চূর্ণ প্রতিমা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
যখন বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন রাত্রি আটটা বাজিয়াছে। কিছুকাল বিশ্রাম করিয়া, আহারাদি শেষ করিয়া শয়ন করিলাম।
শয়ন করিলাম সত্য, কিন্ত নিদ্রা আসিল না। জহরের আচরণের কথা ভাবিতে লাগিলাম। জহর প্রথমতঃ আমার সহিত যেরূপ ভাবে কথাবার্ত্তা কহিয়াছিল, তাহাতে তাহাকে সুস্থ বলিয়াই বোধ হইয়াছিল। মনে করিয়াছিলাম, কোন লোক অন্যায় করিয়া তাহার নামে মিথ্যা দোষারোপ করিয়াছে। কিন্তু শেষে সে যেরূপ আচরণ দেখাইল, তাহাতে তাহাকে উন্মাদ বলিয়াই বোধ হইল। হীরাখানির নাম উল্লেখ করিবামাত্র জহরলাল অজ্ঞান হইয়া পড়িল কেন? এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিয়া এই স্থির করিলাম, জহরলালই হীরাখানি কুড়াইয়া পাইয়াছে। কিন্তু বোধ হয়, এখনও বিক্রয় করিবার কোনরূপ পন্থা করিতে পারে নাই।
এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম, জহরের উপর সন্দেহ ততই বাড়িতে লাগিল। অবশেষে স্থির করিলাম, পরদিন স্থানীয় পুলিসের সাহায্যে জহরলালের বাড়ী অনুসন্ধানের জন্য মাজিষ্ট্রেটের অনুমতি লইব।
পরদিন বেলা প্রায় এগারটার পর ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি পাইলাম। চারিজন কনষ্টেবল ও একজন ইন্স্পেক্টার আমার সঙ্গে চলিলেন।
সদলবলে জহরের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। আমি আগে আগে যাইতে লাগিলাম, পুলিসের লোক সকল আমার অনুসরণ করিতে লাগিল। দরজার সম্মুখেই বৃদ্ধকে দেখিতে পাইলাম, কিন্ত সে আমায় চিনিতে পারিল না। যখন সন্নাসীবেশে আসিয়াছিলাম, তখন কৃত্রিম কণ্ঠে কথাবার্ত্তা কহিয়াছিলাম। আজ স্বাভাবিক কণ্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বাড়ীর মালিক কে?”
বৃদ্ধ, এতগুলি পাহারওয়ালা ও আমাদের দুইজনকে দেখিয়া, ভয়ে কাঁপিতে লাগিল; বলিল, “আজ্ঞে, আমারই এ বাড়ী।”
আমি বলিলাম, “ম্যাজিষ্ট্রেটের হুকুম মত আমি এই বাড়ী তল্লাস করিতে আসিয়াছি।”
বৃদ্ধ আমার কথায় চমকিত হইল; বলিল,”এই বাড়ী কি? আপনাদের ভুল হয় নাই ত?”
আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম, “বাপু, আমরা পুলিসের লোক। আমাদের এত ভুল হয় না।”
বৃ। আমাদের বাড়ীতে কি হইয়াছে? কোন্ অপরাধে আপনি আমার বাড়ী তল্লাস করিতে আসিয়াছেন?
আ। সে কথা কি জান না? মিছামিছি কথা বাড়াও কেন?
বৃ। দোহাই ধর্ম্মাবতার, আমি কিছুই জানি না। আমায় যে শপথ করিতে বলিবেন, আমি সেই শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আমি সত্য সত্যই কিছু জানি না।
আ। জহর ব’লে কোন লোক এখানে থাকে?
