৪৬

বিহারীর খবর লইয়া মহেন্দ্র ফিরিয়া আসিবে, এই স্থির করিয়া বাড়িতে তাহার জন্য আহার প্রস্তুত হইয়াছিল। অনেক দেরি দেখিয়া পীড়িত রাজলক্ষ্মী উদ্‌বিগ্ন হইতে লাগিলেন। সারারাত ঘুম না হওয়াতে তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলেন, তাহার উপরে মহেন্দ্রের জন্য উৎকণ্ঠায় তাঁহাকে ক্লিষ্ট করিতেছে দেখিয়া আশা খবর লইয়া জানিল, মহেন্দ্রের গাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছে। কোচম্যানের কাছে সংবাদ পাওয়া গেল, মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি হইয়া পটলডাঙার বাসায় গিয়াছে। শুনিয়া রাজলক্ষ্মী দেয়ালের দিকে পাশ ফিরিয়া স্তব্ধ হইয়া শুইলেন। আশা তাঁহার শিয়রের কাছে চিত্রার্পিতের মতো স্থির হইয়া বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল। অন্য দিন যথাসময়ে আশাকে খাইতে যাইবার জন্য রাজলক্ষ্মী আদেশ করিতেন―আজ আর কিছুই বলিলেন না। কাল রাত্রে তাঁহার কঠিন পীড়া দেখিয়াও মহেন্দ্র যখন বিনোদিনীর মোহে ছুটিয়া গেল, তখন রাজলক্ষ্মীর পক্ষে এ সংসারে প্রশ্ন করিবার, চেষ্টা করিবার, ইচ্ছা করিবার আর কিছুই রহিল না। তিনি বুঝিয়াছিলেন বটে যে, মহেন্দ্র তাঁহার পীড়াকে সামান্য জ্ঞান করিয়াছে; অন্যান্য বার যেমন মাঝে মাঝে রোগ দেখা দিয়া সারিয়া গেছে, এবারেও সেইরূপ একটা ক্ষণিক উপসর্গ ঘটিয়াছে মনে করিয়া মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত আছে; কিন্তু এই আশঙ্কাশূন্য অনুদ্‌বেগই রাজলক্ষ্মীর কাছে বড় কঠিন বলিয়া মনে হইল। মহেন্দ্র প্রেমোন্মত্ততায় কোনো আশঙ্কাকে কোনো কর্তব্যকে মনে স্থান দিতে চায় না, তাই সে মাতার কষ্টকে পীড়াকে এতই লঘু করিয়া দেখিয়াছে― পাছে জননীর রোগশয্যায় তাহাকে আবদ্ধ হইয়া পড়িতে হয়, তাই সে এমন নির্লজ্জের মতো একটু অবকাশ পাইতেই বিনোদিনীর কাছে পলায়ন করিয়াছে। রোগ আরোগ্যের প্রতি রাজলক্ষ্মীর আর লেশমাত্র উৎসাহ রহিল না― মহেন্দ্রের অনুদ্‌বেগ যে অমূলক, দারুণ অভিমানে ইহাই তিনি প্রমাণ করিতে চাহিলেন।

 বেলা দুটার সময় আশা কহিল, “মা, তোমার ওষুধ খাইবার সময় হইয়াছে।” রাজলক্ষ্মী উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। আশা ওষুধ আনিবার জন্য উঠিলে তিনি বলিলেন, “ওষুধ দিতে হবে না বউমা, তুমি যাও।”

 আশা মাতার অভিমান বুঝিতে পারিল―সেই অভিমান সংক্রামক হইয়া তাহার হৃদয়ের আন্দোলনে দ্বিগুণ দোলা দিতেই আশা আর থাকিতে পারিল না, কান্না চাপিতে চাপিতে গুমরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে আশার দিকে পাশ ফিরিয়া তাহার হাতের উপরে সকরুণ স্নেহে আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে লাগিলেন; কহিলেন, “বউমা, তোমার বয়স অল্প, এখনো তোমার সুখের মুখ দেখিবার সময় আছে। আমার জন্য তুমি আর বৃথা চেষ্টা করিয়ো না বাছা―আমি তো অনেক দিন বাঁচিয়াছি— আর কী হইবে।”

