চূর্ণ প্রতিমা/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বেলা একটার পর আমি নফরের দোকানে আসিলাম। দেখিলাম, নফর বড় ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করিলাম, “নফরচন্দ্র! আমায় চিনিতে পার?”
নফর আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল; বলিল, “আজ্ঞে হাঁ, চিনিতে পারিয়াছি; কিন্তু মহাশয়, আমি এক ভয়ানক বিপদে পড়িয়াছি, এখন আপনার কথা শুনিতে পারিব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে? আমিও বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য তোমার এখানে আসিয়াছি।”
ন। আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। দুইজন কারিগর সাংঘাতিক রূপে আহত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। তাহাদের বাঁচিবার আশা নাই।
আ। কেন? কিসে তাহাদের এমন অবস্থা হইল?
ন। আমি আহার করিতে গিয়াছিলাম। দোকানে দুই জন কারিগর বসিয়া কার্য্য করিতেছিল। এমন সময়ে কোথা হইতে জহরলাল দৌড়িয়া দোকানে প্রবেশ করে। দোকানের ভিতর আসিয়া সে আপনার জায়গায় বসিয়াছিল। সে কি জন্য আসিয়াছে, একজন কারিগর জিজ্ঞাসা করিলে, সে বলে যে, তাহার হস্তনির্ম্মিত কালীমূর্ত্তিগুলি দেখিতে আসিয়াছে। আগেই বলিয়াছি যে, ছয়খানি প্রতিমার মধ্যে পাঁচখানির ফরমাইস ছিল। তাহার মধ্যে দুইখানি কেবল পাঠান হইয়াছিল। তিনখানির রং ভাল শুকায় নাই বলিয়া পাঠান হয় নাই। সেগুলি সেদিনের মত শুকাইতে দেওয়া হইয়াছিল। জহরলাল তাহা দেখিতে পায় এবং সেই তিনখানি প্রতিমা লইয়া সে পলায়ন করিতে ইচ্ছা করে। পুতুল তিনটী লইয়া সে যখন পলায়ন করিতে ছিল, তখনই দুইজন কারিগর তাহাকে ধরিয়া ফেলে। পাগলের বল বড় ভয়ানক। সে দুইজনকে ধাক্কা দিয়া দূরে নিক্ষেপ করে, এবং দৌড়িয়া আমার দোকান হইতে পলায়ন করে। কারিগর দুইজনও তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িতে লাগিল এবং অনেক কষ্টে দুইজনে তাহাকে ধরিয়া ফেলে। জহরলাল ধরা পড়িয়া আগে পুতুল তিনটী একস্থানে ফেলিয়া দেয়, পরে দুইজনকে এমন আঘাত করে যে, তাহাদের বাঁচিবার আশা নাই! এখন তাহারা হাঁসপাতালে রহিয়াছে।
আমি শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন পুতুল তিনটী কোথায়?”
ন। কারিগর দুইজনকে সাংঘাতিকরূপে আঘাত করিয়া জহরলাল পুতুল তিনটা লইয়া কোম্পানীর বাগানের ভিতর যায়। সেখানে সে সেগুলিকে গুঁড়াইয়া ফেলিয়া যেমন পলায়ন করিবে, অমনি তিন চারজন পাহারওয়ালা তাহাকে ধরিয়। ফেলে।
আ। তাহা হইলে জহরলাল আবার ধরা পড়িয়া থানায় গিয়াছে। এই সেদিন তাহাকে পাগল বলিয়া মুক্ত করিয়া দিলাম; আবার ধরা পড়িল!
ন। আজ্ঞে না, সে এখন ধরা পড়ে নাই। পাহারওয়ালাগুলিকে আাধমরা করিয়া সে সেখান হইতে কোথায় পলায়ন করিয়াছে, তাহা জানা যায় নাই।
আ। যে সকল লোক তোমার দোকানে কালীর প্রতিমা গড়িবার ফরমাইস দিয়াছিল, তাহাদের নাম-ধাম জহর জানিত?
ন। আজ্ঞে হাঁ, জানিত বই কি! সেই ত খাতায় তাহাদের নাম-ধাম লিখিয়াছিল।
আ। দুইখানি প্রতিমা তুমি যথাস্থানে পাঠাইয়াছ, কেমন?
ন। আজ্ঞে হাঁ।
আ। একখানি ত জোড়াসাঁকোর সুধীন্দ্র মুখুয্যের বাড়ী পাঠাইয়াছ, আর একখানি?
