চরিতাবলী/হণ্টর
হণ্টর
ইংলণ্ডের অন্তঃপাতী লেনৰ্কশায়র প্রদেশে হণ্টরের জন্ম হয়। তাঁহারা ভাই ভগিনীতে দশটি ছিলেন; তন্মধ্যে তিনি সর্ব্বকনিষ্ঠ। বৃদ্ধ বয়সের ও সর্ব্ব শেষের পুত্র বলিয়া, তিনি পিতার আদরের ছেলে ছিলেন। তাঁহার পিতা, আদর দিয়া, তাঁহাকে এক বারে নষ্ট করিয়াছিলেন। হণ্টর যা খুসী হইত তাই করিতেন; কোন বিষয়ে কাহার উপদেশ অথবা বারণ শুনিতেন না। কোনপ্রকার শাসনে থাকা তাঁহার পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকর হইয়া উঠিয়াছিল। সর্ব্বদা আপন ইচ্ছা অনুসারে চলিয়া, এমন বিষম দোষ জন্মিয়া গিয়াছিল যে, তিনি কোন বিষয়ে অধিক ক্ষণ মনোযোগ করিতে পারিতেন না। সুতরাং বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, তথাকার নিয়ম অনুসারে চলিয়া, মনোযোগপূর্ব্বক লেখা পড়া শিখা তাঁহার অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহার কর্ত্তৃপক্ষীয়েরা অনেক কষ্টে তাঁহাকে অতি সামান্য লেখা পড়া শিখাইয়াছিলেন। সে সময়ে সকলেই লাটিন শিখিত; তদনুসারে তাঁহাকেও লাটিন শিখাইবার জন্যে বিস্তর চেষ্টা হইয়াছিল। কিন্তু তিনি কোন মতেই শিখিলেন না। অনেক বয়স পর্য্যন্ত তিনি খেলা, তামাসা ও আমোদ অহ্লাদে কাটাইলেন, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখা, অথবা বিষয়কর্মে্মর চেষ্টা দেখা, কিছুই করিলেন না।
হণ্টরের পিতা সঙ্গতিপন্ন লোক ছিলেন। ইংলণ্ড দেশের প্রথা এই, জ্যেষ্ঠ পুত্রই পৈতৃক বিষয়ের অধিকারী হয়। তদনুসারে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ সমস্ত পিতৃধন অধিকার করিলেন। হণ্টর বাপের আদরের ছেলে ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি মৃত্যুকালে তাহার জন্যে কোন বন্দোবস্ত করিয়া যান নাই। সুতরাং, কোন বিষয়কর্ম্ম না করিলে, তাঁহার চলা ভার। দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখেন নাই; সুতরাং যে সকল বিষয়কর্ম্মে লেখা পড়া জানা আবশ্যক, তাঁহার সেরূপ বিষয়কর্ম্ম করিবার ক্ষমতা ছিল না। তাঁহার এক ভগিনীপতি কাঠরার কর্ম্ম করিতেন; তাঁহার নিকট নিযুক্ত হইয়া, তিনি মেজ ও কেদারা গড়া শিখিতে লাগিলেন। নানা প্রকারে দায়গ্রস্ত হওয়াতে, তাঁহার ভগিনী পতির ব্যবসায় বন্ধ হইয়া গেল; সুতরাং হণ্টরেরও কর্ম্ম গেল। তিনি নিজে এরূপ কর্ম্ম চালান, তাঁহার এমন উপায় ছিল না; সুতরাং অতঃপর কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
এই সময়ের কিছু পূর্ব্বেই, তাহার এক অগ্রজ লণ্ডন রাজধানীতে চিকিৎসাব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছিলেন। ইনি শারীরস্থান বিদ্যা বিষয়ে উপদেশ দিতেন। শরীরের কোন্ স্থানে কিরূপ আছে, শব কাটিয়া ছাত্রদিগকে দেখাইয়া দিতে হইত। উপদেষ্টা স্বয়ং সেই সমস্ত নির্বাহ করিতে পারেন না, এজন্য তাঁহার সহকারী থাকিত। হণ্টর, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে আপন অগ্রজের নিকট পত্র দ্বারা এই প্রার্থনা করিয়া পাঠাইলেন, আপনি আমাকে আপন সহকারী নিযুক্ত করুন; যদি না করেন, আমি