 শুনিয়া আশার রোদন আরো উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, সে মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিল।

 এইরূপে রোগীর গৃহে নিরানন্দ দিন মন্দ গতিতে কাটিয়া গেল। অভিমানের মধ্যেও এই দুই নারীর ভিতরে ভিতরে আশা ছিল, এখনই মহেন্দ্র আসিবে। শব্দমাত্রেই উভয়ের দেহে যে-একটি চমক-সঞ্চার হইতেছিল, তাহা উভয়েই বুঝিতে পারিতেছিলেন। ক্রমে দিবাবসানের আলোক অস্পষ্ট হইয়া আসিল; কলিকাতার অন্তঃপুরের মধ্যে সেই গোধুলির যে আভা তাহাতে আলোকের প্রফুল্লতাও নাই, অন্ধকারের আবরণও নাই― তাহা বিষাদকে গুরুভার এবং নৈরাশ্যকে অশ্রুহীন করিয়া তোলে, তাহা কর্ম ও আশ্বাসের বল হরণ করে, অথচ বিশ্রাম ও বৈরাগ্যের শান্তি আনয়ন করে না। রুগ্‌ণগৃহের সেই শুষ্ক শ্রীহীন সন্ধ্যায় আশা নিঃশব্দপদে উঠিয়া একটি প্রদীপ জ্বালিয়া ঘরে আনিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউমা, আলো ভালো লাগিতেছে না, প্রদীপ বাহিরে রাখিয়া দাও।”

 আশা প্রদীপ বাহিরে রাখিয়া আসিয়া বসিল। অন্ধকার যখন ঘনতর হইয়া এই ক্ষুদ্র কক্ষের মধ্যে বাহিরের অনন্ত রাত্রিকে আনিয়া দিল তখন আশা রাজলক্ষ্মীকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “মা, তাঁহাকে কি একবার খবর দিব।”

 রাজলক্ষ্মী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “না বউমা, তোমার প্রতি আমার শপথ রহিল, মহেন্দ্রকে খবর দিয়ো না।”

 শুনিয়া আশা স্তব্ধ হইয়া রহিল; তাহার আর কাঁদিবার বল ছিল না।

 বাহিরে দাঁড়াইয়া বেহারা কহিল, “বাবুর কাছ হইতে চিট্‌ঠি আসিয়াছে।”

 শুনিয়া মুহূর্তের মধ্যে রাজলক্ষ্মীর মনে হইল, মহেন্দ্রের হয়তো হঠাৎ একটা কিছু ব্যামো হইয়াছে, তাই সে কোনোমতেই আসিতে না পারিয়া চিঠি পাঠাইয়াছে। অনুতপ্ত ও ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “দেখো তো বউমা, মহিন কী লিখিয়াছে।”

 আশা বাহিরে প্রদীপের আলোকে কম্পিতহস্তে মহেন্দ্রের চিঠি পড়িল। মহেন্দ্র লিখিয়াছে, কিছুদিন হইতে সে ভালো বোধ করিতেছিল না, তাই সে পশ্চিমে বেড়াইতে যাইতেছে। মাতার অসুখের জন্য বিশেষ চিন্তার কারণ কিছুই নাই। তাঁহাকে নিয়মিত দেখিবার জন্য সে নবীন-ডাক্তারকে বলিয়া দিয়াছে। রাত্রে ঘুম না হইলে বা মাথা ধরিলে কখন কী করিতে হইবে, তাহাও চিঠির মধ্যে লেখা আছে, এবং দুই টিন লঘু ও পুষ্টিকর পথ্য মহেন্দ্র ডাক্তারখানা হইতে আনাইয়া চিঠির সঙ্গে পাঠাইয়াছে। আপাতত গিরিধির ঠিকানায় মাতার সংবাদ অবশ্যঅবশ্য জানাইবার জন্য চিঠিতে পুনশ্চের মধ্যে অনুরোধ আছে।

 এই চিঠি পড়িয়া আশা স্তম্ভিত হইয়া গেল— প্রবল বিকার তাহার দুঃখকে অতিক্রম করিয়া উঠিল। এই নিষ্ঠুর বার্তা মাকে কেমন করিয়া শুনাইবে।