ন। আমার মনে নাই। খাতা দেখিয়া বলিতে পারি।
আ। বেশ, তোমার খাতা আন দেখি।
নফরচন্দ্র তাড়াতাড়ি খাতা আনিল। দুই চারিখানি পাতা উল্টাইয়া বলিল, “সেখানি নিকটেই পাঠান হইয়াছে।”
আ। কোথায়?
ন। বাগবাজারে।
আ। কাহার বাড়ীতে?
ন। হরিশবোসের বাড়ী।
আ। হরিশ বোস? তাঁহার সঙ্গে আমার বেশ আলাপ আছে। জহরের আর কোন খোঁজ করিয়াছ?
ন। আমি আর কি খোঁজ করিব? যখন সে পুলিসের হাত হইতে পলায়ন করিয়াছে, এবং পাহারওয়ালাগুলিকে আধমরা করিয়াছে, তখন পুলিসের লোকই তাহার সন্ধান লইতেছে।
আ। এসব ঠিক, জান?
ন। স্বচক্ষে দেখি নাই বটে, কিন্ত শুনিয়াছি,জনকতক পাহারওয়ালা জহরের বাড়ীর দরজার নিকট বসিয়া আছে। সে বাড়ীতে আসিলেই ধরা পড়িবে।
জহরলালের অদ্ভুত আচরণে আমার সন্দেহ আরও বাড়িতে লাগিল। কেনই বা সে প্রতিমাগুলিকে গুড়াইয়া ফেলিতেছে! নিজের হাতের গড়া-জিনিষ লোকে ইচ্ছা করিয়া ভাঙ্গিতে চায় না। জহর কেন এ নিয়মের ব্যতিক্রম করিল।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আমি বাগবাজারে হরিশবাবুর বাড়ীতে যাইলাম। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। ঘরে ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে। বাড়ীর ছোট ছোট ছেলেরা চীৎকার করিয়া পাঠাভ্যাম করিতেছে। বাবুরা বাহিরে বসিয়া সান্ধাসমীরণ সেবা করিতেছেন। এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম।
হরিশবাবু সেখানে ছিলেন। আমাকে দেখিয়া অতি সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া নিকটে বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিশবাবু, কেমন আছেন? আনেক দিন আপনার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই।”
হরিশবাবু সহাস্যবদনে বলিলেন, “না, অনেকদিন আপনাকে দেখিতে পাই নাই। কোথাও গিয়াছিলেন নাকি?”
আমি উত্তর করিলাম, “না। চাকরে কি ইচ্ছামত কাজ করিতে পারে?”
হ। এখন এদিকে কোথায় গিয়াছিলেন?
আ। আপনারই নিকট আসিয়াছি।
হ। আমার পরম সৌভাগ্য। এখন কি করিতে হইবে বলুন?
আ। আপনি কি নফরের দোকান হইতে একখানি কালী গ্রতিমা কিনিয়াছেন?
হ। হাঁ, কিনিয়াছি। কিন্ত আপনি সে কথা জানিতে পারিলেন কিরূপে?
আ। নফরের মুখে শুনিয়াছি। প্রতিমাখানি খুব যত্নে রাখিবেন।
হ। কেন বলুন দেখি? একটা মাটীর পুতুল আবার যত্নে রাখিব কি?
আ। প্রতিমাখানির দাম সামান্য নহে।
হ। মাটীর পুতুল বলিয়া দাম কিছু বেশী বলিয়া বোধ হয় বটে, কিন্তু কারিকুরি দেখিলে উহার মূল্য অতি সামান্য বলিয়া মনে হয়।
আ। হাঁ, পুতুলগুলির গঠন অতি সুন্দর। প্রতিমাখানি রাখিয়াছেন কোথায়?
হ। আমার বৈঠকখানায়।
হরিশবাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে একজন চাকর দৌড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে আমাদের নিকট আসিল। বলিল, “বাবু! কোথা হইতে একটা লোক আসিয়া আপনার বৈঠকখানার সমস্ত জিনিষ ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে।”
হরিশবাবু বড় ভাল মানুষ, চাকরদেরও তিনি কখনও কড়া কথা বলেন না। কিন্তু তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হইয়াছেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে সে?”
ভৃত্য সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “আজ্ঞে, তাহাকে আর কখনও দেখি নাই।”
হ। অচেনা লোক এ বাড়ীতে আসিল কেমন করিয়া? দরওয়ান বেটারা কি করিতেছিল? আর যখন সে বৈঠকখানার দরজার কাছে আসিয়াছিল, তখন তোরাই বা কি করিতে ছিলি?
