চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/শৃঙ্গার বা আদিরস
বৈষ্ণব কবিতা বা গীতগোবিন্দের ভেতর যে-রস পরিবেশিত হয়েছে, তার নাম হলো শৃঙ্গার রস বা আদিরস। এই শৃঙ্গার রস বা আদিরসের অন্যতম চরম সার্থক প্রকাশ হলো গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দের প্রত্যেক শ্লোক, শ্লোকের প্রত্যেক অক্ষর এই রসে টইটম্বুর হয়ে আছে। সমস্ত কাব্যের মধ্যে এমন কোন শ্লোক নেই, শ্লোকে এমন কোন পদ নেই, পদে এমন কোন অক্ষর নেই যা এই অমৃতরসে নিষিক্ত হয়নি। কবির প্রাণের উত্তাপে ভাষা গ’লে হয়ে গিয়েছে রস-নির্ঝরিণী, আদি-রসের নির্ঝরিণী।
আমরা সাধারণ ভাষায় যে-অর্থে রস, ভাব, প্রেম, মান, অভিমান ইত্যাদি কথা ব্যবহার করি, বৈষ্ণব-সাহিত্যে কিন্তু এই সব কথার একটা করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সংজ্ঞা বা অর্থ আছে, যে সংজ্ঞার সঙ্গে পরিচিত না হলে বৈষ্ণব-কবিতার আসল স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। অণু বা পরমাণু আমরা সাধারণ ভাষায় যে অর্থে ব্যবহার করি, বৈজ্ঞানিকের কাছে কিন্তু এই দুটী কথার তাৎপর্য্য তার অতিরিক্ত অনেক কিছু। বৈজ্ঞানিকের কাছে অণু বা পরমাণুর একটা রূপ আছে, সে-রূপের আঙ্কিক ব্যাখ্যা আছে, ওজন আছে, গতি আছে, তেজ আছে। ঠিক সেই রকম বৈষ্ণব-সাহিত্যে এমন কতকগুলি শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, রস-বিজ্ঞান-সম্মত যাদের একটা স্বতন্ত্র টেক্নিক্যাল তাৎপর্য্য আছে। এই শব্দ-তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত না হলে, বৈষ্ণব-সাহিত্য বোঝা সম্ভব নয়।
বৈষ্ণব-রস-শাস্ত্র অনুযায়ী শৃঙ্গার রসের একটা স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা আছে। শৃঙ্গ মানে হলো, সম্ভোগ করবার ইচ্ছার পূর্ণ জাগরণ। এই সম্ভোগ করবার বাসনা যাতে পরিতৃপ্ত হয়, তাকে বলে শৃঙ্গার রস। প্রত্যেক সুরের যেমন একটা রূপ আছে, রূপের অধিষ্ঠাতা দেবতা আছে, তেমনি রসেরও রূপ আছে এবং তার অধিষ্ঠাতা দেবতাও আছে। শৃঙ্গার রসের রূপ হলো শ্যামবর্ণ, তার অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
এই শৃঙ্গার রস, যার মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে আছে কাম-ইচ্ছা, এই রস হলো জগতের আদি রস, কারণ এই কাম-ইচ্ছা অর্থাৎ সৃজন-বাসনা থেকেই এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃজন হয়েছে। ভগবানের অন্তরে জাগে এই আদিম কাম, সৃজন-বাসনা, তিনি এক ছিলেন, বহু হবার বাসনা তাঁর মধ্যে জাগার ফলে সৃষ্ট হলো এই বিচিত্র বিশ্ব। তাই আমাদের শাস্ত্রে ভগবানকে বলা হয়, “রসো বৈ সঃ”, তিনি রস, তিনিই আদি-রস। শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই আদিরসের রসঘন প্রত্যক্ষ মূর্ত্তি।
আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারে কাম শব্দের একটা কুৎসিত তাৎপর্য্য দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে ও রস-সাহিত্যে কামের মানে হলো আদিম সৃজন-বাসনা, সেই অনাদি শক্তি যা অনন্ত কাল ধরে বীজ থেকে অঙ্কুরকে ফোটায়, অঙ্কুর থেকে বৃক্ষকে জন্ম দেয়, বৃক্ষ থেকে জন্ম দেয় ফুল আর ফল। সমস্ত জীবনের জননী। তাই আমাদের বিবাহের মন্ত্রের একটা প্রধান অংশ হলো কামস্তুতি। এই কামকে স্তুতি বা স্তব করে আমাদের বিবাহ সিদ্ধ ও সার্থক হয়। এই কামস্তুতির মন্ত্র হলো,
ওঁ ক ইদং কস্মা অদাৎ
কামঃ কামায়াদাৎ।
কামো দাতা, কামঃ প্রতিগ্রহীতা
কামঃ সমুদ্রমাবিশৎ।
এই কন্যাকে কে সম্প্রদান করছে?
কাকেই বা সম্প্রদান করা হচ্ছে?
কামই এই কন্যাকে সম্প্রদান করছে।
এবং কামকেই সম্প্রদান করছে।
কামই দাতা, কামই গ্রহীতা।
সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, তেমনি এরা কাম-সমুদ্রেই মিলিয়ে গেল।
এই আদি-রসের বিলাস বা লীলার লক্ষ্য হলো আনন্দ, যে-আনন্দ হলো সকল জীবের কাম্য। আনন্দকে লাভ করাই হলো জীব-লীলার চরম ও পরম লক্ষ্য, কারণ ভগবান হলেন নিত্য আনন্দস্বরূপ। উপনিষদে তাই বলেছে,
আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি,
আনন্দং প্রযন্ত্যভিসংবিশন্তি।
আনন্দ থেকেই এই নিখিল প্রাণময় বিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে, আনন্দকে আশ্রয় করেই জীব জীবনধারণ করে এবং জীব-লীলার শেষে এই আনন্দেই লয়প্রাপ্ত হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেম-লীলার মধ্যে এই আনন্দের পরমতত্ত্বই প্রকট হয়ে উঠেছে। ভগবান এই আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যে নিজেকে বহুরূপে বিস্তার করে লীলা করছেন। সেই হলো বৃন্দাবন-লীলা । বৃন্দাবনে শ্রীমতী আর সখীদের সঙ্গে যে রাস-লীলা শ্রীকৃষ্ণ করেছিলেন, অনন্তকাল জুড়ে প্রত্যেক নর-নারীর অন্তরেই চলেছে সে নিত্য রাস-লীলা।