বৃ। আজ্ঞে হাঁ, থাকে। জহর আমারই বড় ছেলে।
আ। সে একখানা হীরা চুরি করিয়া আনিয়াছে।
বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বলিল, “একথা আমি বিশ্বাস করিতে পারি না। জহর আমার আজ চারিদিন হইল, পাগল হইয়া গিয়াছে। সে এই চারি দিন বাড়ী হইতে বাহির হয় নাই।”
আমি অতি কর্কশভাবে বলিলাম, “তোমার ছেলে যদি এতই সাধু হয়, তবে সেদিন হাজতে গিয়াছিল কেন?”
বৃদ্ধ উত্তর করিল, “সন্দেহ করিয়া তাহাকে হাজতে পাঠান হইয়াছিল। জহর আমার তেমন নয়। সে যাহাই হউক, আপনারা যাহা করিতে আসিয়াছেন করুন। আমি আাপনাদিগকে বাধা দিব না।
আমাদিগের এইরূপ কথাবার্ত্তার পর, ইন্স্পেক্টার মহাশয় কনষ্টেবলদিগকে ইঙ্গিত করিলেন। কনষ্টেবলগণ তন্ন তন্ন করিয়া বৃদ্ধের বাড়ী অন্বেষণ করিল, কিন্ত কোথাও সেই হীরাখানিকে পাওয়া গেল না।
প্রায় দুইঘণ্টা ধরিয়া চারদিক দেখিবার পর আমরা বিমর্ষভাবে পুলিসে ফিরিয়া আসিলাম।
পুলিস হইতে যখন বাড়ী ফিরিলাম, তখন বেলা পাঁচটা বাজিয়া গিয়াছে। সে দিন আর কোন কাজ করিতে ভাল লাগিল না, কোথায়, কি করিয়া হীরাখানি পাইব, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলাম।
পরদিন অফিসে বসিয়া আছি, এমন সময় একজন পুলিস-কর্ম্মচারী তথায় উপস্থিত হইলেন; বলিলেন, “শুনিয়াছেন মহাশয়! পুলিসের কাজে আপনি চুল পাকাইয়াছেন, কখন কোন পাগলকে চুরি করিতে শুনিয়াছেন?”
ইন্স্পেক্টার মহাশয়ের সহিত আমার যথেষ্ট সদ্ভাব, ছিল। আমি তাঁহাকে অতি সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া একখানি চেয়ারে বসিতে বলিলাম। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, “ব্যাপার কি?”
ই। এমন কিছু নয়। তবে এক পাগল চুরি অপরাধে ধরা পড়িয়াছে।
আ। কে সে পাগল? তাহার নাম কি?
ই। জহরলাল।
আ। বাড়ী কোথায়?
ই। সিকদার পাড়া।
আ। কোথায় চুরি করিয়াছে?
ই। চুরি করে নাই, করিতে গিয়াছিল।
আ। কোথায়?
ই। জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেদের বাড়ী।
আ। জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেরা ত বড়লোক। তাহাদের দেউড়িতে সর্ব্বদাই তিন চারিজন দরোয়ান আছে। সে বাড়ীতে চোর গেল কেমন করিয়া?
ই। সে কথা বলিতে পারিলাম না; কিন্ত চুরি অপরাধে জহর ধরা পড়িয়াছে।
আ। জহর কি চুরি করিয়াছিল?
ই। না, চুরি করিতে পারে নাই; তবে কতকগুলি জিনিষপত্র তোলপাড় করিয়াছে।
আ। জহর এখন কোথায়?
ই। হাজতে।
আ। কেন? সে যখন কিছুই চুরি করে নাই, তখন তাহাকে হাজতে রাখা ভাল হয় নাই।
ই। চুরি করে নাই বটে, কিন্তু কতকগুলি দামী জিনিষ নষ্ট করিয়াছে।
আ। কিসে?
