছে, খাদ্য বস্ত্র আবাস বিদ্যা চিকিৎসা, আরও কত কি। সমাজের যারা যোগ্যতম, অর্থাৎ সুস্থ প্রকৃতিস্থ বুদ্ধিমান কাজের লোক, শুধু তাদেরই যাতে মঙ্গল হয় সেই চেষ্টা করুন, যারা আতুর অক্ষম জড়বুদ্ধি আর স্থবির তাদের সেবার জন্যে টাকার অপব্যয় করবেন না। জানেন বোধ হয়, ২৫।৩০ বৎসর পরে ভারতের লোকসংখ্যা ৪০ কোটির স্থানে ৮০ কোটি হবে। এত লোক পুষবেন কি করে? যতই কৃষিবদ্ধি আর জন্মশাসনের চেষ্টা করুন, বিশেষ কিছু ফল হবে না, আশি কোটি অধিবাসীর ঠেলা কিছুতেই সামলাতে পারবেন না।

 — আপনি কি করতে বলেন?

 —আমি যা চাই তা শুনেলে নেহেরুজীর মতন র‍্যাশনাল লোকও কানে আঙুলে দেবেন। আমি বলি—লীভ ইট টু নেচার। কিছু কালের জন্যে সব হাসপাতাল বন্ধ রাখতে হবে, ডাক্তারদের ইনটার্ন করতে হবে, পেনিসিলিন স্ট্রেপটোমাইসিন প্রভৃতি আধুনিক ওষুধে নিষিদ্ধ করতে হবে, ডিডিটি আর সারের কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। কলেরা বসন্ত প্লেগ যক্ষ্মা দুর্ভিক্ষ বার্ধক্য ইত্যাদি হল প্রকৃতির সেফটি ভাল্‌ভ, এদের অবাধে কাজ করতে দিন, তাতে অনেকটা ভূভার হরণ হবে। শায়েস্তা খাঁর আমলে দু আনায় এক মন চাল পাওয়া যেত। তার কারণ এ নয় যে তিনি ধানের চাষ বাড়িয়েছিলেন কিংবা কালোবাজারীদের শায়েস্তা করেছিলেন। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে লড়েন নি, ফ্রী হ্যাণ্ড দিয়েছিলেন। আর আমাদের এখনকার দয়াময় দেশনেতাদের দেখুন, বলেন কিনা প্রাণদণ্ড তুলে দাও! আমার মতে শুধু খুনী আসামী নয়, চোর ডাকাত জালিয়াত ঘুষখোর ভেজালওয়ালা কালোবাজারী দাঙ্গাবাজ ধর্ষক রাষ্ট্রদ্রোহী—সবাইকে সরাসরি ফাঁসি দেওয়া উচিত। তাতে যতটুকু লোকক্ষয় হয় ততটুকুই লাভ। আতুরাশ্রম সেবাশ্রম হাসপাতাল আর হেল্থ সেণ্টার প্রতিষ্ঠা করলে দেশের সর্বনাশ হবে। প্রকৃতিকে বাধা দেবেন না মশাই, কাজ করতে দিন। তার পর দেশের বাড়তি জঞ্জাল যখন দূর হবে, লোকসংখ্যা যখন চল্লিশ কোটি থেকে নেমে দশ কোটিতে দাঁড়াবে, তখন জনহিত কর্মে কোমর বেঁধে লাগবেন।

 হেমন্ত বলল, তা হলে নীতীশের টাকাটার কোনও সদ্‌গতি হবে না?

 —কেন হবে না, অবশ্যই হবে। ওই টাকায় প্রোপাগাণ্ডা করে লোকমত তৈরি করতে হবে, সুরেন বাঁড়ুজো যেমন বলতেন, এজিটেশন এজিটেশন অ্যাণ্ড এজিটেশন। আমার একটা থিসিস লেখা আছে, তার লক্ষ কপি ছাপিয়ে লোকসভা রাজ্যসভা আর বিধানসভার সদস্যদের মধ্যে বিলি করতে হবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যাকে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য বলেছেন তা ঝেড়ে না ফেললে নিস্তার নেই। দেশের ওআর্থলেস রুগ্ন অথবা অক্ষম লোকদের উচ্ছেদ করে শুধু বলবান বুদ্ধিমান কাজের লোকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শুনুন নীতীশবাবু, হেমন্তবাবু, আগে আমাদের দেশনেতাদের নির্মম বজ্রাদপি কঠোর হওয়া দরকার, তার পর জমি তৈরী হলে মনের সাধে লোকহিত করবেন।

 হাততালি দিয়ে হেমন্ত বলল, চমৎকার। গীতার 'শ্রীভগবানুবাচ’ আর Nietzscheর Thus spake Zarathustraর চাইতে ঢের ভাল বলেছেন। বহু ধন্যবাদ ডক্টর খাণ্ডারী, আপনার বাণী আমরা গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখব। এই কুড়ি টাকা দয়া করে নিন, যৎকিঞ্চিৎ প্রণামী। আচ্ছা আজ উঠি, নমস্কার।


ফেরার পথে নীতীশ বলল, লোকটা উন্মাদ না পিশাচ? হেমন্ত বলল, তেত্রিশ নয়ে পইসে উন্মাদ, তেত্রিশ পিশাচ আর চৌত্রিশ জবরদস্ত জনহিতৈষী। মনুস্মৃতি, মার্ক্‌সবাদ গান্ধীবাদ, সবই এখন সেকেলে হয়ে গেছে, তাই ডক্টর প্রেমসিন্ধু খাণ্ডারী নতুন বাণী প্রচার করে যুগাবতার হবার মতলবে আছেন। তবে এঁর প্রলাপবাক্যের মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও কিঞ্চিৎ আছে। শোন নীতীশ, তোমার দানসত্রের ভার পরের হাতে দিও না, তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, কেবলই মনে হবে ব্যাটা চুরি করছে। নিজের খুশিতে দান কর, সেবাশ্রমে আতুরাশ্রমে হাসপাতালে স্কুল-কলেজে, যেখানে তোমার মন চায়। যদি ভুলক্রমে অপাত্রে কিছু দিয়ে ফেল তাতেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। কিন্তু ফতুর হয়ে দান করো না। নিজের সংসারযাত্রার জন্যেও কিছু রেখো। তোমার স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে যদি কষ্টে পড়ে, তোমাকে যদি রোজগারের জন্যে ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে লোকসেবায় মন দিতে পারবে না।

 দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নীতীশ বলল, বেশ, তাই হবে। কিন্তু টাকাটা তো আসলে তোমার, অতএব লোকসেবার ভার তুমিই নেবে, আমি তোমার সহকারী হব।

 —আঃ, তোমার খুঁতখুঁতুনি এখনও গেল না দেখছি। বেশ, টাকাটা না হয় আমারই। কিন্তু আমার ফুরসত কম, দানসত্রের ভার তোমাকেই নিতে হবে, তবে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছি। জান তো, ভক্ত বৈষ্ণব তাঁর সর্ব কর্মের ফল শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করেন। তুমিও নিষ্কামভাবে লোকহিতে লেগে যাও, কর্মের ফল শ্রীকৃষ্ণের বদলে আমাকেই অর্পণ করো। পিতৃপুরুষদের দেনা শোধ করে তুমি তৃপ্তিলাভ করবে, স্বহস্তে দান করে ধন্য হবে। আর, তোমার দানের পুণ্যফল আমি ভোগ করব। ফণীবাবুর ব্যবস্থার চাইতে এই রকম ভাগাভাগি ভাল নয় কি?

১৮৮১