চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/চৈতন্যদেবের গম্ভীরালীলা
মহাপ্রভুর এই দিব্যোন্মাদময় গম্ভীরা-লীলার মধ্যেই আছে, সকল বৈষ্ণব-কবির পরমসাধ্য-ধন, রাধা-প্রেমের নিগূঢ় তত্ত্ব। কবি বাসুদেব ঘোষ সেই কথাই অপরূপ মধুর পয়ারে গেয়ে গিয়েছেন,—
যদি গৌর না হ’ত কি মেনে হইত
কেমনে ধরিতাম দে।
রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা
জগতে জানাত কে।
মধুর-বৃন্দা-বিপিন-মাধুরী
প্রবেশ-চাতুরী-সার।
বরজ-যুবতী-ভাবের ভকতি
শকতি হইত কার।
প্রেমময়ী শ্রীরাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপশক্তি, হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত্ত বিগ্রহ। “কৃষ্ণ বাঞ্ছা পূর্ণ করে এই কার্য্য তাঁর।” রায় রামানন্দ সহজ ভাবে এই রাধাতত্ত্ব বোঝাবার জন্যে বলেছেন,—
কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আ-হ্লাদিনী।
সেই শক্তি-দ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি॥
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন।
ভক্তগণে সুখ দিতে হ্লাদিনী কারণ॥
হ্লাদিনীর সার অংশ প্রেম তার নাম।
আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের ব্যাখ্যান॥
প্রেমের পরম সার মহাভাব জানি।
সেই মহাভাবরূপা রাধা-ঠাকুরাণী॥ (চৈ চঃ, মধ্যলীলা)
এই রাধা-ভাবে তন্ময় হয়ে নীলাচলধামে গম্ভীরাকক্ষে মহাপ্রভু যে লীলা-মাধুর্য্য বিকশিত করে গিয়েছেন, তার মধ্যে মূর্ত্তি ধরে জেগে উঠেছে এই মহা-প্রেম, যে-প্রেমকে যুগ যুগ ধরে বৈষ্ণব-কবিরা অপরূপ সুরে, ছন্দে, ভাষায় রূপ দিয়ে গিয়েছেন, শ্রীমতী হলেন যার মূর্ত্ত বিগ্রহ।
মহাপ্রভুর জীবনের এই শেষতম অধ্যায়ে দেখি, ক্রমশ ক্রমশ তিনি কি জাগরণে, কি নিদ্রায়, কি স্বপ্নে, সর্ব্বক্ষণ কৃষ্ণ-চেতনায়, কৃষ্ণ-বিরহে লীন হয়ে আছেন।
তাঁর দুই পাশে দুই মহাভক্ত, স্বরূপ আর রামানন্দ, সর্ব্বদাই তাঁর কাছে কাছে আছেন। দিনের বেলা কোন রকমে সমুদ্র-স্নানে, জগন্নাথ-দর্শনে আর কীর্ত্তনে কেটে যায় কিন্তু যেমনি অপরাহ্ণ পড়ে আসতে থাকে, ধীরে ধীরে নামে সন্ধ্যার ছায়া, আকুলতর হয়ে ওঠে মহাপ্রভুর বিরহ। বিব্রত, আতঙ্কিত হয়ে ওঠে স্বরূপ আর রামানন্দ। সে দিব্য-উন্মাদনার মহাতরঙ্গের বেগ রোধ করবার শক্তি তাঁদের কোথায়? তাঁরা তবুও আলাপে, আলোচনায়, তাঁকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন, ভাগবত পড়ে শোনান, গীতগোবিন্দ পড়ে শোনান। এইভাবে রাত্রি শেষ হয়ে আসতে থাকে। মহাপ্রভুকে শয্যায় শুইয়ে তবে তাঁরা বিশ্রাম করতে যান।
একদিন এই রকম মধ্যরাত্রির আলাপ-আলোচনার পর মহাপ্রভুকে শয্যায় শয়ন করিয়ে স্বরূপ আর রামানন্দ বিশ্রামের জন্যে নিজেদের ঘরে গিয়েছেন। মহাপ্রভুর ঘরের দরজার কাছে শুয়ে আছে ভক্ত-ভৃত্য গোবিন্দ।
স্বরূপ আর রামানন্দ চলে যাবার পর, ঘরের বাইরে থেকে গোবিন্দ বুঝতে পারলো মহাপ্রভু শয্যা গ্রহণ করেননি। অবিরাম নাম গান করে চলেছেন। নিদ্রাহীন চোখে ভৃত্য গোবিন্দও ঘরের বাইরে বসে সেই মধুর নাম গান শোনে। শুনতে শুনতে সে-ও তন্ময় হয়ে যায়। হঠাৎ তার চমক ভাঙ্গতেই সে বুঝতে পারলো, মহাপ্রভুর ঘর নিস্তব্ধ। হঠাৎ মহাপ্রভু নীরব হয়ে গেলেন কেন? তবে কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? ভক্ত-ভৃত্যের মন সন্দেহে দুলে উঠলো। ধীরে দরজা খুলে গম্ভীরাকক্ষের ভেতরে উঁকি মেরে দেখে, ঘর শূন্য। গোবিন্দ আলো জ্বেলে চারিদিকে খোঁজে। কি আশ্চর্য্য, ঘরের সমস্ত দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! অথচ ঘরের মধ্যে মহাপ্রভু নেই।