 আশার বিলম্বে রাজলক্ষ্মী অধিকতর উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, “বউমা, মহিন কী লিখিয়াছে শীঘ্র আমাকে শুনাইয়া যাও।”

 বলিতে বলিতে তিনি আগ্রহে বিছানায় উঠিয়া বসিলেন।

 আশা তখন ঘরে আসিয়া ধীরে ধীরে সমস্ত চিঠি পড়িয়া শুনাইল। রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “শরীরের কথা মহিন কী লিখিয়াছে, ঐখানটা আর-এক বার পড়ো তো।”

 আশা পুনরায় পড়িল, “কিছুদিন হইতে আমি তেমন ভালো বোধ করিতেছিলাম না, তাই আমি—

 রাজলক্ষ্মী। থাক্ থাক্‌, আর পড়িতে হইবে না। ভালো বোধ হইবে কী করিয়া। বুড়ো মা মরেও না, অথচ কেবল ব্যামো লইয়া তাহাকে জ্বালায়। কেন তুমি মহিনকে আমার অসুখের কথা খবর দিতে গেলে। বাড়িতে ছিল, ঘরের কোণে বসিয়া পড়াশুনা করিতেছিল, কাহারো কোনো এলাকায় ছিল না― মাঝে হইতে মার ব্যামোর কথা পাড়িয়া তাহাকে ঘরছাড়া করিয়া তোমার কী সুখ হইল। আমি এখানে মরিয়া থাকিলে তাহাতে কাহার কী ক্ষতি হইত। দুঃখেও তোমার ঘটে এইটুকু বুদ্ধি আসিল না!

 বলিয়া বিছানার উপর শুইয়া পড়িলেন।

 বাহিরে মস্‌মস্‌ শব্দ শোনা গেল। বেহারা কহিল, “ডাক্তারবাবু আয়া।” ভাক্তার কাশিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আশা তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া খাটের অন্তরালে গিয়া দাঁড়াইল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কী হইয়াছে বলুন তো।”

 রাজলক্ষ্মী ক্রোধের স্বরে কহিলেন, “হইবে আর কী। মানুষকে কি মরিতে দিবে না। তোমার ওষুধ খাইলেই কি অমর হইয়া থাকিব।”

 ডাক্তার সান্ত্বনার স্বরে কহিল, “অমর করিতে না পারি, কষ্ট যাহাতে কমে সে চেষ্টা—”

 রাজলক্ষ্মী বলিয়া উঠিলেন, “কষ্টের ভালো চিকিৎসা ছিল যখন বিধবারা পুড়িয়া মরিত— এখন এ তো কেবল বাঁধিয়া মারা। যাও ডাক্তারবাবু, তুমি যাও― আমাকে আর বিরক্ত করিয়ো না, আমি একলা থাকিতে চাই।”

 ডাক্তার ভয়ে ভয়ে কহিল, “আপনার নাড়িটা একবার―”

 রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে কহিলেন, “আমি বলিতেছি তুমি যাও। আমার নাড়ি বেশ আছে— এ নাড়ি শীঘ্র ছাড়িবে এমন ভরসা নাই।”

 ডাক্তার অগত্যা ঘরের বাহিরে গিয়া আশাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আশাকে নবীন-ডাক্তার রোগের সমস্ত বিবরণ জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে সমস্ত শুনিয়া গম্ভীরভাবে ঘরের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করিল। কহিল, “দেখুন, মহেন্দ্র আমার উপর বিশেষ করিয়া ভার দিয়া গেছে। আমাকে যদি আপনার চিকিৎসা করিতে না দেন, তবে সে মনে কষ্ট পাইবে।”

 মহেন্দ্র কষ্ট পাইবে, এ কথাটা রাজলক্ষ্মীর কাছে উপহাসের মতো শুনাইল। তিনি কহিলেন, “মহিনের জন্য বেশি ভাবিয়ো না। কষ্ট সংসারে সকলকেই পাইতে হয়। এ কষ্টে মহেন্দ্রকে অত্যন্ত বেশি কাতর করিবে না। তুমি এখন যাও ডাক্তার। আমাকে একটু ঘুমাইতে দাও।”

