ছবি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি ছদ্মবেশ পরিয়া আসিলাম। এবার আমায় দেখিয়া ডাক্তার হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করিয়াছিলাম, কেবল বেশ পরিবর্ত্তনেই ছদ্মবেশ হয় না, পরিচ্ছদের সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব, গতি বিধি, অঙ্গ সঞ্চালন এই সমস্তও পরিবর্ত্তন করিতে হয়। আমার বন্ধু আমার এই নূতন সাজে বড়ই আনন্দিত হইলেন। অমরা যথাসময়ে সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর নিকটে গমন করিলাম।
অভিনেত্রী সাতটার পূর্ব্বে বাড়ী ফিরিবে না, এ সংবাদ জানিতাম। আমরা যখন তাহার বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা ছয়টা মাত্র। তখনও এক ঘণ্টা সময় ছিল জানিয়া, আমরা উভয়ে নিকটস্থ এক পানের দোকানে আড্ডা করিলাম। কথায় কথায় আমি ডাক্তারকে বলিলাম, “যখন অভিনেত্রী গণপতকে বিবাহ করিয়াছে, তখন ছবিখানি বোধ হয় আর তাহার প্রয়োজন হইবে না। কারণ গণপত যদি কখনও সে ছবি দেখিতে পায়, তাহা হইলে অভিনেত্রীর প্রতি তাহার স্নেহের হ্রাস হইবে।”
ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু ছবিখানি সে কোথায় রাখিয়াছে? ছবিখানি কত বড়, জানিয়াছ?”
আ। ক্যাবিনেট আকার। নিতান্ত ছোট নয়। সুতরাং অভিনেত্রী যে উহাকে সঙ্গে করিয়া ফিরিবে, তাহা বোধ হয় না।
ডা। না। সেটা অসম্ভব কিন্তু সে কোথায় রাখিয়াছে?
আ। নিশ্চয়ই তার বাড়ীতে আছে। যেখানে রাখিলে সে ইচ্ছামত গ্রহণ করিতে পারিবে, সকল সময়ে দেখিতে পাইবে, এইরূপ স্থানে রাখাই সস্তব।
ডা। কিন্তু তাহার বাড়ীতে দুইবার চুরি হইয়া গিয়াছে। যদি তাহার বাড়ীতেই ছবিখানি থাকিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাইত।
আ। পেশাদার চোরের দ্বারা এ কার্য্য সম্ভবে না। তাহারা কি খুঁজিতে জানে?
ডা। তুমি কোথায় দেখিবে?
আ। আমি দেখিব না। নিজে কোথাও সন্ধান করিতে চেষ্টা করিব না।
ডা। তবে?
আ। অভিনেত্রী আমায় দেখাইয়া দিবে?
ডাক্তার হাসিয়। উঠিলেন। বলিলেন, “তোমার কথা মন্দ নয়। সে ছবিখানি প্রাণপণে লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে, আর তুমি বলিতেছ যে, সে তোমায় ছবির সন্ধান বলিয়া দিবে।”
আ। সেকি সহজে দেখাইবে? আমি তাহাকে দেখাইতে বাধ্য করিব।
ডা। কিসে?
আ। কৃতকার্য্য হইলে সে কথা বলিব। এখন সাবধান, ঐ শোন, গাড়ীর শব্দ পাওয়া যাইতেছে। বোধ হয়, অভিনেত্রী গৃহে ফিরেতেছে। সাবধান ডাক্তার, যেমন যেমন বলিয়াছি, ঠিক সেই মত কার্য্য করিও। নতুবা নিশ্চয়ই ঠকিতে হইবে।
ডা। সে ভয় নাই গোয়েন্দা মহাশয়! আজ নূতন তোমার কাজ করিতেছি না।
ডাক্তারের কথা শেষ হইবার ঠিক পরেই দেখিলাম, দূরে একখানি বড় ল্যাণ্ডো দুইটা প্রকাণ্ড তেজীয়ান ওয়েলার ঘোড়ার অতিবেগে অভিনেত্রীর বাড়ীর দিকে টানিয়া আনিতেছে। আমি বুঝলাম, কার্য্যের সময় উপস্থিত হইয়াছে। দেখিলাম, আমি যেমন যেমন বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম, সমস্তই ঠিক আছে।
কিছু পরেই গাড়ীখানি অভিনেত্রীর বাড়ীর দ্বারে থামিল। অভিনেত্রী গাড়ী হইতে অবতরণ করিবামাত্র একজন ভিখারী তাহার নিকট একটী পয়সা চাহিল। তাহার দেখাদেখি, আরও দশ বার জন অভিনেত্রীর চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ভিক্ষা চাহিতে লাগিল। ক্রমে ঠেলাঠেলি আরম্ভ হইল। পরে অভিনেত্রীর সম্মুখেই এক ভয়ানক দাঙ্গা উপস্থিত হইল। অনেকেই কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন করিয়া মহা কোলাহল ও মারামারি করিতে লাগিল। ইত্যবসরে আমি বেগে সেই ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
দুই একটা লোকের সহিত সামান্য দাঙ্গা হাঙ্গামা করিয়া অভিনেত্রীর অতি নিকটে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে করিতে পড়িয়া গেলাম। তখন দাঙ্গা কমিয়া গেল, অনেকেই আমার চারিদিকে বেষ্টন করিল।
আমার হাতে উৎকৃষ্ট আলতা ছিল। সেই আল তা মুখে চিবাইয়া হাতে মুখে মাখিয়া আবার হাত দুটী মুখে ঢাকা দিলাম। যখন মুখ হইতে হাত নামাইল; আমার মুখে রক্ত ও আমাকে অজ্ঞানবৎ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া সকলেই বলিল, “বেচারা মারা গিয়াছে।”
অভিনেত্রী চমকিত হইল। তাহার সম্মুখে একটা নরহত্যা হইল দেখিয়া মনে ভয়ও হইল। সে কাতরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “ভদ্রলোকটী কি বাস্তবিক মরিয়া গিয়াছেন?