ই। একটা দামী শ্যামা-প্রতিমা ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দিয়াছে। আমার ইচ্ছা, আপনি একবার তাহাকে দেখিয়া আসুন। লোকটা যে রকম করিয়া সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা দেখিলে, আপনিও আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন, তখন লোকটাকে একজন পাকা চোর বলিয়া বুঝিতে পারিবেন।
আমি বলিলাম, “যদি তুমি আমাকে জোড়াসাঁকোয় লইয়া যাও, তাহা হইলে দেখিয়া আসিতে পারি। কিন্ত সে যাহাই করুক না কেন, যখন সে পাগল, আবার যখন কিছুই লয় নাই, তখন তাহাকে কিছুই করা যাইতে প্রারে না। তথাপি চলুন, আমরা গিয়া দেখিয়া আসি।”
এই বলিয়া আমি চাকরকে একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বলিলাম, গাড়ী আনীত হইলে, আমি ইন্স্পেক্টারকে লইয়া তাহাতে উঠিলাম। ইন্স্পেক্টার গাড়োয়ানকে যোড়াসাঁকো যাইতে আদেশ করিলেন।
প্রায় আধ ঘণ্টার পর আমরা জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেবাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীর কর্ত্তা বাড়ীতেই ছিলেন। তিনি আমাদিগের আগমন-বার্ত্তা পাইয়া তাড়াতাড়ি দরজায় আসিলেন, এবং অতি সমাদরে বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলেন। দেখিলাম, জহরলাল অনেকগুলি জিনিষ নষ্ট করিয়াছে। তাহার মধ্যে এক কালিপ্রতিমা এমন করিয়া ভাঙিয়াছে যে, তাহার আর কোন চিহ্ন নাই। একখানা ইট দিয়া যেন গুঁড়াইয়া ফেলিয়াছে। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, অপর জিনিষগুলি যেখানে ভাঙ্গা পড়িয়াছিল, প্রতিমাখানি সেখানে গুড়ান হয় নাই। উহাকে একটী নিভৃত স্থানে লইয়া গিয়া জহর সে কার্য্য করিয়াছে। কিছুক্ষণ চারিদিক ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন্ কোন্ জিনিস চুরি গিয়াছে?”
বাড়ীর কর্ত্তার নাম সুধীন্দ্রনাথ। তাঁহার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে খর্ব্বাকৃতি, হৃষ্টপুষ্ট ও গৌরবর্ণ। কালা পেড়ে একখানি পাতলা দেশী ধুতি পরিয়া, খালি গায়ে, একজোড়া চটীজুতা পায়ে দিয়া, তিনি এতক্ষণ আমার সহিত চারিদিকে ঘুরিতে ছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনিয়া উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে না, কোন জিনিষ চুরি যায় নাই। আপনিই দেখিলেন, আমার অনেক টাকার জিনিষ নষ্ট হইয়াছে। কিন্তু বলিতে কি, একটী কড়ার জিনিষ ও চুরি যায় নাই।’
আ। কখন আপনারা এই ব্যাপার জানিতে পারেন?
সু। আজ প্রাতে।
আ। কে প্রথমে দেখিতে পায়?
সু। আমার এক চাকর।
আ। চোর ধরিল কে?
সু। সেই চাকর।
আ। কোথায় সে? আমি তাহার মুখের গোটাকতক কথা শুনিতে চাই?
সুধীন্দ্রনাথ তখনই “সদা সদা” বলিয়া চীৎকার করিলেন। দূর হইতে একজন উত্তর করিল, “যাই।”
কিছুক্ষণ পরে একজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ উৎকলনিবাসী যুবক সুধীন্দ্রবাবুর নিকটে আসিল। সুধীন্দ্রনাথ তাহাকে দেখাইয়া বলিলেন, “এই লোক চোর ধরিয়াছে।”
আমি তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। বলিলাম, “তুমিই চোর ধরিয়াছ?”
সদা অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “আজ্ঞে হাঁ; কিন্ত তাহাকে ধরিতে কোনরূপ কষ্ট পাইতে হয় নাই। সে নিজেই ধরা দিয়াছে।”
আ। কি রকমে চোর ধরিয়াছ বল দেখি?
