অরণ্যে
অর্জুন
অর্জুন

আমি যেন পাইয়াছি প্রভাতে জাগিয়া
ঘুম হতে, স্বপ্নলব্ধ অমূল্য রতন।
রাখিবার স্থান তার নাহি এ ধরায়;
ধরে রাখে এমন কিরীট নাই কোথা,

গেঁথে রাখে হেন সূত্র নাই, ফেলে যাই
হেন নরাধম নহি—তারে লয়ে তাই
চিররাত্রি চিরদিন ক্ষত্রিয়ের বাহু
বদ্ধ হয়ে প’ড়ে আছে কর্তব্যবিহীন।

চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ

চিত্রাঙ্গদা

কী ভাবিছ?

অর্জুন

ভাবিতেছি মৃগয়ার কথা।
ওই দেখো, বৃষ্টিধারা আসিয়াছে নেমে
পর্বতের ’পরে; অরণ্যেতে ঘনঘোর
ছায়া; নির্ঝরিণী উঠেছে দুরন্ত হয়ে,
কলগর্ব-উপহাসে তটের তর্জন
করিতেছে অবহেলা। মনে পড়িতেছে,
এমনি বর্ষার দিনে পঞ্চ ভ্রাতা মিলে
চিত্রক-অরণ্য-তলে যেতেম শিকারে।
সারাদিন রৌদ্রহীন স্নিগ্ধ অন্ধকারে
কাটিত উৎসাহে; গুরুগুরু মেঘমন্দ্রে
নৃত্য করি উঠিত হৃদয়; ঝরঝর
বৃষ্টিজলে, মুখর নির্ঝরকলোল্লাসে

সাবধান পদশব্দ শুনিতে পেত না
মৃগ; চিত্রব্যাঘ্র পঞ্চনখচিহ্নরেখা
রেখে যেত পথপঙ্ক-’পরে, দিয়ে যেত
আপনার গৃহের সন্ধান; কেকারবে
অরণ্য ধ্বনিত। শিকার সমাধা হলে
পঞ্চ সঙ্গী পণ করি মোরা সন্তরণে
হইতাম পার বর্ষার সৌভাগ্যগর্বে-
স্ফীত তরঙ্গিণী। সেইমত বাহিরিব
মৃগয়ায়, করিয়াছি মনে।

চিত্রাঙ্গদা

হে শিকারী,
যে মৃগয়া আরম্ভ করেছ, আগে তাই
হোক শেষ। তবে কি জেনেছ স্থির—
এই স্বর্ণমায়ামৃগ তোমারে দিয়েছে
ধরা? নহে তাহা নহে। এ বন্য হরিণী
আপনি রাখিতে নারে আপনারে ধরি।
চকিতে ছুটিয়া যায় কে জানে কখন
স্বপনের মতো। ক্ষণিকের খেলা সহে,
চিরদিবসের পাশ বহিতে পারে না।
ওই চেয়ে দেখো, যেমন করিছে খেলা
বায়ুতে বৃষ্টিতে, শ্যাম বর্ষা হানিতেছে

নিমেষে সহস্র শর বায়ুপৃষ্ঠ-’পরে,
তবু সে দুরন্ত মৃগ মাতিয়া বেড়ায়
অক্ষত অজেয়, তোমাতে আমাতে, নাথ,
সেইমত খেলা, আজি বরষার দিনে—
চঞ্চলারে করিবে শিকার প্রাণপণ
করি, যত শর যত অস্ত্র আছে তূণে
একাগ্র আগ্রহভরে করিবে বর্ষণ।
কভূ অন্ধকার, কভু বা চকিত আলো
চমকিয়া হাসিয়া মিলায়; কভু স্নিগ্ধ
বৃষ্টিবরিষন, কভু দীপ্ত বজ্রজ্বালা।
মায়ামৃগী ছুটিয়া বেড়ায় মেঘাচ্ছন্ন
জগতের মাঝে, বাধাহীন চিরদিন।