দুই একজন বলিল, “না, মরেন নাই। কিন্তু আর বড় বেশী দেরীও নাই।”
অভিনেত্রী পুনরায় চমকিতা হইল। সে বলিল, “উহাঁকে আমার বৈঠকখানায় আনিতে পার?”
তখন অনেকেই সে কার্য্যে সাহায্য করিল। আমি অনায়াসে অভিনেত্রীর বৈঠকখানায় আনীত হইলাম। আমাকে রাখিয়া সকলে চলিয়া গেল, তখন আমি এরূপে হাত বাড়াইলাম, যাহাতে অভিনেত্রী বুঝিল, আমার বড় গরম হইতেছে। সে ঘরের জানালা খুলিয়া দিল।
আমি যেখানে ছিলাম, দেখান হইতে বাহিরের অনেকটা দেখা যায়। আমি কৌশলে ঘাড় ফিরাইয়া ডাক্তারকে দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, ভাক্তারও আমার দিকে চাহিয়া আছে।
যখন দেখিলাম, সমস্ত ঠিক হইয়াছে, তখন ডাক্তারকে সঙ্কেত করিলাম। ডাক্তার প্রস্তত ছিল। সেও সেই দুইটী গোলা বাহির হইতে অতি বেগে গৃহ মধ্যে নিক্ষেপ করিল। দুইটী সামান্য শব্দ করিয়া অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল, চারিদিক ধূমে আচ্ছন্ন হইল। বাহির হইতে লোক সকল “আগুন লাগিয়াছে” “আগুন লাগিয়াছে” রলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল।
অভিনেত্রী, ভয়ে, যেখানে ছবিখানি, তাহার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর বস্তু, লুকাইয়া রাখিয়াছিল, সেইখানে তাড়াতাড়ি গমন করিল। গৃহে আগুন লাগিয়াছে শুনিয়া, তাহার চিত্তের স্থিরতা ছিল না। আমি যে সেই ঘরে শুইয়া রহিয়াছি, তাহা সে ভুলিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি সেই ছবিখানি বাহির করিতে উদ্যত হইল। প্রায় অর্দ্ধেক তুলিলে পর আমি সাড়া দিলাম, যেন আমার জ্ঞান সঞ্চার হইল। অভিনেত্রী সেই শব্দে চমকিত হইয়া ছবিখানি যথাস্থানে রাখিতে বাধ্য হইল এবং আমার নিকটে আগমন করিল।
আমাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে আনন্দিত হইল। কিন্তু তাড়াতাড়ি পলায়নের চেষ্টা করিল; বলিল, “ঘরে আগুন লাগিয়াছে।”
আমি তখন অভিনেত্রীকে বুঝাইয়া দিলাম যে, বাস্তবিক তাহার গৃহে আগুন লাগে নাই; কোন শত্রু বাহির হইতে কোনরূপ আতস বাজী নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে; সেই জন্যই এত ধূম নির্গত হইতেছে
আমার কথায় অভিনেত্রী আমার মুখের দিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। পরে আমার কথার সত্যাসতা নিরূপণ করিবার জন্য বাহিরে গমন করিল। আমিও সেই সুযোগে সেখান হইতে পলায়ন করিলাম।
অনেক কষ্টে গোলদীঘিতে আসিয়া ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিলাম। ডাক্তার ইতিপূর্ব্বেই একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া রাখিয়াছিল; আমি আসিলে উভয়ে গাড়ীতে উঠিলাম এবং শীঘ্রই ডাক্তারের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।