স। আমি প্রতিদিনই রাত্রি চারিটার সময় বিছানা হইতে উঠিয়া থাকি। কাল রাত্রি চারিটার পূর্ব্বে একটা শব্দ শুনিয়া আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিলাম; একটা আলো জালিলাম, তাহার পর সেই আলো লইয়া ঘরের বাহির হইলাম। আবার একটা শব্দ শুনিতে পাইলাম। বোধ হইল, কে যেন কাচের বাসনগুলি আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিতেছে। আমি তখনই উপরে গেলাম। বৈঠকখানার সম্মুখে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম বড় বড় কাচের পুতুল, ভাল ভাল ছবি, দুইটা ভাল ঘড়ি, বড় আয়নাখানা, আর সমস্ত ভাল ভাল জিনিষ চুরমার হইয়া গিয়াছে। সকল জিনিষই বাবুর বড় সখের ছিল। আমিও ছেলেবেলা হইতে এ সকল জিনিষ দেখিয়া আসিতেছি। জিনিষগুলির অবস্থা দেখিয়া আমার বড় দুঃখ হইল। বাবুকে খবর দিতে অন্দরে যাইতেছি, এমন সময়ে বৈঠকখানার ভিতর একজন লোককে দেখিতে পাইলাম। তখনই বৈঠকখানার ভিতর গমন করিলাম। দেখিলাম, একটা লোক আপনাপনি কি বকিতে বকিতে ঘরের ভিতর পায়চারি করিতেছে। আমায় দেখিয়াই সে অট্টহাস্য় করিল। সে বিকট হাসি দেখিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল, তাহাকে উপদেবতা বলিয়া ভ্রম হইল; কিন্তু বিশেষ ভয় হইল না। সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে তুমি? এত রাত্রে এখানে কি করিতেছ?”
লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে কট্মট করিয়া চাহিয়া রহিল বলিল, “আমি কে, জান? আমার নাম জহরলাল। এ অঞ্চলে আমায় কেহ চেনে না বটে, কিন্তু আমাদের ওদিকে অনেকেই এ অধীনকে চেনে।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে কি করিতেছ? বাড়ীর মধ্যেই বা আসিলে কেমন করিয়া? এই সব ভাল ভাল জিনিষগুলি নষ্ট করিয়াছ কেন?”
লোকটা অট্টহাস্য় করিয়া উঠিল; সে হাসি অনেকক্ষণ থামিল না। যখন তাহার হাসি থামিল, তখন আমি তাহাকে আরও গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু সে কোন কথার জবাব দিল না। আপনার মনে কখন হাসিতে কখন বা বকিতে লাগিল। আমি তখন তাহাকে উন্মাদ বলিয়া ভাবিলাম এবং বাবুর কাছে ধরিয়া লইয়া যাইবার উপক্রম করিলাম। লোকটার শরীরে অসুরের মত বল। আমি নিজে বড় জোয়ান বলিয়া মনে মনে অহঙ্কার করিতাম; আমার সেই অহঙ্কার চূর্ণ হইল। এইরূপ গোলযোগে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল। বাড়ীর আর আর চাকরেরা তখন উঠিয়ছিল। আমি তাহাদের একজনকে বাবুকে ডাকিতে বলিলাম। বাবুও তখনই আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। আমি তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া লোকটাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, একেবারে থানায় খবর দিলেন। থানার লোক আসিয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল।”
সদার কথা শুনিয়া আমি সুধীন্দ্র বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ইচ্ছা কি? লোকটাকে আমি চিনি। সে সম্প্রতি পাগল হইয়া গিয়াছে। যদি আপনার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে তাহাকে পাগ্লা-গারদে পাঠাইতে পারি। কিন্ত যখন সে কোন জিনিষ লয় নাই, আর যখন সে উন্মাদ অবস্থায় এই কার্য্য করিয়াছে, তখন তাহাকে বৃথা কষ্ট দেওয়া ভাল নয়।”
সুধীন্দ্রবাবু অতি সজ্জন লোক। তিনি বলিলেন, “আপনি যেরূপ বলিবেন, তাহাই হইবে। যে সকল জিনিষ সে নষ্ট করিয়াছে, তাহা আর ফিরিয়া পাইবার আশা নাই। আমার যথেষ্ট ক্ষতি হইলেও যদি আপনি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে বলেন, তাহাতে আমার আপত্তি নাই।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে আপনার বাড়ীতে প্রবেশ করিল কিরূপে? আর কত রাত্রেই বা সে এ বাড়ীতে আসিল?”