সৈনিক দলে প্রবিষ্ট হইব। তাঁহার ভ্রাতা সম্মত হইলেন এবং তাঁহাকে লণ্ডনে আসিতে লিখিয়া পাঠাইলেন। হণ্টর, অগ্রজের পত্র পাইয়া, অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, এবং অবিলম্বে লণ্ডনে আসিয়া কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন। প্রথম দিনেই, তিনি আপন কর্ম্মে এমন নৈপুণ্য দেখাইলেন যে, তাছার ভ্রাতা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কছিলেন, কালক্রমে তুমি এ বিষয়ে অদ্বিতীয় লোক হইবে, তখন তোমার চাকরীর আর কোন ভাবনা থাকিবেক না। হণ্টর, কিছু দিন পরেই, শারীরস্থানবিদ্যা অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিয়া, অতি ত্বরায় এমন ব্যুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন যে, লণ্ডনে আসার পর এক বৎসর না যাইতেই, উক্ত বিদ্যায় শিক্ষা দিবার উপযুক্ত হইয়া উঠিলেন, এবং কতকগুলি ছাত্রকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন।
অনন্তর তিনি, অল্প দিনের মধ্যেই, চিকিৎসাবিদ্যায় বুৎপন্ন হইয়া, চিকিৎসাব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। তদ্ব্যতিরিক্ত, তাঁহাকে শিষ্যদিগকে শিক্ষাদানপ্রভৃতি অনেক কর্ম্ম করিতে হইত। এই সমস্ত কর্ম্ম করিয়া অবসর পাইলেই, তিনি বিদ্যার অনুশীলন করিতেন। তৎকালে যে সকল ব্যক্তি শারীরস্থানবিদ্যায় বিশারদ ছিলেন, তিনি তাঁহাদের সকলের প্রধান বলিয়া গণ্য হইয়াছিলেন। তাঁহার দ্বারা অস্ত্রচিকিৎসা ও শারীরস্থানবিদ্যার যেরূপ উন্নতি হইয়াছিল, আর কাহার দ্বারা সেরূপ হয় নাই। বস্তুতঃ, এই সকল বিদ্যার উন্নতির নিমিত্ত, তিনি বিস্তুর যত্ন, বিস্তর পরিশ্রম ও বিস্তর অর্থব্যয় করিয়াছিলেন। তিনি নানা কর্ম্মে ব্যাপৃত ছিলেন, সুতরাং দিবাভাগে অবসর পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। অধিক অবসর লাভের নিমিত্ত, তিনি নিদ্রার সময় সঙ্কোচ করিয়াছিলেন। রাত্রিতে সমুদয়ে চারি ঘণ্টা, ও দিবসে আহারের পর এক ঘণ্টা, এইমাত্র নিদ্রা যাইতেন।
দেখ! হণ্টর কেমন আশ্চর্য্য লোক। বাল্যকালে পিতা মাতার আদরের ছেলে ছিলেন, অত্যন্ত আদর পাইয়া এক বারে নষ্ট হইয়া গিয়াছিলেন, কিছুই লেখা পড়া শিখেন নাই। লেখা পড়া জানিতেন না, এজন্য, উদরের অন্নের নিমিত্ত, অবশেষে ছুতরের কর্ম্ম আরম্ভ করিয়াছিলেন। যদি তাঁহার ভগিনীপতির কর্ম্ম, বন্ধ হইয়া না গিয়া, উত্তরোত্তর উত্তম রূপে চলিত, তাহা হইলে তিনি ঐ ব্যবসায়ে পরিপক্ক হইয়াই জন্ম কাটাইতেন। তাঁহার ভগিনীপতির কর্ম্ম বন্ধ হইয়া যাওয়াতে, তিনি নিঃসন্দেহ, অনুপায় ভাবিয়া, আপনাকে হতভাগ্য বোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার ভগিনীপতির কর্ম্ম বন্ধ হওয়া তাঁহার ও জগতের সৌভাগ্যের হেতু হইয়াছিল। তাঁহার কর্ম্ম বন্ধ হইল, আর কোন উপায় নাই, এই ভাবিয়া, হণ্টর আপন ভ্রাতার নিকট প্রার্থনা করেন। ঐ সময়ে তাঁহার বয়স কুড়ি বৎসর। কুড়ি বৎসর বয়সে লেখা পড়া আরম্ভ করিয়া, তিনি জগদ্বিখ্যাত ও চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন।