চিদ্বিলাস/সাংখ্য দর্শন

সাংখ্য দর্শন।

 মহর্ষি কপিলদেব এই দর্শনের প্রণেতা। ইনি কহেন যে ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তিই অত্যন্ত পুরুষার্থ।

 ত্রিবিধ দুঃখ যথা,—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দ্বিবিধ—শারীর ও মানস। আধিভৌতিক দুঃখ মনুষ্য, পশু, পক্ষী ও স্থাবরাদি ভূত পদার্থ হইতে উৎপন্ন হয়। আধিদৈবিক দুঃখ যক্ষ রাক্ষসাদি দেবযোনির আবেশ নিবন্ধন উৎপন্ন হয়।

 জগতে আসিয়াই লোক এই ত্রিবিধ দুঃখের অধীন হইয়া পড়ে। পুরুষকার অবলম্বন করিলে কখন কখন কোনও প্রকার দুঃখের ক্ষণিক অবসান হয় বটে, কিন্তু তাহাকে পুরুষার্থ বা মোক্ষ বলা যাইতে পারে না। এই দুঃখ সমূহের চিরাবসান অর্থাৎ তাহাদিগের পুনরুৎপত্তির কারণ পর্য্যন্ত নাশ করাই পুরুষার্থ।

 প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তির কারণ। কিন্তু এই বিবেক-জ্ঞান লাভ করিতে হইলে পুরুষ ও প্রকৃতির স্বরূপ ও কার্য্য এবং জগৎ কি ও তাহার কারণ কি ইত্যাদি জানিতে হইবে। এই নিমিত্ত সাংখ্যকার পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের অবতারণা করিয়া সমস্ত বিষয় বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।

 পরিদৃশ্যমান জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে আমরা জড় ও চৈতন্য এই দুই পদার্থ দেখিতে পাই। চৈতন্য পদার্থ পুরুষ এবং জড় পদার্থ প্রকৃতি নামে অভিহিত হয়। এই দুই পদার্থই অনাদি, কিন্তু উভয়ে ভিন্নধর্ম্মী। সাংখ্যমতে পুরুষ বহু, কিন্তু কোনওপ্রকার প্রমাণ দ্বারা ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন সিদ্ধাস্ত করা যায় না।

 প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ব; মহৎ হইতে অহঙ্কার; অহঙ্কারের সাত্বিক অংশ হইতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন এবং পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়, এবং অহঙ্কারের তামস ভাব হইতে পঞ্চ তন্মাত্রা —শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—এবং তাহা হইতে পঞ্চ মহাভূত যথা, ক্ষিতি, জল, তেজ বায়ু ও আকাশ—সৃষ্ট হয়।

 পূর্ব্বোক্ত চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বের তিনটি প্রকার-ভেদ আছে, যথা, (১) প্রকৃতি, (২) প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন, (৩) এবং বিকৃতি। প্রকৃতি শব্দে কারণ বুঝায়। মূলা প্রকৃতি ত্রয়োবিংশতি তত্ত্বের কারণ অথচ নিজে কাহারও কার্য্য নহে, অতএব ইহা কেবলই কারণ ভাবাপন্ন। কিন্তু মহত্তত্ব প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন অথচ অহঙ্কারের কারণ, অতএব ইহা প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন। আবার যে সমস্ত তত্ত্ব হইতে অপর কোনও প্রকার তত্ত্ব উদ্ভূত হইতেছে না তাহারা কেবলই বিকৃতি ভাবাপন্ন।

 কিন্তু পুরুষতত্ত্ব প্রকৃতি বা বিকৃতি ভাবাপন্ন নহে। পুরুষ কোনও কারণ হইতে উদ্ভূত হয় নাই এবং পুরুষ হইতে কোনও কিছু উদ্ভূত হয় না।

 প্রকৃতির সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ আছে; কিন্তু পুরুষ নির্গুণ। প্রকৃতির রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টি, সত্ত্বদ্বারা স্থিতি ও তমঃ দ্বারা প্রলয় হইয়া থাকে। সৃষ্টি শব্দের অর্থ আবির্ভাব এবং প্রলয় শব্দের অর্থ তিরোভাব।

 প্রকৃতির স্থুল ক্রিয়া দ্বারা যখন জগৎ স্থুল-রুপ ধারণ কবে তখনই ইহার আবির্ভাব এবং যখন প্রকৃতির সূক্ষ্মক্রিয়া দ্বারা জগৎ সূক্ষ্মভাবাপন্ন হয় তখনই ইহার তিরোভাব। বস্তুতঃ ইহার একেবারেই ধ্বংস নাই।

 প্রকৃতিতে সৃষ্টির প্রবৃত্তি ও ভোগের উপাদান আছে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি ও ভোগ হইয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃতিই ভোক্ত্রী ও কর্ত্রী; পুরুষ ভোক্তাও নহেন কর্ত্তাও নহেন। পুরুষ প্রকৃতিতে আসক্ত হইয়া কর্ম্মীরূপে প্রতীয়-মান হয়েন।

“অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহং ইতি মন্যতে।”

 অহঙ্কার বিমূঢ় ভাবই দুঃখের কারণ। অতএব পুরুষ যখনবিদ্যা আশ্রয় পূর্ব্বক অহং তত্ত্বের উপরে উঠিয়া স্বরূপে অবস্থিত হয়েন তখন প্রকৃতির তিনগুণের সাম্যাবস্থা হয়।

 প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞান সম্বন্ধে আরও কিছু স্পষ্ট করিয়া লিখিত হইতেছে। পুরুষ যদিও নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয় এবং নির্গুণ, তথাপি অদৃষ্টবশতঃ অহঙ্কারকে আশ্রয় করিয়া নিজের দুঃখের বীজ নিজে রোপন করেন। কর্ম্মফল হইতে অদৃষ্টের উৎপত্তি। দর্শনকারগণ বলেন যে কর্ম্মের প্রথম নাই কারণ সৃষ্টি অনাদি, অতএব পুরুষের অদৃষ্টও অনাদি। কিন্তু অনাদি হইলেও সাংখ্যমতে কর্ম্মফল সান্ত। জ্ঞান কর্ম্মফলের ধ্বংস করিতে পারে। কর্ম্মফলের ধ্বংস হইলেই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ নষ্ট হইবে। তাহা হইলেই মুক্তি। এক্ষণে এই প্রকৃতি পুরুষের সংযোগ ধ্বংসকারী জ্ঞান কি? “নিজ স্বরূপ বোধ।” প্রকৃতিই সমস্ত ভোগের আধার ও বোধক, নিজে সমস্ত ভোগ হইতে পৃথক, এইরূপ জ্ঞান দ্বারা নিজের স্বরূপ বুঝিতে পারিলে আর কর্ম্মফলে বাধ্য হইতে হয় না।

ওঁ তৎ সৎ