সু। ঠিক কত রাত্রে আসিয়াছে বলা যায় না। তবে বোধ হয়, রাত্রি দুইটার পূর্ব্বে সে এখানে আসিতে পারে নাই।
আ। কেমন করিয়া জানিলেন?
সু। আমার ছোট ভাই গত রাত্রে থিয়েটার দেখিতে গিয়াছিল। সে রাত্রি দুইটার সময় বাড়ীতে ফিরিয়া আইসে। খুব সম্ভব, সে দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিল।
আ। দরজা কি তবে খোলা ছিল?
সু। না, খোলা ছিল না।
আ। তাহাকে দরজা খুলিয়া দেয় কে?
সু। আমাদের জমাদার।
আ। তাহা হইলে সেই দরজা বন্ধ করিয়াছিল?
সু। সে তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারে না। সে বলে যে, ঘুমের ঘোরে যে কি করিয়াছে, তাহা তাহার মনে নাই।
আ। তবে তাহাই সম্ভব। যে মাটীর পৃতুলটা গুঁড়াইয়া ফেলিয়াছে, শুনিলাম, সেখানা কালীর প্রতিমুর্ত্তি। আপনি উহা কোথায় পাইয়াছেন?
সু। কিনিয়াছি।
আ। কোথা হইতে?
সু। কুমারটুলি হইতে।
আ। দোকানদারের নাম জানেন?
সু। জানি বই কি,—নফরের দোকান। নফর কুমোরের নাম শুনিয়াছেন বোধ হয়?
আ। শুনিয়াছি। কত টাকায় উহা কিনিয়াছেন?
সু। ঐ কালীমূর্ত্তি আর একখানা শিবের মূর্ত্তি এই দুইখানা পাঁচ টাকায় লইয়াছি।
আ। কতদিন পূর্ব্বে কিনিয়াছেন?
সু। প্রায় মাস খানেক হইল টাকা দিয়াছিলাম বটে, কিন্ত কাল বৈকালে উহা আমার বাড়ীতে পৌঁছিয়াছে।
আ। শিবের মূর্ত্তিটা কোথায়?
সু। অন্দরে রাখিয়াছি। এখানে রাখিলে তাহারও এই দুর্দ্দশা হইত।
আ। এখন যদি তাহাকে পাগলা গারদে পাঠাইতে আপনার ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে সেই মর্ম্মে একখানি পত্র লিখিয়া দিন। আমি থানায় গিয়া তাহার মুক্তির উপায় দেখিব। বেচারাকে বৃথা হাজতে রাখিবার কোন কারণ দেখি না।
আমার কথায় সুধীন্দ্রনাথ সম্মত হইলেন; এবং তৎক্ষণাৎ একখানি পত্র লিখিয়া দিলেন। আমি ইন্স্পেক্টার বাবুর সহিত থানায় আসিলাম। পরে পুলিসের সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমার উদ্দেশ্য জ্ঞাপন করিলাম। সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট সাহেব আমাকে বিলক্ষণ চেনেন, তিনি আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া হাসিলেন এবং তখনই জহরলালের মুক্তির আদেশ দিলেন। জহরলাল মুক্ত হইল।