চূর্ণ প্রতিমা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
পরদিন প্রাতে জহরলালের বাড়ীতে যাইলাম। সেবার সন্ন্যাসীবেশেই গিয়াছিলাম। বৃদ্ধ আমায় দেখিয়া অতান্ত রোদন করিল; বলিল, “ঠাকুর, ভাল হওয়া দূরের কথা, জহরের পাগলামি আরও বাড়িয়াছে। পরশ্ব রাত্রে হাত-পায়ের বন্ধন ছিঁড়িয়া সে যে কোথায় গিয়াছিল, তাহার সন্ধান পাই নাই। কাল সকালে শুনিলাম, সে নাকি জোড়াসাঁকোর কোন ধনাঢ্য লোকের বাড়ীতে গিয়া কি উৎপাত করিয়াছিল। কত টাকার জিনিষ যে সে নষ্ট করিয়াছে, তাহাও বলিতে পারি না। বাড়ীর কর্ত্তা তাহাকে প্রথমে থানায় দিয়াছিলেন। শেষে জহরকে পাগল বলিয়া স্থির করিয়া অব্যাহতি দেন। কাল সন্ধার পর জহর ফিরিয়া আসিয়াছে। সেই অবধি সে কোন জিনিষ খায় না, কাহারও সহিত কোন কথা কয় না, কেবল কাঁদিতেছে। এমন কেন হইল ঠাকুর? কোন্ পাপে আমার রোজগারি ছেলের এ দুর্দ্দশা হইল?”
আমি পূর্ব্বের মত কৃত্রিম কণ্ঠে বলিলাম, “পরে সমস্তই জানিতে পারিবে। আমার বোধ হয়, তোমার ছেলে কোন গুরুতর পাপ করিয়াছে। সেই জন্য তাহার এই রকম পরিবর্ত্তন হইয়াছে।”
বৃদ্ধ আমার কথায় প্রথমতঃ আশ্বস্ত হইল; পরে বলিল, “ঠাকুর, আপনার অগোচর কিছুই নাই। বলুন, কি করিলে জহরের পাপ শাস্তি হয়। যদি আমার জীবন দিয়াও জহরকে সুস্থ করিতে পারি, তাহাতেও আমি পশ্চাৎপদ হইব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “জহর কোথায়?”
বৃ। সে ঘরেই আছে।
আ। হাত-পা বাঁধা?
বৃ। আজ্ঞে না। যখন বন্ধন ছিঁড়িয়া সে একবার পলায়ন করিয়াছিল, তখন আর তাহাকে বাঁধিবার কোন আবশ্যকতা দেখি না। সে খোলাই আছে, তবে তাহার ঘর বাহির হইতে চাবি দেওয়া হইয়াছে।
আ। ভাল কাজ কর নাই। তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়া দাও। সে নিজের ইচ্ছামত কাজ করুক। তাহা হইলে বোধ হয়, তাহার মেজাজ ঠাণ্ডা হইতে পারে
বৃ। যে আজ্ঞা। আপনি যেমন আদেশ করিবেন, আমি সেইরূপ করিব; কিন্তু ভয় হয়, পাছে জহর আমায় আবার প্রহার করে।
আ। জহরের ঘর খুলিয়া দাও এবং তোমরা সকলে একটী ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া থাক, তাহা হইলে সে আর তোমাদের উপর অত্যাচার করিতে পারিবে না। কিন্তু আমার বোধ হয়, ছাড়া পাইলে সে বাড়ীতে থাকিবে না।
বৃ। তবেই ত ঠাকুর! সেও এক জ্বালা। এই বুড়ো বয়সে কোথায় তাহার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইব?
আ। জহরের বেশ জ্ঞান আছে। তবে মধ্যে মধ্যে সে উন্মাদ হইয়া উঠে। তাহার জন্য় তোমাদের চিন্তা করিবার কোন কারণ নাই। সে যেখানেই থাকুক না কেন, দুই একদিনের মধ্যেই বাড়ী ফিরিবে ইহা নিশ্চয়।
বৃ। তবে আপনি এই চাবি লউন। জহরের ঘর আপনিই খুলিয়া দিন। ইতিমধ্যে আমি মেয়েদের লইয়া একটা ঘরের ভিতর গিয়া দরজ! বন্ধ করিয়া দি।
আমি বৃদ্ধের হাত হইতে চাবি লইলাম এবং যে ঘরে জহর আবদ্ধ ছিল, সেই ঘরের দরজা খুলিয়া দিলাম। চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে জহরলাল বেগে ঘর হইতে বাহির হইল এবং কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া একেবারে রাস্তায় গিয়া উপস্থিত হইল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলাম, কিন্তু পাগলের সঙ্গে দৌড়ান বড় সহজ ব্যাপার নহে। অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না, অগত্যা বাড়ীতে ফিরিলাম।