গোবিন্দ তৎক্ষণাৎ স্বরূপ আর রামানন্দকে ডেকে তুল্লো। মশাল জ্বেলে তিন জনে আতঙ্কিত অন্তরে খুঁজতে বেরুলেন। বাড়ীর আশে-পাশে চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে মশালের আলোয় দেখতে পেলেন মহাপ্রভু গোশালার মধ্যে গাভীদের কাছে কর্দ্দমাক্ত বাসে বসে আছেন। মহাভাবের প্রভাবে তাঁর চেহারা বিস্ময়কর ভাবে পরিবর্ত্তিত হয়ে গিয়েছে। সেই দীর্ঘ সুঠাম দেহ যেন বর্ত্তুলের মত বেঁকে গোল হয়ে গিয়েছে, হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গিয়েছে, সারা দেহ বিকশিত কদম্বের মতন রোমাঞ্চিত, স্থির আয়ত দুই চোখ থেকে অবিরাম জলধারা গড়িয়ে পড়ছে। নিদ্রা ত্যাগ করে গাভীরা মহাপ্রভুকে পরিক্রমণ করছে, আদরে তাঁকে লেহন করছে। সমাধিতে মহাপ্রভুর কোন বাহ্য চেতনা নেই।
প্রভুর জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্যে স্বরূপ আর রামানন্দ আকুল ভাবে নাম কীর্ত্তন করতে সুরু করে দিলেন।
বহু চেষ্টা-চরিত্রের পর মহাপ্রভুর সমাধি ভাঙ্গলে তিনি ব্যাকুল ভাবে চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগলেন। কেঁদে উঠলেন, এ তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?
বলেন আর দুই চোখ দিয়ে ধারা গড়িয়ে পড়ে। বহুক্ষণ পরে আবেগ সংবরণ করে বলেন, গম্ভীরার ঘরে বসে নাম-কীর্ত্তন করছিলাম, এমন সময় হঠাৎ কাণে এলো, মধুর বংশী-ধ্বনি! সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো, বুঝলাম, শ্যামরায় আমাকে বেণু সঙ্কেতে ডাকছে! আর কি আমি ঘরে থাকতে পারি? সেই বাঁশীর স্বর আমাকে টেনে নিয়ে এলো বৃন্দাবনে, দেখি, গোষ্ঠে গাভীরা বিহার করছে, আর আমার নওলকিশোর বিকশিত কদম্বের তলায় বাঁশী বাজাচ্ছে। সেখান থেকে এ কোথায় আমাকে নিয়ে এলে তোমরা?
কৃষ্ণ-বিরহে উন্মাদ হয়ে ওঠেন মহাপ্রভু—যে-বিরহ একদিন উন্মাদ করে তুলেছিল শ্রীমতীকে। শ্রীমতীর মতনই তিনি আকুল ভাবে কেঁদে ওঠেন,
হা হা শ্যামসুন্দর,
হাহা পীতাম্বর-ধর,
হা হা রস-বিলাস-সাগর
কাঁহা গেলে তোমা পাই,
তুমি কহ তাহা যাই!
যুগায়িতং নিমিষেণ
চক্ষুষা প্রাবৃষায়িতম্।
শূন্যায়িতং জগৎ সর্ব্বং
গোবিন্দবিরহেণ মে॥
চোখের পলক-পাতে মনে হয় যেন যুগ-যুগান্ত চলে যায়, নয়নে ছেয়ে আসে বর্ষার জলধারা, হে কৃষ্ণ, হে গোবিন্দ, তোমার বিরহে শূন্য যে আমার নিখিল জগৎ!
এমনি আর একদিন রাত্রিতে কৃষ্ণ-বিরহে অধীর হয়ে মহাপ্রভু একা সমুদ্রের তীরে চলে আসেন। পূর্ণ চাঁদের শুভ্র আলো রেণু রেণু হয়ে মিশে গিয়েছে সমুদ্রের নীল জলের সঙ্গে। মহাপ্রভুর দিব্য-নয়নে ফুটে ওঠে যমুনার তীরে হেমবরণা শ্রীমতীর সঙ্গে শ্যামবরণ কৃষ্ণের প্রেম-লীলা। নিজেকে আর তিনি ধরে রাখতে পারেন না। মহানন্দে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন নীল সাগরের বুকে। তরঙ্গে তরঙ্গে মহাসাগর সে-পুণ্যদেহকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে কোণারকের দিকে।
এধারে দুর্ভাবনায়, আতঙ্কে ভক্তদের আহার-নিদ্রা চলে যায়। তাঁরা চারিদিকে খুঁজে বেড়ান কোথায় গেলেন মহাপ্রভু। জগন্নাথ মন্দির, গুণ্ডিচা বাড়ী, চাক পাহাড়, যেখানে যেখানে মহাপ্রভু যেতে পারেন বলে তাঁরা অনুমান করলেন, সেখানে সেখানে ছুটলেন। কিন্তু কোথাও মহাপ্রভুর কোন সন্ধান মিললো না। হঠাৎ স্বরূপ দামোদরের মনে একটা কথা জেগে উঠলো, ভাবের ঘোরে তিনি কি তবে কোণারকের পথ ধরে চলে গেলেন? সেই সঙ্গে তাঁর মনে জেগে ওঠে এক চরম আশঙ্কা, সমুদ্রের ধার দিয়েই কোণারকের পথ……তবে কি মহাসাগর টেনে নিল মহাপ্রভুকে?