 নবীন-ডাক্তার বুঝিল, রোগীকে উত্ত্যক্ত করিলে ভালো হইবে না। ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া যাহা কর্তব্য আশাকে উপদেশ দিয়া গেল।

 আশা ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “যাও বাছা, তুমি একটু বিশ্রাম করো গে। সমস্ত দিন রোগীর কাছে বসিয়া আছ। হারুর মাকে পাঠাইয়া দাও―পাশের ঘরে বসিয়া থাক্।”

 আশা রাজলক্ষ্মীকে বুঝিত। ইহা তাঁহার স্নেহের অনুরোেধ নহে, ইহা তাঁহার আদেশ― পালন করা ছাড়া আর উপায় নাই। হারুর মাকে পাঠাইয়া দিয়া অন্ধকারে সে নিজের ঘরে গিয়া শীতল ভূমিশয্যায় শুইয়া পড়িল।

 সমস্ত দিনের উপবাসে ও কষ্টে তাহার শরীর-মন শান্ত ও অবসন্ন। পাড়ার বাড়িতে সেদিন থাকিয়া থাকিয়া বিবাহের বাদ্য বাজিতেছিল। এই সময়ে সানাইয়ে আবার সুর ধরিল। সেই রাগিণীর আঘাতে রাত্রির সমস্ত অন্ধকার যেন স্পন্দিত হইয়া আশাকে বারংবার অভিঘাত করিতে লাগিল। তাহার বিবাহরাত্রির প্রত্যেক ক্ষুদ্র ঘটনাটিও সজীব হইয়া রাত্রির আকাশকে স্বপ্নচ্ছবিতে পূর্ণ করিয়া তুলিল; সেদিনকার আলোক,কোলাহল, জনতা; সেদিনকার মাল্যচন্দন, নববস্ত্র ও হোমধূমের গন্ধ; নববধূর শঙ্কিত লজ্জিত আনন্দিত হৃদয়ের নিগূঢ় কম্পন― সমস্তই স্মৃতির আকারে যতই তাহাকে চারি দিকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল, ততই তাহার হৃদয়ের ব্যথা প্রাণ পাইয়া বল করিতে লাগিল। দারুণ দুর্ভিক্ষে ক্ষুধিত বালক যেমন খাদ্যের জন্য মাতাকে আঘাত করিতে থাকে, তেমনি জাগ্রত সুখের স্মৃতি আপনার খাদ্য চাহিয়া আশার বক্ষে বারংবার সরোদনে করাঘাত করিতে লাগিল। অবসন্ন আশাকে আর পড়িয়া থাকিতে দিল না। দুই হাত জোড় করিয়া দেবতার কাছে প্রার্থনা করিতে গিয়া সংসারে তাহার একমাত্র প্রত্যক্ষ দেবতা মাসিমার পবিত্র স্নিগ্ধ মূর্তি আশার অশ্রুবাষ্পচ্ছন্ন হৃদয়ের মধ্যে আবির্ভূত হইল। পুনরায় সংসারে দুঃখঝঞ্ঝাটে সেই তাপসীকে আহ্বান করিয়া আনিবে না, এতদিন ইহাই তাহার প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু আজ সে আর কোথাও কোনো উপায় দেখিতে পাইল না— আজ তাহার চতুর্দিকে ঘনায়িত নিবিড় দুঃখের মধ্যে আর রন্ধ্রমাত্র ছিল না। তাই আজ সে ঘরের মধ্যে আলো জ্বালিয়া কোলের উপর একখানা খাতায় চিঠির কাগজ রাখিয়া ঘনঘন চোখের জল মুছিতে মুছিতে চিঠি লিখিতে লাগিল―

 শ্রীচরণকমলেষু―

  মাসিমা, তুমি ছাড়া আজ আমার আর কেহ নাই; একবার আসিয়া তোমার কোলের মধ্যে এই দুঃখিনীকে টানিয়া লও― নহিলে আমি কেমন করিয়া বাঁচিব। আর কী লিখিব, জানি না। তোমার চরণে আমার শতসহস্রকোটি প্রণাম।

তোমার স্নেহের চুনি