ভৃ। আজ্ঞে, আমি বাজারে গিয়াছিলাম।
হ। রামচরণ কোথায়?
ভৃ। সে যে মার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে গিয়াছে।
হ। আর দোবে?
ভৃ। আজ্ঞে, দরওয়ানদের কথা বলিতে পারি না।
হ। লোকটা ধরা পড়িয়াছে ত?
ভৃ। আজ্ঞে, হাঁ।
হ। তাহাকে এখানে আন্।
ভৃ। আজ্ঞে—লোকটার গায়ে অসুরের মত বল। তিনজন দরোয়ানে অতিকষ্টে ধরিতে পারিয়াছে। এখনও তাহারা লোকটাকে ধরিয়া রহিয়াছে। বোধ হয়, একবার ছাড়া পাইলে এখনই পলায়ন করে। তাহাকে এখানে আনা বড় সহজ নহে।
“তবে চল্, আমরাই যাইতেছি”, এই বলিয়া হরিশবাবু, দাঁড়াইয়া উঠিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনি এ সময়ে আমার বাড়ীতে আছেন। একবার আমার সঙ্গে আসুন, ব্যাপার কি, দেখা যাউক।”
আমি সম্মত হইলাম; বলিলাম, “আপনি না বলিলেও আমি আপনার সঙ্গে যাইতাম। বোধ হয়, আপনার স্মরণ আছে যে, বাল্যকাল হইতে আমি এই সকল কার্য্যে আনন্দ বোধ করিয়া থাকি।”
বৈঠকখানার দরজার নিকট গিয়া দেখিলাম, উহার একপার্শ্বে নফরের দোকানের সেই কালী-প্রতিমাখানি চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, প্রায় তিন ভাগ ভাল ভাল জিনিষ একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কলিকাতার বনীয়াদী বড়লোকের বৈঠকখানা যেমন সুন্দর করিয়া সাজান, তাহা বোধ হয়, সকলেরই জানা আছে। ঘরে যত দামী ও সৌখিন জিনিষ ছিল, প্রায় সকলগুলিই ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। আর সেই ঘরের একপাশে তিনজন বলিষ্ঠ দরোয়ান জহরলালকে বলপূর্ব্বক ধরিয়া রহিয়াছে।
সহসা জহরলালের দৃষ্টি আমার দিকে পতিত হইল, সে যেন চমকিত হইল। তাহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল এবং পরক্ষণেই এক বিকট চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেল। দারোয়ান তিনজন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল।
হরিশ বাবু এই ব্যাপার দেখিয়া, একজন চাকরকে লোহার শিকল আনিতে আদেশ করিলেন। শিকল আনীত হইলে জহরলালকে উত্তমরূপে বন্ধন করা হইল।
হরিশ বাবু তখন আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করা যায় বলুন দেখি?—থানায় খবর দিব কি?”
আমি বলিলাম, “এখনই থানায় লোক পাঠাইয়া দিন। বড় ভয়ানক ব্যাপার! লোকটা সামান্য নয়।”
হরিশ বাবু আমার কথা বোধ হয় ভাল বুঝিতে পারিলেন না। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি এ লোক আপনার চেনা?”
আমি বলিলাম, “এখন আমায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। কিছু পরেই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। আগে আমি আপনাকে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।”
হ। কি বলুন?
আ। এই দরজার পার্শ্বে একটা ভাঙ্গা প্রতিমূর্ত্তি পড়িয়া আছে। ওটী কি? জিনিষটা এমন করিয়া ভাঙ্গা হইয়াছে যে, উহাকে আর কিছুতেই চেনা যায় না।”
হ। ইহাই বোধ হয়, সেই কালীমুর্ত্তি। হাঁ, ইহারই কথা আপনি বলিয়াছিলেন।
আ। প্রতিমাখানি আপনি কাল পাইয়াছেন?