সমস্ত ভক্ত মিলে কোণারকের পথে সমুদ্রের তীর ধরে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন। যাকেই পথে দেখেন, তাকেই জিজ্ঞাসা করেন, ওগো, তোমরা কি এই পথ দিয়ে যেতে দেখেছ, গৌরবর্ণ-তনু এক উন্মাদকে?
হঠাৎ স্বরূপের নজরে পড়লো, এক জেলে সমুদ্রের ধার দিয়ে চলেছে, কিন্তু সমুদ্রের দিকে তার নজর নেই……সে আপনার মনে নেচে নেচে চলেছে আর কেঁদে কেঁদে গাইছে হরিনাম। সেই হরি-ধ্বনির আকর্ষণে ভক্তরা ছুটে তার কাছে আসে। দেখে জেলের দুচোখ দিয়ে অশ্রু-ধারা গড়িয়ে পড়ছে আর মুখে অবিরাম ধ্বনিত হচ্ছে মধুর হরিনাম।
বিস্ময়ে স্বরূপ জিজ্ঞাসা করে,—হাঁ ভাই! এ দশা তোমার কে করলো?
জেলে বলে,—প্রভু, সাগরে জাল ফেলি, মাছ তুলি, বাজারে বেচি, খাই। কাল ভোর রাতে সাগরে জাল ফেলে পেয়ে গিয়েছি সোনার পাহাড়। জল থেকে আর জাল টেনে তুলতে পারি না, এত ভারী। মনে বড় আনন্দ হলো, না জানি কত মাছ আজ জালে পড়েছে। টেনে তুলে দেখি, হরি হরি, এক তাল কাঁচা সোণা গো……কাঁচা সোণার ঠাকুর গো……আমার জালের ভেতর বসে মৃদু মৃদু গাইছে হরিনাম……কোন জ্ঞান নেই, কোন চেতনা নেই, শুধু বলে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ! কৃষ্ণ!
স্বরূপ চীৎকার করে ওঠে,—কোথায় ভাই তোমার সেই সোণার ঠাকুর!
জেলে ভক্তদের বাড়ীতে নিয়ে আসে। সমস্ত ধীবর-পল্লী থেকে উঠছে নামগান। জেলের উঠোনের একধারে বসে মহাপ্রভু গেয়ে চলেছেন কৃষ্ণনাম আর তাঁকে ধিরে ধীবর-পল্লীর যত নর-নারী আকুল হয়ে গেয়ে চলেছে সেই মধুর নাম।
বহু চেষ্টাচরিত্রের পর স্বরূপ দামোদর প্রভুর জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন, সারাপথ হরিনামে মুখরিত করে তাঁকে নিয়ে ফিরে আসেন গম্ভীরায়।
কোন কোন চরিতকার বলেন, মহাপ্রভু আবার আর একদিন পূর্ণিমার রাত্রিতে সমুদ্রের নীলরূপে তাঁর প্রিয়তমের দর্শন পেয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন। এবং সমুদ্রের অতল-নীলে অদৃশ্য হয়ে যান।
মহাপ্রভু ছিলেন ভগবানেরই অবতার। তাঁর স্পর্শে লোকে পেতো চিরানন্দের স্বাদ! তবে তিনি কেন এমনভাবে ভগবৎ-বিরহে কাঁদতেন?
তিনি যে মহাবস্তু পেয়েছিলেন,—তাকে পাবার পথ দেখিয়ে দেবার জন্যেই তিনি তাঁর শেষ জীবনে এই বিরহ-লীলা প্রকট করেন। এই ঐকান্তিক বিরহের ভেতর দিয়েই শ্রীমতী তাঁর পরমেশ্বরকে তাঁর পরম-ঈপ্সিতকে পেয়েছিলেন, এই বিরহ-সাধনার ভেতর দিয়েই আমরা সাধারণ মানুষ পেতে পারি সেই পরমেশ্বরের সন্ধান। বৈষ্ণবকবিরা তাই এমন করে গেয়ে গিয়েছেন এই বিরহের গান। এই বিরহ বিচ্ছেদ নয়, এই বিরহই হলো প্রেমের আরতি।
গীতগোবিন্দ হলো এই প্রেমেরই আরতি, ছন্দে, ভাষায়, সুরে।