চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/পূর্বরাগ
“সজনি কি হেরিনু যমুনার কূলে।
ব্রজকুল-নন্দন, হরিল আমার মন,
ত্রিভঙ্গ দাঁড়ায়ে তরুমূলে॥
গোকুল নগরী মাঝে, আর কত নারী আছে,
তাহে কোন না পড়িল বাধা।
নিরমল কুলখানি, যতনে রেখেছি আমি,
বাঁশী কেন বলে রাধা রাধা॥”
কবে সে-যমুনার কূলে, ব্রজকুল-নন্দন বাঁশী বাজিয়ে শ্রীমতীর মন হরণ করেছিল, আজও সে-বাঁশী বেজে চলেছে…আজও চকিতে গৃহ-কাজের মাঝে, জীবনে যার আসে সৌভাগ্যের লগ্ন, সে শুনতে পায়, সেই বাঁশী বাজছে।
শ্রীকৃষ্ণের পূর্ব্বরাগ হয়, কালীয় দমনের দিনে। কবি গোবিন্দদাস সেই অপরূপ মুহূর্ত্তটিকে রূপ দিয়ে গেয়েছেন। কালীয়-দমনের দিনে, কালিন্দীর তীরে, ছুটে এসেছে কতশত কৌতূহলী “ব্রজ নব বালা”, তারা গলাগলি দাঁড়িয়ে আছে, যেন “থির বিজুরিক মালা”। সেই স্থির বিজলীর মালার মধ্যমণিরূপে, ওগো সখা, দেখে এলাম, এক অপরূপ মনোমোহিনী নারী……
নায়িকার চরিত্র বা অবস্থাভেদে পূর্ব্বরাগেরও আবার বিভিন্ন রূপ আছে । মুগ্ধা নারীর পূর্ব্বরাগ আর প্রগল্ভা নারীর পূর্ব্বরাগ এক-রকমের নয়। সাধারণত তিন রকমের প্রকাশ দেখা যায়—মুগ্ধা, মধ্যা ও প্রগল্ভা।
পূর্ব্বরাগের একটী প্রধান অঙ্গের নাম হলো, অভিযোগ। এইসব শব্দ আমরা সাধারণত যে-অর্থে ব্যবহার করি, বৈষ্ণব কবিরা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা অর্থে তা ব্যবহার করে গিয়েছেন। পূর্ব্বরাগের সৃষ্টি যে-যে উপায়ে হয়, তার মধ্যে প্রধান হলো, সাক্ষাৎ দেখা, স্বপ্নে দেখা কিংবা চিত্রপটে দেখা। শুনেও পূর্ব্বরাগ হয়, তার মধ্যে সখীমুখে শোনা, দূতীমুখে শোনা, ভাটমুখে শোনা কিংবা বাঁশীর শব্দ শোনা হলো প্রধান। এই প্রথম দর্শনের প্রভাবের ফলে নায়ক বা নায়িকার মনে স্বভাবতই জেগে ওঠে বাসনা, কি করে অপর পক্ষের দৃষ্টি-আকর্ষণ করা যায়। যে-যে উপায়ে অপর পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তাদেরই বলে অভিযোগ। এবং এই অভিযোগের এক-একটী লক্ষণের অর্থও এক-এক রকম। যেমন নায়িকার অভিযোগ হলো, কিশলয়-দংশন অর্থাৎ নায়ককে দেখিয়ে নায়িকা নতমুখে কচি কিশলয় দাঁত দিয়ে দংশন করতে থাকে। নায়কও অভিযোগে পটু। নায়িকাকে দেখিয়ে নায়ক আধখানা খাওয়া ফল সখার মুখে তুলে দেয়, ফুলের মালা ছিঁড়ে স্রোতের জলে ভাসিয়ে দেয়, গাছের গায়ে নখের সাহায্যে লিখে রেখে যায় নায়িকার নাম ইত্যাদি।