হ। প্রতিমাখানি, বোধ হয় কাল প্রাতেই পাইয়াছি।
আমি ইতিপূর্ব্বেই নফরের মুখে সে সংবাদ লইয়াছিলাম। প্রতিমখানির অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, জহরলাল ঘরের অন্যান্য জিনিষ যে রকমে ভাঙ্গিয়াছে, পুতুলটাকে তাহার অপেক্ষা অনেক অধিক যত্ন করিয়া গুঁড়ান হইয়াছে। কেন এমন হইল? ঘরের আরও ভাল ভাল জিনিষ থাকিতে জহরলাল এই মাটীর পুতুলটাকে এমন করিয়া ভাঙ্গিল কেন? ঘরের চারিটী দেওয়ালে চারিটী এক রকমের ইংলিস-মেড-ঘড়ি ছিল। সেগুলিকে ও রকম করিয়া গুঁড়ায় নাই কেন? এই সকল প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে উদয় হইল।
পরক্ষণেই জোড়াসাঁকোর সুধীন্দ্রবাবুর আসবাব ভাঙ্গার কথা মনে পড়িল। সেও জহরলালের কাজ। সেখানেও জহরলাল পুতুলটীকে গুঁড়াইয়াছে। ঘরের অপরাপর জিনিষগুলিকে কেবল আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছিল। জহরলাল কি রকমের পাগল? লোকের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া বৈঠকখানার জিনিষ পত্র ভাঙ্গিবার তাৎপর্য্য কি? আর পুতুলগুলিকেই বা এ রকমে গুঁড়াইয়া ফেলিবার অর্থ কি?
নফরের দোকানে যে তিনটী পুতুল ছিল, তাহাদেরও এই দুর্দ্দশা। সেখানেও জহরলাল পুতুলগুলিকে গুঁড়াইয়াছিল। পুতুল গুঁড়ানই জহরলালের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশেই সে সুধীন্দ্র ও হরিশবাবুর বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছে। যখন জহরলালের উদ্দেশ্য স্থির রহিয়াছে, তখন সে পাগল কোথায়? জহরলাল নিশ্চয়ই পাগল নয়। তবে বোধ হয়, কোন ভয়ানক দুশ্চিন্তায় তাহাকে পাগলের মত করিয়া ফেলিয়াছে। নতুবা পাগলের উদ্দেশ্য ঠিক থাকে না। তাহাদের মনে যখন যাহা উদয় হয়, তাহাই করিয়া থাকে। পাগলের মনের ঠিক থাকে না। জহরলাল যখন মন ঠিক করিয়া কাজ করিতেছে, তখন সে কোন মতেই পাগল নহে।
তবে সে কেন এমন পাগলামি করে? এই প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদয় হইল। ভাবিলাম, জহরলাল অনেক দিন ধরিয়া ঐ রকম প্রতিমা গড়িয়া আসিতেছে। কলিকাতার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ীতেই জহরলালের প্রস্তুত কালীমূর্ত্তি আছে। জহরলাল সেগুলি ভাঙ্গিবার চেষ্ট করিতেছে না কেন? যদি নিজের হাতের প্রস্তুত পুতুলগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলিতে তাহার এতই ইচ্ছা হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে অন্যগুলি না ভাঙ্গিয়া নূতন প্রস্তুত পুতুলগুলি ভাঙ্গিতেছে কেন?
কিছুক্ষণ এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিয়া আমি হরিশবাবুকে বলিলাম, জহরলাল এখনও অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে। ইত্যবসরে একবার উহার কাপড়খানি ভাল করিয়া দেখা দরকার। পুলিস আসিতে না আসিতে সে কার্য্য করিলে ভাল হয়।
হরিশবাবু আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন বলুন দেখি? আমার বোধ হয়, লোকটা কিছুই লইতে পারে নাই।”
আ। একবার দেখা দরকার। যদি কোন দামী জিনিষ কোথাও লুকাইয়া রাখিয়া থাকে, সহজেই বাহির করা যাইবে।
হ। তবে কি লোকটা চোর?
আ। সে কথা এখন বলিব না। পরে সমস্ত কথাই জানিতে পারিবেন। এতদিন উহাকে পাগলই মনে করিয়াছিলাম। আজ আমার সে ভ্রম গিয়াছে।
হ। লোকটার কাজ দেখিলে বোধ হয়, সে পাগল।
আ। আমিও আগে সেইরূপ মনে করিতাম, কিন্তু এখন আমার বোধ হয়, লোকটা পাগল নয়।
হ। কেন?
আ। পাগলের মনের ঠিক থাকে না। এ লোক একটা উদ্দেশ্য করিয়া এই সকল কার্য্য করিতেছে।
হ। লোকটা কে? ইহার বাড়ী কোথায়? আপনি যখন ইহাকে চেনেন, তখন ইহার নাম ধামও আপনার জানা আছে।
আ। হাঁ, আছে। লোকটার নাম জহরলাল, বাড়ী সিকদার পাড়া।
হ। জহরলাল তবে আরও দুই এক জায়গায় এ রকম কাণ্ড করিয়াছে?
আ। হাঁ, আরও দুই জায়গায় জহরলাল এইরূপ উৎপাত করিয়াছে। বড় ভয়ানক রহস্য হরিশবাবু! এখন আমায় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। শীঘ্রই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। এখন একবার জহরলালের কাপড় খুঁজিয়া দেখুন।
হরিশবাবু তখনই দুইজন লোককে সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। অনেকক্ষণ ধরিয়া জহরলালের কাপড় দেখা হইল, কিন্তু কোন জিনিষ পাওয়া গেল না।
এই সময়ে পুলিসের লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। ইন্স্পেক্টার বাবু আমার পরিচিত ছিলেন। আমায় দেখিয়া বলিলেন, “আপনি প্রথমেই আসিয়াছেন দেখিতেছি। কিছু বুঝিতে পারিলেন কি? লােকটা কে?
আ। জহরলাল।
ই। আমিও তাই ভাবিয়াছিলাম।
ই। সেবা’র আপনার অনুরােধেই সে মুক্তি পাইয়াছিল।
আ। হাঁ। জহরলালকে মুক্তি দিবার কারণ আছে।
ই। কি কারণ?
আ। সে কথা পরে জানিবেন। এখন লােকটাকে এখান হইতে লইয়া যান।
ই। জহরলাল কোথায়?
আ। ঐ যে, বৈঠকখানার ভিতরে পড়িয়া আছে। এতক্ষণ অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল। এখন দেখিতেছি, উহার জ্ঞান হইয়াছে।
ই। হঠাৎ অজ্ঞান হইল?
আ। আমাকে এখানে দেখিয়াই জহর হতচেতন হইয়া মেঝের উপর পড়িয়াছিল। আপনি উহাকে এখান হইতে লইয়া যান। কিন্তু বিশেষ সাবধানে থাকিবেন। নতুবা সুবিধা পাইলেই ও আবার পলায়ন করিবে।
ই। কিসে জানিলেন?
অ। উহার কার্য্য এখন শেষ হয় নাই। খুব সম্ভব, এবার আমার বাড়ীতে গিয়া উৎপাত করিবে।
ইনস্পেক্টার মহাশয় হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, আপনার অপরাধ কি?
আমি বলিলাম, “আমার ঘরে উহার হাতের প্রস্তুত একখানি কালীমূর্ত্তি আছে। এবার সেইখানা ভাঙ্গিবার জন্য চেষ্টা করিবে বলিয়া বোধ হয়।”
ই। শুনিয়াছি ও লোকটা ভাল ভাল পুতুল গড়িতে পারিত। ও কি নিজের হাতের প্রস্তুত পুতুলগুলি এই রকম করিয়া ভাঙ্গিয়া বেড়াইতেছে?
আ। হাঁ; কিন্তু সকলগুলি নয়।
ই। তবে কোনগুলি?
আ। পাগল হইবার ঠিক আগে যে পুতুলগুলি গড়িয়াছিল, ও এখন কেবল সেইগুলিই ভাঙ্গিয়া বেড়াইতেছে।
ই। আপনার বাড়ীতে উৎপাত করিবে কেন?
আ। আমিও যে উহার হাতের একখানি কালীমূর্ত্তি কিনিয়াছি।
ই। সর্ব্বশুদ্ধ কয়খানি মূর্ত্তি লোকটা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে?
আ। পাঁচখানি।
ই। পাগল হইবার আগে কয়খানি গড়িয়াছিল?
আ। ছয়খানি।
ই। তবে যেখানি ভাঙ্গিতে বাকি আছে, সেখানি আপনারই বাড়ীতে?
আ। হাঁ, সেইজন্যই সাবধান হইতে বলিতেছি।
ই। আমরা বিশেষ সাবধানে থাকিব, সে জন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি কি আমাদের সঙ্গে থানায় যাইকেন না?
আ। না, আপনাদের সঙ্গে যাইতে পারিব না বটে, কিন্তু আমিও শীঘ্রই থানায় যাইব।
ইন্স্পেক্টার মহাশয় তখন জহরলালকে আবদ্ধ অবস্থায় একখানা গাড়ীর উপর তুলিলেন এবং আপনি ভিতরে বসিয়া পাহারওয়ালাগুলিকে গাড়ীর চালে বসিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ী চলিয়া গেল।